“আমায় ওরা খুব মেরেছে দিদি, দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছে। চারটে পাঁচটা লঙ্কার জল খাইয়ে বুকের ওপর পা তুলে দিয়ে বলেছে- বল চুরি করেছিস। স্বীকার কর। আমার ভালো লাগতো না ও বাড়িতে কাজ করতে। খুব কথা শোনাত, সারাক্ষণ বকাবকি করত.....”
বন্দনা মহাকুর, বয়েস ১৫ বছর। বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন। হতদরিদ্র বাবা মার ৫ মেয়ে, অথচ গায়ে কাজ নেই। তাই কলকাতায় সব মেয়েকেই কাজে পাঠানো। ছোট মেয়ে বন্দনাকে দমদম শেঠবাগান এর শ্রাবণী সাহা সঞ্জয় সাহার বাড়িতে ২৪ ঘণ্টার বাচ্চা দেখার কাজে দেয় মাস ছয়েক আগে। মাইনে পাওয়ার কথা ছিল পনেরো’শ। কাজে ঢোকার দেড় মাসের মাথায় একবারই কলকাতার বাসন্তি কলোনিতে মেজোদিদির বাড়ি এসেছিল বন্দনা। দিদির সাড়ে চার বছরের ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে- একদিনের জন্য। মাইনেও মিলেছে মাত্র একমাসের। একটা মেয়ের পেটের চিন্তা করতে হচ্ছে না তাতেই খুশি ছিল গরীব বাবা মা। কিন্তু গত মাসে হঠাত ফোন, বাবা-মা-দিদিকে ডেকে শ্রাবণী সাহা জানায়, তোমাদের মেয়ে দেড় লাখ টাকার সোনার গয়না চুরি করে তোমাদের দিয়ে এসেছে। মাস দুই আগে যখন বাড়ি গিয়েছিল তখন। তারপর তাদের সামনেই শুরু হয় মেয়েকে মারধর। আমরা গয়না নিইনি, আর আমার বোন যদি গয়না নিয়ে থাকে তো ওকে পুলিশে দাও, তোমরা আটকে রেখে মারধর করছ কেন? একথা বলায় দিদি পূজাকেও মারধর করে আটকে রাখে একরাত একদিন, সঙ্গে সাড়ে চার বছরের ছোটছেলে। বলেছে বেশী কথা বললে তোর ছেলেকে দুলাখ টাকায় বেচে দেব। চুপচাপ দেড়লাখ টাকা এনে দিবি, নাহলে তোর বোনকে ছাড়বো না। কোন যোগাযোগ রাখতে পারবি না। পাড়ার দশ বারো জন লোক মিলে কোনমতে পরের দিন প্রথমে পূজার ছেলে ও পরে পূজাকে ছাড়িয়ে আনতে পারে পরের দিন রাতে। বোনকে বাঁচাতে পূজারা এরপর অভিযোগ দায়ের করতে যায় দমদম পুলিশ ফাড়িতে। পুলিশ সব শুনে বন্দনার জামাইবাবুকে নিয়ে সোজা চলে যায় ওই বাড়ি। ফিরে এসে বলে তোমাদের মেয়ে চুরির দোষ মেনে নিয়েছে, এখন বাচতে চাও তো এরা যা বলছে সব মেনে নাও। দেড়লাখ টাকা এনে দাও আর মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। না হলে মেয়েকে এদের হাতে তুলে দাও, কোন যোগাযোগ করতে আর যেওনা। আর এর পর থানায় বিরক্ত করতে আসলে এখানেও মার খাবে।
পূজারা এরপর পাড়ার ক্লাব, পার্টির মহিলা সমিতি, এলাকার ছোটবড় দাদা দিদি সবার কাছে গেছিল সাহায্যের জন্য। কিন্তু ভোটের মরশুমে লাভের আশা না থাকায় পাত্তা দেয় নি কেউই। স্থানীয় এক সংগঠনের সুত্রে আমরা বিষয়টা জানতে পারি গত ১৭ই মে। ঘটনার মাস খানেক বাদে। তারপর থেকে ছোটাছুটি শুরু। প্রথমে CWC (Child Welfare Committee)-র কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয় মেয়েটিকে উদ্ধার করার