এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • কলকাতার কানাচে ২ -- নিউজ চ্যানেল

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ০২ এপ্রিল ২০১১ | ১১৮৭ বার পঠিত
  • সেক্টর ফাইভ পর্ব | নিউজ চ্যানেল
    ভারতবর্ষে রেলগাড়ির পত্তন এক বিরাট বিপ্লব ঘটিয়েছিল। রেলগাড়ি ভেঙে ফেলেছিল পুরাতন জীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে আর উত্থান হয়েছিল এক নতুন হিন্দুস্থানের। স্বয়ং মার্ক্স সায়েব সে নিয়ে কঠিন প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আজ কলকাতার নিউজ চ্যানেলগুলি আর তাই ছোটোভাই বাংলা সংবাদপত্র বাজারে এসে চুপচাপ আরও বড়ো বড়ো বিপ্লব ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে। কিন্তু মার্ক্স সায়েবের মতো মহাপ্রাণ ব্যক্তি না থাকায় কোনো কল্কে পাচ্ছেনা। অগত্যা, এই ক্ষুদ্র কলমচিকেই এই মহান বিপ্লবের কয়েকটি দিক তুলে ধরার উদ্যোগ নিতে হল। নিচে দেওয়া হল বাংলা নিউজ চ্যানেলের ঘটিয়ে চলা চলমান বিপ্লবের নানা অভিমুখের এক খন্ডিত চিত্র।

    সামাজিক বিপ্লব

    বেশি নয়, এই বছর-কুড়ি আগেও সকালের চায়ের আগে কাগজওয়ালা বাড়িতে খবরের কাগজ সাপ্লাই না দিলে হেবি ধাতানি খেত। বাড়ির ছেলে-বুড়ো-মদ্দা রোজ সকালে শকুনের মতো বারান্দার দিকে তাক করে বসে থাকতো। কাগজ এল কি এলনা ছোঁ মেরে কেউ একজন নিয়ে হাওয়া। পুরো লটারি পাওয়ার কেস। যে পেল, সে পেল, সে হয়তো বাথরুমে বসে আরামে প্রাত:কৃত্যের সঙ্গে সংবাদপাঠ করছে, আর বাকি বাড়িময় হাহাকার। খোঁজ খোঁজ রব, দরজায় দড়াদ্দম লাথি। ঘন্টাখানেক পরে সে কাগজ হয়তো পাওয়া গেল। এবং পাওয়া মাত্রই পাঁচ-টুকরো। বাড়ির বৌদিমনি ঘেন্নাপিত্তি ত্যাগ করে সাতের পাতার দখল নিয়েছেন। বড়ো কত্তা প্রথম পাতায় মুখ গুঁজে গম্ভীর। আসলে পড়ছেন না হাতি, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খবরের শেষাংশ বৌদিমনির কাছ থেকে খুঁজে পাবার ছক কষছেন। বাড়ির বুড়ো বাবা "আমার বয়স হয়েছে বলে কেউ পোঁছেইনা' অভিমান নিয়ে বারান্দায় আরাম কেদারায় সামিল। শেষে এক কাপ চায়ের সঙ্গে আস্ত কাগজখানা বরের থেকে হাইজ্যাক করে নিয়ে সাপ্লাই করে বৌদিমনি সেই অভিমান ভাঙাচ্ছেন। অত:পর দুপুর পর্যন্ত কাগজখানি বুড়ো কত্তার দখলে। তিনি জগৎ সংসারের নানা জটিল ও কুটিল সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন ও ঘামিয়ে চলেছেন।

    নিউজ চ্যানেল আসার পর এসব সিনেমাটিক দৃশ্যাবলী হাওয়া। পরিবারে আর প্রাত্যহিক জমায়েত হয়না। একটি পাতা নিয়ে বাপ-ছেলের ইমোশনাল টানাপোড়েন হয়না। খেলার খবরের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা নেই। শব্দছক নিয়ে দেবর-বৌদির মিষ্টালাপ শেষ। সামাজিক মিলনোৎসব সব লাটে উঠেছে। হবে কিকরে, এখন সকালের তাজা খবরের জন্য খবরের জন্য কাগজকে কেউ আর পোঁছেই না। এখন সারাদিনই খবর আসছে ছোটো ছোটো প্যাকেটে। খবর মানেই হাতে গরম রিয়েলিটি শো। বারাসাতে ট্রেন দুর্ঘটনা? আধ ঘন্টার মধ্যে নিউজ চ্যানেলে সরাসরি দেখানো হচ্ছে হাত-পা-কাটা লাশ। ব্যারাকপুরে গণপিটুনি? খুঁটিতে বাঁধা রক্তারক্তি ভিকটিমকে সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করছেন মরতে কেমন লাগছে দাদা? গোটা বাংলা দেখছে সেই হাতে গরম দৃশ্য। হাসপাতালে ভাঙচুর? পুলিশের আগেই পৌঁছে যাচ্ছে টিভি ক্যামেরা। কে মারছে, কাকে মারছে, কিভাবে মারছে, কটা চেয়ার ভাঙল, সব সিধে সেঁধিয়ে যাচ্ছে ড্রয়িংরুমে। দেখতে-দেখতে কত্তাগিন্নি ডিনার করছেন। সন্ধ্যে বেলায় পিতামহের জ্ঞানবিতরণের যুগ শেষ। লাঠি নয়, বৃদ্ধদের হাতে এখন রিমোট, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁরা বিভিন্ন চ্যানেলে একই খবরের নানা ভার্সন দেখে চলেছেন।

    এ এক সামাজিক বিপ্লব, যেখানে বার্তালাপের জায়গা নিচ্ছে এসএমএস, খবরের জায়গা নিচ্ছে রিয়েলিটি শো, একান্নবর্তী পরিবারের জায়গা নিচ্ছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। প্রাত্যহিক সংবাদপত্রের জায়গা নিচ্ছে সবজান্তা বাক্স।

    সাহিত্য বিপ্লব

    তার মানে অবশ্য এই নয়, যে, খবরের কাগজ উঠে যাচ্ছে। তারাও রীতিমতো বাঘা তেঁতুল। লোকে খবরের কাগজ নিয়ে সাতসকালে অর কাড়াকাড়ি করেনা ঠিকই। কিন্তু খবরের কাগজগুলো কি তা বলে ছেড়ে দেবার পাত্র? তাজা খবরের একঘেয়ে অফস্পিন ব্যাটসম্যানরা ধরে ফেলছে বলে তারা এখন শৈল্পিক "দুসরা'য় মন দিয়েছে। খবরের কাগজ আর সকালবেলার সহজপাঠ নয়, ভাতঘুমের সঙ্গী কিংবা সাঁঝবেলার সান্ধ্যভ্রমন। একদা মাসিপিসিরা দুপুরে রোমান্টিক উপন্যাস পড়তেন, সেসব পাট কবেই চুকে গিয়েছে, এখন সেই স্থান দখল করেছে দৈনিক সংবাদপত্র। সন্ধ্যেবেলায় কচি ছেলে-মেয়েরা প্রেমপত্র লিখত কিংবা পড়ত, এখন পড়ে এসএমএস আর খবরের কাগজ। খবরের কাগজ এখন দিবানিদ্রার পাশবালিশ, নিয়ন-সাঁঝের ঝিকিমিকি বেলা।

    অবাক হবার কিছু নেই, দিনকাল বদলে গেছে। সেই পুরোনো সাদা-কালো লেটার প্রেসের বোরিং কাগজ আর নেই। এখন রঙিন অফসেটের যুগ। জেন ওয়াই এর জন্য তৈরি হচ্ছে স্মার্ট কাগজ। স্মার্ট ও স্লিক। বহিরঙ্গে। আর অন্তরঙ্গের পরিবর্তনটি আরও বৈপ্লবিক। রোজকার বাঁধাধরা খবরের পাঁচন ছেড়ে বাংলা রিপোর্টিংএর নতুন মেনু এখন সাহিত্য। খবর পরিবেশনের দায় এখন নিয়েছে নিউজ চ্যানেল, আর সাহিত্য পরিবেশনের দায় নিয়েছে খবরের কাগজ। সে অবশ্য ভালই হচ্ছে, কারণ এখন বাংলা বই-টই মোটামুটি উঠেই গেছে, স্টারমার্ক জাতীয় নামী দোকানে গেলে বাংলা বইয়ের জন্য দেখা যায় গোটা দুই তাক বরাদ্দ। তার অর্ধেকই আবার দখল করে আছে এক গাদা রবীন্দ্ররচনাবলী আর রবীন্দ্রজীবনী। খবরের কাগজ না দেখলে সাহিত্যকে আর দেখত কে?

    তাই বাংলা কাগজই এখন বঙ্গসাহিত্যের অলঙ্কার। চেতনার অঙ্গীকার। সৌন্দর্যের অভিজ্ঞান। আজ কাগজে খেলার খবর পড়লে মনে হয় নেভিল কার্ডাস পড়ছি। ডানদিকে বাঁদিকে জীবনানন্দ আর এলিয়টের কোটেশন। রাজনৈতিক খবর পড়লে মনে হয় রিপোর্টার সাক্ষাৎ গার্সিয়া মার্কেজের মাসতুতো ভাই। চিলে থেকে সদ্য ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। এক্সক্লুসিভ অন্তর্তদন্ত পড়লে মনে হয় উম্বার্তো একোর উপন্যাস। সঙ্গে কিছুটা পাঁচকড়ি দে'র পাঞ্চ। তেমন-তেমন খুন-জখমের খবর পড়েল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে পড়ে। টুকরো খবর পড়লে মনে হয় এসএমএস পড়ছি। আর কিছু কিছু স্পেশাল খবর, আহা যেন কবিতা। সংবাদ, মূলত:কাব্য।

    ভুরু কুঁচকিয়ে লাভ নেই। এই জন্যই বাংলা খবরের কাগজ এখনো লোকে পড়ে। গবগবিয়ে পড়ে। কিন্তু সকালবেলায় নয়। দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায়। সাহিত্যপাঠের জন্য। খবরের জন্য নয়। বিশুদ্ধবাদীরা এতে অনেকেই নাক কোঁচকাচ্ছেন ও কোঁচকাবেন, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায়না। খবরের কাগজ এখন অন্য এক মহান দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত। খবরের কাগজের রিপোর্টিং আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মরা গাঙে নতুন জোয়ার এনেছে এবং আনছে। এই পরিবর্তন অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু এই নবীন কারিগরির পিছনের বিশ্বকর্মাকে অনেকেই মিস করে গেছেন। সাহিত্যজগতে এই নবজাগরণের ভগীরথ কে? কে এই অনামা বিশ্বকর্মা? বাংলা নিউজ চ্যানেল আবার কে?

    নাট্য বিপ্লব

    শুধু সাহিত্যেই নয়, নাটকেও বাংলা নিউজ চ্যানেলের প্রভাব অপরিসীম। গিরীশ ঘোষ যেমন বাংলা রঙ্গমঞ্চের ধরন-ধারনই বদলে দিয়েছিলেন, সত্যজিৎ রায় যেমন বাংলা ফিল্মে নিয়ে এসেছিলেন রিয়েলিজমকে, বাংলা নিউজ চ্যানেল সংবাদপাঠে একটি অনুরূপ, বা আরও বৃহদাকার বিপ্লব সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের দিগন্ত আরও সুদূরপ্রসারী। বোরিং খবরের সঙ্গে তারা মিশিয়ে দিচ্ছে আধুনিক রঙ্গমঞ্চের প্রেক্ষাপটকে। উপস্থাপনার সঙ্গে মিশিয়ে দিছে নাট্যকলাকে। সংবাদপাঠের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে অভিনয় দক্ষতার। বাংলা নিজ চ্যানেলের স্টুডিওতে আজ হাজির হচ্ছে আস্ত প্রসেনিয়াম থিয়েটার।

    সংবাদপাঠিকারা আজ আর শুধু সংবাদ পড়েন না। সংবাদের সঙ্গে মিশিয়ে দেন অনুভূতি। আবেগ। বিদ্রূপ। হাসি, কান্না, চুনী ও পান্না। একেকটি খবরের জন্য বরাদ্দ আছে একেকটি অনুভূতির আঙরাখা। দুর্গোৎসবের কি দোলের খবর পড়ার সময় পাঠিকাদের মুখে খেলে যায় এক আনন্দের হাসি। যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে "নব আনন্দে জাগো'। সেলিব্রিটির বিয়ের নাচ-গানের লাইভ পরিবেশনার সময় উপস্থাপক-স্থাপিকারা এতটাই উদ্বেল হয়ে পড়েন, যেন, মনে হয় বিয়ে সেলিব্রিটির নয়, তাঁদেরই। আবার দু:খের খবরে গলা হয় গাঢ়। স্বর হাস্কি বা ব্যারিটোন। যখন যেমন প্রয়োজন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবরের থিমসং যেন ব্রহ্মসঙ্গীত। আর সেলিব্রিটির মৃত্যুসংবাদে চোখ ছলছল। নাকে আসে জল। আছে মৃত্যু, আছে দু:খ, তবু নিজের ক্রুশ নিজেই বয়ে চলেছি, --এরকম একটা এক্সিটেন্সিয়ালিস্ট হাবভাব। দূরের খবরে, যেমন লিবিয়ায় বোমা কি জাপানে সুনামির সময় আবার গলায় আসে এক নিরাসক্তি। অনেক দূর থেকে যেন দু:সংবাদ বয়ে আনছে নির্লিপ্ত বেতারবার্তা। আর কাছের সংবাদ, যেমন বাইপাসে দুর্ঘটনার সময় আবার ফুটে ওঠে পাশের বাড়ির মাসীমার উদ্বেগ -- এমনটা তো আমার সঙ্গেও হতে পারে যে কোনো দিন।

