কথা সে নাছোড়বান্দা সঙ্গ নেবেই কিছু
আজন্মকাল ছায়ার মতো আসছে পিছু পিছু
যে কথা ঠোঁট ঘুরে যায় ঘরের ডাকে নিক চিনে
সে কথা ডাক দিতে থাক হজমীগুলি দিক কিনে।
সে কথা খুব পুরোনো, আষ্টেপিষ্টে ব্যাগ আটকিয়ে - নিচ্ছে পথে যা কুড়নো। দশ পয়সার হজমীগুলির মোড়ক ম্যাগাজিনের পাতা, প্রথম ক্লাসেই বিপদ আসে ভুললে হঠাৎ অঙ্ক খাতা। দূরের থেকে দেখলে সবই একই রকম ভাবা যেত, অরিজিতের গায়ে যে কেমন ভালো ছেলের বাস বেরোত - জানত যারা এখন সবাই মাঝবয়সী বলতে পারো। যেমন ধরো, অমল হচ্ছে পালের গোদা, সামলাতো সব ঝুটঝামেলা - হোক না হঠাৎ মারপিট সব উঁচু ক্লাসের সঙ্গে বিরাট, কিম্বা একটা ম্যাচ বাঁচানো খেললো একাই সেকেন্ড হাফ। এদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় যে ফি শুক্কুরে দেয় হাজিরা মারকাটারি নতুন ছবির প্রথম শোয়ে। একই কথার ল্যাজমুড়োতে এদের সবাই এক থালাতে বরাদ্দ পায় - দেখতে সবই একই রকম, স্কুল য়ুনিফর্ম - কারোর শুধু গোঁফের রেখা কারুর আবার তারই সঙ্গে দুটো তিনটে হালকা রোঁয়া থুৎনি বেয়ে। নদী যেমন প্রথম প্রথম চলতে গিয়ে পাথর পেরোয় খরস্রোতে, গোঁত লাগিয়ে।
এরাও তেমন সেই পুজোতে জনা আষ্টেক মাঝবয়সী, আন্ডাবাচ্চা গিন্নী নিয়ে ফিরে আসে ক্লাসঘরে সব। অনেকদিনের জমিয়ে রাখা সময় খরচ দু-দিক জ্বলা মোমবাতিতে আতসবাজী। সারিবদ্ধ গাড়ির লাইন যায় এগিয়ে। রাস্তা বোধ হয় এ পাগলামির শরিক বলেই ঠারেঠোরে দেয় ইশারা। কখন সেটা আছড়ে পড়ে নদীর বুকে নয়তো বুকে পাথর চেপে পার করে দেয় খন্দখানা। ছাড়ায় যখন রোটাং তখন অমল বলল দেখিস আর মেঘ পাবি না - ন্যাড়া পাহাড়, চুড়োয় বরফ, মাঝখানে সব ভাস্কর্য - হাওয়ায় যেমন কাটাছাঁটা, নয়ত নিছক ঝুরঝুরো। পড়বো পড়বো করেও পাথর আটকে থাকে, জীবন যেমন অহরহ, কার যে কেমন হাওয়া জোটে - নয়তো সবই চান করলে ঘোর তামাটে। অনেক নীচে ছিল নদী। যেসব পাথর অনেক আগেই সেই নদীতে, তাদের দেখি জলমাখা গায়ে ধুসর মতো শ্যাওলা জোটে। নয়তো এরাই ন্যাংটাপুটো, এমন নীল রং কেন সেই অসীমবাবুর কর্মশালায় - ইচ্ছেমতো যথেচ্ছাচার সে ভদ্রলোক চালান এমন দূর থেকে সব একই রকম - ঠাহর করলে আয়না দেখায় যা দেখতে চাই, বেলুনওয়ালা, ঠেলাগাড়ির দোকানঘরে কিনতে থাকা ব্যাং আধুলির রাজ্য যেমন।
তাবোয় ছিল মনাস্টারি, মাত্র হাজার বছর হল ক'দিন আগে। মাটির বাড়ির গায়ে এখনো রোদ্দুরে যা ঝিলিক মারে তাক লেগে যায়। পাশেই নতুন পাকা বাড়ির গেস্ট হাউসেই আমরা ছিলাম - সে রাত্তিরে ঐ আকাশে চাঁদ দশমীর পড়লো ঢলে সেই পাহাড়ের পাশেই হয়ত আড্ডা দেবে সে ভদ্রলোকও। অমনি দেখি ভীড় করে সব নাম না জানা স্কুল য়ুনিফর্মে তারাগুলো - যেন হঠাৎ স্কুল ছুটি তাই হুল্লোড়ে সব ছড়িয়ে গেছে স্কুলের মাঠে। ঠোঁট থেকে ঠোঁট ঘুরতে থাকে গানের লাইন - বাজনা বাজে। তরল শব্দ ভাসিয়ে দেয় মাঝের ছুটি বছর কুড়ি। সেসব কথা নিই কুড়িয়ে হরিলুটের সেই বাতাসা প্রথম দেখা পোস্টারে সেই আধখোলা বুক শিরশিরানি ফিসফিসিয়ে ডাকতে থাকে। বাজনা বাজে, অনেক দূরে গার্লস স্কুলের ছুটি হলে লম্বামতো যে মেয়েটার মাথায় শুধু রৌদ্র ছিল - সেসব কথা ঠোঁট থেকে ঠোঁট চুমুক মারে।
আমরা যারা বেঁচে আছি এই জীবনে হয়ত দু-এক টুকরোই পাই জ্যান্ত হতে। ছা-পোষা সব সংখ্যা হওয়া গেরস্ত বা তিনের পাতার সেলিব্রেটি এই জীবনে মুহূর্ত সেই একটি দুটি, সঙ্গে একটি মোরগঝুঁটি - মৃত্যু সেটি। সেই যে মুকুটমণিপুরে বাঁধ বরাবর হাঁটছিলাম সে টুপটুপাটুপ বৃষ্টি মেখে, হঠাৎ যেন জ্বলন্ত স্টোভ ছ্যাঁকা দিয়ে পাশ দিয়ে কে বেড়িয়ে গেল দেখছি তখন আকাশ থেকে ঝকঝকে এক ইয়া মোটা জড়ির গোছা দুভাগ হয়ে সেঁধিয়ে গেল নেড়া দুই ল্যাম্পোস্টে। সে ফ্রীজশট আমরা কজন একইসাথে বসে পড়ি হকচকিয়ে। কাছ থেকে সব দেখা ছিল যাদের সঙ্গে তাবোর সে রাত জ্যান্ত করে আর অবসাদ সকাল জুড়ে - হয়ত এবার সব পাওনাই মিটিয়ে নেওয়া এই বছরেই।
এর মধ্যে সে বেড়ানর গল্প সব একইরকম - যেমনটি হয় আর সবারই, ভালো জায়গা দেখতে থাকা, সকাল সকাল তৈরী হওয়া চানটি সেরে - ছবি তুললে দাঁত ক্যালানো। আমার তোমার এলবামে সব হলদে হওয়া দাঁতের ছবি।
যা বলছিলাম সে মোমবাতি যার দু-দিকটাই জ্বালিয়েছিলাম আমরা ক'জন। কাজেই সেটা আলো দিলেও ধরতে গিয়ে যখন সবাই খাচ্ছি ছ্যাঁকা তখন যেন তলানিটাই ফোঁটা ফোঁটা ঢালতে থাকি। পরের দিনে খুব সকালে ফিরব বলে জাগতে থাকি। আমরা সবাই সে ক্লাসঘরে যেমন তেমন জায়গা করে - বিছনা জুড়ে চেয়ার পেতে - নয়তো নিছক মেঝের ওপর থেবড়ে বসি। জানলাধারে বসত ক্লাসে ইন্দ্রনীল সে আজকেও সে জানলা পেতে - নেয় কুড়িয়ে ক্লাসনোট সব ক্যামকোডারে। আবীর যেমন রঙ ছড়াত স্কুলের ব্যাগে - আজকেও সে মেঝের ওপর বাবু হয়ে রঙীন সব ঝিলিক টুকরো বিলিয়ে দিল। রঙ লেগে যায় হাতের পাতায় চোখে মুখে, যেমন করে খেলার ছলে সব কাগজেই পাহাড় খাঁজে সূর্য ওঠে। কোণ থেকে সেই বেড়িয়ে আসা হঠাৎ নদী, সেটাই আবার বাঁক ঘুরতেই আপনমনে ভাসতে থাকা নৌকা সে এক, ছই তুলে সে - ""দেখছ কেমন আঁকছি'' বলে তাকিয়ে থাকে। আসল নামকে মেরে গুলি ঢালি ওকে আমরা বলি - সেই পদবীর বুকের পাটা পোক্ত এমন রোদে পুড়ে জলে ভিজে বিরাট একটা গাছের মতো - তাকিয়ে থাকি। একাই যেন এজমালি সে - হাঁক ডাকে ওর বয়স আবার ভয়ে সিঁটিয়ে কাঁপতে থাকে। কী যে এমন কৌশলে ও লেত্তি ছাড়ে - ঘুরতে থাকি আমরা সবাই টুপির পালক দিই খসিয়ে।
সাবধানী এক খুঁতখুঁতানি তাও তো মজুত এ সংসারে। সে লোকটাকে মফস্বলে এই বাজারেও বদ্যি বলে মান্যি করে। কিন্তু ওসব হাফপ্যান্টুল চেনা এতই হাড়ে হাড়ে, বিষম লাগে। আচ্ছা করে দি ধুইয়ে - ঠাট আর ঠমক ছদ্ম রাগে। মিচকেপোড়া শুভজিতটা এমনি যেন সাদামাটা - অনেক শুনে, একটা দুটো ছাড়বে যখন, ভাজা মাছটাও হাত পা মেলে গুণতিতে ঠিক সাতান্নটা।
অমল যখন করলো শুরু শেষের ক্লাসে মাঝের থেকে, আমরা যারা এর মধ্যে স্কুল আসিনি ফোকর ফাঁকে। এর ওর বিয়ের গল্পগাছা, শিকেয় তোলা খাঁচা খুললেই বেবাক জ্যান্ত চিরশরৎ নীলকন্ঠ। এ ডাল থেকে ঐ পাতাতে ফুরুৎ করে উড়তে থাকা সেসব পাখি খুব সেয়ানা। সাদা বরফচুড়ো থেকে ঠোঁট থেকে ঠোঁট এক এক ফোঁটা গলতে থাকা কথারা সব হাজির ক্লাসে খুব সকালে। মাণিকতলা থেকে আসা বাসের থেকে নামল ওরা তো আমরা সব ফুলবাগানের। সেই শুরুতে মাঠের মধ্যে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় কথা প্রেয়ার হবে। তারপর সব ক্লাসের দিকে যাওয়ার ফাঁকে হোমটাস্কটা হয়নি সেটা মনে পড়ে বিড়ম্বিত।
সময় তখন সবে শুরু - হল যখন স্কুল দুপুরে, দিদিমণি এক ধাক্কায় চেঞ্জ হয়ে সব যাবেন স্যরে। তখন ক্লাসেই মাঝেমধ্যে চার অক্ষর পাত্তা পাবে। দু-চারবার বাসের টিকিট ফাঁকি দিলেই হাত পা মেলে নুন শো হবে। ব্যাগে রাখা রঙীন টী শার্ট, সাদা জামাও বদলে যাবে। সে যে সেবার প্রথম ওরা নিউ এয়াম্পায়ারে বিয়ার নিয়ে জল মেশালো - ক্লাস নাইনেই - টাওয়ার লজে কদিন পরেই মাল খেতে সব ক্লাস পালালো!
এমন সে এক গেরস্থালী - উঠোন জুড়ে হরিণ চড়ে। বাদার জলেও সপ্তডিঙা ছিপ ফেলে সব হাঙর ধরে। ক্লাস রুমে না আঁটতো যারা কিচিরমিচির তারসানাই - স্কুলের বাইরে চায়ের দোকান নেয় হাজিরা নেই কামাই । অবাক করা কিশোরী সব মেঘ ঢেকে নয় মুখ ফিরিয়ে সে রোদ্দুরে দু-এক কথা আসছে ফিরে নাও ঘুরিয়ে। বাজী লড়ে বলতে যাওয়া সেসব কথার কাঁপছিল পা। উড়িয়ে দিয়েও সেসব কথা বলতে থাকি - ""যা থেমে যা''!
ক্লাস চলে যায় এদিক সেদিক অন্তহীন এক রাত্রি জুড়ে - স্বপ্ন যেন পক্ষীরাজে সওয়ার ছিল লাগাম ছেড়ে। চারজনাতেই মিলেমিশে লাইন দিত যে মেয়েটির - নাম ছিল তার কী যেন লাইনে আজও বাড়াচ্ছি ভীড়। লাইন পেরোয় পরীক্ষা সব ক্লাস চলে যায় শিরায় শিরায়, ঘুম ঢুকিয়ে ডাক পেরে যায় স্বপ্ন গুলো কে নিবি আয়। আমরা সবাই নিশির ডাকে নিভতে থাকা - উসকে তুলে ধুল ঝেড়ে সব ফের পেতেছি নক্সীকাঁথা।
সেসব কথা বাড়তে বাড়তে এখন পুরো আস্ত নদী। যে যার মতো মতো নৌকা ভাসায়, জল তোলে কেউ, কেউ বা কিছু না করে সেই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। জলেই জল বাড়তে থাকে - পায়ের পাতা ভিজল যখন কেমন যে এক শিরশিরনি, এক গোড়ালি জল মানে সব জুতো মোজা যায় বগলে। হাঁটু জলে প্রথম টের পাচ্ছিল সেই স্রোতের আভাস। তটভূমি দেয় হারিয়ে মাঝবয়সী ভুল পরবাস। জলরঙে সব হাবুডুবু বাজনা বাজে দূরে কোনো, এমন স্রোতে কথাই শুধু আঁকড়ে থাকে আঙুলগুলো, সময় গোণো। সেই কথারা নিজের মতো জলস্রোতে বইতে থাকে - নিজের মতো বকতে থাকে - সেই কথাদের সঙ্গ ছাড়ি। দেখি ওরা এখনো সেই আগের মতো - ঠোঁট থেকে ঠোঁট অক্লেশে সব বিড়ির কাউন্টারের কথা স্রোতের মধ্যে ভাসতে থাকে, ডুবতে থাকে। এক এক করে জল থেকে সব উঠতে থাকে মাঝবয়সী শরীরগুলো ঘড়ির কাঁটার পোষাকে সব তোমার মতো আমার মতো, আসতে যেতে দেখবে এদের দূর থেকে সব একইরকম - স্কুল য়ুনিফর্মে সবাই যেমন একইরকম - মাঝবয়সেও। সেই কথারা আবার যদি নেয় চিনে সব ছায়াশরীর, স্কুলেই ফিরি না হয় যেন ভুলেই ফিরি কথার ফিকির।
২৯ মার্চ, ২০১০