আর্জি নিয়ে। CWC দশ দিনেও কোন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এরপর শ্রমিক মেয়েদের নিয়ে কাজ করা ‘অহল্যা’ পত্রিকার পক্ষ থেকে ব্যরাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কাছে অভিযোগ জানানো হয়। দুতিন দিন যাতায়াত করে শেষে গত আঠাশে মে কমিশনারেটের চিঠি নিয়ে দমদম থানায় অভিযান করেছিলাম আমরা। সঙ্গে বাসন্তী কলোনির জনা চল্লিশেক কাজের মেয়ে সহ আরো অনেক বন্ধুরা। পুলিশের সমস্ত গড়িমশি টালবাহানার পর বন্দনা তার মায়ের কাছে ফিরেছে। কিন্তু শুধু তো বন্দনা নয়, ওই বাড়িতে কাজ করে আরো তিনটি মেয়ে, নানা বয়েসের। বন্দনার মুখেই শুনলাম আর আমাদের বন্ধুরা সেদিন বন্দনাকে আনতে গিয়ে চাক্ষুষ দেখেও এসেছে বন্দনার থেকেও ছোট একটি মেয়ের আরো করুণ অবস্থা। পাড়ার লোকেদের দাবী এর আগেও একটি পরিচারিকা মেয়েকে প্রেশার কুকারের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে বের করেছিল ওই পরিবার।
কথোপথনটি ব্যক্তিগত হলেও বন্দনা কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত ঘটনা নয়। কেউ নথি না রাখলেও এরকম আরো অনেক ঘটনা যে ঘটছে তা ‘কাজের মেয়েদের’ সাথে খানিক যোগাযোগ থাকলেই জানা যায়। ছোটবড় মানসিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়া এখনও এ পেশার প্রতিদিনকার বাস্তবতা। যেমন জোর করে বা মিষ্টি কথায় বাড়তি কাজ করিয়ে নেওয়া, না করতে চাইলেই অশান্তি বা কাজ খারাপ বা ভুল হওয়ার অজুহাতে চেঁচামিচি। কিছু বন্ধুদের উদ্যোগে গড়া মেট্রোপলিটনের সংগ্রামী গৃহকর্মী ইউনিয়ন (প্রস্তুতি কমিটি)র এক সদস্য সালমাদি (যিনি বাঙালি ভদ্রলোকদের বাড়িতে রান্নার কাজ করার জন্য অণিমা নাম নিতে বাধ্য হন!) কিছুদিন আগে যখন তাঁর কর্মক্ষেত্রে রান্না করছিলেন তখন তাঁকে বাসন মাজার বাড়তি কাজ করতে বলা হয়। তিনি জানান যে তাঁর পরপর কয়েকটি কাজ রয়েছে ফলে তিনি বাড়তি কাজ ওই মুহূর্তে করতে পারবেন না। পরে এসে করে দেবেন। গৃহকর্ত্রী জেদ ধরে যে না, তক্ষুণি করতে হবে। সালমাদি রাজি হন না। তখন এক কড়াই গরম তরকারি সালমাদির গায়ে ঢেলে দেওয়া হয়। তাদেরই আর একজন মিনতিদিকে গয়না চুরির ভুঁয়ো অভিযোগ দিয়ে একরাত্তির জেলখাটানো হয়েছিল। যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার উদাহরণতো আছেই। জয়নগরের সার্র্কাস মাঠে এক বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজ করত ইয়াসমিনা গাজী, বয়েস ১২। মাস তিনেক আগে একদিন সকালবেলায় তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ইয়াসমিনার মৃতদেহ নিয়ে থানায় আসা হয়েছিল। তার দাদার কাছ থেকে জয়্নগরের পত্রিকা সংগঠক কিছু বন্ধু জানতে পেরেছিল যে তাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। অভিযুক্ত ঐ বাড়িরই এক যুবক। শোনা যায় তাকে পুলিশ এরেস্ট করতে বাধ্য হলেও পরে ছেড়ে দিয়েছে। এই ঘটনাতেও প্রথম থেকেই থানার ভয়ানক উদাসীনতা ছিল প্রথম থেকেই। গতবছর সেপ্টেম্বারের আরো একটি ঘটনা - দুটি নেপালি মেয়ের গুরগাওয়ের এক সৌদি পরিবারে কাজ করতে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা অনেকেরই মনে থাকবে। এরকম ঘটনা তলায় তলায় ঘটছে অনেক। খবরের কাগজেও তার সামান্ন দুএকটারই দেখা মেলে। এই ঠিকে কাজে নেওয়ার সাথেই যুক্ত হওয়ার থেকে পাচার হয়ে যাওয়ার উদাহরণও মেলে বহু।
কলকাতা ও তার আশেপাশের বেশীরভাগ কাজের মেয়েরা এখনো ঘণ্টায় ২০ টাকা মজুরির নিচে মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত বাড়িগুলোতে কাজ করে। হাতে হাজা, হাটুতে ঘা, বাত নিয়ে। কাজের কোন নির্দিষ্ট মাপ বা নিয়ম এখানে নেই। মাসে ৪ দিন ছুটিও জোটেনা (বড়জোর দুদিন) অনেকেরই। অসুস্থ হয়ে একদিন কাজে না গেলে মাইনে কাটা যায়। নানা ছুতো দেখিয়ে পূজোর মাসে বোনাস দিতে চায় না কাজের বাড়ির বৌদি দাদা রা। কখনো তুমি ৬ মাস কাজ করো নি বোনাস পাবে না, কখনো পুজোর মাসের আগে আগে নানা বাহানায় কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া। এদের মুখেই শোনা পুজোর আগেই চুরির অপবাদ দিয়ে কাজ ছাড়ানোটা খুব ঘটে। তারপর ভাঙা কাপে চা খেতে দেওয়া, প্লাস্টিকের ঠোঙায় জলখাবার, বাথরুমে যাওয়া মানা, জল পর্যন্ত খেতে দেয় না অনেক বাড়ি। ভালো কাজের বাড়ি হলে ওরাই আবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় তবে শ্রমিকের অধিকার নয় পুরোটাই পয়সাওয়ালা চাকরিজীবী বাড়িগুলোর দয়া দাক্ষিণ্যে চলে এদের জীবন। তারপর উপরি পাওনা এই চুরি ছিনতাইয়ের তকমা আর শ্রাবণী সাহা দের মত মানুষদের টাকার লোভ আর জল্লাদ সুলভ মানসিকতা। আর একবার তকমা জুটলে কোন পার্টি, কোন থানা, কোন ভদ্দরলোক কি বিশ্বাস করবে এদের! বলুন তো? কারণ ‘ছোটলোক’দের তো জন্ম তকমা চোর-ছ্যাঁচোড়ের। এখানেই আসলে কাজ করে যায় আমাদের ‘ছোটলোক’ বিরোধী মধ্যবিত্ত শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি। আছে আরো অনেক মাত্রা। মর্যাদা এতই কম যে এই কাজের মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের শ্রমিক বলে মনে করতে পারেনা। আর ঘরে বাইরে পিতৃতান্ত্রিক শোষণের শিকার মেয়েরা কাজের বাড়ির দুর্ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়েই উঠতে পারে না। সমস্ত ধরণের সামাজিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত দূর দূর থেকে কাজে আসা মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা যত বেশী, সেই অনুপাতেই চলে দাসত্ব। এই পেশার পরিশ্রম এত বেশি আর মজুরি ও মর্যাদা এত কম যে এর থেকে বেশ্যাবৃত্তিকেও অনেকে সম্মানজনক এবং শোষণহীন মনে করে অনেক মেয়েরাই। বছর কয়েক আগে ইউনিয়ন বহির্ভূত যৌনকর্মীদের মধ্যে করা প্রথম সর্বভারতীয় সমীক্ষায় দেখা গেছে যৌনকর্মীদের মধ্যে ৭১ শতাংশ এই পেশায় আসার আগে গৃহ্শ্রমিকের কাজ করতেন। পেশা বদলের পিছনের পরিস্থিতিটা এইরকমই।
গৃহশ্রমিক মেয়েদের জন্য কোনরকম সামাজিক সুরক্ষার বা শ্রমিকের স্বীকৃতির ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি এ রাজ্যের সরকার। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ ILO স্বীকৃতি সত্ত্বেও এই কাজের মেয়েদের এখনও শ্রমিক হিসেবে স্বীকার করেনি। অথচ এ দেশে পরিষেবা ক্ষেত্রে যত মেয়ে কাজ পায়, তার দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে গৃহশ্রমিকের কাজ। তবে সম্প্রতি আসা অসংগঠিত ক্ষেত্র শ্রমিক সুরক্ষা আইনের আওতায় আনা হয়েছে গৃহশ্রমিক মেয়েদের। কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা বিরোধী আইন অনুযায়ীও সুরক্ষা পাওয়ার কথা এই মেয়েদের। কিন্তু কীভাবে তা নিশ্চিত নয় এখনো। মহারাষ্ট্র, বিহার, কর্ণাটক, কেরালা ও সম্প্রতি রাজস্থানের মত রাজ্যে গৃহশ্রমিক মেয়েদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে ওয়েলফেয়ার বোর্ড। মহারাষ্ট্র সরকার ২০১৩ সালে শুরু করে গৃহশ্রমিকদের নথিভুক্তকরণের কাজ, ন্যূন্তম মজুরি মাসে ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য নির্ধারিত হয়েছে ৬৫০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত। এই বছরই রাজাস্থান সরকার ঘোষণা করেছে একিভাবে মাসে রোজগার হতে লাগবে কম সে কম ৫৬৪২ টাকা। আমাদের রাজ্যে এখনো সেসব দূরস্থ। কেন্দ্রীয় লেবার ওয়েলফেয়ার দপ্তর সম্প্রতি গৃহশ্রমিক সম্পর্কে জাতীয় নীতির খসড়া তৈরি করে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়র দপ্তরে পাঠিয়েছে। তাতে মাসে অন্তত ৯০০০ টাকা রোজগার ও বছরে অন্তত ১৫ টি সবেতন ছুটির সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সুপারিশ থাকলেও কিভাবে তা প্রয়োগ হবে বা হচ্ছে তাও বেশ কঠিন প্রশ্ন। এই কাজের মেয়েদের একটা বড় অংশ সবরকম সামাজিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত গরীব হওয়ার কারণে আর মেয়ে হওয়ার কারণে। টাকা পয়সার হিসেবও অনেকে বোঝে না। এদের সংগঠিত করতে না পারলে লড়াই করে জেতা অধিকার প্রয়োগ করা যাবেনা। জাতীয় নীতি তে সুপারিশ আছে গৃহশ্রমিক নিয়োগ সেন্টার বা সংগঠনের মাধ্যমে কাজে নিযুক্ত হোক। কিন্তু সেন্টার একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে আর এদেরই পরিশ্রমের পয়সা থেকে মুনাফা তুলবে। পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা যদিও আরো প্রাথমিক স্তরে, নতুন সরকার শপথ নিয়েছে সদ্য। নতুন মরশুমে গৃহশ্রমিক মেয়েদের ‘শ্রমিক স্বীকৃতি-ন্যূনতম মজুরি-ওয়েলফেয়ার বোর্ড’ এর দাবীতে সোচ্চার হওয়া যায় কিনা সেটাই দেখার।