এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • লার্স ভন ত্রীয়ের -- অ্যান্টিক্রাইস্ট

    বিক্রম পাকড়াশী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ | ৭৭৬ বার পঠিত
  • প্রোলগ

    লার্স ভন ত্রীয়েরের নতুন ছবি, অ্যান্টিক্রাইস্ট নিয়ে অনেকদিন ধরেই বাজারে নানান গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিলো। সেইসব ভাসমান গুজবের অধিকাংশই একমত যে সিনেমাটা অত্যন্ত দগদগে রগরগে ধরণের হয়েছে। যেন পাড়ার উঠতি ছোঁড়া এসে হাত নাড়িয়ে বলছে - পাগলা খাবি কি রে, ঝাঁঝেই মরে যাবি। এ ধরণের গুজব, শহুরে রূপকথা, যেমন - এক্সরসিস্ট দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কিংবা বিবরের মতো সাহসী সাহিত্য গত একশো বছরে হয় নি, এগুলি আসবে ও যাবে। কিন্তু গুজবটা এক্ষেত্রে বেশ বড়ো করেই পৃথিবীতে ছড়ালো, কান চলচ্চিত্র উৎসবে বহু দর্শক ছি ছি করে বেরিয়ে গেলেন, অথচ সেই সিনেমার হিরোইন পেলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। ডেনিশ সমালোচকরা, ত্রীয়েরের জাতভাইরা বললেন এটিই ওনার এযাবৎ সেরা সৃষ্টি, কিন্তু পরিচালকের মুখ থেকে তাঁর কাজ নিয়ে প্রায় কোনও উচ্চবাচ্য বের করা গেলো না, এমন কি সিনেমাটি কি নিয়ে, তাও না। যেন বলছেন - শিল্পের কি আর মানে হয়? সাহস করে দু একজন বললেন এই ছবির কোনও মাথামুণ্ডু নেই, অত্যন্ত অফেন্সিভ, অশ্লীল, তাঁদের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে কিছু বাড়লো, কিন্তু কেউ এক কথায় সিনেমাটিকে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। আসলে, ভন ত্রীয়েরের নামটিকে চট করে উড়িয়ে দেওয়া শক্ত। ওয়ান ফাইন মর্নিং উনিই তো ডগমে ৯৫ শুরু করেছিলেন (উৎসাহী পাঠক সিনেমা জগতের এই আন্দোলন নিয়ে জানতে গুগল করুন)। আবার উনিই প্রথম একজন মূল ধারার চলচ্চিত্রকার যিনি পর্নোগ্রাফিক সিনেমা তৈরির কোম্পানি বানালেন, এবং তার সবকটা সিনেমাই হিট হলো। আঘাত হোক, চমক হোক, আসল যৌনদৃশ্য ব্যবহার করার সস্তা শোবাজি হোক, এখনও ভদ্রলোক সিনেমা বানালে মানুষ হলে যায় নতুন কিছু পাবার আশায়। তাই উনি ওনার চরিত্রগুলির ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে দর্শকদের আহত করে, শক দিয়ে তাদের হলে আনবেন, নাকি অশ্লীলতার, ডিগনিটির লক্ষ্মণরেখাটিকে সপাটে মুছে নতুন করে আঁকতে আঁকতে হঠাৎ চক ফেলে দিয়ে আমাদের হাতে ঠিক-ভুলের সমস্ত দায়িত্ত্ব দিয়ে অ্যাবরাপ্টলি বেরিয়ে যাবেন তা আগাম বোঝা দুষ্কর। উনি হয়তো নিজেই জানেন না। ফলে হলে ঢুকতেই হলো।

