এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • স্টেডিয়ামে আমি, বউ আর মমতাজ যখন বঙ্গশার্দুল দেখছিলাম

    আরিফ জেবতিক লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ০৪ এপ্রিল ২০১১ | ৯২৪ বার পঠিত
  • এক.
    আমি যখন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে আধাঘন্টার মধ্যে বিশ্বকাপের সবগুলো টিকিট বিক্রি করে ফেলতে পারলাম, তখন নিজের ব্যবসায়ী দক্ষতা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মানুষ সবসময়ই নিজের কৃতিত্ব দিয়ে বউয়ের কাছে দাম বাড়াতে চায়, আমি তাই দৌড়ে পাশের রুমে গিয়ে বউকে বললাম-বিশ্বকাপের সব টিকিট বিক্রি করতে পেরেছি। মোট ষোল হাজার টাকা লাভ হয়েছে।

    আমার বউ অবাক হয়ে বলল,"আমরা খেলা দেখব না?' "অবশ্যই দেখব। বড় স্ক্রিনের এলইডি টিভি ভাড়া করে আনা হবে। খেলা দেখা হবে লিভিংরুমে। এ উপলক্ষে ব্যাপক খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হবে। খিচুড়ি আর গরুর মাংস। তুমি কোরবানির মাংসগুলো এই সুযোগে শেষ করে ফেলতে পারবে।

    (ফুটনোট: আমার ছোটভাই কোনো একদিন বিদেশ থেকে ফিরে এসে কোরবানির গরুর মাংস খাবে এই আশায় আমার বাসার ফ্রিজে গত কয়েক বছরের কোরবানির গরুর মাংসের একটা বড় সংগ্রহ আছে। এই কাণ্ডটি করেন আম্মা। তিনি সন্তান স্নেহে অন্ধ, কিন্তু আমার ভাতৃপ্রেম আরো বেশি, তাই অন্তত গত কয়েকবছরের মাংসগুলোর গতি করার জন্য আমি উদ্বিগ্ন থাকি। নিজের ভাইকে বিষাক্ত মাংস খাওয়াতে রাজি না আমি। )

    আমার স্ত্রী অত্যন্ত শক্ত গলায় বলল, "তুমি আমাকে যুক্তি দাও, ঠিক কেন তুমি এই টিকিটগুলো বিক্রি করে দিলে?' আমি বললাম, "স্টেডিয়ামে নাকি সিগারেট খেতে দেয় না! সিগারেট না খেয়ে ৮ ঘন্টা ধরে তো থাকতে পারব না। তাই টিকিট বিক্রি করে দিয়েছি।' আমার স্ত্রী আমার দিকে "রোষকষায়িত লোচনে' তাকাল। আমি মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়তে থাকলাম। সে কোনকিছুই সহজে ভুলে না, সুতরাং হাতের লক্ষী টিকিট যে আমি নেটে ঠেলে দিয়েছি, তার জন্য আমার আসন্ন বিপদের কথা স্মরণ করতে থাকলাম।

    দুই.
    বিশ্বকাপ যখন শুরু হলো, তখন আমার বাসায় উত্তপ্ত অবস্থা। নিজের দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ, সেখানে খেলা দেখব না? ধিক নিজেকে। আমার নিজেরই খারাপ লাগতে শুরু করল, বউয়ের কথা আর কী বলব।

    বিশ্বকাপ উপলক্ষে যখন সংসার ভাঙ্গে ভাঙ্গে অবস্থা, তখন আমাকে উদ্ধার করতে এল আমার একমাত্র বোনের স্বামী। এই ছেলের নাম শমশের রাসেল, তাঁর জীবনে লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্য ত্যাগ করা। সে এবং আমার বোন তাঁদের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড টিকিট দুটো আমাকে দান করে দিয়ে হাসিমুখে সাধারণ রোদমাখা গ্যালারির টিকিটে খেলা দেখতে চলে গেল।

    সেই টিকিট নিয়ে সকাল থেকেই আমার জোশ এসে গেল। ডিএসএলআর ক্যামেরা ভেতরে নেওয়া যায় না, তাই আমি একটা পয়েন্ট এন্ড শুট কিনে ফেললাম। ব্যাকআপ হিসেবে আরেকজনের উচ্চ ক্যামেরা সম্পন্ন একটা মোবাইল সেট নিয়ে এলাম। মাথার ব্যান্ডানা, ক্যাপ, মাথাল, জার্সি জোগাড় করে একেবারে বেরাছেরা অবস্থা।

    তিন.
    অতি উৎসাহে মাঠে যেতে খানিকটা দেরি হলো। অবশ্য এসব দেরি নিয়ে আমি ভাবিত না, খেলার প্রথম অংশ গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরের ব্যাটিং। তখন টার্গেট থাকে সামনে, খেলায় উত্তেজনাটা থাকে বেশি। আমার বোন আর রাসেল সকাল থেকেই স্টেডিয়ামে গিয়ে হাজির, তারা কিছুক্ষন পরে পরে মুখে রঙ মাখিয়ে বিভিন্ন নকশা করছে, সেই নকশা পছন্দ হচ্ছে না বলে আধাঘন্টা পরে আবার মুখ মুছে সেখানে রঙ লাগাচ্ছে।

    বাংলাদেশের ব্যাটিং শুরু হয়েছে। স্টেডিয়ামের ভেতর থেকে উল্লাস ভেসে আসছে।

    জোরে একটা চিৎকার। আমি বোনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, "কী অবস্থা?' সে বলল, "ভাইয়া, দুইটা উইকেট পড়ে গেছে!'

    আমি ঠোঁট উল্টালাম। আমার বোনের ক্রিকেট জ্ঞান কম, সে নিশ্চয়ই দুই রানকে দুই উইকেট বলছে। দুই উইকেট পড়ার তো প্রশ্নই উঠে না।

    গেট খুঁজে যখন নিজের নম্বর দেওয়া সিটে গিয়ে বসেছি, পাশের লোককে জিজ্ঞেস করলাম, "কী অবস্থা ভাই?' সে বলল, "৪ উইকেট চলে গেছে।' আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। বলে কী!

    ব্যাপক খাওয়া দাওয়ার প্ল্যান নিয়ে এসেছি। ভাবলাম, খেলার যে অবস্থা, খাওয়া শুরু করব একটু পরে। আপাতত এককাপ কফি নিয়ে বসি। কফি আনতে আনতে উইকেট পড়ে গেল আরো দুইটা। জোড়ায় জোড়ায় উইকেট পড়ছে। আজিব কাণ্ড!

    চার.
    আমার একটু দূরেই বসেছেন গায়িকা মমতাজ। মমতাজের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। তখন আমি মোটাসোটা গোলাকার ছিলাম, আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েকদিনের মাঝেই মমতাজ সেই গোলাকারত্বকে অমর করতে গাইলেন, "পোলা তো নয় যেন, আগুনেরও গোলা।' এবারের বিশ্বকাপের থিম সং এটি, আশরাফুল ভাই গানটির সঙ্গে নাচতে খুব পছন্দ করেন। সেই কাণ্ডের পরে আমি অভিমানে মমতাজের সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছি।

    সুতরাং তাঁকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে খেলা দেখতে থাকলাম। এক পর্যায়ে কে মাঠে যাচ্ছে কে যাচ্ছে না, এসব হিসাব রাখাই মুশকিল হয়ে গেল। এমন জায়গায় বসেছি, খেলোয়াড়রা মাঠে যাচ্ছে আসছে আমার দুইহাত দূর দিয়ে, তাঁদের করুণ মুখ দেখে কষ্ট লাগছে। বাঙালের বীরপুঙ্গব কিছু সন্তান তাঁদেরকে উচ্চস্বরে গালি দিচ্ছেন, কী বাজে অবস্থা!

    পাঁচ.
    আমি মনে মনে ঠিক করলাম, ভবিষ্যতে আর টিকিট বিক্রী করব না। নিজের জন্য রাখব। ক্রিকেট ম্যাচে সিগারেট খাওয়া যায় না এমন নয়, এরকম ম্যাচ হলে চা খেতে খেতেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাবে, বাইরে এসে সিগারেট ধরানো যাবে আরামসে।

    ছয়.
    ওয়েস্ট ইন্ডিজের আর মাত্র ১০ রান করার বাকি। পাশের দর্শককে উনার স্ত্রী বললেন,"চলো, বাড়ি যাই, পরে বের হতে ভিড় হবে।'

    ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, "যা বুঝো না, তা নিয়ে কথা বলবা না। ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা, এই ১০ রানের মাঝেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাকি সব উইকেট পড়ে যেতে পারে। চুপ করে খেলা দেখো।' আজকের দিনের প্রাপ্তি এই আশাবাদিতা শিক্ষা!

    সাত.
    খেলা শেষে সেই আশাবাদী মানুষটার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বলল, "ব্যাপার না এটা। বিশ্বকাপের সব গেম কি আমরা একলাই জিতব নাকি? সব দলই তো দুই তিনটা ম্যাচ জিতবে, দুই তিনটা হারবে।' ভেবে দেখলাম কথাটি সত্যি। আজ হেরেছি, কাল জিতব। সেই জেতার দিনের খেলা দেখতে আসার আশা নিয়ে আজ তাই গ্যালারি ছাড়লাম।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ০৪ এপ্রিল ২০১১ | ৯২৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন