এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • খাদ্য নিরাপত্তা, দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব এবং প্রস্তাবিত বায়োটেকনোলজি বিল - ২০১০

    পূর্ণেন্দু চক্রবর্তী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ জুন ২০১০ | ১৪৭৯ বার পঠিত
  • সংসদে পেশ হতে চলেছে "বায়োটেকনোলজি রেগুলেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়া - ২০১০' শীর্ষক বিলটি। বিলটির প্রস্তাবনায় ভারতে "জিন-প্রযুক্তি' সংক্রান্ত সমস্ত "গবেষণা, ব্যবহার, উৎপাদন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের' একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের ভার একটি স্বশাসিত জাতীয় সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে (ন্যাশনাল বায়োটেকনোলজি অথরিটি)। প্রস্তাবিত বিলটির একটি খসড়া ২০০৮ সালে ভারত সরকারের জৈব-প্রযুক্তি মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় এবং আগ্রহী সমস্ত পক্ষের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করা হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সংসদে পেশ হতে চলা এই খসড়া প্রস্তাবের উপর কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছে যা থেকে এই বিলটির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকছে।

    ১) আগেই বলা হয়েছে আধুনিক "জিন-প্রযুক্তি'-র প্রয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কেই এই নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির আওতায় এনে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকছে সমস্ত জেনেটিক্যালি মডিফায়েড প্ল্যান্ট, ভাইরাস, ক্লোনড অ্যানিমাল, ডিএনএ ভ্যাক্সিন বা সাধারণ ভ্যাক্সিন যাতে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম ব্যাবহার করা হয়েছে ইত্যাদি। বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার সাথে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে এগুলি সম্পর্কিত যেকোন আইন/নির্দেশিকা বাতিল বলে গণ্য হবে (" stand repealed' )। সম্ভবত:, কৃষি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে সমস্যা হতে পারে ভেবে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনবোধে রাজ্যগুলিকে এই "আইনের' এক বা একাধিক বিধি মেনে চলবার নির্দেশ দিতে পারে এবং রাজ্য সেই নির্দেশ অনুসরণ করবে (" shall comply with such directions' )। রাজ্য বায়োটেকনলজি কমিটিগুলির কোন বিশেষ ভূমিকার কথা স্বীকার করা হয় নি। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ভূমিকা কার্যত হবে ঠুঁটো জগন্নাথের মত।

    ২) এই সংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত কোন বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে না বা কোন আদালত সংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অভিযোগ নিষ্পত্তিতে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা হবে যার দেওয়ানি আদালতের সমতুল্য ক্ষমতা থাকবে। অভিযোগ সংক্রান্ত ঘটনা ঘটার দু বছরের মধ্যে আবেদন করতে হবে নতুবা আবেদন গ্রাহ্য হবে না। ফৌজদারি অভিযোগ থাকলে ঈশ্বর না ট্রাইবুনাল কার শরণাপন্ন হতে হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা হয নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন আদালতে এই মুহুর্তে GMO নিয়ে ঝুলে থাকা মামলাগুলি হয়ত এই ট্রাইবুনালে নিয়ে এসে বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

    ৩) ২০০৮-এর খসড়া প্রস্তাবে "তথ্যের অধিকার' সংক্রান্ত আইনের কোন উল্লেখ ছিল না। জানা যাচ্ছে, নতুন প্রস্তাবে এই নিয়ে বিশদ ব্যখ্যা দেওয়া আছে। বলা হচ্ছে - "( Disclosure of confidential commercial information,) such information shall, notwithstanding anything contained in the Right to Information Act, 2005, be retained as confidential by the authority and not be disclosed to any other party. (sic) এবং অবশ্যই অথরিটির রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে না।