    গ্রীফ

    অসাধারণ একটি দৃশ্য দিয়ে অ্যান্টিক্রাইস্টের শুরু । স্বামী - স্ত্রী - বাচ্চা, সুখী পরিবার। স্বামী - স্ত্রী রমণে আবদ্ধ। ক্যামেরা খুব কাছ থেকে চোখ রাখছে, খুঁটিয়ে, পারলে প্রতিটি রোমকূপ দেখাতে চায় - প্রচণ্ড সীৎকারের মধ্যে আমরা দেখতে পাই বাচ্চাটির একটি খেলনা টেডি বেয়ার, বেলুনে বাঁধা, উড়ছে, খোলা জানালা দিয়ে উড়ে যেতে চাইছে, বাচ্চাটি হামাগুড়ি দিয়ে সেই জানালার সিল-এ উঠে গেছে, সে ভালুকটার হাত ধরতে চায় - আর তারপর বাচ্চাটা পড়ছে তো পড়ছেই, তার দেহটা পড়ছে তো পড়ছেই, দো তলা থেকে ঝরা পাতার মতো ভেসে ভেসে নেমে আসছে মাটির ওপর। আর এই অসম্ভব একটি ট্র্যাজেডির পর, যা পড়ে থাকছে, তা কেবল জ্যামিতি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে স্বামী-স্ত্রীর পজিশান কি ছিলো - মিশনারি, স্বামীর চোখ ছিলো নিচের দিকে আর স্ত্রীর ওপর দিকে, তার চোখের কোনা দিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে সে দেখতে পেয়েছিলো, সবটাই। আরও একটা কথা, ভারসাম্য হারানোর ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত (এমন অনেক মুহূর্তই চোখের আড়ালে ছিলো), ঠিক সেই শেষ মুহূর্তটির আগে, ভারসাম্য তখনও হারায় নি - বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, সেকেন্ডের ভাগ্নাংশের আগে দেখতে পেয়ে, একটা চিৎকার করে উঠলেও হয়তো বাচ্চাটি বেঁচে যেতো। দর্শক সবে এই শক পেয়েছে, মেয়েটি নিজেকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে, তার স্বামী, পেশাদার কাউন্সেলার, কোল্ড র‌্যাশানালিটি দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, তাকে সবরকমভাবে সাহায্য করতে চাইছে, অথচ আমাদের মনে হচ্ছে স্বামীটি যেন ক্রমাগত একটা ভঙ্গুর কাঁচের পাত্রে চাপ দিয়ে চলেছে - সিনেমার তো সবে শুরু। সবকিছুতে ভয়, কেবল ভয়, ডিপ্রেশান, আরও ভয়। ওদের জঙ্গলের মধ্যে একটা সুন্দর বাড়ি আছে, সেখানে যেতে সবচেয়ে বেশি ভয়। স্বপ্নে মেয়েটি দেখতে পায়, সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তার গতি শ্লথ হয়ে আসছে, সাদা কাপড় গায়ে, পা যেন মাটি ছুঁতে চায় না, তারপরে একটা ছোট্ট সেতু, পেরোনো যাচ্ছে না ... স্বামী বলছে তোমাকে জিততেই হবে, ভয়কে হারাতে হবে, ঐ বাড়িতে গিয়ে আমরা থাকবো। এর মধ্যেই ইতস্তত: রমণের চেষ্টা, হতাশা। সিনেমাটা বানানোর পুরো সময় জুড়ে নাকি ভন ত্রীয়ের ডিপ্রেশানে ভুগছিলেন। সারাদিন কান্নাকাটি, মুষড়ে পড়া, ঘর থেকে না বেরোনো, কারওর সাথে কথা নয়, এমনটাই চলছিলো। এমনকি ক্যামেরা, যে ক্যামেরার দখল নিতে তিনি সবসময় উৎসুক, তাকে অবধি অ্যান্টিক্রাইস্টে ত্যাগ করলেন। বললেন, জীবনে এর পরে আর একটাও সিনেমা বানাতে পারবো কি না জানি না। অনেক বোদ্ধা লিখেছেন, যে ঐ ডিপ্রেশানের ছাপ সিনেমায় সর্বত্র। তাই কি? বরং সব কিছুই কেমন যেন পরিকল্পিত, যেন ট্র্যজেডির পেছনে আরও বড়ো কোনও একটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে, এভাবেই সিনেমাটা তৈরি। তার সাথে অসাধারণ ক্যামেরার কাজ, অসাধারণ অভিনয়। কিন্তু এডিটিং, ঐ কাট-গুলো, দৃশ্যগুলো, হঠাৎ কার কথা মনে করিয়ে দেয়? একজন পরিচালক, আর একটি পুরনো সিনেমা? হয়তো। আপাতত: আমাদের আরও দেখতে হবে।