    বিদ্রূপ আর গাম্ভীর্য আসে মূলত রাজনৈতিক খবরে। অমুক পন্থী চ্যানেলের পাঠিকা বিরোধী পক্ষের খবর দেবার সময় ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখেন এক অপূর্ব বাঁকা হাসি। বক্তব্য কোট করার সময় এমন ভাবে ছুঁড়ে দেন, শুনলে অবিশ্বাস করার কোনো জায়গাই থাকেনা, যে, বক্তব্যটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আর "নিজেদের' খবর দেবার সময় গলা করেন গম্ভীর। পরিষ্কার বোঝা যায়, যে, এই খবরটি খুব সিরিয়াস। এক্কেবারে নো-ননসেন্স। দর্শকরা গুরুত্ব দেবেন কিনা সে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু নিউজ চ্যানেলে এই নিয়ে কোনো ছ্যাবলামো বরদাস্ত করা হবেনা।

    খবরে এই বিদ্রূপ ও হিউমার গুঁজে দেবার প্রচেষ্টাটি এতো বড়ো পরিসরে বিশ্বের আর কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। এটি সম্পূর্ণ ভাবেই খবরের জগতে বাংলা চ্যানেলের নিজস্ব বৈপ্লবিক অবদান। ছোটো থেকে দূরদর্শনের বোরিং এবং ফ্ল্যাট খবর দেখে যাঁরা বড়ো হয়েছেন, তাঁরা একটু হোঁচট খান ঠিকই, কিন্তু আপামর জনসাধারণের দরবারে এটি বিগ হিট। খবর আজ আর শুধু খবর নয়, ঘাতপ্রতিঘাতে পূর্ণ লাইভ রিয়েলিটি শো। যাতে ঢুকে আছে শোক ও আনন্দ। ব্যঙ্গ ও অনুভব। সুদীর্ঘ বাংলা নাট্যচর্চা তার দীর্ঘ ইতিহাসে যে কাজটি করতে পারেনি, বাংলা নিউজ চ্যানেল মাত্র দেড় দশকে তুড়ি মেরে সেই কর্মটি সমাধা করেছে। নাট্যকলাকে নিয়ে এসেছে জনতার দরবারে। শুধু নিয়ে আসা নয়, তাকে জনপ্রিয় করেছে।

    লোকসাংস্কৃতিক বিপ্লব

    একথা ভাবলে ভুল হবে, স্রেফ আঁতেল সাহিত্য আর গ্রুপ থিয়েটার নিয়েই নিউজ চ্যানেলের সমস্ত মাথাব্যথা। এই জাতীয় এলিটপনাকে কবেই নিউজ চ্যানেল ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। ভোটে যেমন, টিআরপিতেও তেমনই একজন দর্শকের একটিই ভোট। তিনি রোগা না মোটা, লম্বা না কালো, আঁতেল না হাড়হাভাতে, তাতে কিস্যু যায় আসে না। এই ব্যাপারে নিউজ চ্যানেল পরিপূর্ণ উত্তরাধুনিক। শিল্পের কোনো রকম হায়ারার্কিতেই তার বিশ্বাস নেই। তাই শুধু এলিট সাহিত্য বা শিল্প নয়, জনতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারও আজ বাংলা নিউজ চ্যানেলেরই হাতে। নতুন মোড়কে বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিস্মৃতপ্রায় ফর্মকে তারা তুলে এনেছে জনতার দরবারে, যার নাম খেউড়। এবং এর অবিরত পরিবেশনায় বাঙালি দর্শককুলকে করে তুলেছে মুগ্ধ ও মোহিত।

    না-না ভুল বুঝবেন না। "খেউড়' নামক কোনো অনুষ্ঠান কোনো বাংলা নিউজ চ্যানেলে আদপেই হয়না। নতুন বাংলায় এদের নাম বদলে গেছে। এদের এখন "সামনা-সামনি' বা "এই পক্ষ- ঐ পক্ষ' জাতীয় নামকরণ করা হয়। কিন্তু চ্যানেলবিশেষে নামকরণ যাই হোক না কেন, বিষয়বস্তু সেই একই। মানে, কোনো একটি ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক, বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ থেকে চাট্টি লোককে এনে স্টুডিওতে বসিয়ে দেওয়া হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত নন কিন্তু কারো পক্ষে বা বিপক্ষে আছেন এরকম সেলিব্রিটিদেরও এখানে অকাতরে চান্স দেওয়া হয়। কিছু হোক বা না হোক, তাঁরা একে অপরকে তেড়ে গাল দিয়ে যাবেন, এইটিই হল অনুষ্ঠানের থিম। এর পোশাকি নাম আলোচনা। বিষয় নিশ্‌চয়ই একটা কিছু থাকে, কিন্তু অনুষ্ঠানের শুরুর পর থেকে তার আর দেখা পাওয়া যায়না। বিষয় ব্যাপারটাই এখানে গৌন, মুখ্য হল চাপান-উতোর। একজন আরেকজনকে ঝেড়ে কাপড় পরাবেন, সরকারি সুবিধে নেওয়া থেকে শুরু করে বাংলো বাড়ির মালিকানা নিয়ে কটাক্ষ করবেন। জবাবে অন্যজন আরও তেড়ে প্রথমজনের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক-ব্যক্তিগত দেউলিয়াপনা নিয়ে গাল দেবেন। এইভাবে চলতেই থাকবে, যতক্ষণ না বিষয়টা চিল চিৎকার বা হাতাহাতির পর্যায়ে পোঁছয়। সবাই একসাথে ফেঁড়ে চিৎকার করবেন, কারো কথা কেউ শুনতে পাবেন না। এই পর্যায়ে একজন রেফারি এসে হস্তক্ষেপ করবেন, যাঁর পোশাকি নাম সঞ্চালক।

    অনুষ্ঠানের নাম-ধাম যাই হোক না কেন, এ সেই চিরপুরাতন তর্জা গান ও খেউড়ের নতুন সংস্করণ। জনতার দরবারে সেই পুরাতন দিনের মতই আজও যা সুপারহিট। এইসব অনুষ্ঠান এতটাই জনপ্রিয়, যে তারা কিছু স্টারেরও জন্ম দিয়ে ফেলেছে। সেই স্টাররাই বিভিন্ন চ্যানেলে বারবার ডাক পান, নিজেদের অমৃতবাণী পরিবেশনের জন্য। স্রেফ এই অনুষ্ঠানগুলির কারণেই নিউজ চ্যানেল আর এত বড় হিট। লোকে আজ খেলা ছেড়ে নিউজ চ্যানেল দেখে। ট্রেনে-বাসে-অফিসে ফিল্ম স্টারদের ছেড়ে "বিতর্ক' নিয়ে আলোচনা করে। সেদিন আর দূরে নয়, যখন, টিভি অ্যাওয়ার্ডে এই স্টারদেরও নমিনেশন থাকবে, লোকে রাস্তায় তাঁদের দেখলে ঘিরে ধরে অটোগ্রাফ নেবে। সেদিনও আর দূরে নেই, যখন টিভি সিরিয়ালগুলি দুনিয়া থেকে ক্রমশ উঠে যাবে। তার জায়গা নেবে প্রাচীন লোকসংস্কৃতির এই অবলুপ্তপ্রায় ধারাটি।

    সব মিলিয়ে, সোজা বাংলায়, মাত্র দেড়, মেরেকেটে দুই দশকের ইতিহাসেই বাংলা নিউজ চ্যানেল বঙ্গরঙ্গমঞ্চে ফাটিয়ে দিয়েছে। পন্ডিতরা টিভি যুগে লোকসংস্কৃতির অবসান ও বোকা বাক্সের উত্থান নিয়ে এতকাল অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু আজকের বাংলায় ঘটতে চলেছে এক প্রকৃতই উলটপুরাণ। নিউজ চ্যানেলের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলার সংস্কৃতি। সাহিত্য থেকে শুরু করে সাবল্টার্ন কালচার অবধি সমস্ত কিছুর পুনরুজ্জীবনের পথ দেখাচ্ছে নিউজ চ্যানেল ও তার ছোটোভাই সংবাদপত্র। হে সুধীজন, আসুন, সমস্বরে এই নবীন মসীহাদের জয়গান গাই।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    সেক্টর ফাইভ পর্ব | নিউজ চ্যানেল
  • ধারাবাহিক | ০২ এপ্রিল ২০১১ | ১১৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন