এই বিষয়ে একাধিক লেখা গুরুচন্ডালিতে প্রকাশিত হবার পর, প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাওয়া এই লেখাটি প্রকাশ করা হল। জমে উঠুক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক।
দিবাকর ব্যানার্জির ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি!’ অনেকের ভালো লাগেনি, কিন্তু লাগেনি বলে বিরক্ত’ও হচ্ছেন অনেকে, যাদের ভালো লেগেছে। আমার ভালো লাগেনি, আমি এটা ব্যোমকেশ-অবগত বাঙালি বিশুদ্ধবাদী হিসেবে বলছি না। বলছি সিনেমার ও গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত হিসেবে। কিন্তু তার আগে অনেকের আপত্তির থেকে নিজেকে একটু তফাতে অবস্থিত করা যাক। ব্যোমকেশের গল্পের একজন একনিষ্ঠ ভক্তের আপন মনের মাধুরি মেশানো ফ্যানফিক্শনে আমার আপত্তি নেই – বরং এই ছবিটি দেখতে যাওয়ার সময়ে সেটাই আমি আশা করেছিলাম। আমার চল্লিশের গল্পে ডেথমেটাল ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই (আমি কোয়েন্তিন তারান্তিনোর ছবির ভক্ত)। ভারতীয় পিরিয়ড ফিল্মের সাথে জাপানি ইয়াকুজা ছবির জঁর-মিশ্রনে আপত্তি নেই, এই ধরণের পরীক্ষা আমাকে আমোদ দেয়। ইতিহাসের কল্পিত সংস্করণে আমার আপত্তি নেই – তারান্তিনোর ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড্স’-এর শেষে হিটলার সমেত তাবৎ নাৎসীবাহিনী একটি সিনেমা হলে ইহুদীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়, এটি আমার অন্যতম প্রিয় ছবি।
কিন্তু ইতিহাস (এবং সিনেমার ইতিহাস) সম্পর্কে অনবগত বা উদাসীন হলেই দিবাকরের এই ছবিটির মত দায়সারা ব্যাপার হয় – তাই ১৯৪৩-র প্রেক্ষাপটে এই ছবিটিতে বিশ্বযুদ্ধ আছে কিন্তু ধর্মতলায় আমেরিকান জি আই নেই, ‘জয় বাংলা’ নামে একটি রাজনৈতিক দল আছে কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কোনো অভিঘাত নেই, গান্ধিজি আছেন নেতাজী নেই, বোসপুকুরে খুন হয় কিন্তু অভুক্ত লাশেদের মন্বন্তর নেই, গ্রামপতনের শব্দ নেই, গাঙে মরা নেই তাই গঙ্গায় নায়িকা সাতার কাটতে ঝাঁপ দেন অনায়াসে। ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতার প্রশ্ন বাদ দিলেও ব্যোমকেশ-অজিত-সত্যবতীর মধ্যে কোনো রসায়ন নেই; রহস্য সন্ধানে মেথড নেই তার বদলে সাংবাদিকতার ন্যায় তথ্য উন্মোচন আছে; সন্দেহভাজনের তালিকা একটি গোয়েন্দা গল্পে ভীষণ ছোটো কারণ মূল চরিত্রের বাইরে অন্য চরিত্রদের সময়ই দেওয়া হয়নি যে তারা ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠবে; একটি রহস্য কাহিনীতে প্লটের গভীরতাহীনতা আছে যা অন্তত গোয়েন্দা গল্পের শতাধিক বছরের ইতিহাসের পর মেনে নেওয়া যায়না। প্লট জটিল নয় অথচ আখ্যান জটিল; সম্পাদনার সময়ে এমন অনেক শট আসে যা আসার কথা নয় (বিরতির আগে দ্রুত মন্তাজে ব্যোমকেশের আলোকপাতের মুহূর্তে কয়েকটি শট আসলে ক্লাইম্যাক্সের); শহর দেখানোর সময়ে অযথা ফোকাসের অগভীরতা যার ফলে মনে হয় হয়তো অদূরেই ২০১৪-র কলকাতা তাই এই ধোঁয়াসা – অভিজ্ঞতাটি উপভোগ্য হয়নি। কিন্তু এইসব নিয়ে কথা বলার জন্য এই লেখার অবতারণা নয়। আমি শুধু একটি বিশেষ সূত্র নিয়ে কথা বলবো।
ব্যোমকেশ প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে ফিল্ম নোয়া্র (film noir) প্রসঙ্গটা বারবার আসছে। দিবাকরই এনেছেন, বলেছেন তিনি একটি ‘বেঙ্গলি নোয়া’-র রচনা করতে চান ব্যোমকেশ ও সমসাময়িক পাল্প ফিকশন অবলম্বনে। আমার এই প্রসঙ্গেই কেন বিশেষ অসুবিধে আছে, সেটা গুছিয়ে বলা যাক। তার জন্য একটু ইতিহাস বলতে হবে, অপ্রাসঙ্গিক হবে না আশা করি।
ফিল্ম নোয়া জিনিসটা একধরণের জঁর বা গোত্র নাকি একধরণের স্টাইল বা শৈলী সেটি নিয়ে ধন্দ আছে, দুইয়ের দিকেই যুক্তির পাল্লা ভারি। জঁর হলে তার একটি বিশেষ জগত তৈরি হয় – চরিত্র, প্রেক্ষাপট, আখ্যানভঙ্গী, গল্পের উপাদান নিয়ে; আর শৈলী হলে সেটা যে কোনো ধরণের গল্পেই ব্যবহার করা যায়। বস্তুত, ফিল্ম নোয়ার যাত্রাটি ভীষণ বিচিত্র, সেটি নিয়ে সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।
১৯৪০ ও ’৫০-এর দশকের হলিউডে যে বিশেষ এক গোত্রের ছবি তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে সেইসব ছবির নির্মাতারাও ততটা সচেতন ছিলেন না। ফরাসি চলচ্চিত্রামোদী লেখকেরা এই গোত্রটিকে রীতিমত আবিষ্কার করেন পঞ্চাশের দশকে (যে জন্যে একটি আমেরিকান জঁরের নাম ফরাসি), সেটাও হয়েছিল একটি বিচিত্র পরিস্থিতির ফলে – বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে জার্মান অধিকৃত প্যারিসে আমেরিকান ছবির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল যা যুদ্ধের পরে উঠে যাওয়ায় এতদিনের না-দেখানো আমেরিকান ছবি প্রায় প্লাবনের মত প্যারিসের হলগুলি ভরিয়ে দেয় যুদ্ধের পর। এতে এক বিচিত্র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল – পার্শ্ববর্তী দুটি হলে যে দুটি আমেরিকান ছবি চলছে তাদের মধ্যে ফারাক হয়তো দশ বছরের। এছাড়া সিনেমাথেক ফ্রঁসে ও তার কর্ণধার অঁরি লাংলোয়া তো আছেনই, যিনি শুধু অর্ধশতকের ছবির যত্নশীল সংগ্রাহক ও টীকাকারই ছিলেন তাই’ই নয়, তিনি সাধারণ দর্শকদের নামমাত্র মূল্যে ছবিগুলি দেখতেও দিতেন। ফলে এই সময়েই ফরাসি সিনেফিলদের সুযোগ হল প্রায় দেড় দশকের আমেরিকান ছবি পাশাপাশি দেখে ফেলার এবং সেখান থেকে কিছু প্যাটার্ণ লক্ষ্য করার। মূলত অস্তিত্ববাদী ও সুররিয়ালিস্টরা একধরণের আমেরিকান ছবি লক্ষ্য করলেন যেগুলি আঁধারাকীর্ণ, ধোঁয়াটে নাগরিক অস্তিত্ব এবং অবদমিত হিংসা ও যৌনতার একটি প্রকাশ। কালো/অন্ধকার ছবি – ফিল্ম নোয়া – তারা নাম দিলেন। এই নামকরণের সাথে একটি উপন্যাসকেন্দ্রিক স্ক্যান্ডালের যোগ আছে – সেটি উহ্য রেখে বলা যায় যে এই ফিল্ম নোয়ার পূর্বসূরী হল ‘রোমান নোয়া’ বা অন্ধকারাচ্ছন্ন উপন্যাস।
যাই হোক, এই বিশেষ ছবিগুলির নির্মাতারা – পরিচালক ও আলোকচিত্রী মূলত – দেখা গেল বেশিরভাগই ইউরোপীয়, যারা যুদ্ধের সময়ে হলিউডে প্রায় শরনার্থী হয়েছিলেন, এবং তাদের অনেকেই হয় ইহুদি, নয় বামপন্থী। তাদের তিক্ত, নিরাশাবাদী, ইউরোপীয় চোখ দিয়েই তারা আমেরিকাকে দেখতে থাকলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, অনেকক্ষেত্রে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের অ-বাস্তবোচিত শৈলী হলিউডের বাস্তববাদী ছবির সাথে যুক্ত হল। এছাড়া ফরাসি কাব্যিক বাস্তববাদের একধরণের প্রভাব পড়লো এইসব ছবিতে। জন্ম হল ফিল্ম নোয়ার – যে জন্মের কথা তার জনকেরাও সচেতনভাবে জানতেন না।
কিন্তু কোন ধরণের গল্প কেন্দ্র করে এই ছবিগুলি বানানো হল? এখানেই ব্যোমকেশের প্রসঙ্গ খাটে বেশি, দেখা গেল যে একটি বিশেষ ধরণের গোয়েন্দা গল্প কেন্দ্র করে ছবিগুলি বানানো হচ্ছে। এই গোয়েন্দা গল্পগুলি আদ্যন্ত আমেরিকান – এবং কোনান ডয়েল বা আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাসের সাথে তার মিল যতটা অমিল ঢের বেশি। এই ব্যাপারটা বুঝলেই বোঝা যায় কেন ব্যোমকেশের সাথে নোয়ার প্রসঙ্গ আসে বা আসেনা।
ব্রিটিশ মডেলের গোয়েন্দা গল্পের কেন্দ্রে যে ধরণের চরিত্র থাকেন – শ্রেষ্ঠ উদাহরণ অবশ্যই শার্লক হোম্স বা আমাদের ফেলুদা – তিনি পাশ্চাত্ত্যের ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদের পরাকাষ্ঠা ধরে নেওয়া যায় – তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন, আবেগহীন, যুক্তিবাদী একজন মানুষ, মগজাস্ত্রই যার প্রধান আয়ুধ। তিনি আসেন – এইটে জরুরি, তিনি এমন একটি স্থানে, অঞ্চলে, পরিবারে আসেন যেখানে তিনি আগন্তুক – দ্যাখেন, জয় করেন। ইতিমধ্যে একটি অপরাধ ঘটেছে বা রহস্যের উদ্গম হয়েছে, যার সাথে সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলিকে হাফ-ব্লাইন্ড বলা যায়, গোয়েন্দা সেখানে শুধুই প্রখর দৃষ্টিশক্তিতে বলীয়ান নন, তিনি যৌক্তিকভাবে, নিরাসক্তভাবে দেখতে জানেন – তাই সত্য তার কাছে ধরা দেয়।
এ আমাদের চেনা মডেল – ফেলুদা বা ব্যোমকেশ এই মডেলেই পড়েন। কিন্তু আমেরিকান ধারায় একটি নতুন নায়ক দেখা গেল। এই নায়ক হয় প্রাক্তন পুলিশ নয় যুদ্ধফেরত প্রাক্তন সৈনিক। হোম্সের মত অ্যাডভেঞ্চার ও বুদ্ধির অভিযানের উত্তেজনা তার নেই ততটা। তার পেশা গোয়েন্দাগিরি – শখের গোয়েন্দা তিনি নন, নিজের পেশার প্রেমে সে পড়ে নেই। তাকে ভাড়া করা যায় বিভিন্ন কাজে, অনেক ক্ষেত্রেই কেসের ব্যাপারে তার চয়েস থাকেনা জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। পুলিসের সাথে তার সম্পর্ক গোলমেলে, যদি পুলিশের চক্ষুশূল বেশি হয়ে ওঠা হয় লাইসেন্স হারানোর ভয় থাকে। ড্যাশিয়েল হ্যামেটের স্যাম স্পেড বা রেমন্ড শ্যান্ডলারের ফিলিপ মার্লো এই ধরণের চরিত্র। এই গোয়েন্দা একাকী, তিক্ত, বিষন্ন একটি চরিত্র – একটি পতিত সমাজে টিকে থাকা নাইটের মত এই নায়ক অন্ধকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় – মার সে যতটা দিতে জানে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই হয়তো তাকে মার খেয়ে টিকে থাকতে শিখিয়েছে বেশি।
এই নায়কের চারণক্ষেত্র – এখানেই ব্রিটিশ মডেলের থেকে প্রধান তারতম্য – প্রধানত মেট্রোপলিটান শহর। এমন একটি শহর যার অলিগলি হাতের তালুর রেখার মত চেনা এই নায়কের, অথচ যা বৃহত্তর ইতিহাসের টানে পালটে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। খানিকটা মিল পাওয়া যেতে পারে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্ধী’-র সিদ্ধার্থের সাথে। এই ধরণের গোয়েন্দা গল্পে বেশিরভাগ সময়েই এই চেনা শহরের দুঃস্বপ্নের নগরী হয়ে ওঠার সাথে যুঝতে থাকে, সেই শহর থেকে নায়কের বিযুক্তির আখ্যান পাই আমরা। অনেক ক্ষেত্রেই নায়ক দ্যাখেন যে হয়তো সামান্য একটি ব্ল্যাকমেলের কেস থেকে বা পরকীয়ার গল্প থেকে এক শহর জোড়া দুর্নীতি, অপরাধচক্র, অভিসন্ধির জালে সে জড়িয়ে পড়ছে; পরতের পর পরত রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে যেখানে – আবার একটি পার্থক্য – সব চরিত্রই তার থেকে হয়তো বেশি জানে, তার না জানাটাই হয়ে ওঠে প্রধান রহস্য। এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই নাগরিক ভুলভুলাইয়ার যক্ষের মত আসে এক নারী – ফরাসিরা নাম দিলেন ফাম ফাতাল (femme fatale) – এমন এক কুহকিনী যে যেন এই কপট শহরেরই প্রতিমূর্তি। এইবার যে ঘটনাটি অনেক ক্ষেত্রে ঘটে তা ব্রিটিশ মডেলের গোয়েন্দার ক্ষেত্রে ঘটবে না কখনো – নায়ক প্রেমে বা যৌনসম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এই নারীর সাথে। শেষে শহরের কুহকের সমাধান না ঘটুক, এই নারীর রহস্যের উন্মোচন তাকে করতেই হয়, এই নারী ও রহস্যের পাকচক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
বিপন্ন পৌরুষ, কুহকিনী নারীর স্বকীয়তা এবং পরিবর্তমান অধঃপতিত নগর – এই তিনটি এই ধরণের গল্পের প্রধান উপাদান, সেখানে গোয়েন্দার বিজয়াখ্যানের চাইতে তার সারভাইভালের গল্প, ক্ষতবিক্ষত হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফেরার গল্পই প্রধান হয়ে ওঠে। নায়কের এই অস্তিত্ত্ববাদী অভিজ্ঞতায় ইন্ট্রোস্পেকশন জরুরি বলেই আরেকটি প্রধান পার্থক্য রচিত হয় ব্রিটিশ মডেল থেকে – যা আগের মডেলে অসম্ভব – আমেরিকান গল্পগুলি অনেকসময়েই এই সহকারীহীন একাকী নায়কের প্রথমপুরুষে রচিত, যেহেতু আত্মকথন সেখানে জরুরি। এটা ফেলুদা, হোম্স বা ব্যোমকেশে টেকনিকালি অসম্ভব প্রায়, কারণ তাহলে গোয়েন্দার বিশ্লেষণের হদিশ আমরা শেষ দৃশ্যের অনেক আগে থেকেই পেতে আরম্ভ করবো। আমেরিকান গল্পগুলিতে ক্রমবর্ধনাম ধোঁয়াসা, নায়কের নিষ্পৃহতার অসম্ভাব্যতা, তার আবেগের বল্গাহীন প্রকোপ যেহেতু বেশি জরুরি ফার্স্ট পার্সন ন্যারেশন তাতে যায় ভালো। ফিল্ম নোয়া এই প্রতিটি উপাদানের পুংখানুপুঙ্খ সিনেমাটিক রূপ দেবে – ক্লান্ত পুরুষকন্ঠের ভয়েস ওভার (যা অনেকক্ষেত্রে গল্পের নিষ্পত্তি হওয়ার পর ফিরে দেখা), আলো-আঁধারির নাগরিকতা (যা বিপন্নতা ও নৈতিক ধূসরতার রঙ), ফ্ল্যাশ-ব্যাক (কারণ তা ব্যক্তিচরিত্রের মনস্তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত দেয়), একরৈখিক আখ্যানের পরিহার, লাইটিং-য়ের মাধ্যমে চরিত্রকে প্রেক্ষাপটের চাইতে কম বা সমান গুরুত্ব দেওয়া (কারণ চরিত্রের নিস্তার নেই, সে তাই’ই শহর যেভাবে তাকে রচিত করবে), এমন যৌনসম্পর্কের গল্প বলা যা বিবাহে প্রতিষ্ঠিত হবেই না, ভায়োলেন্স যা অবদমিত কিন্তু মাথাচাড়া দিলে ভয়ংকর, তা পরাজয়ের সম্মুখে জিত যতটা, ততটা দুষ্টের দমনের শীর্ষক নয়।
ষাটের দশকে অদ্ভূতভাবে নোয়া চলে যায় পিছনের দিকে। ১৯৫৮-র ‘টাচ্অব ইভিল’-কে নোয়ার প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ধরে নেওয়া যায় – যেখানে ভিলেন আর কেই বা হতে পারে, দোর্দন্ডপ্রতাপ গোয়েন্দা ছাড়া? নোয়ার নায়কের অন্ধকারে পতনের যে সম্ভাবনা ছিলই – দুদশক ধরে নায়কের দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার পর – তার গল্প বলেন অরসন ওয়েল্স। বোঝা যায় যে নোয়ার অবতলে আসলে – ম্যাককার্থিবাদের প্রেক্ষিতে – ক্যাপিটালিজমের একটি সুপ্ত সমালোচনা চলছিল – লোভ, স্বার্থ, নাগরিক দূর্নীতি, রাজনৈতিক ও নৈতিক স্খলনের এই গল্পগুলিতে একটি কেস্সল্ভ করে গোয়েন্দা status quo আনতে পারেন না, বরং এই অপরাজিত অন্ধকারই তার অভিজ্ঞতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
যুদ্ধপরবর্তী বিষন্নতা, পারিবারীক কাঠামোয় ঘূণ ধরে যাওয়া এই আমেরিকার অবতলের গল্প শীতল যুদ্ধের শুরুতে যেমন পরিপক্ক হয়েছিল, সেভাবেই ষাটের যুববিদ্রোহ, কাউন্টার-কালচারের অবসান হওয়ার সময়ে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের প্রতি সন্দেহে, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় দূর্নীতির উন্মোচনে এবং সার্বিক শীতযুদ্ধকালীন প্যারানোইয়ার উত্থানে নোয়া আবার ফিরে এলো ষাটের শেষে ও সত্তরে।
কিন্তু এবার একটা বড় পার্থক্য দেখা গেল। পরিচালকরা এখন তরুণ – অনেকক্ষেত্রেই তারা স্টুডিওর শিক্ষানবিশি থেকে শুরু না করে ফিল্ম স্কুলের ছাত্র। পঞ্চাশের ফরাসি তাত্ত্বিকদের লেখা তারা পড়ে ফেলেছেন, দেখে ফেলেছেন সেই সিনেফিলিয়ার ফলশ্রুত ফরাসি নবতরঙ্গের ছবিকে – যেখানে নোয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এই পরিচালকেরা ফিল্ম নোয়ার ধরণধারণ নিয়ে হয়ে উঠলেন অতিসচেতন, যা প্রথম অধ্যায়ের পরিচালকরা – অর্থাৎ নোয়ার পিতারা – ছিলেন না। অর্থাৎ এবার নোয়া সচেতনভাবে একটি জঁর হয়ে উঠলো। আরেকটি বড় পার্থক্য – সাদা-কালোর যুগ চলে গেছে। সেই অবিস্মরণীয় নোয়া সিনেমাটোগ্রাফি এবার করতে হবে রঙে। দ্বিতীয় পার্থক্য – ভায়োলেন্স ও যৌনতা নিয়ে আগের কড়া সেন্সরশীপ’ও আলগা হয়ে গেছে। মেথড অ্যাক্টিংয়ের ফলে পালটে গেছে নায়কের বিগত পার্সোনা। নৈতিক স্খলন, নারীর যৌন আগ্রাসন ও পৌরুষের বিপন্নতা এখন নতুন অভিনয়ের রীতিতে নিউরোসিসের রঙে রাঙিয়ে নেওয়া সম্ভব। এবার তৈরি হবে ‘নিও-নোয়া’ – যার অন্যতম চূড়ান্ত ক্রিস্টোফার নোলানের ‘মেমেন্টো’-য় – যেখানে গোয়েন্দা নিজের অপরাধেরই তদন্ত করে এবং অদৃশ্য করে সমস্ত সূত্র, নিজেকে নির্মাণ ও বিনির্মাণের গল্পের লুপে ঘূর্ণায়মান একটি নিষ্পত্তিহীন গল্পে।
১৯৮০-র দশকের পর থেকে দেখা যায় – বিশ্বায়নের পর সারা বিশ্বে মেট্রোপলিটান জীবন প্রায় এক ধাঁচের হয়ে যাওয়ার পর – নোয়া সারা পৃথিবীর ছবিতেই প্রায় একধরণের গ্লোবাল শৈলী বা গোত্র হয়ে উঠেছে। এই বিচিত্র ইতিহাস সম্পর্কে অবগত থাকলে আরেকটি জিনিসও এড়িয়ে যাওয়া যায় – সেটা হল ফিল্ম নোয়া এবং গ্যাংস্টার জঁরের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা, যা অনেকেই অহরহ করেন। দিবাকর ব্যানার্জির ছবিটিতে যে জঁরটি আসে তা হল গ্যাংস্টার – নোয়া নয়।
ব্যোমকেশ থেকে বাঙালির নোয়া হয়? হতে পারে, কারণ প্রেক্ষাপট প্রায় এক। শরদিন্দুতে অনুগত হলে হয়? না, কারণ ব্যোমকেশ আমেরিকান মডেলটির গোয়েন্দা নন, আদ্যন্ত ব্রিটিশ মডেলটির ধাঁচে সে তৈরি – এক কথায় শার্লক হোম্সের বা লর্ড পিটার উইমসির মডেলে। তার সাথে শহরের সম্পর্ক মার্কিন গোয়েন্দার মত নয়, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার দুঃসহ ভার, তিক্ততা, বিষণ্ণতার ভার তার নেই, সে নিরাসক্তই থাকে। নারীদের সাথে বা বাস্তবের জটিলতার সাথে সে জড়িয়ে পড়েনা, নির্মোহ থাকতে পারে। নায়ক চরিত্রে দিবাকর যে পার্থক্যটা করে একটি অবশ্যম্ভাবী বাঙালি নোয়ার যে জন্ম দিতে পারতেন, তা পারেননি। লাভের মধ্যে ফিল্ম নোয়া বা নিও-নোয়া একটি আলগা কসমেটিক্স হয়ে রয়েছে মাত্র – সেই শৈলীর বিশ্ববীক্ষাটি গেছে হারিয়ে। এই বিশ্ববীক্ষাটিই নোয়ার আসল সম্পদ, আলগা শৈলী নয়। লাভের মধ্যে একধরণের চলচ্চিত্রীয় অজ্ঞতার শিকার হচ্ছি আমরা।
দিবাকরের ব্যোমকেশ নোয়ার নায়ক নয়। স্বস্তিকার চরিত্রটি ফাম ফাতালের অসমাপ্ত ও অপটু স্কেচ মাত্র। শরদিন্দুর খলচরিত্রচিত্রায়নে যে ধূসর জটিলতা থাকতো – যার সাথে নোয়ারিশ কল্পনার সাযুজ্য আছে – এই ছবির অবাস্তব অপ্রাপ্তমনস্ক ভিলেনিতে তা ক্যারিকেচারে পর্যবসিত হয়েছ। নোয়া কখনোই উচ্চমনস্ক শিল্প নয়, শরদিন্দুও নন। কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও নোয়া ও শরদিন্দুর ব্যোমকেশে প্রাপ্তমনস্কতা আছে, নেহাতই স্বপনকুমারের মত কিশোরবেলার ফ্যান্টাসি নয় তা। চৈনিক ড্রাগ মাফিয়ার মধ্যে যে পাল্প ছেলেমানুষি আছে, তার সাথে ব্যোমকেশকে না জড়ালেই ভালো হত। বস্তুত এই ছবির ভিলেনের সাথে মোগাম্বোর মিল বেশি, ব্যোমকেশের সাথে মিস্টার ইন্ডিয়ার।
এই প্রসঙ্গে বলি – জনৈক ব্লগার বলেছেন যে এখনকার গোয়েন্দার মুশকিল হল গ্রহণযোগ্য হতে গেলে একটি পরিবারের বা পাড়ার রহস্য সমাধান করলে হয়না, দেশের, জাতির বা বিশ্বের উদ্ধার করতে হয়। কপিরাইটমুক্ত শার্লক হোম্স নিয়ে কিছু অধুনান্তিক কল্পনার ফল এটা। দিবাকরকেও তাই করতে হয় – পূর্ব এশিয় গব্বর সিং রচনা করতে হয় তাকে ব্যোমকেশের প্রতিপক্ষে। একটু যদি পিছন ফিরে তাকাই, তাহলে ১৯৪০-য়ের দশক হল এমন একটা সময় যখন বাঙালি যে শুধুমাত্র একটি ভিন্ন মডেলের আধুনিকতার সাথে ধাক্কা খাচ্ছে এই সময়ে তাই’ই নয়, বৃহত্তর রাজনীতিতেই তার ভূমিকা সংকুচিত হতে হতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নেতাজীর অন্তর্ধান এবং অন্তরাল থেকে বিপজ্জনক রণকৌশল, বামপন্থীদের স্বাধীনতা ও সংগ্রাম নিয়ে মৌলিকভাবে ভিন্ন অবস্থান, যুদ্ধ, মন্বন্তর, আশু দাঙ্গা ও দেশভাগ – এই সময়টা বাঙালির রাজনৈতিক অসহায়তা ও বিমূঢ়তার সাক্ষ্য বহন করে। আজকের ফ্যান্টাসিতে ব্যোমকেশ তখন দেশোদ্ধার করলেন! অজিত তাকে বললো – “তুমি তো কলকাতাকে বাঁচালে!” যখন কার্যত কলকাতা ভঙ্গুর হয়ে উঠছে – মানিক, কল্লোল গোষ্ঠী ও জীবনানন্দের লেখা যেই ভাঙনের সাক্ষ্য বহন করবে। এই ফ্যান্টাসি খানিকটা ইতিহাসের ক্ষতে ব্যান্ডেজের মত – ক্ষত ঢেকে দিলেও সেখানেই যে ক্ষত আছে তার দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। প্রশ্ন হল এই ফ্যান্টাসি এখন রচনা করতে হচ্ছে কেন, সেটাই বা কিসের সিম্পটম।