কেন্দ্র সরকার ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করেছে, উদ্দেশ্য হলো কালো টাকা এবং জাল টাকাকে ধরা। সেই সিদ্ধান্তের মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের সকলকে যাদের জীবনেও কালো টাকা ছিল না বা জাল টাকার কারবারি নই। এই নীতি ঠিক না ভুল সেটা আলোচনা করতে গেলে প্রথমে যেটা করা দরকার তা হলো নীতির কার্যকারিতা কেমন সেই সম্পর্কে আলোচনা, সেটা হলে তবেই এই নীতির কস্ট-বেনিফিট এনালিসিস করা যাবে। এই আলোচনায় আমি কোনো কন্সপিরাসি থিওরি, যেমন "বিজেপির নেতারা আর বড় ব্যবসায়ীরা আগের থেকে জানতো আর টাকা সরিয়ে নিয়েছে", "আম্বানি রিলায়েন্স জিও বানিয়ে কালো টাকা সাদা করে নিয়েছে", অথবা "অনাদায়ী ঋণের জন্যে ব্যাংকে টাকা নেই তাই এসব করে ব্যাংকে অক্সিজেন দিচ্ছে" - এসবে যাবো না, নীতিটির ভালো খারাপ নিয়েই আলোচনা করবো। আমি বলছি না যে এগুলো মিথ্যে, সত্যি হতেই পারে, কিন্তু ধরে নিচ্ছি যে সরকার সৎ উদ্দেশ্যেই পুরোটা করেছে।
প্রথমে জাল টাকার বিষয়টা আলোচনা করা যাক কারণ এই বিষয়টা সবচেয়ে সহজে বোঝা যাবে। বাজার ৫০০ আর ১০০০ টাকার জাল নোটে ছেয়ে গেছে আর তাই পুরোনো নোট্ বাতিল করা দরকার। এই নীতিতে কোনো দ্বিমত নেই, নোট্ যদি আকছার জাল হতে থাকে তাহলে নতুন নোট্ বানানোই উপায়। কিন্তু তার জন্যে রাতারাতি করে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট্ বাতিল করার প্রয়োজন নেই। সরকার বলতে পারতো যে আগামী দু মাস বা তিন মাসের মধ্যে এই পুরোনো নোটগুলো অচল হয়ে যাবে আর তার জায়গায় নতুন নোট্ আসবে, এই সময়সীমার মধ্যে আপনারা পুরোনো নোট ব্যাংকে বদলে নতুন নোট নিয়ে নিতে পারেন। ব্যাংকে জমা দেওয়া বা বদলানোর সময়তেই নোট্ পরীক্ষা করে নেওয়া যেত আর যেগুলো জাল সেগুলোকে বাতিল করে দেওয়া যেত। বাজারে ৫০০, ১০০০ টাকার নোটের কারবারি হঠাৎ করে বন্ধ হতো না, দু মাস কি তিন মাস ধরে সেটা আসতে আসতে হতো। সে ক্ষেত্রে এরকম তাড়াহুড়ো করে বাতিল করার, অথবা ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ওপর উর্দ্ধসীমা লাগানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না, অর্থাৎ এই তাড়াহুড়োর ফলে জাল নোট্ ধরায় কোনো বাড়তি লাভ হচ্ছে না, ধীরে সুস্থে করলেও একই হতো। এখন দেখা যাচ্ছে যে নতুন যে ২০০০ টাকার নোট্ বেরিয়েছে তা ছাপানোতে কোনো বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি (প্র: দ্য হিন্দু) এবং ভবিষ্যতে এরও জাল অনুকরণ বেরোনোয় কোনো বড় অসুবিধে হবে না। তাহলে একদিকে দেখা যাচ্ছে যে জাল নোট্ আটকানোটা এই তাড়াহুড়োর উদ্দেশ্য নয় এবং ভবিষ্যতেও যে জাল নোট্ আটকাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে এই তাড়াহুড়োর কারণ কি?
কারণটা হলো কালো টাকা নষ্ট করা। কি ভাবে? ধরুন আপনার কাছে অনেক নগদ কালো টাকা মজুত আছে। সবটাই ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট্। এবার সরকার যেই ৫০০ আর ১০০০-এর নোট্ বাতিল করলো অমনি আপনার কাছে দুটো পথ খোলা রইলো। এক, আপনি সমস্ত কালো টাকা ব্যাংকে জমা দিলেন আর দুই হলো সব নোট্ নষ্ট করে দিলেন। প্রথম পথটায় সমস্যা হলো যে শুধুই আপনার টাকার বড় অংশটাই অঘোষিত আয় বলে সরকার কেটে নেবে তাই নয়, কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যে আপনার হাজতবাস পর্যন্ত হতে পারে যদি ফাঁকি দেওয়ার অঙ্কটা বড় হয়। তা ছাড়াও আরেকটা বিষয় আছে। কালো টাকা দুভাবে উৎপন্ন হয় - এক হলো অঘোষিত আয় যাতে আপনি কর দেন না আর দুই হলো অবৈধ কারবার থেকে অর্থাৎ স্মাগলিং বা ঘুষ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একজন কোনোভাবেই ওই টাকা নিজের বৈধ ব্যাংক একাউন্টে জমা করতে পারবে না কারণ তার আয়ের উৎসটাই অবৈধ আর ধরা পড়লে হাজতবাস নিশ্চিত। এসব কারবার যারা করে তাদের অবশ্যই বেনামি ব্যাংক একাউন্ট থাকে অথবা কোনো ভুয়ো ব্যবসা বা কোম্পানি রেজিস্টার করা থাকে যার আড়ালে তারা অবৈধ কাজ করে। ফলে সেইসব বেনামি একাউন্ট বা ভুয়ো কোম্পানির একাউন্টে ওই টাকা ঘোরানো যেতে পারে। তবে যেটাই হোক, দেশে যদি প্রচুর পরিমান কালো টাকা উৎপন্ন হয় তাহলে এই নীতির ফলে তার অন্তত কিছুটা ধাক্কা খাওয়া উচিত। কিন্তু কতটা ধাক্কা খাবে?
প্রথমে কালো টাকা বা কালো ধন কাকে বলে তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। কালো টাকা বা কালো ধন বলতে কিন্তু আমরা অজান্তেই দুটো পৃথক জিনিসের কথা বলি। একটা হলো কালো আয় অন্যটা কালো সম্পদ। কালো আয় হলো সেই আয় যা আয়করের আওতায় পড়া সত্ত্বেও তার ওপর কোনো কর দেওয়া হয়নি অথবা অবৈধ কারবার থেকে করা আয়। কালো সম্পদ হলো কালো আয় জমে জমে যে ধনসম্পদ হয়েছে সেটা। একজন মানুষ কার্যক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে আয় করছে আর সেই আয়ের একটা অংশ জমে জমে হচ্ছে সম্পদ। যেমন কল থেকে যদি টিপ্ টিপ্ করে জল পড়ে সেই পড়ন্ত জল হলো আয় আর সেই কলের নিচে যে বালতিটা রয়েছে আর তাতে যে জল জমা হচ্ছে সেটি হলো সম্পদ। ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট্ বাতিল করে কালো আয়কে আটকানো যাবে না যদ্দিন কালো আয়ের উপায় খোলা থাকে। যে ব্যবসায়ী নিজের রোজগার কমিয়ে দেখায় প্রতি বছর, সে সামনের বছরেও কমিয়েই দেখাবে এবং তার ফলে কালো আয় তৈরী হবে। যে পুলিশ ঘুষ খেত সে কাল থেকে নতুন ৫০০ বা ২০০০ টাকার নোটে ঘুষ খাবে, অর্থাৎ নোট্ বাতিল করে কালো আয় বন্ধ করা যায় না। সেটা করতে হলে কালো আয় যারা করে তাদেরকে তদন্ত করে খুঁজে বের করতে হবে। এর কোনো শর্ট কাট নেই। তাহলে নোট্ বাতিল করে কি লাভ হলো?
নোট্ বাতিলের উদ্দেশ্য চিরতরে কালো আয় বন্ধ করা নয়, নোট্ বাতিলের উদ্দেশ্য হলো কালো সম্পদকে আক্রমণ করা। অর্থাৎ কালো আয় জমিয়ে জমিয়ে যে সম্পদ হয়েছে তার কিছুটা সরকারের খাতায় ফিরিয়ে আনা অথবা মূল্যহীন করে দেওয়া। এখন বিষয় হচ্ছে নোট্ বাতিল করে কালো সম্পদের কতটা ক্ষতি করা যাবে এটা নির্ভর করছে কালো সম্পদের কতটা ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটের আকারে রয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস সংবাদপত্রটি আয়কর দফতর থেকে পরিসংখ্যান ঘেঁটে বলছে যে গত ৩ বছরে যত আয়কর দফতরের রেড হয়েছে তাতে উদ্ধার করা কালো সম্পত্তির মোট ৬% নগদ টাকা হিসেবে রয়েছে। বাকিটা সোনা দানা, বেনামি একাউন্ট, বিদেশী মুদ্রা, এবং বেনামি জমি বাড়ির আকারে রয়েছে। এতে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। মানুষ সম্পদ দিয়ে কি করে? সমস্ত মানুষই সম্পদকে ব্যবহার করেন আরও বেশি সম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যে। আমরা সম্পদ ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে রাখি যাতে সুদ জমে, জমানো সম্পদ দিয়ে জমি বাড়ি কিনি যাতে দাম বাড়লে বিক্রি করে লাভ করা যায়, শেয়ার বাজারে খাটাই একই উদ্দেশ্যে। যাঁরা ব্যবসায়ী তাঁরা সম্পদকে পুনরায় ব্যবসায় মূলধন হিসেবে লাগান যাতে ব্যবসা আরও বাড়ে। পুঁজিবাদে সম্পদই হলো পুঁজি, সম্পদের কাজ হলো পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়ে উৎপাদনে কাজে লেগে আরও বেশি সম্পদ হওয়া। তাই কালো ধন সম্পদের মাত্র ৬% নগদ টাকা হিসেবে থাকলে আশ্চর্য্যের কিছু নেই কারণ নগদ টাকা জমিয়ে কোনো লাভ নেই, উল্টে ক্ষতি। ক্ষতি কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে নগদ টাকার ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাসমান, ১০ বছর আগে ৫০০ টাকা দিয়ে যা কেনা যেত এখন তার চেয়ে অনেকটাই কম কেনা যায়। তাই দীর্ঘদিন ধরে কেউ নিজের কালো সম্পদ নগদে রেখে দেবে না। হয়তো অল্প সময়ের জন্যে রাখতে পারে কিন্তু সুযোগ পেলেই অন্য কোনো সম্পদে তাকে বদলে ফেলবে। প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাংক গভর্নর এবং বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন বলেছেন যে ভারতের অধিকাংশ কালো টাকাই হাওয়ালা মারফত বিদেশে চলে যায় আর বিদেশী মুদ্রা হয়ে যায়। উনি বলছেন যে এর পেছনে কারণ হলো কালো ধনের অধিকাংশটাই মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কন্সেন্ট্রেটেড এবং তাদের বিদেশে টাকা পাঠানোর হাজার একটা চ্যনেল জানা আছে। তাহলে এই ৫০০, ১০০০ নোট্ বাতিল করে মোট কালো সম্পদের একটা ছোট অংশকেই ধাক্কা দেওয়া সম্ভব, সেই ধাক্কাও যে কতদূর সফলভাবে দিতে পারবে তাই নিয়ে সন্দেহ আছে কিন্তু মোট কালো সম্পদের সিংহভাগটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকলো শুরুতেই।
কিন্তু এই নীতিকে শুধুই কমজোরি বললে অর্ধেক বলা হয়। এই নীতি মূলগত ভাবে জনবিরোধীও। কী ভাবে? দুটো দিক নিয়ে ভাবলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যাবে। প্রথমত, ভেবে দেখুন যে দেশে যে কালো সম্পদ তা যদি না থাকতো তাহলে সেই সম্পদ কোথায় যেত? অধিকাংশ কালো সম্পদই তৈরী হয়েছে সরকারকে আয়কর ফাঁকি দিয়ে অথবা দেশের সম্পদ লুঠ করে অথবা ঘুষ খেয়ে। কোনোভাবে যদি কালো আয় আটকানো যেত তাহলে এই সম্পদ আজকে থাকতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে। সরকার আয়কর বেশি পেলে তাই দিয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প নিতে পারতো, নেতা অফিসাররা যে ঘুষ খায় তার অধিকাংশের মাশুলও দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই, সরাসরি বা মারফতি। অর্থাৎ এই কালো সম্পদের ওপর অধিকার সাধারণ মানুষেরই। কিন্তু নোট্ অচল করে যদি এই কালো সম্পদের একটা অংশকে ধ্বংস করে দেওয়া হয় তাহলে সেই অংশটা আর সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে আসার কোনো উপায় থাকে না। ধ্বংস করার কথা বলছি কারণ এই কালো সম্পদের বেশিটাই কেউ বৈধভাবে ব্যাংকে জমা দেবে না, কারণ তাতে শুধু টাকা যাবে না উল্টে জেল যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। এ যেন অসৎ রেশন ডিলারের গুদাম জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার। রেশন ডিলারের ক্ষতি হলো বটে কিন্তু যারা সেই রেশনের হকদার তারা কিছুই পেলো না। দ্বিতীয় সমস্যাটা আরও বড়। আমাদের দেশের প্রায় ৯০% মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। তাদের মাইনে পত্র রোজগার সবটাই নগদে হয়। এর ফলে নগদ কালো টাকা খালাস করার একটা বড় জায়গা হচ্ছে অসংগঠিত ক্ষেত্র। নগদ কালো টাকা দিয়ে পরিচারক, ড্রাইভার, দারোয়ানের মাইনে, দোকান বাজার, নির্মাণ শ্রমিকের মাইনে, কারখানা বা ব্যবসার নিচু তোলার শ্রমিকের মাইনে - এসবই খরচ করা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো যে এই মানুষগুলির যে হেতু কাজ করার কন্ট্রাক্ট থাকে না তাই কোনো প্রমানও থাকে না যে এদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং মাইনে দেওয়া হয়েছে। নগদ কালো টাকা দিয়ে যেটুকু খরচ খরচা করা হয়ে থাকে তার বড় অংশটাই এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি করা মানুষজনের শ্রম ও পরিষেবা কিনতে ব্যবহার হয়ে থাকে। যদি নগদ কালো টাকার বেশিটাই ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটে থেকে থাকে তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে এই নগদ কালো টাকা দিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে যে শ্রম ও পরিষেবা কেনা হচ্ছে তার মাইনেও ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট মারফৎ দেওয়া হচ্ছে। তাহলে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করলে এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের একটা অংশও ক্ষতির মুখে পড়বেন যদিও তাঁরা কোনো অন্যায় করেননি, কর ফাঁকি দেননি বা অবৈধ কারবার করেননি। হ্যা, এটা ঠিক যে এইসব মানুষরা ব্যাংকে একাউন্ট খুলে এদের টাকা জমা করতেই পারেন। কিন্তু মুশকিল হলো যে এরা ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোর একদম তলায় বাস করেন, ব্যাংক সম্পর্কে এদের ধারণা কম, একাউন্ট নেই অনেকের আর যাদের আছে তারাও ব্যবহার করায় সড়গড় নন। ফলত এই মানুষেরা শিকার হবেন বিভিন্ন দালাল চক্রের যারা মোটা কমিশনের বিনিময় এদের টাকা ব্যাংক থেকে বদলে আনবে বা ব্যাংকের একাউন্টে জমা করে দেবে।
তাহলে যা বোঝা গেলো তা হলো যে এই নোট্ বাতিল করে কালো সম্পদের একটা ক্ষুদ্র অংশকেই টার্গেট করা যেতে পারে, বেশি আশা না করাই ভালো। কিন্তু অপরদিকে এর কুফল ভোগ করবেন সমাজের দুর্বল অংশের মানুষজন।