২০১৩ সালের আইনটির নাম ছিল খটোমটো। জমি অধিগ্রহন, পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠন ক্ষেত্রে ন্যায্য ক্ষতিপুরণ ও স্ব্চ্ছতা আইন (রাইট টু ফেয়ার কমপেনসেশন এন্ড ট্রান্সপারেন্সি ইন ল্যান্ড একুইজিশন, রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড রিসেটলমেন্ট এক্ট 2013 - অত:পর "নতুন জমি আইন" নামে অভিহিত)। কিছুদিন আগে প্রবর্তিত জমি অধিগ্রহণ অরডিন্যান্সটি এল এই আইনটিরই পরিবর্তে, তাকে জায়গায়। শুধু আইনী সংজ্ঞায় নয়, নতুন এই অর্ডিন্যান্সটি প্রকৃত অর্থেই পুরোনো আইনটিকে একেবারে বাতিল করেছে। প্রধান আঘাতটি এসেছে ভূমিপুত্রদের অধিকারের প্রশ্নে। ২০১৩র আইনে ভূমিপুত্রদের ন্যায্য ক্ষতিপুরণ হিসাবে যেটুকু অধিকার দেওয়া হয়েছিল, জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্সে বাতিল করা হয়েছে তার অনেককিছু, কেড়ে নেওয়া হয়েছে অনেক বেশি৷
জমি অধিগ্রহণ আইনের পরিবর্তন অবশ্য নতুন নয়। সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা আইনটি পরিবর্তনের একাধিক চেষ্টা হয়েছে ও বহুবার বিভিন্ন সংযোজন ও সংশোধন করা হয়েছে যার মধ্যে 1962 এবং 1984 সালের সংযোজনদুটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ৷ অবশেষে 2013 সালে নতুন জমি আইনটি প্রবর্তিত হয়৷ ইতিমধ্যে 2005 এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন (স্পেশাল ইকোনমিক জোন এক্ট 2005) পাশের মাধ্যমে "উন্নয়ন" এর নামে একলপ্তে বৃহৎ ভূমিকে অধিগ্রহন করে শিল্পাঞ্চলে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ কিন্তু স্থানীয় রাজনীতি এবং স্থানীয় মানুষের বাধার কারণে একে স্থায়ী সমাধান হিসাবে ব্যবহার করা যায় নি৷কিন্তু নানা পরিবর্তন সত্ত্বেও এর আগের বিভিন্ন সংযোজন বা সংশোধনীগুলির কোনটাই কিন্তু ঔপনিবেশিক আইনটির একটি ধারা, "সামাজিক অভিঘাত পরিমাপ আইন" (সোশাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট বা সিয়া)কে সম্পূর্ণ বিলোপ করার পথে হাঁটেনি৷ বর্তমান অর্ডিন্যান্সে এই সিয়াকে বহু প্রকল্পের ক্ষেত্রে কার্যতঃ সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করা হয়েছে যা অত্যন্ত অদূরদর্শীতার পরিচায়ক৷ যদিও "আর্জেন্সি ক্লজ" বা আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে সিয়াকে এড়িয়ে জমি অধিগ্রহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এই "আপৎকালীন" আইনটি অবশ্য সুকৌশলে প্রায়শঃই ব্যবহৃত হয়েছে বহু ক্ষেত্রেই৷ "জনস্বার্থে"র নামে প্রায় যে কোন অধিগ্রহনকেই "আপৎকালীন" এর তকমা দিয়ে সিয়াকে কার্যতঃ অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে৷ এই মুহুর্তে দেশের বিভিন্ন অংশে বলপূর্বক জমি অধিগ্রহনের বিরুদ্ধে চলতে থাকা একাধিক আন্দোলনের আবেগ এবং দেশে বিদেশে এই ভূমি অধিগ্রহন আইনের তুলনামূলক বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের অসহিষ্ণুতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়৷ অতীতে বহুবার দেখা গেছে এভাবে যথেষ্ট আলোচনা ব্যতিরেকে বলপূর্বক জমি অধিগ্রহনের চেষ্টা সংশ্লিষ্ট শাসক দলের জনসমর্থন ভিত্তি ধসিয়ে দেবার প্রধান কারন রূপে প্রতীত হয়েছে৷
এই প্রেক্ষিতে আগের জমি অধিগ্রহন আইন (ল্যান্ড একুইজিশন এক্ট 1894 - অতঃপর পুরনো জমি আইন হিসাবে অভিহিত) এবং 2014 সালের 31শে ডিসেম্বর প্রবর্তিত জমি অর্ডিন্যান্স (অতঃপর বর্তমান জমি অর্ডিন্যান্স নামে অভিহিত) দুটির তুলনামূলক আলোচনা করে দেখা যেতে পারে৷ অন্ততঃ চারটি প্রধান কারন দেখা যাচ্ছে যা থেকে বলা যেতে পারে যে বর্তমান অর্ডিন্যান্সটি পুরনো জমি আইনের তুলনায় বহুগুন বেশি কঠোর৷ প্রথমতঃ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যতঃ 'সিয়া'র অবলুপ্তিকরণ৷ 'সিয়া'র দীর্ঘসূত্রিতার কারণগুলি বিশ্লেষণ করে তাকে পরিমার্জনের মাধ্যমে সময়োপযোগী করে তোলাই যখন ছিল সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তখন গোটা ব্যবস্থাটাকেই কার্যতঃ অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হল৷ যে কোন অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মূল ভীত্তি হল খরচের তুলনায় অধিক লাভ করা৷ ক্ষতিপুরণের চহিদা পুরণ করা খরচের মধ্যেই ধরা হয়ে থাকে এবং সেই ক্ষতিপুরণের হিসাবে শুধু যারা জমি হারাচ্ছেন তারাই নন, যারা সেই জমির ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের জীবিকার জন্য নির্ভরশীল তাদেরকে সামিল করাটাও জরুরী৷রাষ্ট্র যদি নতুন আইনে প্রস্তাবিত "ন্যায্য ক্ষতিপুরণ" এর দাবীটি সত্যি সত্যিই প্রয়োগ করতে চেয়ে থাকে তবে এই সমগ্রিক ক্ষতির একটা মোটামুটি হিসাব করা জরুরী৷ জমি অধিগ্রহণকে যদি "জাতীয় স্বার্থে"র নামে সঙ্গত এবং অবশ্যম্ভাবী হিসাবে দেখানো হয় তবে এই বিপুল অধিগৃহিত জমির বিনিময়ে কী ধরণের "সম্ভাব্য লাভ" হতে পারে তার বিবরণী জনগণের বিচারের জন্য উপলব্ধ থাকা বাঞ্ছনীয়৷ 'সিয়া'কে কার্যতঃ সম্পূর্ণ অবলুপ্তিকরণ কিন্তু এই সমস্ত অধিগ্রহনের যথাযথতাকে জনগণের সামনে তুএ ধরার প্রাথমিক দায়িত্বটুকু এড়িয়ে যাবারই নামান্তর৷ পুরনো জমি আইনে অন্ততঃ এই ব্যবস্থাটুকু ছিল যার বলে এ ধরণের যে কোন প্রকল্প শুরু করার আগে অন্ততঃপক্ষে সেটি অর্থনৈতিকভাবে আদৌ লাভজনক হবার সম্ভাবনা রাখে কি না তা দেখে নেওয়া যেতে পারত৷ বর্তমান ব্য্বস্থায় প্রায় যে কোন প্রকল্পই শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু "লক্ষ্য" ঘোষণা করেই "জনস্বার্থে"র তকমা লাভে সক্ষম৷ 'সিয়া' অবলুপ্তিকরণের অর্থ অতঃপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহনের বিষয়টি কোন রকম প্রশ্ন বা বিচারের উর্দ্ধে চলে গেল৷
আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে আপৎকালীন ধারায় [পুরানো জমি আইনের ধারা 17(1); নতুন জমি আইনের ধারা 40(1)] 'সিয়া' প্রয়োঅগ না করেও জমি অধিগ্রহন করা যেতে পারে৷ পুরনো আইনে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এই ধারার প্রয়োগ করা যাবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নির্দেশিকা নেই, ফলে এই ধারার যথেচ্ছ অপব্যখ্যা ও অপব্যবহার আমরা পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছি৷ নতুন জমি আইনে এই ধারাটির প্রয়োগ কেবলমাত্র জাতীয় প্রতিরক্ষা অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত আপৎকালীন ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু বর্তমান অর্ডিন্যান্সের বলে শিল্পতালুক বা স্বল্পমূল্যের আবাসন প্রকল্পের মত বহু ক্ষেত্রকেই সিয়ার আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ আপাতদৃষ্টিতে মাত্র পাঁচটি ক্ষেত্রকে সিয়ার বাইরে রাখার উল্লেখ দেখে মনে হতে পারে যে এই অন্যায্য ধারাটি কেবলমাত্র সিমাবদ্ধ ক্ষেত্রের জন্যই প্রযোজ্য - কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে প্রায় প্রতিটি প্রধান বিনিয়োগ ক্ষেত্রকেই সুকৌশলে এই ছাড়ের আওতায় এনে ফেলা হয়েছে৷
এক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তনটি হল সরকারী বিভিন্ন ক্ষেত্রের সম্প্রসারণের নামে ব্যাপক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্তর্ভুক্তি৷ যদিও 'বেসরকারী কোম্পানি' শব্দবন্ধটিকে পুরো অর্ডিন্যান্সে সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে "বেসরকারী উপস্থিতি" বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ অর্ডিন্যান্সটির সেকশন 3 (YY) তে এর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে : "'বেসরকারী উপস্থিতি' (প্রাইভেট এনটিটি) অর্থাৎ যে কোন সংস্থা যা সরকারী অথবা সরকারের দ্বারা অধিগৃহিত নয় এবং যার মধ্যে প্রোপ্রাইটরশিপ, পার্টনারশিপ, কোম্পানি, কর্পোরেশন, অলাভজনক সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থা যা সমকালীন আইনদ্বারা সিদ্ধ তা অন্তর্ভুক্ত৷" সেই সঙ্গে বেসরকারী হাসপাতল, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিও নতুন অর্ডিন্যান্সের বলে "পরিকাঠামোগত প্রকল্প"এর অন্তর্ভুক্ত৷1962 এবং 1984 র সংযোজনগুলি সরকারের পক্ষে জমি অধিগ্রহনের বিষয়টি সহজ হয়েছিল "বিশেষ অঞ্চলে"র তকমাদানের মাধ্যমে - কিন্তু বর্তমান অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এটির পথে যাবতীয় বাঁধা এক ঝটকায় অপসারিত করা হল৷ ভারতের অপরিণত জমি বাজার, যার উন্নতিসাধন আশু প্রয়োজন, তার পক্ষে এটি একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক ব্যবস্থা৷
তৃতীয় বড় পরিবর্তনটি হল সরকারী-বেসরকারী যৌথ উদ্যোগ (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ - পিপিপি মডেল) এর জন্য জমি অধিগ্রহনের আইনসিদ্ধকরণ৷ নতুন জমি আইনে সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহনের ক্ষেত্রে অন্ততঃ 70 শতাংশ ভুক্তভোগী পরিবারের আগাম সম্মতি নেবার কথা বলা হয়েছিল৷ বর্তমান অর্ডিন্যান্সে শুধু যে এই পূর্বানুমতির ধারাটি তুলে দেওয়া হয়েছে তাই নয়, এই বিষয়টিকে 'সিয়া'র আওতা থেকেও মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে৷ এভাবে এক ঝটকায় পিপিপি কে জাতীয় প্রতিরক্ষার মত ক্ষেত্রের সঙ্গে এক সারিতে বসানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া গেল৷
চতুর্থতঃ 'সিয়া'র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা, সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলির সঙ্গে আলোচনার অবকাশটুকুও এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে অবলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে৷ প্রতিকূল সামাজিক অভিঘাতকে অতিক্রম করে কোন প্রকল্পের "লাভজনক" হওয়া সম্ভব কি না তা বিচার করার পাশাপাশি সেই প্রকল্পটি সত্যই "জনস্বার্থে" কি না বা তার উপযোগী কি না তা বিচার করাও 'সিয়া'র অন্যতম লক্ষ্য ছিল৷ কোন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহনকে বাতিল করা বা প্রয়োজনে প্রকল্পটিকেই বাতিল করার যে ক্ষমতা পূর্বে বিশেষজ্ঞদের ছিল তা-ও এর দ্বারা কেড়ে নেওয়া হল৷ কোন জমিকে 'খাসতালুক' ঘোষণা করার পেছনে প্রধান যুক্তি হল বৃহত্তর জনস্বার্থে কোন জমি অধিগ্রহনের ক্ষেত্রে সামান্য কিছু অনিচ্ছুক ব্যক্তির জমি ত্যাগের অনীহা৷ অনেক সময় কৌশলগতভাবেও কোন প্রকল্পকে বিলম্বিত করার জন্য ইচ্ছা করে জমি ধরে রাখা হয়৷ পুরনো জমি আইনটিতে 'সম্মতি' নেবার কোন ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু একমাত্র আপৎকালীন ব্যবস্থা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই পূর্বালোচনা বাধ্যতামূলক ছিল৷ এখন যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে 'সিয়া' প্রযোজ্যই নয় তাই যারা জমি হারালেন তারা জানতেও পারবেন না ঠিক কোন কাজে লাগবে সেই জমি৷ স্থানীয় অধিবাসীদের পরিবেশগত ও অন্যান্য অনেক মূল্যবান তথ্য জ্ঞাতব্য থাকে যা পূর্বালোচনার সময়ে উঠে আসে ও পরিমার্জিত হয়, যার সম্ভাবনা এখন আর রইল না৷ নিঃসন্দেহে এটা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক কারণ প্রকৃত অর্থে "উন্নয়ন" বলতে বোঝায় উন্নততর সুযোগ-সুবিধা, উন্নততর জীবন-যাপন এবং উন্নততর পরিবেশ৷
বারবার এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে নতুন জমি আইনটি প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের জন্য অত্যন্ত অসুবিধাজনক এবং এই যুক্তিতে একাধিকবার এই আইনটিতে সংযোজন এবং সংশোধনের মাধ্যমে এমন সব ধারা ঢোকানো হয়েছে যাতে প্রকৃত প্রস্তাবে আইনটি আগের চেয়েও (পুরানো আইন) বেশি বৈসাম্যমূলক এবং শোষণধর্মী হয়ে উঠেছে৷ সম্মতির প্রয়োজনীয়তা, অধিগ্রহণের পাঁচ বছরের মধ্যে নির্মাণ বা উৎপাদন শুরু না হলে তা ফিরিয়ে দেবার ধারা কিংবা সেচখাল সমৃদ্ধ বহুফসলী জমিকে অধিগ্রহন না করার মত যে ক'টি উৎসাহব্যঞ্জক ধারা নতুন জমি আইনে রাখা হয়েছিল, বর্তমান অর্ডিন্যান্সে তার সবকটিকেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে এর মূল দুর্বলতাগুলিকেও উপেক্ষা করা হয়েছে - যেমন ক্ষতিপুরণের ক্ষেত্রে অধিগৃহিত জমির চলতি বাজারমূল্যকেই সূচক ধরে নেওয়া৷ যে সব ব্যক্তিবর্গ এই নতুন অর্ডিন্যান্সের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন তারাও কিন্তু চলতি বাজারমূল্যকে ক্ষতিপুরণের ভিত্তিমূল্য হিসাবে ধরার বিরোধিতাই করেছেন৷ ভারতীয় জমিবাজারের সঙ্গে ন্যুনতম পরিচয় আছে এরকম ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যে এখানে চলতি বাজারদর প্রকৃত দরের চেয়ে অনেক কম করে দেখানো থাকে৷ শুধু তাই নয় স্ট্যাম্প ডিউটি, কর এবং অন্যান্য কারণে প্রকৃত জমির পরিমাণও কম করে দেখানো থাকে৷ যদি 'সিয়া'র রক্ষাকবচ বা কোনরকম আলোচনা ছাড়াই জমি মালিকদের জমি ছাড়তে বাধ্য করা হয় তবে অন্ততঃ নিজেদের জমির জন্য যে ন্যুনতম মূল্য তারা স্থির করেছেন সেটুকু তো পাওয়াঈ উচিত! বর্তমান অর্ডিন্যান্স কিন্তু জমি মালিককে একপ্রকার বাধ্য করছে বিনা প্রশ্নে রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া দামে নিজের জমি সরকারের হাতে তুলে দিতে - যা ভারতের অদক্ষ জমিবাজারের কারণেই অবশ্যম্ভাবীভাবে অলাভজনক৷ কেউ যদি দীর্ঘদিন আইনী লড়াইতেও প্রবৃত্ত হ'ন এবং জয়লাভও করেন তবে তার প্রাপ্তি বলতে বড়জোর আদালতের মধ্যস্থতায় প্রাপ্তব্য কিছু পুরষ্কার - কারন আমাদের বিচার বিভাগও এখনো চলতি বাজারদরকেই ভীত্তিমূল্য হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন৷
এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে জাতিগতভাবে কি করে আমরা এরকম একটা অবস্থায় এসে পৌঁছলাম যেখানে "উন্নয়ন" মানে "কিছু দাও আরো বেশী নিয়ে যাও (give some and take more back later )" এর হিসাব৷ এর প্রধান কারণ সম্ভবতঃ ন্যায় বিচারের পীঠস্থান হিসাবে এবং একটি নির্বাচিত সরকারের শাসনের অধিকারের সীমারেখা নির্ধারণে আমাদের বিচারবিভাগের ব্যর্থতা৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েকে সামাজিক "ন্যায্যতা"র ধারণার প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করা হয় এবং সেখানে বিচার বিভাগের সক্রিয় অংশগ্রহন থাকে - কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আদালতের রায়গুলি সাধারণের বা বিদ্বজ্জনের পর্যালোচনার উর্ধ্বেই থেকে যায় বা রেখে দেওয়া হয়। বেশ কিছু রায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে আদালত জনস্বার্থের বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট সরকারের ওপরেই নীতি নির্ধারনের ভার অর্পণ করেছে৷ উদাহরণ স্বরূপ আর এল অরোরা বনাম উঃপ্রঃ সরকারের মামলাটিতে (AIR 1962 SC 764) মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট প্রথমে এক বেসরকারী সংস্থার হয়ে জমি অধিগ্রহণের বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন কিন্তু পরে 1962 সালে পুরনো জমি আইনের সংশোধনের পর সেই অধিগ্রহণ আইনী স্বীকৃতি পেয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে ওই রায়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংশোধনীর প্রযোজ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে যে পিটিশন দাখিল করা হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত তা-ও খারিজ করে দেন৷ সোমাবন্তি ও অন্যান্য বনাম পঞ্জাব সরকার মামলায় (AIR 1963 SC 151) বলা হয়েছিল যে যদি কোন বেসরকারী প্রকল্পে সরকার এমন কি একশো টাকাও বিনিয়োগ করে থাকেন তবে সেটি খাসতালুক আখ্যা পাবার জন্য বৈধ বিবেচিত হবে৷ এই সওয়ালটি পরবর্তীকালে "জনস্বার্থে" জমি অধিগ্রহণের বহু মামলায় উদাহরণ হিসাবে নেওয়া হয়েছে৷ এমন কি এর প্রায় চার দশক বাদেও 2003 সালে প্রতিভা নিমা ও অন্যান্য বনাম মধ্যপ্রদেশ সরকারের মামলাতেও (2003 10 SSC 626) এই উদাহরণের ভীত্তিতে রায় দেওয়া হয়েছে৷ সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে মানুষ এসব ক্ষেত্রে রাস্তায় নেমেছেন এবং আইনী সমাধানের পরিবর্তে আন্দোলন সংগ্রামের ওপরেই বেশি নির্ভর করেছেন৷বস্তুতঃ যখন বর্তমান অর্ডিন্যান্সটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তাতে নতুন জমি আইনের বেশ কিছু দৃষ্টিভঙ্গীগত পরিবর্তনের কথাও ভাবা হয়েছিল৷ বর্তমান অর্ডিন্যান্সটি কার্যকর হয়ে যাবার পর কার্যতঃ মূল আইনে (নতুন জমি আইন) উল্লেখিত "ন্যায্যতা" বা "স্বচ্ছতা"র ভানটুকুও আর রাখা হয়নি এবং কৃষকের "অধিকার" এর কোন অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় নি৷ প্রকৃতপক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে আদালত চাইলেও আর সাধারণ মানুষের ন্যায্য অভিভাবক হিসাবে কোন পদক্ষেপ নেবার ক্ষমতা তার নেই৷
এক কথায় তাহলে এই দাঁড়ালো যে অর্ডিন্যন্সটি জারি হবার পরে এখন সিয়া, বিচার বিভাগীয় বিবেচনা, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সম্মতি গ্রহণ, তুলনামূলক বিচার ইত্যাদির সম্পূর্ণ বিলোপসাধন৷ যে দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামবাসী দরিদ্র ভারতবাসী বিপুল ঋণের ভারে জর্জরিত, প্রায় সব ক্ষমতাসীন সরকারের আমলেই তাদের মধ্যে একই রকম উচ্চ হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে৷ এরকম একটা অবস্থা কি কোন গণতন্ত্রে বাঞ্ছনীয়? এমন কি একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিভঙ্গীতেও কি এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অনুৎসাহব্যঞ্জক একটা পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? অধিগ্রহণের পথের বাঁধা দূরীকরণ তো শিল্পের শুধুমাত্র প্রাথমিক ধাপ৷ এরপরে যখন নির্মাণ বা উৎপাদন শুরু হবে তখন সেখানে বিপুল সংখ্যায় স্থানীয় মানুষের যোগদান প্রয়োজন৷ সিঙ্গুরে টাটাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে গণ অসন্তোষের কারণে উৎপাদনের যে কোন পর্যায়েই বাঁধা আসতে পারে৷ কিছু মানুষের তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য অবশিষ্টদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে এই ধরণের আইনী রক্ষাকবচ কি ভবিষ্যতে আরো গভীর সামাজিক অসন্তোষ এবং তদ্জনিত অস্থিরতারই জন্ম দেবে না যা ভবিষ্যত বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রতিকূল রূপে প্রতিপন্ন হবে? 1962 সালে নেহরুর তথাকথিত "আধুনিক ভারতের মন্দির" গুলি বানানোর জন্য পুরনো জমি আইনে যে সংযোজনা আনা হয়েছিল, তার পিছনে কিন্তু প্রায় দশ কোটি দেশবাসীর পুনর্বাসনের প্রশ্নটি ঝুলে ছিল না যা আজ ভীষণভাবেই আছে৷ আজকের ভারত এমন কোন পদক্ষেপ নেবার জায়গায় আছে কি যাতে আগামী অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এই সংখ্যাটা বহুগুন বেড়ে যেতে পারে?