    পেইন (কেওস রেইনস)

    কারণ এই স্বামী-স্ত্রী জুটি তাদের ভাঙা জীবন নিয়ে চলে আসে ঐ জঙ্গলের বাড়িতে। দুজনে, একা। আর সেই একাকীত্বের মধ্যে ভন ত্রীয়ের তৈরি করেন মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার একটি ভয়াবহ গল্প। মেয়েটি হাঁটতে বেরোয়, গাছ থেকে একটি পাখির ছানা পড়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মরে যায়। একটি হরিণ শাবক জঙ্গলের মধ্যে তা শরীরের বিশাল হাঁ মুখ থেকে একটি শাবকের জন্ম দিতে দিতে মৃতবৎসার মতো চলে যায়। একটি পেট উপড়ে নেওয়া শেয়াল মাটিতে পড়ে থাকে, তখনও জীবন্ত, মেয়েটিকে দেখে হেসে বলে ''কেওস রেইনস!'' রজার এবার্ট বক্তব্য রাখেন - ভন ত্রীয়ের কাকে আঘাত করার চেষ্টা করছেন? দর্শকের মুখে কতগুলি ঘুঁষি মেরে যাওয়া? নাকি অন্য আরও বেশি কিছু। ''বেশি কিছু'' শুরু হয় এর পরেই। মেয়েটির পড়াশুনা মধ্যযুগে মহিলাদের ওপর বর্বরতার ওপর - যত সময় যায়, তার মনে হতে থাকে যে মেয়েদের মধ্যে যে জন্মগত, অন্তর্নিহিত নোংরামি, যে হীন মনুষ্যেতর প্রবৃত্তিগুলো আছে, তার সমুচিত শাস্তি এই বর্বরতাগুলি। মেয়েটি কখনও উলঙ্গ হয়ে জঙ্গলের মধ্যে মাস্টারবেট করতে থাকে। কখনও স্বামীর সাথে শুতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পুরনো ছবি বেরিয়ে আসে, দেখা যায়, যে বাচ্চাটির পায়ে সবসময় ভুল, উল্টো জুতো পড়ানো থাকতো। বাচ্চাটির অটোপ্সি রিপোর্ট আসে। পা, পা নিয়ে কি লেখা? এবং মধ্যমৈথুনে মেয়েটি একটি কাঠের টুকরো দিয়ে তার স্বামীর যৌনাঙ্গ সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করে, বীর্যের বদলে পিচকিরির মতো রক্ত বেরিয়ে এসে তার জামা ভিজিয়ে দেয়। একটি ড্রিল দিয়ে সে তার অজ্ঞান স্বামীর পা ফুটো করে তাতে বাটখারা আটকে যন্ত্রপাতিগুলি ফেলে চলে যায়। মনে পড়ে, এডওয়ার্ড মান্‌খ এর স্ক্রীম ছবির সিরিজটাকে - ব্রিজের ওপর, একা সেই মানুষটার ভয়াবহ চিৎকার উনি একবার এঁকে থামতে পারেননি - ঐ একই ছবি, ঐ একই চিৎকার বছরের পর বছর আঁকা হয়েছে। কিন্তু এই উন্মাদ পরিচালকের থেকে আমরা কি পাবো? হোস্টেল নয়, অন্য কোন একটা সিনেমার কিছু সীন ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

