প্রতিদিন এইসময় অমরেশ বাড়ী ফেরে, ঠিক রাত সাড়ে আটটায়। সাইকেলটা চালিয়ে সে এসে ঢোকে তাদের গলির মুখটায়, যদি না ল্যাম্পপোষ্টের বালবটা কেটে গিয়ে অথবা চুরি হয়ে গিয়ে থাকে, কখনো কখনো হয় সেরকম, সেরকম না হলে তাকে দেখা যায় হলুদ ঘষটানো আলোর ভেতর একবার জোরে প্যাডেলটা ঘুরিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলতে। আর প্যাডেল করতে হবে না, গলিটায় সামান্য ঢাল আছে, কপালের ঘামটা জুড়োতে জুড়োতে প্যাডেল না করার পরিশ্রমহীনতাটুকু উপভোগ করে ঠিক যে জায়গাটায় এসে মনে হয় আর একবার প্যাডেল করতেই হবে, নইলে ব্যালেন্স রাখা যাচ্ছে না আর, ব্যালেন্স রাখবার জন্যে সে হ্যান্ডেলটা ধরে সামনের চাকাটা ডানদিক-বাঁদিক করে, তবু প্যাডেল করে না, তারপর ধপ করে পা-টা যেজায়গায় মাটিতে ফেলে থেমে যায়, ঐখানটাতেই তাদের বাড়ি। বাড়ি ঢুকে সে হাত-পা ধোয়, হাত-পা ধুতে ধুতে বালতিভর্তি ঠান্ডা জল দেখে তার লোভ হয়, কখন সে মগে করে জল তুলে মাথায় ঢালতে শুরু করেছে খেয়ালই হয় না, এতক্ষণে তার শরীর থেকে সারাদিনের ক্লান্তিটা মুছতে শুরু করে। দু'ঘন্টা যাওয়া-দু'ঘন্টা আসা — ট্রেনে অনান্য ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে এই মোট চার ঘন্টার অবিশ্রান্ত অন্তহীন তর্কের ফলে ধরে যাওয়া মাথাটা একটু একটু করে ছাড়ে, তবুও জল ঢালার ফাঁকেই মাথার শিরাগুলো যেন দপদপিয়ে ওঠে, বেশ করছে এনআরসি করছে, বেশ করছে রিফিউজিগুলোকে তাড়াচ্ছে, তোরা পোবোন্ধো মারিয়ে কি করেছিস এতদিন? দম আছে শালাদের টাইট দিচ্ছে, আগের আগের সরকারগুলো কী ছিঁড়েছিল, খুব জ্বলছে মাইরি ন্যাকাষষ্ঠী আঁতেলগুলোর, দ্যাখ কেমন লাগে ব্যাটারা — কখন যেন বাক্যের স্রোত মাথার ভেতর বাধাহীনভাবে ভেসে আসতে শুরু করেছে ফের, যেন এখনো ট্রেনের কামরাতেই বসে আছে, মাথাটা ঝাঁকিয়ে বাথরুম থেকে খালিগায়ে গামছা পরে বেরিয়ে সে তিনবার তর্জনীটা কপালে ঠেকাল। তারপর রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে আড়চোখে দেখতে পেল রীতা বুঁদ হয়ে বসে আছে টিভির সামনে, তার প্রিয় সিরিয়ালের শেষপর্ব না মহাপর্ব কি একটা আছে আজ, এখন গতর নাড়াবে না, তাকে না ঘাঁটিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে গামছা পরেই অমরেশ বঁটিটার ওপর উবু হয়ে বসে শশা কাটতে শুরু করল, পাশে বেড়ে নিয়েছে একবাটি মুড়ি। ঘ্যাস ঘ্যাস করে শশার খোসা ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল মুড়ির ওপর, শশা কাটা হয়ে গেলে বঁটিটা সরিয়ে আঁশবঁটিটা টেনে পিঁয়াজ কাটতে শুরু করল। শালা কি ঝাঁজ মাইরি, চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে তার, হাত তুলে কবজি আর কনুইয়ের মাঝখানটা দিয়ে জল মুছে নিল, নাকের জলে চোখের জলে হতে হতে কখন যেন আঙুলের ডগাটা বঁটিতে পেয়ে যায়, ফ্যাঁস করে অনেকখানি কেটে গিয়ে গাঢ় লাল রক্ত গড়িয়ে এল। সেইসময়ই টিভিতে বড়বউ জানতে পারে মেজবউ গর্ভবতী এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে তীব্র মিউজিক বেজে উঠল, শুনতে পেয়ে অমরেশের সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল বউয়ের ওপর, দড়াম করে মুড়িসুদ্ধু বাটিটা ছুঁড়ে দিল দরজার দিকে, রান্নাঘরের দরজায় লেগে আছড়ে পড়ল সেটা, চারদিকে শশা, পেঁয়াজ ও মুড়ি ছিটিয়ে গেল। কী হল, কী হল — বলতে বলতে রীতা উঠে এল, অমরেশ প্রচণ্ড জোরে ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল — যাও যাও বেরোও, বেরোও বলছি, সিরিয়াল গেলোগে, এখানে কী করছো? রীতা ব্যাপারটা বুঝে পাল্টা চিৎকার জুড়ে দিল — অ অমনি চোখ জ্বলে গেল তোমার? একটু যেই সিরিয়ালটুকু দেখতে বসেছি, অমনি বাবুর মেজাজ টঙ!
— হ্যাঁ টঙ হবে মেজাজ, এই যে সারাদিন তেতেপুড়ে এলাম, বাড়ি ঢুকে এক গেলাস জলও পাইনা, পটের বিবি বসে বসে সিরিয়াল মারাচ্ছেন!
— বেশ করছি, কম হারামি নও তুমি, জানি হাড়ে হাড়ে, হেবি চোখ জ্বলা লোক! পারব না দাসী-বাঁদী হয়ে থাকতে!
বাইরের ঘরের তক্তাটার ধারে বসে বুকের ওপর মাথাটা ঝুঁকিয়ে জয়প্রকাশ ঝিমুচ্ছিলেন, ঝগড়ার আওয়াজ পেয়ে বিস্বাদ মুখে একটা মৃদু শব্দ করলেন, রোজ এই এক অশান্তি, ছেলে-বউ দুজনেই যেন সাপে-নেউলে একেবারে, জয়প্রকাশ একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর কিছু বলবার সাহস নেই ওদের, সংসারে তাঁর আর কোনো মূল্যই নেই সেটা তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ এখনো মরছেন না এটাই সমস্যা, ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়া টর্চের মতো বাড়ির এ কোণে সে কোণে ঠেকতে ঠেকতে বেঁচে থাকা। আরে বাবা মরণ কি কারোর হাতে? নিজের হাতে হলেই ভালো হত, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার পর বেঁচে থাকা বড় কষ্টের, তাঁর স্ত্রী-কে এই কষ্ট পেতে হয়নি, সে কেমন ড্যাঙ ড্যাঙ করে চলে গেল চোখের ওপর দিয়ে আর তিনি আটকে পড়েছেন। এই বাড়ির সামনের গলিটা থেকে বেরিয়ে বড়োরাস্তা ধরে একটু এগোলে রাস্তাটা আড়াআড়িভাবে আরেকটা রাস্তা কেটে দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ঐ চৌমাথা জায়গাটা একটু বাজার মত, চায়ের দোকান, মুদিখানার দোকান, সেলুন, ডাক্তারখানা — এইসব আছে, ডাক্তারখানাটার পাশে 'সুহাসিনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের' লাগোয়া একটা ছোট্টো কালী মন্দির; দুবেলা ঐখানে গিয়ে একটু ফুল-বাতাসা দিয়ে আসা — ব্যাস, এইটুকুই জয়প্রকাশের কাজ সারাদিনে, এইকাজটাই তিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে করে আসছেন। এছাড়া আর কোনো পার্থিব ব্যাপারের সঙ্গে তাঁর কোনো সংস্রব নেই, লোকেও মাঝেসাঝে যদি পুজোটুজো দিতে আসে তো এল, এছাড়া তাঁকে কেউ পাত্তা দেয়না। পুজোও কমে গেছে মন্দিরটায়, নমো নমো করে টিকে আছে; মন্দিরটার পিছনে একটা বটগাছ মাথার ওপর ঝাঁকড়ে রয়েছে ছাতার মতো, ফলে মন্দিরটার সারা গায়ে শ্যাওলা, অযত্নের ছাপ, দেয়ালগুলোর চুনখসে ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে পড়েছে এখানে-সেখানে, মফস্বল শহরের অন্যান্য বড়ো বড়ো চমৎকার মন্দিরগুলোর তুলনায় নেহাতই একটা উপদ্রব মাত্র। লোকের আর দোষ কি, খামখা পুজো দিতে আসবে কেন? তবু ঐখানটাতেই সারাজীবন জয়প্রকাশ পুরোহিত হয়ে রয়ে গেলেন, ঐখানটাতেই ঘন্টা নেড়ে টুং টুং করে গেলেন — ছেলের কথাটা মনে পড়ল তাঁর — লোকের কারোর মুরোদ বেশি হয়, কারোর কম, কিন্তু তা বলে তোমার মত নিমুরুদে বাপ যদি একপিস দেখেছি মাইরি! কি যে করলে সারাজীবন, টুং টুং টুং টুং! তাও যদি একটা ডবকাগোছের মন্দিরে করতে, শাঁসালো পার্টি বাগাতে, তো শালা মানে ছিল কিছু। কাকাকে দেখো, তোমার নিজের ভাইকে