গদ্য নিয়ে বলতে গেলে কী দিয়ে শুরু করা যায় বলুন দেখি! আচ্ছা বেশ, আমাদের সবার চেনা কিছু লেখককে দিয়ে শুরু করা যাক, একথা মনে রেখে যে আমরা সকলেই দেশকে ভালোবাসি। সাগরময় ঘোষ যখন একজন করে নতুন লেখককে দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় উপন্যাস লেখার সুযোগ দিচ্ছেন, সেই সময়ে এক এক করে তিনজন লিখলেন উপন্যাস, এবং প্রত্যেকেই অচিরেই বা কিছু পরে পরেই প্রতিষ্ঠা পেলেন। "আত্মপ্রকাশ', "ঘুণপোকা' এবং "দৌড়'। নি:সন্দেহে ভালো লেখা, (যদি আপনার ভালো না লেগে থাকে) অন্তত সেই সময়ে একেবারে ফেলে দেওয়ার মত লেখা ছিল না। মজাটা হল এই, যে এই লেখাগুলোর (এর সাথে যোগ করে নিন "প্রতিদ্বন্দ্বী') মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল আছে, সেটা পরপর পড়ে ফেললেই ঠিক বোঝা যায়। হতাশা, বেকারত্ব, দূর্নীতি (এবং তার প্রতি ঘৃণা) আর বোহেমিয়ান জীবন যাত্রা। এর প্রভাব কিছুটা পরবর্তী সময়ের যুবমানসেও পড়েছিল বই কি। এইখানে আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, এঁরা কি তখন ই "মাল্যবান' পড়ে ফেলেছিলেন! জানি না। যদিও বলে রাখা ভালো যে "মাল্যবান' ও তার সঙ্গী সাথীদের খুঁজে পেতে ছাপা না হলে যে বাংলা সাহিত্যের বিরাট কিছু ক্ষতি হয়ে যেত, এরকমটা আমার মনে হয় নি। এরপর এঁদের আর কোন লেখাতে এই জিনিসগুলো এইরকম প্রবলভাবে আর আসে নি, প্রতিষ্ঠা এসে গেলে মানসিকতা বদলে যেতেই পারে, তাতে আখেরে ক্ষতি কিছু হয়নি, সিকোয়েল তৈরি হয়নি ভালোই তো। আর একজনকে নিয়ে না বললেই নয়, কারণ এই নয় যে তিনি আমার খুব পছন্দের, কারণ এই যে, তাঁকে নিয়ে লোকজন অনর্থক এবং বিস্তর মাতামাতি করে থাকেন। নাম সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। পড়েছিলুম কিছু কিছু, খুব খারাপ লেগেছিল, তাও নয়, মনেও ছিলেন তিনি অল্প অল্প। পরে যখন মার্কোয়েজ/মার্কেজ কিছু কিছু পড়লাম তখন প্রথমেই যা মাথাতে এল তা হল : "যা: শালা!' ভীষণ প্রভাব এবং ততখানি গভীরতার অভাব (কিছুটা তার গভীরতা, কিছুটা আরোপিত)। তাহলে আছে কী, আছে রাগ (বন্ধুদের উপর, প্রতিষ্ঠানের উপর এবং আরও কি কি জানা সম্ভব নয়), লিখনভঙ্গী, শব্দ চয়ন, নিজস্ব ভঙ্গীতে বাক্য গঠন। এদের তাকে বাঁধিয়ে রাখা যেতে পারে, বুকে নয়। "ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড'-এর প্রভাব "মিডনাইটস চিলড্রেন'-এও পাই, কিন্তু সেক্ষেত্রে রুশদির টানটান গল্প বলার পটুত্ব বেঁধে রাখে শেষ অব্দি। প্রভাব থাকেই, কিন্তু তার সাথে থাকে কিছু নতুনত্ব, বক্তব্যে এবং লিখনভঙ্গীতে, সামঞ্জস্য প্রয়োজন তাদের। অন্যথায় বিপদ, যা ঘটেই থাকে। বন্ধুবর বলেছিল দেবর্ষী সারগি পড়তে, নাকি দারুণ! পড়ে ফেললুম, মনে হল মন্দ না, অন্য রকম ভাবে লিখছেন, ভালো কথা, কিন্তু কী লিখছেন, কথা নয় কাহিনি নয়, দর্শন, ঈশ্বর-মনুষ্য চিন্তা, গভীরতা কতখানি, ডোবা যায় না, চুল ভেজে না, শুধু গায়ে একটু ছিটে লাগে মাত্র। "দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং' পড়ে বুঁদ হয়ে ছিলুম কয়েক মাস, এই পার্থক্য, আমি বরং কুন্দেরায় ফিরে যাব বার বার। স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র বা অনিল ঘড়ুই খুব একটা খারাপ না লাগলেও সেই অনূভুতি আসেনি যা প্রথম এবং মাঝের দিকের শীর্ষেন্দু পড়ে আসত। শুধু মোটামুটি, খারাপ না, ঠিকঠাক, এসব পড়ে আর শুনে হতাশ! পাগল করে দেবে কে, আবার?
এবার দেখা যাক আর একটা প্রয়োজনীয় দিক, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং সমান্তরাল লেখালিখি। শুধু যারা লেখক হিসাবে একটু আধটু নাম করেছেন তারাই নয়, আমরা যারা লিখে টিখে থাকি মাঝে মধ্যে, তারাও এর ই মধ্যে পড়ি। কাজেই কিছুটা আত্মসমালোচনাও বলা যেতে পারে। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে যে সাহিত্য (?!) পত্রিকাটি বের হয় তা এখন আমরা অনেকেই হয়ত আর আগের মত অতটা উৎসাহ নিয়ে পড়ি না। অনেককেই বলতে শুনেছি যে এর থেকে অমুকদা বা অমুক দিদি অনেক অনেক ভালো লেখে (কী আর করা যাবে, হর্ষ দত্ত বা সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য এক্ষুনি এক্ষুনি রিটায়ার করবেন সে রকম কোন খবর নেই)। কিন্তু ঘটনা হল লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত অনেককে আমি এইরকম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং সমান্তরাল লেখালিখির কথা বলতে দেখেছি। সেই লেখালিখি কিছু কিছু পড়ে মাঝে মধ্যেই মনে হয় যে এ তো আর একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, এক ধাঁচে লেখা, আট দশটা লিটল ম্যাগাজিনের গদ্য লেখা পড়তে পড়তে সব গুলিয়ে যেতে থাকে, যেন একই স্যারের নোট মুখস্থ করে পরীক্ষায় লেখা হচ্ছে। তারই মধ্যে ভাল মন্দও আছে, সে তো থাকবেই, একই স্যারের সব ছাত্রই কি সমান নম্বর পায়! অথচ, কতকিছুই তো করা যেতে পারে, হচ্ছে না। সারল্য বিসর্জন গেছে, সর্বত্র চলছে কঠিন করে দেওয়ার খেলা, অদ্ভুত ঘোরের মত ভঙ্গীতে (মাঝে মধ্যে একটু ফিচলেমো মিশিয়ে, অনেক পাবলিক খায়) ন্যারেটিভ, অথব অসংলগ্ন কথা ওলট-পালট করে সাজিয়ে পরিবেশন করা। অথবা নিছক ফিচলেমি করে যাওয়া, "পান' মিশিয়ে দেওয়া মাঝে মধ্যে, এরই মাঝে সিরিয়াস বিষয় বস্তু নিয়ে কথা বলা-ছেঁড়া ছেঁড়া অনুভূতি সাজিয়ে যাওয়া, এবং আম্মো পারি ভাবখানি সযত্নে টেবিলের তলাতে রাখা । বহু আগে পড়েছিলাম যে বুদ্ধদেব বসু দুজন সাহিত্যিক সম্পর্কে একটু সমালোচনা করেছিলেন: একজনের জন্য বলেছিলেন যে কিভাবে লিখতে হয় তিনি খুব ভাল জানেন, কিন্তু তাঁর লেখার কিছুই নেই; আর একজনের জন্য বলেছিলেন যে এনার লেখার অনেক কিছু আছে, কিন্তু কিভাবে লিখতে হয় উনি জানেন না। প্রথম জন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এবং দ্বিতীয় জন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা নিজেদের কোনটা বলব, ভাবি। লিখনভঙ্গী আয়ত্ত্বÄ করার খেলাতে আর কতদিন কাটাব, অনেক পাঠক শুধু আপনাদের লেখাই পড়ে না আরও অনেকের লেখাই পড়ে, সেটুকু ভুলে গেলে বিপদ।
সার্বিক ডিসক্লেমার: এ লেখার উদ্দেশ্য নিছক সমালোচনা মাত্র নয়, যদি আপনি লেখালিখি করেন বা করার ইচ্ছা রাখেন, তাহলে একটু ভাবুন, একটু কষ্ট করুন, শুধু এইটুকু অনুরোধ। আমরা সঙ্গে আছি, অপেক্ষায়।