    ডেস্পেয়ার (জিনোসাইড)

    ওরহান পামুকের কারা কিতাপ (দা ব্ল্যাক বুক) বলে একটা বই আছে। একটা লোক আরেকটা লোককে খুঁজে চলেছে। সন্দেহ, তার সে তার বৌয়ের সাথে ভাগলবা হয়েছে। যে খুঁজছে, সে সাধারণ লোক, যাকে খোঁজা হচ্ছে, সে নামকরা কলামনিস্ট। যত সময় যাচ্ছে, অনুসন্ধানী বুঝতে পারছে যে ঐ কলামনিস্টকে ধরার, সে এর পরে ঠিক কি করতে চলেছে তা বোঝার একমাত্র উপায় হলো তার মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ে তার মতো করে ভাবা। প্রতিটা মুহূর্তে সে কি ভাবছে জানতে পারলেই তার পরের মূভটা ধরে ফেলা যাবে। আর তাই সে ঐ কলামনিস্টের লেখা একের পর এক কলাম পড়ে চলেছে, তার মধ্যে কোনও গোপন সূত্র যেন লুকিয়ে আছে। কিন্তু ত্রীয়ার এখানে থামলেন না, কোয়েন্তিন তারান্তিনোর পথেও হাঁটলেন না। স্বামীটির যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন তাকে ভয় সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে। নিজেকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে সে একটা শেয়ালের গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর তার স্ত্রী - কোথায় তুই! কাপুরুষ! বেরিয়ে আয়! কোথায় তুই! কাপুরুষ! বলে চিৎকার করে তাকে খুঁজতে থাকে। আর কোথাও কোনও শব্দ নেই - একটি শব্দে সে ধরা পড়ে যাবে। প্রচণ্ড যন্ত্রনায় সে অন্ধকার গর্তে একটা দেশলাই জ্বালায় - ভেতরে একটা পাখির বাচ্চা, কর্কশ স্বরে ডাকতে থাকে। আলো নিভে যায়, কিন্তু পাখি থামে না। কোথায় তুই? কাপুরুষ! বেরিয়ে আয়! সে আর থাকতে পারে না, পাখির বাচ্চাটাকে আছড়ে আছড়ে পাথরে ঠুকে ঠুকে মেরে ফেলতে চায়, পারে না, কর্কশ আওয়াজটি ক্ষীণ হয়ে যায়, আর সেই নৈ:শব্দের অব্যর্থ লক্ষ্যে তার স্ত্রী তাকে খুঁজে বের করে। জীবন্ত কবর দিতে চায়,পারে না, মেয়েটি তাকে সেই বাড়িতে ফিরিয়ে আনে, দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে।