দেখো, একই মায়ের পেটে তো হয়েছ; দেখো কিরকম কলকাতায় গিয়ে সারাজীবন চুরুট টানতে টানতে আমেরিকা-ফামেরিকাকে গাল দিয়ে গেল, এন্তার জ্ঞান মারিয়ে গেল মার্কস-লেনিন-হ্যানাত্যানা নিয়ে, অথচ ছেলেটাকে ঠিক বিদেশে পাঠিয়ে দিল টাইমলি, কোথায় থাকে জানো? ডুসেলডর্ফ। কোন দেশ জানো? আর কাকে বলছি! সাইন নাইন্টি কস নাইন্টি গুলিয়ে ফেলত ঐ গবেট ছেলেটা আর আমি অঙ্কে লেটার লাগিয়ে গলায় সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ালাম, বাপের মুরোদ থাকলে তো কিছু হবে! ঠিকই বলে ছেলেটা, জয়প্রকাশ ভেবে দেখেছেন মুরোদ তাঁর সত্যিই নেই, কিছুই করতে পারেননি তিনি জীবনে। ছেলেটাও নষ্ট হয়ে গেল তাঁর জন্যেই, তবুও এখন কী একটা চাকরি জুটিয়েছে, খুব খাটনি, তাও ভালো। ঈশ্বর মঙ্গল করুন, ঈশ্বর ছাড়া কার ওপরেই বা ভরসা রাখবেন, আস্তে আস্তে বিষণ্ণভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
— ব্যোম কালী!
সন্ধ্যের ধোঁয়াশার ভেতর সনাতন সবে তেলেভাজাগুলো ছেড়েছে গরম তেলে আর একটা পাগলাটে হাওয়ার চক্করে পাক খেতে খেতে তেলেভাজার গন্ধ চলকে পড়ছে চারদিকে, রাস্তার উল্টোদিকে 'ড্রিম হেয়ার কাটিং' সেলুনের ভারী কাঁচের দরজাখানা ঠেলে একটু ঠান্ডা বাতাস চেয়ে মফিজুল বাইরে এসে হাওয়ায় সেই গন্ধটাই পেল এবং কানে একটা গোলমালের শব্দ শুনে সেলুনের পাশে অবনীডাক্তারের চেম্বারের দিকে তাকিয়ে দেখল ডাক্তার একজন রোগীকে ধমকাচ্ছে — চট করে বোঝা গেল না জিভ বের করার জন্যে নাকি না বের করার জন্যে, এমনসময় রাস্তার উল্টোদিকের সনাতনের তেলেভাজার স্টলের পাশে সবজীর দোকানগুলোয় যে অফিসফেরতা লোকগুলো ভিড়েছে তাদের পেরিয়ে চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে আওয়াজ উঠল — ব্যোম কালী! আওয়াজটা এপারে অবনীডাক্তারের চেম্বার টপকে 'সুহাসিনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের' লাগোয়া কালীমন্দিরটার সামনে দাঁড়ানো জয়প্রকাশকে লক্ষ্য করে। জয়প্রকাশ নামাবলীর খুঁটে বাঁধা চাবির থোকোটা থেকে একটা চাবি বেছে নিয়ে মন্দিরের গ্রিলের গেটটা খুললেন, আস্তে আস্তে ঢুকলেন মন্দিরে। চায়ের দোকানের সবক'টা ছেলেকেই তিনি চেনেন, ছুটি থাকলে অমরেশও ওখানে এসে জোটে কোনো কোনোদিন, চোখের সামনে এদের বড় হতে দেখেছেন জয়প্রকাশ। তখনকার দিনগুলোতে পুরোহিত হিসেবে জয়প্রকাশের কিছুটা দর ছিল পাড়ায়, লোকে ডাকত লক্ষ্মীপুজোয়, সত্যনারায়ণ দিতে, এমনকি পৈতেও দিয়েছেন তিনি কখনো কখনো, এদেরই কারোর কারোর পৈতে দিয়েছেন। কারোর সাত, কারোর নয়, কারোর এগারো বছরে পৈতে হয়েছে, ন্যাড়ামাথায় গেরুয়া পরে ব্রহ্মচারীর বেশে হাতে বেলডাল ধরে ছেলেগুলো যখন দাঁড়াত, তাদের বাবা, মা, আত্মীয়-স্বজন ভক্তি ভরে প্রণাম করত তাদের, ছেলেগুলো জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত লজ্জা-লজ্জা করে এবং তাদের সদ্য কৈশোরের মুখগুলো দেখে তাদের পরিবারের লোক জিগ্যেস করত — ঠাকুরমশাই বলুন কি