    কি ধরণের তথ্য এই "গোপনীয়তা' রক্ষার অছিলায় চেপে যাওয়া হতে পারে? ২০০৭ সালে "তেহেলকা' একটি রিপোর্টে দাবী করে বহুজাতিক কোম্পানীগুলির তরফ থেকে জৈব-প্রযুক্তি মন্ত্রকের কাছে এমনকি কোথায় কোথায় "ফিল্ড ট্রায়াল' হচ্ছে সেই তথ্যও গোপন রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে। জৈব-প্রযুক্তি মন্ত্রকের কাছে "গ্রিনপিসের' একটি আবেদনের পারিপ্রেক্ষিতে মনসান্টো "বায়োসেফটি ডেটা' প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। অন্য একটি "জনস্বার্থ মামলায়' সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পর বিটি বেগুনের "বায়োসেফটি ডেটা' বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। বিটি বেগুনের জনশুনানির সময় এই "ডেটা, ডেটার অ্যানালিসিস' এবং "সরকারি বিশেষজ্ঞ কমিটির' রিপোর্টের অজস্র অসঙ্গতি প্রকাশ্যে এসেছে।

    ৪) নতুন প্রস্তাবের ৬৩ নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে - " Whoever, without any evidence or scientific record, misleads the public about the safety of the organisms and products ... shall be punished with imprisonment for a term which shall not be less than six months but which may extend to one year and with a fine which may extend to Rs 2 lakh or with both. (sic) আইনপ্রণেতারা অবশ্য "বৈজ্ঞানিক', "প্রমাণ' ইত্যাদি শব্দগুলির বিশদ ব্যাখ্যার মধ্যে যান নি। তবে এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় "বিজ্ঞানের' সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেবেন তিন সদস্যের একটি সরকারি কমিটি, এতটা দু:সাহসিক চিন্তাভাবনা অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশের সরকার এখনও পর্যন্ত করে উঠতে পারেন নি।

    এখানেই অবশ্য শেষ নয়। ন্যাশনাল বায়োটেকনোলজি অথরিটির আপিসের সামনে ধর্ণায় বসলে বা বিক্ষোভ দেখালেও তিন মাসের জেল অথবা পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে। " Any person who, without reasonable excuse, resists, obstructs or attempts to obstruct ... an Officer of the authority ... shall be guilty of an offence.'

    বেসুরো কন্ঠস্বরগুলিকে চুপ করিয়ে রাখবার জন্যে একাধিক আইনী সংস্থান রাখা হলেও, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শনকারীদের জন্য কী ব্যবস্থা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখা হয় নি। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফসল নিয়ে বেআইনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার একাধিক ঘটনা অন্তত: সরকারিভাবেই স্বীকার করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আইনানুগ কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেসব অবশ্য জানা যায় না। প্রস্তাবিত এই বিলটিতে একাধিক প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে যেগুলি ভবিষ্যতে কখনও বাজারে আসতে পারে। যেকোন নতুন প্রযুক্তির সাথেই যথেষ্ট ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকে যায়। কোন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও কোন স্পষ্ট উল্লেখ নেই।

    ৫) "কার্টেগানা প্রোটোকল' অনুযায়ী যেকোন (জেনেটিক্যালি) "মডিফায়েড অর্গানিজম' সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষের সীমিত অংশগ্রহণও কতখানি কাযর্করী হতে সেটা সম্প্রতি বিটি বেগুন নিয়ে জনশুনানির সময় বোঝা গিয়েছে (উৎসাহী পাঠক এই বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশের নোট টি পড়ে দেখতে পারেন)। বিলটিতে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয় নি।

    পরিশেষে একটি কথা বলা যায়, এই বিলটির আগমন খুব আকস্মিক কিছু নয়। "খাদ্য নিরাপত্তা',"দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের' (কেউ কেউ এটাকে "চিরসবুজ বিপ্লব'ও বলছেন) ঢক্কানিনাদের আড়ালে "সিড অ্যাক্ট (২০০৪)', "পাবলিক ফান্ডেড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বিল (২০০৮)', "ভারত মার্কিন কৃষি সমঝোতা' ( India US Agriculture Knowledge Initiative ) ইত্যাদির মাধ্যমে বৃহৎ পুঁজির আবাহনের যে প্রক্রিয়া চলেছে এটাকে তারই অংশ বলা যায়। বিলটি অবিকৃত ভাবে আইনে পরিণত হলে, তাই স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারে একটি বিশাল প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।

    ৬ই জুন, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ জুন ২০১০ | ১৪৭৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন