"তোমাদের ছোটবেলার পুজো কেমন ছিল একটু বল না !"
আমাদের ছোটবেলার পুজো? শিশুবেলায় পুজো কি তাই তো জানতাম না। অনেক ছোটবেলায় গ্রামের কারোর পারিবারিক দূর্গাপুজো ছিল না। বারোয়ারি পুজোও ছিল না। বারোয়ারি পুজো একটাই ছিল - বছরের শেষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কালী এমনকি ওলাইচন্ডী, শীতলা পর্যন্ত অনেক দেবদেবীর পুজো হতো। গ্রামে কোনো দুর্গাপূজা ছিল না। ওই শৈশবে নতুন জামাকাপড় হতো কিনা তাও মনে নেই।
আমি ময়মনসিংহ জেলার একটি ছোট গ্রামের গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের কথা বলছি।
তারপর বয়স যখন বাড়লো, মনে পড়ে, নতুন জামা প্যাণ্ট পাওয়ার কথা। প্যাণ্ট মানে আন্ডারওয়ারের মতো ফিতে দেওয়া সুতির রঙিন কাপড়ের প্যান্ট। অনেকটা কাপড়ের থান কিনে বানিয়ে দেওয়া হতো বলে বাড়ির সব ছেলেদের একই কাপড়ের প্যান্ট। সস্তা পড়তো। নতুন কাপড়চোপড় হতো - আমরা তাতেই খুশিতে আটখানা। পুজো হতো আড়াই-তিন মাইল দূরে দূরে যে জমিদার বাড়িগুলি ছিল, সেখানে । কামলার কাঁধে চেপে একদিন যেকোন একটা পুজো দেখে আসা - কিশোরবয়সে পুজো দেখার এর কোনো রকমফের ছিল না।
বয়স বাড়লে একটা পরিবর্তন হলো ।সমবয়সীরা দল বেঁধে একদিনে দু-তিনটে পাশের গাঁয়ের জমিদারবাড়ির পুজো দেখে আসতাম। দুপুরের খাওয়ার পর বেরিয়ে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরে আসা। ওই সময় দুর্গাপুজো নিয়ে আমাদের কোনো উন্মাদনা ছিল না, যা পরবর্তীকালে তৈরী হয়। আমোদের উপকরণ হিসেবে দুর্গাপূজাকে দেখা হতো না, ধর্মীয় বাতাবরণে এবং যথাসম্ভব শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন মেনে পালন করা হতো।
আমি যখন অষ্টম বা নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন আমাদের গ্রামে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়। আমাদের কাজ মূলত: ছিল কর্মকর্তাদের ফরমাশ খাটা - বাজারের জিনিসপত্র বয়ে আন রে, মণ্ডপঘর পরিষ্কার কর রে, আঙিনা ঝাঁট দে রে ইত্যাদি । এতে ঠিক পুজোর আমেজ ছিল না । মনে এই ভাব জাগতো, "পুজো তো বড়দের ব্যাপার। আমাদের কি?" তবে ওই দূর্গাপুজোর দুটো ব্যাপার মনে আছে এখনো । এক, পদ্মফুল আনার গল্প । দুই কাকুর সাথে আমরা কমবয়েসী দুজন গিয়েছিলাম ধোয়া চাদর নিয়ে পদ্ম তুলতে । চাদরে পোটলা বেঁধে ফুল ভর্তি করে নিয়ে এসেছিলাম। আর মনে আছে আমার এক পিসতুতো বোন, নাম ছিল ডলি, প্যান্ডেলের সামনে আরতি নেচে আরতি করেছিল। দুটো পদ্ম ফুলের মধ্যেকার পদ্মচাকি ফেলে দিলে একটা ঝুমকোর মতো দেখায়। ওর সাজগোজ হয়ে যাবার পর দুটো পদ্মের ঝুমকো ও কনুই-এর ওপরে পদ্ম দিয়ে একটা গয়নার মতো বেঁধে দিয়েছিলাম। সবাই সেই ফুলের সাজের খুব প্রশংসা করেছিল।
দেশভাগের পরেকার কথা। শিলিগুড়ির কাছে থানজোড়া চাবাগানে ছিলাম। ওখানে একবারের পুজোর কথা মনে পড়ে। পুজো দেখতে বাগানকতৃপক্ষ ট্রাকের ব্যবস্থা করেছিলেন। দল বেঁধে সবাই শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম পুজো দেখতে। পুজোয় তখন কোনো বিশেষ ধুমধাম ছিল না। পুজো নিয়ে তেমন টানও তৈরী হয় নি আমার।
এরপর দুবছর ঝাড়গ্রামে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। পুজোর ছুটি উড়িষ্যায় এক গন্ডগ্রামে বাবার কাছে গিয়ে থেকেছি । বাবা ওখানে একটি ডিস্পেন্সারিতে ডাক্তার ছিলেন। ওখানে যদিও কোনো পুজো হতো না কিন্তু বাবা বিজয়ার দিনে গাঁয়ের অনেক লোককে নেমন্তন্ন করে বিজয়াদশমী পালন করতেন।
আইএসসি পাশের পর কলকাতায় কাকার কাছে এলাম। আমার ছোট কাকা, ডাকতাম সোনাকাকু বলে, কসবায় বাসাভাড়া করে থাকতেন । কলকাতায় কাকিমার ভাই পরিমলের সঙ্গে আমার প্রথম পুজো দেখা। পরিমলমামা বলতাম, যদিও এক বয়সী আমরা। সেবার এক মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
সেদিন ছিল অষ্টমী বা নবমী। পরিমলমামারা থাকতেন বাঁশদ্রোণীতে, তবে বেড়াতে এসেছেন কসবায় দিদি-জামাইবাবুর কাছে। আমি ও পরিমলমামা সন্ধেবেলায় প্রতিমা দেখতে বেরোবো ঠিক করলাম। আমি তখন কলকাতার কিছুই চিনি না। পরিমলমামার গাইডেন্সে আমরা কলেজস্ট্রীট পর্যন্ত যাবো, এটা ঠিক হলো। কাকিমার কাছ থেকে কিছু পাথেয় মিললো । আমরা কসবা থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে নানান প্যান্ডেলে প্রতিমা দেখতে দেখতে রাসবিহারী এভিনিউ ধরে পৌঁছলাম শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডে। ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি প্রতিমা দেখলাম। এরপর কালীঘাট এলাকায় কয়েকটি প্রতিমা দেখে, ভবানীপুর হয়ে আমরা চৌরঙ্গী পৌঁছে গেলাম। ট্রামে করে কলেজস্ট্রীট গেলাম। ট্রাম থেকে নেমে আবার হন্টন। এদিকে পা আর টানছে না। দুজনেই খুব ক্লান্ত। কলেজস্কোয়ারের পুজো দেখে ঐখানে একটা বেঞ্চিতে বসে দুজনে চীনাবাদাম খেলাম। তারপর উত্তর কলকাতার দিকে এগোলাম। এতক্ষন সোজাসাপটা রাস্তায় এসেছি, এবার আর রাস্তা ঠিক রাখতে পারলাম না। বেশ কিছু রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে ও সেইসঙ্গে আরও কয়েকটা পুজো দেখে একটি মণ্ডপে পৌঁছে দেখি খুব ভিড়। শুনলাম, ওটা "ফায়ার ব্রিগেডের" পুজো । দারুন জমকালো। তখনকার কলকাতায় এক নম্বর পুজো ছিল ওটাই । এরপরের গন্তব্য পার্ক সার্কাস ময়দান। আর পা চলছিল না । একটা বা দুটো পুজো দেখলাম। পায়ে হেঁটেই ফিরে এলাম বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে। তখন প্রায় রাতশেষ, কাছেই ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান কেন্দ্র। মামা বললেন, এখন বাড়িতে গিয়ে সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে কাজ নেই। বরং কিছুক্ষন ভারত সেবাশ্রম সংঘে কাটিয়ে সকাল হলে যাওয়া যাবে বাসায়।
ওখানে গিয়ে দেখি গানবাজনার আসর বসেছে। আমরা দুজন সবার পেছনে গিয়ে বসলাম। কেউ সেতার বাজাচ্ছিলেন তখন। সেই বাজনার ঝংকার অপূর্ব লাগছিলো । প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট চললো। বাজনা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখি ভোর হয়ে গেছে । আমরা কসবা ফিরে এলাম, বাড়ি ফিরে দেখি কাকিমা চায়ের আয়োজনে ব্যস্ত।
এরপর এত এত বছর চলে গেলো, আর কখনো প্রতিমা দেখতে বেরোই নি। পাড়ার পুজোয় গিয়েছি । কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় আর ঠাকুর দেখতে উৎসাহবোধ করি নি। বহু বছর পর বাসস্থান রুবির মোড়ের কাছে হওয়ায় কসবা শীতলামন্দিরের নামকরা পুজো পাশেই, দেখি সবাই হুড়মুড় করে ওদিকে পানে দৌড়োয়। কিন্তু আমি কিছুমাত্র টান অনুভব করি না। বয়েস বাড়ায় হৈচৈ আর তেমন ভালো লাগে না । তবে এবার এই বিদেশে মেয়ে জোর করে একটা পুজো প্যান্ডেলে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রতিমা এসেছে কুমারটুলি থেকে। একচালা, খুব সুন্দর প্রতিমা। যাওয়ার ইচ্ছে তেমন না থাকলেও ভালোই লাগলো ওই প্রবাসী পুজোর আবহ।