চমৎকার দেখাচ্ছে আমাদের ছেলেটাকে! জয়প্রকাশ একগাল হেসে বলতেন উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা, হয়তো কোনো ঠাকুর-দেবতার গল্প বলতেন, আর সব্বাইকেই বলতেন — এরকম সুলক্ষণযুক্ত ছেলে আর তিনি কখনো দেখেননি, হয়তো কানের পাশের তিলটা তাঁর অকাট্য প্রমাণ কিংবা বুকের বাঁদিকের জড়ুলটা। শেষকালে সবার প্রণাম করা হয়ে গেলে তিনি প্রণাম করতেন সদ্য পৈতে হওয়া ব্রহ্মচারীকে, দেখতে পেতেন তারা পায়ের আঙুলগুলো যেন একটু গুটিয়ে নিচ্ছে, এতক্ষণ তারা ভেবেছিল সবাই প্রণাম করলেও অন্ততঃ ঠাকুরমশাই করবেন না, এখন তারা সামান্য সংকোচ বোধ করল। জয়প্রকাশ খেয়াল করলেন তিনি মন্দিরের আসনে বসে এইসব ভেবে চলেছেন, মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর, ঠাকুরের ওপর থেকেও কি তাঁর বিশ্বাস সরে যাচ্ছে? জোর করে দু-একটা মন্ত্র ভাবতে ভাবতেই আবার তাঁর মনে পড়ল সেই দৃশ্যটা, তিনি বাবু হয়ে বসে মন্ত্র পড়ছেন, তাঁর দু'হাঁটুতে জড়ানো পৈতের সুতো, পাশে অমরেশ বসে আছে কৌতুহলী চোখে, তখন তার দশ-এগারো বছর বয়েস, পৈতেটা তৈরী করে পরিয়ে দিলেন তিনি অমরেশকে। তাকেও প্রণাম করেছিলেন, অবাক হয়ে সে চেয়ে ছিল, তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে মুখ তুলে তিনি দেখেছিলেন অমরেশের গভীর কালো চোখদুটো, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি বুঝেছিলেন এরকম সুলক্ষণযুক্ত বালক তিনি কখনো দেখেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যের শেতলটুকু দিয়ে জয়প্রকাশ যখন একসময় মন্দিরে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে এলেন, তখন চায়ের দোকানের জটলাটা অনেক ফিকে হয়ে এসেছে।
গুমোট গরম, এদিকে ট্রেনটা ছাড়বার নাম নেই; রাইট টাইম পেরিয়ে তিনমিনিট হয়ে গেল, এখনো বাবুর গতর নড়ল না। হাঁসফাঁস করতে করতে অমরেশ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল, আলোঝলমলে হাওড়া স্টেশন, ব্যস্ত প্ল্যাটফর্মগুলোয় সন্ধ্যের ভিড়। হঠাৎ হর্ন বাজিয়ে ট্রেনটা নড়ে উঠল, আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোতে লাগলো, এইসময় অমরেশের বুকপকেটে ফোনটা বেজে উঠল, ফোনটা বের করে হাতে নিয়ে দেখল রীতা, ধরল, কানে লাগিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে বলল — হ্যালো!
অমরেশের দৃষ্টিকে বাধা দিয়ে পাশের লাইনে আস্তে আস্তে একটা ট্রেন হাওড়া ঢুকতে লাগল, লেডিজ স্পেশাল। কামরার একটা লোক জিভে জল এসে যাওয়ার মতন শব্দ করল — উরেশ্লা!
ওদিক থেকে রীতা — হ্যালো, ট্রেন পেয়েছ?
অমরেশ হাঁ করে লেডিজ স্পেশালটার দিকে তাকিয়ে — হ্যাঁ, উঠেছি। এই হাওড়া ছাড়ল।
— কাকা কী বলল?
একটার পর একটা অচেনা নারীমুখ, লেডিজ স্পেশালটার জানলায়, তার মধ্যে বেছে বেছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় শারীরিক গঠনগুলো স্মৃতিতে ধরে রাখতে রাখতে অন্যমনস্কভাবে অমরেশ — হ্যাঁ বলল, ঐ —
— কী বলল?
বিরক্তভাবে — আরে রাখো এখন, আওয়াজে কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না, গিয়ে বলছি, হ্যাঁ।
ফোনটা কাটতে কাটতেই অমরেশ দেখল লেডিজ স্পেশালটা পেরিয়ে গেল, প্ল্যাটফর্ম ফুরিয়ে গেছে আগেই, এখন কেবল কারশেডের অন্ধকার পড়ে।
— দ্যাখ অমরেশ, লোক কম, এটাই প্রবলেম দলের, ফলে ঠিক করে কাজ করতে পারলে কিন্তু অনেক স্কোপ আছে, ভালো প্রসপেক্ট আছে, অতএব নেমে পড়।
কাকার কথাটা মনে পড়ল, নেমে পড়তে হবে, কাকাও নেমেই পড়েছে, চালু মাল বটে! সারাদিন রোদে রোদে ঘোরার পর অমরেশের চোখদুটো ধরে আসছিল, সেই কোন সকালে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, কাকার সঙ্গে দেখা করতে গেছিল আজ। — চুরুটটা ছেড়ে এটা ধরেছি বুঝলি, ইটস অলওয়েজ গুড টু চেঞ্জ — সোফাটায় গা এলিয়ে বসে চশমা চোখে কাকা আয়েশ করে সিগারেটের ধোঁয়াটা ছাড়তে ছাড়তে বলেছিলেন — দ্যাখ লড়াইটা কার সঙ্গে এটা বুঝতে হবে। এত গণতন্ত্র সেকুলারিজম মারিয়ে আজ স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে কী পেয়েছি আমরা? — একটু কাত হয়ে সামনে কাঁচের টেবিলটার ওপরে রাখা অ্যাশট্রেতে ছাই ঝেড়ে — কী পেয়েছি বল? — আবার সোফায় হেলান দিয়ে — কমিউনিস্টদের দিয়ে তো হল না, ভেবেছিলাম তারা মানুষের জন্যে কাজ করবে, তো তারা পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন, ফলে আমি কী করব? হিন্দুত্ববাদীরাই আজ মানুষের সঙ্গে আছে, আমাকে তাদের সাথেই তো কাঁধে কাঁধ মেলাতে হবে, তাই না?
অমরেশ স্রেফ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ঢক করে মাথা নেড়ে বলেছিল — অবশ্যই।
কাকা সোজা হয়ে বসে সোনালী ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে বললেন — তুই কী যেন করছিস এখন?
— ঐ তো এসপ্ল্যানেডে একটা জামাকাপড়ের দোকানে সেলসজব। দ্যাখো — অমরেশ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে — তুমি স্রেফ আমায় একটু লাইন করে দাও। আমি বাকীটা খেটে করে নেব। এই চাকরিতে আর চলছে না।
কাকা একটু চিন্তিতমুখে — দেখছি, হয়ে যাবে তোর, তুই গিয়ে দেখা কর অমুকের সঙ্গে, তোদের এলাকাতেই কাজ শুরু কর তুই।
— বেশি বাতেলা মেরো না মফিজুলদা, বাংলাদেশে পাকিস্তানে গিয়ে দেখো না ক'টা হিন্দু তোমাদের মতো থাকতে পারছে? ভালো আছ তো, তাই বেশি কথা তোমাদের! — অনেকক্ষণের চিড়বিড়ানি রাগটা উগরে দিল অমরেশ, রবিবারের সন্ধ্যে এখনো অনেকখানি বাকি।
— কি বললি, বল আরেকবার তুই, এইখানে বাস করছি আজ এতগুলো বছর, তোকে তখন চেয়ারের ওপর টুল দিয়ে বসাতে হত, নইলে চুল কাটা যেত না, সেই তখন থেকে চুল কাটছি রে হারামি! এখন বলিস 'কথা তোমাদের'? — মফিজুল আগুন হয়ে বলল। মুহূর্তের মধ্যে চায়ের দোকানের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল, একজন ব্যাঁকা গলায় বলল — অত মাথাগরম করার আর কি আছে মফিজুলদা? মহরমে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়, কাকে মারবে কাকে কাটবে বোঝা দায়, তাতে কি আমরা মাথা গরম করেছি?
— থাকো সব এখানে আর মন পড়ে পাকিস্তানে।
এতগুলো লোকের সামনে অপমানিত হয়ে মফিজুল ফুঁসতে ফুঁসতে হিংস্রস্বরে বলল — এই তোদের সবক'টাকে দেখে নেব, দ্যাখ! আমরা মরে গেছি ভেবেছিস, ছেড়ে দেব? দু'পা এগিয়ে এসে অমরেশের সামনে আঙুল তুলে — ছেড়ে দেব না।
— ওঃ, শাসাচ্ছ! মারবে? মারো না, এসো, মারো! — অমরেশও এগিয়ে আসে দু'পা।
— এই এই বোস অমরেশ, বাড়ি যাও বাড়ি যাও মফিজুলদা — একটা হাতাহাতি হতে হতে বেঁচে যায় সেদিন। মফিজুল চলে যাবার পরে একটু স্তিমিত হয়ে আসে যেন আড্ডাটা। হঠাৎ জয়প্রকাশকে মন্দিরে আসতে দেখে কে একটা খোরাকের গলায় বলে — এই এই পুরুতমশাই। সকলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল — ব্যোমকালী! পুজো সেরে জয়প্রকাশ যখন বেরোলেন মন্দির থেকে, তাঁর পাশে সাইকেল নিয়ে এসে থামল অমরেশ।
— চলো ওঠো, আমিও বাড়ি যাব।
মৃদু হেসে — আমি বসতে পারব না রে!
— আরে ওঠো না! — অমরেশ তাড়া লাগায়।
জয়প্রকাশ একটু কসরত করে উঠে পড়েন সামনের রডে, অমরেশ প্যাডেল করতে শুরু করে।
জয়প্রকাশ বিড়বিড় করে বলেন — তুই বড় রোগা হয়ে গেছিস বাবা!
অমরেশ কোনো উত্তর দেয়না।
— ঠিক করে খাবি দুবেলা। আর খাবিই বা কী, সবই ভেজাল শুনি! — জয়প্রকাশ বকবক করতে থাকেন — আমাদের সময়ে তবু ভালো জিনিস পাওয়া যেত। খাঁটি দুধ, সে তো চোখেই দেখিনি কতদিন। সব কেমন পাল্টে গেল।
অমরেশ বাঁকের মাথায় বেল বাজিয়ে একটা রিকশাকে পাশ কাটায়।
— হ্যাঁরে কাগজে পড়লাম এনারসি হবে এনারসি হবে বলছে লোকে, এইটা সত্যিই হবে এখানে?
অমরেশ দম নিতে নিতে একবার শুধু বলল — চুপ করে বসো।
খবরের কাগজ পড়ে জয়প্রকাশ যেটুকু বোঝেন, খুব বেশি বোঝেন না তিনি, তবু তাতে তাঁর মনে হয় এই দেশ যেন একটা আস্তাবলের মতো, কেবলই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় মাঝে মাঝে আর আগুনে পুড়তে পুড়তে মানুষ যখন চিৎকার করে, তখন যারা আগুন ধরিয়েছিল তাদের খুঁজে পাওয়া যায়না কিছুতেই।
সপ্তাখানেক পরে একদিন সন্ধ্যে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি, রাত্তিরে বাড়ি ফিরে অমরেশ বউকে বলল — আঃ আজকে চটপট খেয়ে শুয়ে পড়ব বুঝলে? হেবি ওয়েদার! রীতা একগাল হেসে — খিচুড়ি বসিয়েছি, সঙ্গে ডিমভাজা। তোমারটা পিঁয়াজ দিয়ে ভাজব না পিঁয়াজ ছাড়া? খাওয়া-দাওয়া সেরে রীতা এসে শোবার ঘরে ঢুকতেই অমরেশ খাট থেকে লাফিয়ে উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে। রীতা অবাক হয়ে বলল — কী? অমরেশ মিটিমিটি হেসে মুখে কিছু না বলে তার রঙচটা কাঁধব্যাগটা থেকে একটা দোমড়ানো-মোচড়ানো কালো ব্রা বের করে টিউবলাইটের আলোয় মেলে ধরল। রীতা হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরতে গেল — আরেঃ!
— পছন্দ?
— হেব্বি তো ডিজাইনটা, কত নিল?
— আরে ওসব ছাড়ো।
অমরেশ রীতাকে জড়িয়ে ধরে বলল — পরো না! তোমাকে মাইরি হেবি সেক্সি লাগবে।
রীতা আদুরে গলায় বলল — ও ও ও। তাই বাবুর আজ সকাল সকাল শুতে যাবার তাড়া? তা কতটা সেক্সি লাগবে শুনি? — বলে সে শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে ব্লাউজটা খুলে দিল, নতুন ব্রা-টা সময় নিয়ে পরল ধীরে ধীরে, পুরো সময়টা সে ম্যাগাজিনের মডেলদের থেকে টোকা কায়দায় ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইল অমরেশের দিকে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে অমরেশকে ছুঁলো। যখন ব্রা-টা দেখবার আর তত প্রয়োজন রইল না, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ক্রমশ দুজনে বিছানায় গিয়ে শুলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন দুজনে পাশাপাশি শুয়ে হাঁপাচ্ছে, অমরেশ খেয়াল করল বাইরে বৃষ্টিটা ধরেছে, গাছের পাতা থেকে টিপ টিপ করে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। অন্ধকারের ভেতর রীতা হঠাৎ জিগ্যেস করল — ওরা ধরবে না তো তোমায়?
অমরেশ চমকে উঠে বলল — কী?
— আমার সাইজ ওটা নয়।
অমরেশ চুপ করে রইল। সেলসম্যানের ইউনিফর্ম গায়ে লাট খাওয়া টপ আর কুর্তিগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতেই তার চোখে পড়েছিল এই চমৎকার ডিজাইনের দামী ব্রা-টা, চোখধাঁধানো জামাকাপড়ের দোকানটায় তখন বেশ ভিড়, গলার টাইটা একটু আলগা করে সাবধানে হিসেব কষেছিল সে, যদিও ঠিক সাইজটা খুঁজে পায়নি; সিসিটিভির নজর এড়িয়ে চট করে এটাকেই তুলে নিয়েছিল। একটা হিংস্র উল্লাস হয়েছিল তার মধ্যে সেইমুহূর্তে, একটা কিছু করতে পারার উল্লাস। যেন প্রতিশোধ নেওয়ার মত আনন্দ, যদিও সে জানেনা কার ওপর কিসের জন্যে।
— ঢ্যামনা! — অন্ধকারের ভেতর একটা শব্দের বিষে নীল হয়ে যেতে লাগল অমরেশের সারাশরীর।
আজ কিসের একটা ছুটি কিন্তু চায়ের দোকানে তত ভিড় নেই, সব হুল্লোড় অবনীডাক্তারের চেম্বারে, রোগী দেখা বন্ধ এখন কিন্তু ডাক্তারখানা খোলা, কেননা ধুন্ধুমার ওয়ানডে ম্যাচ চলছে। অবনীডাক্তার মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে তারিফের সুরে বলছেন — কীরকম বুদ্ধি করে টিভিটা লাগিয়েছি বলো হে — বলে ঘরের ভেতরে সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন।
— কে ব্যাট করছে রে প্রথম? — সনাতন রাস্তার ওপার থেকে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে।
— পাকিস্তান — এদিক থেকে উত্তর যায়।
অফস্টাম্পের বাইরে একটা বল ব্যাটের প্রায় কানা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল আর সমস্বরে ইসসসস বলে সবাই মাথায় হাত দেয়। অথবা উইকেট পড়লে উল্লাসে ফেটে পড়ে। পাড়ার ছেলেগুলো সারা বিকেল বল পিটিয়ে এসে জুটেছে ডাক্তারখানায়, তাদের চোখ টিভির পর্দায় স্থির আর তাদের ব্যাট-বল-উইকেটগুলো ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো দেয়ালের গায়ে একপাশে। চায়ের দোকানের আড্ডাধারীরাও ভিড় করেছে এই ছোট্ট ঘরটায়, অমরেশও রয়েছে। খেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু মদ্যপানও চলছে। কিন্তু আজ পাকিস্তান কী দুর্ধর্ষ খেলছে রে বাবা! একশ পেরিয়ে গেল এক উইকেটে। অবশেষে দুশো আটাত্তর রানে থামল পাকিস্তানের ইনিংস। টিভিতে ইনিংস ব্রেকে বিজ্ঞাপন দেখাতে শুরু করলে অবনীডাক্তার বললেন — আরে ইন্ডিয়া তুলে দেবে।
— টপ অর্ডার ভালো খেললে এ রান তো নস্যি।
তবুও কেউ কেউ একটু বেশি সাবধানী — ওদের অমুক পেসারটা কিন্তু পুরো বিষাক্ত বল করে!
জয়প্রকাশ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরে গিয়ে ঢোকেন, আজ কেউ ব্যোমকালী বলে চেঁচাল না, সবাই আজ ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত। জয়প্রকাশ পুজোয় বসেন, ওদিকে দ্বিতীয় ইনিংসের খেলা শুরু হয়ে গেছে। প্রথমেই একটা রান নিতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ওপেনারদের মধ্যে, ডাইরেক্ট থ্রো এবং আউট।
— ছ্যাঃ — বিরক্তি ঝরে পড়ল ঘরের ভেতর — কোনো মানে হয়?
আরেকটু খেলা এগোতেই কিন্তু বোঝা গেল দিনটা ইন্ডিয়ার নয় আজ। টপ অর্ডার ধসে পড়তেই চাপ এসে পড়ল মিডল অর্ডারের কাঁধে। ব্যাটসম্যানরা যেন সাবধানী হতে গিয়ে গুটিয়ে গেল; ওভারের পর ওভার যায়, কোনো বাউন্ডারী নেই। আস্কিং রেট বেড়ে চলেছে হুড়হুড় করে। পেসারদের বলের গতিও আজ সাংঘাতিক, দাঁত কিড়মিড় করে ঘরের ভেতর কে একজন বলল — চাচাভাইরা খুব গোশত ঠেসে মাঠে নেমেছে আজ! তবুও ত্রিশ ওভারের পর থেকে একটু টেনে খেলে একসময় স্কোর দাঁড়াল ছেচল্লিশ ওভারে দুশো একচল্লিশ। হাতে রয়েছে তিনটে উইকেট। ঝপঝপ করে দুটো উইকেট পড়ে শেষপর্যন্ত দরকার রইল পাঁচরান, দুটো বল বাকী। কিন্তু প্রথম বলটাতেই বোল্ড হয়ে গেল ইন্ডিয়ার লাস্ট ব্যাটসম্যান। ধুস! ঘরের ভেতর সকলে মুহ্যমান হয়ে পড়ল। কেউ উদাসভাবে বলল — নাঃ, আর হলো না। হঠাৎ এইসময় বাইরে হুসস করে তুবড়ি নাকি হাউইয়ের আওয়াজ হলো যেন, সবাই কানখাড়া করে বাজীর আওয়াজ শুনতে পেল, পটকা ফাটাচ্ছে কারা, অমরেশ শুনল। শালা! তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সে, তার চোখ লাল, ধরে ফেলেছে সে কোন পাড়া থেকে আসছে আওয়াজটা। ঘরের বাকীদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন হইহই করে উঠল, মাথায় আগুন জ্বলে গেছে তাদের পটকার আওয়াজে।
— এই চল তো, চল তো!
দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো ব্যাট-উইকেটগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল তারা। বেরিয়েই তাদের চোখে পড়ল 'সুহাসিনী মিষ্টান্ন ভান্ডার' পেরিয়ে কালীমন্দিরটা, মন্দিরে গিয়ে ঢুকল আগে। জয়প্রকাশ হতভম্ব হয়ে গেলেন প্রথমে এদের দেখে।
— দিন পুরুতমশাই! কপালে জম্পেশ করে টীকা লাগিয়ে দিন তো। বড়ো কাজে যাচ্ছি। শুয়োরের বাচ্চাগুলো পটকা ফাটাচ্ছে শালা!
জয়প্রকাশ অবাক হয়ে বললেন — কী? কী বলছ বাবা?
অমরেশ এগিয়ে এসে হিংস্র গলায় — আরে পাঁঠাবলি হবে, বুঝতে পারছ না? দাও দাও জব্বর দেখে মন্ত্র পড়ে দাও দেখি কেমন ক্ষমতা, নাকি এতদিন ফোর-টোয়েন্টিগিরি করে এসেছ?
ঠিক সেই মুহূর্তে জয়প্রকাশ সমস্তটা বুঝতে পারলেন, সমস্তটা; আর বুঝতে পারলেন এতদিন সত্যিই লোক ঠকিয়ে এসেছেন তিনি, ভগবান নামের যে ভাঁওতাবাজিটা তাঁর ভাত জুটিয়েছে এতদিন, তার চেয়ে কুৎসিত মিথ্যে আর কিছু হয় না। মুহূর্তের মধ্যে তিনি মন্দিরের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরলেন অমরেশের পা-দুটো, চোখ তাঁর জলে ভেসে যাচ্ছে, ঝাপসা দৃষ্টির ভেতর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পা-গুলো হাতড়ে হাতড়ে জড়িয়ে ধরতে ধরতে তিনি হাকুলিবিকুলি করতে থাকেন — ও বাবা, যাস না তোরা, ওরে আমি ভুল করেছি রে, নেই নেই কিচ্ছু নেই রে, আমি বুজরুক বাবা! যাস না রে, অমন কাজ করতে যাস না তোরা!
অমরেশ একটা লাথি মেরে গাড়িতে ধাক্কা খাওয়া নেড়ি কুকুরের মতো ছিটকে ফেলে দিল জয়প্রকাশকে, দাঁতে দাঁত ঘষে চিৎকার করে বলল — হট শালা নিমুরুদে! তারপর তারা সাঁইসাঁই করে হাতে ব্যাট আর উইকেটগুলো ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে গেল মন্দির থেকে। জয়প্রকাশ শূন্য মন্দিরে পড়ে রইলেন, একা।