    দা থ্রী বেগার্স

    তার্কভস্কি। হয়তো ত্রীয়ার তার্কভস্কির মতো কিছু করতে চাইছিলেন। লম্বা শটে, দর্শকের ওপর আঘাতে, প্রশ্নে, মানুষের জামা, বোধ, মান, হুঁশ সমস্ত খোসার মতো ছাড়িয়ে হয়তো উনি দেখতে চাইছেন - স্বর্গের সেই অপ্সরাদের সমস্ত কাপড় মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরে যেমন ঋষি প্রশ্ন করেছিলেন ''তারপর?''। একটা বিশাল তার্কভস্কিসুলভ প্রশ্নের জবাব হয়তো খুঁজছে দি অ্যান্টিক্রাইস্ট। কিন্তু তাই যদি হবে, তবে ক্রমাগত একই মোড়ক বার বার ফিরে আসে কেন - ধর্মের, যৌনতার? ভন ত্রীয়ার চিন্তার বলয়ে কি এরা অনেক জেনারাল একটি স্থান দখল করে আছে, না তার্কভস্কির মাপে একটি সিনেমা বানানোর ক্ষমতা ত্রীয়ারের নেই? অপার্থিব এক রাত নেমে আসে। তারাদের দল চকচক করে। নিচে শুয়ে থাকা মানব মানবী দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কিছুদিন আগেই, মেয়েটি ছেলেটিকে জড়িয়ে বলছিলো ছাদে ও কিসের শব্দ? ছেলেটি উত্তর দিয়েছিলো - গাছ থেকে অ্যাকর্ন ঝরে ঝরে পড়ছে। এই অচেতন, ঝলমল রাতে জঙ্গলের তিনটি প্রাণী,একটি কাক, একটি হরিণ আর একটি শেয়াল সেই বাড়িতে এসে দাঁড়ায়, দুজনকে দেখে। মেয়েটি, মেয়েটি খুব দুর্বল, তার প্রচণ্ড রক্তপাত হয়েছে, সে নিজে হাতে একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের যোনি ক্ষতবিক্ষত করেছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এই সময়, এই সময় স্বামীর সবল হবার। এই সুযোগ, তার জ্ঞান ফেরে,সে রেঞ্চটা খুঁজে বার করে, অসীম শক্তিতে নিজের পা থেকে ওজন দেওয়া রডটা খুলে ফেলে, সে মেয়েটির গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাকে মেরে ফেলে, মেয়েটির শরীর সেই কাঠের কেবিনের বাইরে জ্বালিয়ে দেয়, তার কাঠের ঘরের সামনে চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে - না হলে পরের সকালে সে কিভাবে, আহত অবস্থায়, জঙ্গলের পথ ধরে লোকালয়ে ফিরে আসবে? মাটি থেকে সে বেরি তুলে খেতে খেতে যাচ্ছে,পাহাড়ের মাথায় শত শত মেয়ে, সকালের আলোয় তাদের মুখ ঝাপসা, তারা উঠে আসছে তার দিকে। এমন সব দৃশ্যকল্প জুড়ে জুড়ে অ্যান্টিক্রাইস্ট শেষ হয়।

    এপিলগ

    আমার মনে পড়ে রুগেরো দেদাতো বলে এক চিত্রপরিচালকের কথা। ইতালিয়ান। বিভিন্ন বি গ্রেড সিনেমার মধ্যে তিনি একদিন দুম করে বানিয়ে ফেললেন ক্যানিবাল হলোকÙট - পরবর্তীকালের বহু বি গ্রেড সিনেমাল উত্তরসূরী। পশ্‌চিমী দুনিয়ার কয়েকজন লোক আফ্রিকায় কিছু বিপজ্জনক প্রজাতির ট্রাইবালদের ডকুমেন্টারি তুলতে যায় এবং আর ফিরে আসে না। সেইসব জাতি অতি অসভ্য, নরখাদক। একটি রেস্কিউ টিম গিয়ে জঙ্গলে তাদের কিছু ভিডিও খুঁজে পায় যা চালানোর পরে দেখা যায় একের পর এক ভয়াবহ দৃশ্য। জ্যন্ত প্রাণীকে হত্যা করা, আদিবাসীদের মানুষ খাওয়া, তাদের উদ্দেশ্যহীন ও নিষ্ঠুর যুদ্ধ। ভিডিওতে দেখা যায় কিভাবে সময়ের সাথে সাথে অভিযাত্রীদল আরও নৃশংস হয়ে উঠছে। অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার উল্লাসের ডকুমেন্টেশান ঘটতে থাকে। সব কিছু দেখে খুঁজতে যাওয়া দলটি ভিডিও দেখে ভাবে, কে তবে বেশি সভ্য, ওরা না আমরা? সিনেমাটি বহু দেশে ব্যান করা হয়, সম্ভবত: এখনও দু একটি দেশে তা বহাল আছে। ইন ফ্যাক্ট, ছবিটি যখন প্রথম রিলিজ করে তখন ইতালিতে ওনার বিরুদ্ধে একটি কোর্ট কেস হয় যে উনি ওনার সিনেমার অভিনেতাদের হত্যা করেছেন, গুরুতরভাবে জখম করেছেন এবং তাঁকে ঐ কলাকুশলীদের নিয়ে কোর্টে উপস্থিত হতে হয় এই অ্যালিগেশানের বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে। ক্যানিবাল হলোকস্টের পঁচিশতম অ্যানিভার্সারিতে আমি উপস্থিত ছিলাম, শেষ দুটি টিকিটের একটি পেয়েছিলাম। দেদাতো এসেছিলেন। প্রশ্নোত্তরের সময় ওনাকে বলা হয় এই যে আপনি স্ক্রীনে বন্যপ্রাণী হত্যা, বা নরখাদক প্রবৃত্তি, আদিবাসীদের অত্যাচার এসব দেখিয়েছেন, এখন হয়তো আপনাকে এসব করার স্রেফ পার্মিশানই দেওয়া হতো না। দেদাতো বলেন - তাই তো অতোদিন আগে বানিয়েছি। একটি সিনেমার ছাত্র জিজ্ঞাসা করে - আপনার ছবিতে হোমো ইরটিক এলিমেন্ট নিয়ে আপনার কি ধারণা? দোভাষী অনুবাদ করে ও দেদাতো বলেন - নো হোমো, ওনলি সিগারেট, অ্যালকোহল ইয়েস, উওম্যান ইয়েস, নো হোমো। এর পরে আর প্রশ্ন হয় নি। কান উৎসবের পর, ভন ত্রীয়েরকেও ধরা হয়েছিলো - আপনি এই সিনেমায় কি বলতে চান? উনি উত্তর দেন আমার মনে হয় না আমার ছবিকে জাস্টিফাই করার বা বোঝানোর প্রয়োজন আছে। এক অত্যন্ত বিদগ্‌ধ সমালোচক তার উত্তরে বলেন যে সিনেমাটা যখন জনগণের জন্য বানিয়েছেন, লোকে পয়সা দিয়ে দেখতে আসছে, আপনাকে এই কাজটিকে জাস্টিফাই করতেই হবে। এর পরে খুব চেঁচামেচি শুরু হয়, ত্রীয়ের অত্যন্ত বিরক্ত হন এবং সবশেষে বলেন যে আমি হলাম সেরা পরিচালক, হা হা হা। প্রেস কনফারেন্স সেখানেই শেষ হয়। অ্যান্টিক্রাইস্টে একের পর এক দৃশ্য দেখে কেন ক্যানিবাল হলোকস্টের কথা মনে পড়ে? সেই এক চেহারা, এক বাচনভঙ্গী, একই চমক ও আঘাত। একটু দার্শনিক মোড়ক, একটুখানি ধর্মের বিষয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনার মোড়ক। যখন সিনেমা শেষ হয়, দেখতে পাই ভন ত্রীয়ের তাঁর ছবিটিকে আন্দ্রেই তার্কভস্কির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন। পরে খবর পেলাম, যে সিনেমা তৈরির আগে মুখ্য চরিত্রদুটিকে তার্কভস্কির অন্যতম পার্সোনাল সিনেমা, তাঁর বেড়ে ওঠা নিয়ে সিনেমা জেরকালো (দা মিরর) দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু সিনেমার ক্রেডিট, কিংবা অন্য কোথাও ক্যানিবাল হলোকস্টের কোনও উল্লেখ পেলাম না।

    সেপ্টেম্বর ১৪, ২০০৯

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ | ৭৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ***:*** | ০৮ আগস্ট ২০১৪ ০৬:৪৮89302
  • সে কে ধন্যযোগ; ভিকির সলিড পাঁচ-পাঁচটি লেখা তুলে আবার পড়ানোর জন্যে।
  • সে | ***:*** | ০৮ আগস্ট ২০১৪ ১২:১৪89301
  • তুলে দিলাম
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন