কিন্তু যেখানেই ও গেছে জীবনকে আরও সহজ, আরও আকর্ষণীয়, আরও সুবাসিত করেছে। আর এটা কোনও সামান্য ব্যাপার নয়। ওর কাছে ছেড়ে আসা প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমাকে ভালো একটা দিন অতিবাহিত করার অনুভূতি দেয়। আমিও যদি জীবনকে ওরকম সহজ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতাম।
কখনও আমার মনে হত যদি আমি একটা মেয়ে হই, ওরই মতো, শুধু একটা আকর্ষণীয় যোনির মালকিন। কী দারুণ হত যদি কাজের জন্য কারুর যোনিটা লাগিয়ে নেয়া যেত আর ব্যবহার করা যেত কারুর মাথাটাকে, আনন্দের জন্য! সুখের প্রেমে পড়তে! যতটা সম্ভব আরও বেকার হয়ে উঠতে!
কুমিরের চামড়ার মতো পুরু একটা বোধ গড়ে তুলতে! আর যখন বুড়ো হব, সব আকর্ষণ হারিয়ে গেলে, তখন দরকার হলে শোবার জন্য একটা শরীর কিনতে। অথবা একটা কুকুর কিনে তাকে ট্রেনিং দেব কী কী করতে হবে। সময় এলে, মরে যাব, নগ্ন আর একা, কোনও অপরাধবোধ নেই, কোনও খেদ নেই, কোনও মনস্তাপ নেই...
নিসের সাথে বাইরে একটা গোটা দিন কাটানোর পর আমি এরকমই সব স্বপ্ন দেখতাম।
কী আনন্দেরই না হত ওর শরীরের কিছু অংশ চুরি করে আবার ওর হাতেই সেটা ফিরিয়ে দেওয়া গেলে, ঠিক যেন একটা জামার মতো খুলে গেছিল। অথবা অরেঞ্জ২১ কিংবা অভিনুর২২ পথে যতদূর যাওয়া যায় ওর সেই অংশের যদি সঙ্গী হওয়া যেত। একমাস কি দু মাস ধরে আমরা ঘুরে বেড়াতাম, যাযাবরের মতো, ওর আয়াসহীন আলস্যের উষ্ণতা পোহাতাম। ওর হাত আর পায়ের ওপর বসে অপেক্ষা করতাম, শুধু উপভোগ করতাম ওর উপভোগটাকে।
রাতে যখন আর ওর দেখা পাই না, আমি এলোমেলো ঘুরে বেড়াই, রাস্তার ধারের ছোটখাটো বার বা জঘন্য নাইটক্লাবগুলোতে ঢুকি, যেখানে মেয়েগুলো নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরে। কখনও, নিছক একঘেয়েমি থেকেই, ওদের মধ্যে একজনকে নিয়ে নিই, যদিও তাতে বিস্বাদ ছাড়া কিছুই নেই।
প্রায়ই বাড়ি ফিরে দেখি কোলেৎ তখনও জেগে, বাজার থেকে কার্লের এনে দেয়া সেই উদ্ভট জাপানি জামাটা পরে ঘুরঘুর করছে সারা বাড়ি। যেভাবেই হোক না কেন ওর জন্য একজোড়া পায়জামার টাকা আমরা জোগার করে উঠতে পারিনি। সাধারণত আমি ফিরে দেখতাম কোলেৎ টুকটাক কিছু খাচ্ছে। বেচারা, কার্লের ফেরার অপেক্ষায় জেগে আছে।
আমিও ওর সাথে বসে কিছু একটা খেতাম। এমনিই এলোমেলো কথা হত আমাদের। শুনবার মতো কথা ও কখনওই বলত না। ওর কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না, স্বপ্ন ছিল না, অভিলাষ ছিল না। ও ছিল একটা গোরুর মতো সন্তুষ্ট, চাকরের মতো বাধ্য, পুতুলের মতো আকর্ষণীয়। নির্বোধ নয়, কিন্তু বোবা।
একটা চারপেয়ে জানোয়ারের মতো বোবা। অন্যদিকে, নিস একেবারেই মাথামোটা নয়। হ্যাঁ, অলস। গর্হিত পাপের মতো অলস। যা নিয়েই ও কথা বলত আকর্ষক হত, এমনকী যদি বিষয়হীন কিছু নিয়েও বলত। যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে আমি সবচেয়ে মহার্ঘ বলে জানি তা হল মেধা দিয়ে কথা বলার ক্ষমতা।
প্রকৃত প্রস্তাবে, এ ধরনের কথা আমার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এটা জীবনে একটা অবদান রেখে যায়, যেখানে অন্যসব কথা, অর্থহীন দুর্বোধ্যতা টেনে তোলে, প্রাণশক্তি ক্ষইয়ে দেয়, সবকিছুকে নিষ্ফলা তুচ্ছ, অনর্থক করে দেয়। কিন্তু, কোলেৎ হল একমাত্র গবেট গর্দভ।
তুমি যখন ওকে ছোঁবে মনে হবে ঠান্ডা, নিঃসাড় একটা মাংস, জেলির মতো। ও যখন তোমার জন্য কফি ঢালবে তুমি ওর পাছা টিপে আদর করতেই পারো, কিন্তু তোমার মনে হবে একটা দরজার হাতলকে আদর করছ তুমি। ওর এই নিঃসাড় সতীত্বপনা একটা মানুষের থেকেও অনেক বেশি একটা জন্তুর মতো। দু পায়ের খাঁজ ও এমনভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রাখবে যেন কোনও বিপজ্জনক কিছু নয়, বরং নোংরা কিছু একটা ও আড়াল করছে। ফুটোটা ঢেকে বুক দুটো খোলা রেখে দেবে।
বাথরুমে এসে ও যদি আমাকে পেচ্ছাব করতে দ্যাখে, তাহলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাস্তবিক কেজো কথা বলতে থাকে আমার সাথে। একটা পুরুষ মানুষকে পেচ্ছাব করতে দেখে ওর কোনও উত্তেজনাই হয় না; একমাত্র ওর ওপরে চেপে ভেতরে পেচ্ছাব করে দিলেই ও উত্তেজিত হবে।
এক রাতে, বেশ দেরিই হয়েছে ফিরতে, এসে দেখি ঘরের চাবিটা নিয়ে বেরুতে ভুলে গেছি। জোরে জোরে ধাক্কা দিলাম দরজায়, কোনও উত্তর নেই। ভাবলাম আবার হয়তো ওর সেই গোবেচারা ভ্রমণে বেরিয়েছে।
মঁমার্তের দিকে ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়া আর কার্লকে ওর ফেরার পথে ধরা ছাড়া বাস্তবিক আর করার কিছুই ছিল না। ক্লিশির দিকে কিছুটা যেতেই ওর সাথে দেখা হয়ে গেল; আমি ওকে বললাম যে কোলেৎ মনে হয় খাঁচা খুলে ভেগেছে। বাড়ি ফিরে আমরা চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কোলেৎ কোথাওই ছিল না, ওর জিনিসপত্রও কিছুই নিয়ে যায়নি।
দেখে মনে হচ্ছিল বড়জোর কাছাকাছি হাঁটতে বেরিয়েছে। ওইদিন সকালেই কার্ল বলছিল, কোলেতের বয়েস হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্ল ওকে বিয়ে করে নেবে। ওদের উদ্ভট সব হাবভাব দেখে বেজায় হাসছিলাম আমি, কোলেৎ ছিল বেডরুমের জানলায়, আর কার্ল রান্নাঘরের জানলা দিয়ে, যাতে প্রতিবেশীরা সবাই শুনতে পায়, হেঁড়ে গলায় বলছিল, ‘‘বোনজুর, মাদাম উর্সেল, কেমন আছ তুমি আজ সকালে?’’
কার্ল এখন হতাশ। ও নিশ্চিত যে পুলিশ এসে কোলেৎকে নিয়ে গেছে। ‘‘ওরা এবার আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে,’’ ও বলল। ‘‘সব শেষ হয়ে গেল।’’
আমরা বেরিয়ে রাতভর খোঁজার সিদ্ধান্তই নিলাম। রাত তখন তিনটের মতো হবে। সারারাত খোলা থাকা কয়েকটা বার ছাড়া গোটা ক্লিশি তখন ঘুমে কাদা। গোমঁ প্যালেসের উলটো দিকে এক বেশ্যা তখনও তার গুটিকতক খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত। পিগেলের কাছে আমরা ভোররাতের একদল লুম্পেনের খপ্পরেও পড়লাম। সেই নাচঘরটাতে একবার উঁকি দিলাম, যেখানে আমাদের চেনা একটা মেয়ে কাজ করত; কিন্তু ততক্ষণে ওদের ডেরায় ঝাঁপ পড়ে গেছে। সাক্রে কয়্যেরের দিকে এঁকেবেঁকে উঠতে থাকলাম আমরা।
স্তিমিত হতে থাকা আলোকমালার দিকে চেয়ে ক্যাথিড্রালের নীচটায় একটু দাঁড়ালাম। রাতের প্যারিস আরও বড় হয়ে ওঠে। ওপর থেকে কোমল হয়ে আসে তার রোশনাই, চারদিকের নিষ্ঠুরতা আর নোংরামি কমতে থাকে। মঁমার্তের এখান থেকে, প্যারিস, রাতে সত্যিই জাদুকরী একটা কিছু; বিপুল এক রত্নপাথরের মতো একটা বাটির ফুটোতে শুয়ে থাকে সে।
ভোরের মঁমার্তের রূপ অবর্ণনীয় সুন্দর। একটা গোলাপি প্রভা নরম শাদা দেওয়াল ছাপিয়ে চলে যায়। নিরক্ত আকাশে দুর্দান্ত লাল আর নীলে আঁকা, বিরাট সেই বিজ্ঞাপন, যে টাটকা রঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এককথায় তা ইন্দ্রিয়পরায়ণ। হঠাৎই, টিলার ধার ঘেঁষে উঠে আসা একদল যুবতি সন্ন্যাসিনীর মুখোমুখি হলাম আমরা, যারা এতোটাই পবিত্র, প্রশান্ত, আর সৌম্য এবং সম্ভ্রম উদ্রেককারী যে আমাদের নিজেদেরই বড় অপ্রস্তুত বোধ হল।
আর দু পা এগোতেই নীচের খাড়া ঢাল বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে থাকা একপাল ছাগলের সামনে এসে পড়লাম; তাদের পেছনে ঢিমে তালে ল্যাদ খেতে খেতে একটা নিরেট গান্ডু এদিক-সেদিকে অদ্ভুতভাবে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে হেঁটে আসছে। পুরো পরিবেশটা ভীষণ ধীর, শান্ত; যেন চতুর্দশ শতকের এক সকাল।
সেদিন প্রায় সন্ধে অবধি আমরা ঘুমিয়ে কাটালাম। তখনও কোলেতের কোনও দেখা নেই, পুলিশও আসেনি।
পরদিন সকালে, বলা ভালো দুপুরের দিকে, দরজায় একটা ভীতিজনক টোকা। আমি আমার ঘরে, টাইপ করছিলাম। কার্ল দরজা খুলল। কোলেতের গলা শুনলাম, আর তারপরে একজন পুরুষের গলা।
একটু পরেই একজন মহিলার গলাও পেলাম। আমি টাইপ করে যাচ্ছি। জাস্ট কিচ্ছু না শোনার ভান করে যা মাথায় আসছিল লিখে যাচ্ছিলাম।
তখনই কার্ল এল, ত্রস্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেহারা। ‘‘ও কি ওর ঘড়ি ফেলে গেছে এখানে?’’ জিগ্যেস করল। ‘‘ওরা ঘড়িটার খোঁজে এসেছে।’’
‘‘কারা?’’ জানতে চাইলাম।
‘‘ওর মা এসেছে... লোকটা কে জানি না। টিকটিকি হতে পারে। একমিনিট আসবে, পরিচয় করিয়ে দিই তোমার সাথে?’’
কোলেতের মা, মাঝবয়েসিনীদের মধ্যে প্রকৃতই রূপসী, আকর্ষণীয়, রীতিমতো আলাদা করে চোখে পড়ে।
লোকটি, বেশ ভাবগম্ভীর আর ছিমছাম জামাকাপড় পরা, ব্যারিস্টারের মতো লাগছে। সবাই খুব নীচু স্বরে কথা বলছে, যেন একটু আগেই কেউ মারা গেছে এখানে।
তৎক্ষণাৎ আমার মনে হল আমার উপস্থিতি এখানে ফেলনা নয়।
‘‘আপনিও কি লেখক?’’ লোকটি বলল।
আমি বেশ নম্রভাবে বললাম, হ্যাঁ।
‘‘আপনি কি ফরাসিতে লেখেন?’’ উনি জিগ্যেস করলেন।
আমি তখন বেশ কৌশল করে, একটু তোষামোদি প্রত্যুত্তর দিই ওঁকে, আক্ষেপ করে বলি, যদিও পাঁচ-ছ বছর ফ্রান্সে রয়েছি এবং ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, এমনকী সময়ে সময়ে অনুবাদও করে থাকি, কিন্তু আমার স্বভাবসিদ্ধ অক্ষমতা এই অসাধারণ সুন্দর ভাষাটায় নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশ করার মতো দক্ষতা প্রকাশে বারবার আমায় নিবৃত্ত করে।
এই খটমট ভাষাকে সুষ্ঠুভাবে এবং বাক্পটুতার সাথে প্রকাশ করার জন্য যা যা শব্দগুচ্ছ আমার কাছে ছিল আমি তুলে আনলাম। মনে হচ্ছিল, যেন এটা সরাসরি লক্ষ্যবস্তুর ওপর গিয়ে পড়ছে।
কোলেতের মা তখন কার্লের টেবিলের ওপর ডাঁই করে রাখা বইগুলোর নাম পড়ছিলেন। কতকটা যেন আবেগতাড়িত হয়ে একটা বই তুলে উনি লোকটির হাতে দিলেন। ওটা ছিল প্রুস্তের নির্বাচিত রচনাবলীর শেষখণ্ড। ভদ্রলোক বইটার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নতুন চোখে কার্লকে দেখার জন্য তাকাল। বিশ্বাস না হওয়া খুব ক্ষণস্থায়ী একটা দৃষ্টি ছিল ওঁর মুখভঙ্গীতে।
কার্ল, কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল যে, আসলে ও একটা প্রবন্ধ লিখছিল মূলত প্রুস্তের অধিবিদ্যার সাথে ধর্মতত্ত্বের সম্পর্ক, বিশেষ করে হার্মিজ ত্রিসমেগিস্তাসের মতবাদ, যাঁর প্রতি প্রুস্তের একটা মুগ্ধতা ছিলই।
‘‘আচ্ছা, আচ্ছা,’’ অর্থপূর্ণভাবে উনি ভুরু তুলে বললেন। তারপর একটু কড়া চোখে যদিও পুরোপুরি অসম্মত নন, এরকমভাবে আমাদের দুজনের দিকেই তাকালেন।
‘‘আপনি যদি অনুগ্রহ করেন,’’ আমার দিকে ফিরে উনি বললেন, ‘‘আপনার বন্ধুর সাথে আমরা কি কিছুক্ষণ নিভৃতে কথা বলতে পারি?’’
‘‘ওহ্, নিশ্চয়ই,’’ বলে ঘরে ফিরে এসে আমার অসমাপ্ত লেখাটা আবার শুরু করলাম।
মনে হয়, কার্লের ঘরে ওরা মোটামুটি আধ ঘন্টা মতো ছিল। আমার লেখাটায় দশ পাতার মধ্যে আট পাতা জুড়েই আমি স্রেফ আজেবাজে বকে গেছি, ঝানু কোনও সুররিয়ালিস্টও এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝবে না; ইতিমধ্যে ওরা যাবার আগে আমার ঘরে এল বিদায় জানাতে। আমি কোলেৎকে শেষবারের মতো বিদায় জানালাম, যেন ও ছিল সেই অনাথ শিশু যাকে আমরা উদ্ধার করেছিলাম আর এখন যাকে আমরা নিরাপদ ও অক্ষত অবস্থায় তার দীর্ঘ-বিচ্ছিন্ন অভিভাবকদের হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছি। ঘড়িটা ওরা খুঁজে পেয়েছে কিনা সে খোঁজও নিলাম।
না, ওরা পায়নি, তবে ওদের আশা যে আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে পাব। বলল, এটা একজনের বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন।
ওরা বেরিয়ে গেলে দরজাটা বন্ধ করেই কার্ল একেবারে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ‘‘জো, জীবন বাঁচালে তুমি আমার। অথবা হয়তো প্রুস্ত মশাই বাঁচিয়েছেন। নইলে ওই বিটকেল জালি লোকটাও পটে যায়! মাইরি, ফরাসি সাহিত্য...
পুলিশও এখানে সাহিত্য মনস্ক, ভাবা যায়! তার ওপর তুমি একজন আমেরিকান — খ্যাতনামা লেখক, এটা আমাদের মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি চলে আসার পর উনি আমায় কী বললেন জানো?
ভদ্রলোক হচ্ছেন কোলেতের লিগাল গার্ডিয়ান। কোলেতের যখন পনেরো, এরকম সময়ে ও বাড়ি থেকে হঠাৎ পালিয়ে যায়। সে যাই হোক, উনি বললেন যে, উনি যদি আমায় কোর্টে নিয়ে যান তাহলে দশ বছরের জেল আমার পাকা। জিগ্যেস করলেন, সেটা আমার জানা আছে কিনা। বললাম হ্যাঁ। আমার মনে হয় উনি বেশ অবাক হয়েছেন দেখে যে আমি নিজেকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই করছি না। কিন্তু যেটা দেখে উনি সবথেকে বেশি অবাক হয়েছেন তা হল, আমরা দুজনেই লেখক। তুমি জানো লেখকদের প্রতি ফরাসিদের একটা বিরাট সম্মান আছে। একজন লেখক কখনও একটা ছিঁচকে গুন্ডা হতে পারে না। আমার মনে হয় উনি বোধহয় ভেবেছিলেন দুজন পাতি রেড ইন্ডিয়ান বা ব্ল্যাকমেলার দেখবেন এখানে এসে। কিন্তু তোমাকে দেখার পর ওর ভাবনা পালটাল। পরে আমাকে জিগ্যেস করছিল তুমি কী ধরনের বই লেখো, সেগুলোর মধ্যে কিছু অনুবাদ হয়েছে কিনা। আমি বলেছি তুমি একজন দার্শনিক, সেজন্যেই তোমার লেখা অনুবাদ করাটা বেশ কঠিন...’’
‘‘হার্মিজ ত্রিসমেগিস্তাস নিয়ে অদ্ভুত কথা বলেছ তুমি ওকে,’’ আমি বললাম, ‘‘কীভাবে ভাবলে এরকম একটা জিনিস?’’
‘‘আরে, আমি কিছুই ভাবিনি,’’ কার্ল বলল। ‘‘প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম, যা মাথায় এসেছে বলে গেছি... ও হ্যাঁ, ভালো কথা, আরেকটা যেটা ওর দারুণ লেগেছে সেটা হল ফাউস্ট — কেননা এটা ছিল জার্মানে। লরেন্স, ব্লেক, শেক্সপীয়র, এরকম বেশ কিছু ইংরিজি বইও ওখানে ছিল। বলতে পারো আমি ওকে প্রায় বলতেই শুনেছি, ‘এই লোকগুলো এত খারাপ লোক হতে পারে না। বাচ্চাটা কোনও বাজে লোকের খপ্পরেও পড়তে পারত’।’’
‘‘কিন্তু ওর মায়ের বক্তব্য কী ছিল?’’
‘‘ওহ্! তুমি ভালো করে দেখেছ ভদ্রমহিলাকে? শুধু সুন্দরীই নন, যাকে বলে স্বর্গীয়।
জো, আমি ওনার দিকে যখন তাকালাম তখনই প্রেমে পড়ে গেছি। গোটা সময়ে খুবই অল্প কথা বলেছেন উনি।
একদম শেষে বললেন : ‘মঁসিয়ে, আপনার বিরুদ্ধে আমরা পুলিশে কোনও অভিযোগ জানাচ্ছি না, শুধু একটাই শর্তে, আপনি আমাদের কথা দেবেন যে কোলেতের সাথে আপনি কখনও দেখা করবার চেষ্টা করবেন না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন?’ আমি ভালো করে শুনিইনি উনি কী বলছিলেন, পুরো বিহ্বল হয়েছিলাম। বাচ্চা ছেলের মতো মুখ লাল করে তোতলাচ্ছিলাম। যদি উনি বলতেন, ‘মঁসিয়ে, আপনি কি দয়া করে আমাদের সাথে পুলিশ স্টেশনে আসবেন?’ আমি হয়তো বলতাম, ‘নিশ্চয়ই, যা আপনার আদেশ।’ আমি তো ওনার হাতে চুমুই খেতে যাচ্ছিলাম প্রায়, কিন্তু পরে ভাবলাম এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কী পারফিউম লাগিয়েছিলেন খেয়াল করেছিলে? ওটা ছিল...’’ কার্ল একের পর এক পারফিউমের ব্র্যান্ডের নাম, তাদের মডেল নাম্বার বলে যাচ্ছে, যেন এতে আমার খুবই অভিভূত হওয়া উচিত। ‘‘ওহ্, আমি তো ভুলেই গেছি, তুমি তো আবার পারফিউমের ব্যাপারে কিছুই জানো না। শোনো, একমাত্র অ্যা্রিস্টোক্র্যাট মহিলারাই এরম পারফিউম ব্যবহার করে। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই কোনও অভিজাত ঘরের। ধুর! মায়ের সাথে না করে মেয়ের সাথে প্রেম করাটা বোকামি হল। যাক গে, এটা দিয়ে আমার বইয়ের লেখাটা শেষ করলে ভালোই হবে, কী বলো?’’
অবশ্যই ভালো সমাপ্তি, মনে মনে ভাবলাম। বস্তুত মাসখানেক বাদেই কার্ল গল্পটা লিখে ফেলল। যেটা ওর অন্যতম সেরা একটা লেখা। বিশেষ করে প্রুস্ত আর ফাউস্টের জায়গাটা তো অসাধারণ। যতদিন ধরে এটা ও লিখে গেছে, মায়ের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোলেতের কথা ও একেবারে ভুলেই গেছে।
যাই হোক, ইংরেজ মেয়েগুলোর মঞ্চে অবতরণের সাথে এই পর্বটিও শেষ হল, তারপরে আসছে মুদীখানার সেই মেয়েটা, যে ইংরিজি শেখার জন্য পাগল, তারপরে জেনি, এদের মাঝখানে সেই নাচঘরের মেয়ে, আর মাঝেমাঝে কাফে ওয়েপলারের ঠিক পেছনের কানাগলির একটা বেশ্যা — ওই জায়গাটাকে আমরা ওদের খদ্দের ধরার ফাঁদ বলেই চিনতাম, কারণ রাতে বাড়ি ফেরার পথে ওই সরু গলিটা কোনওমতে পেরোতে পারাটা ছিল রীতিমতো বিপদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচা।
আর তারপরে আসছে রিভলভারধারিণী নিদ্রাচারিণী। যে কিনা আমাদের দিন কয়েকের জন্য অনিশ্চিত উত্তেজনায় টানটান বেঁধে রেখেছিল।
একদিন খুব সকালে, সারারাত ধরে কোঁৎ কোঁৎ করে আলজেরিয়ান ওয়াইন গেলার পর, কার্ল হঠাৎ একটা ঝটিতি বেড়ানোর পরিকল্পনা উত্থাপন করল। আমার ঘরের দেওয়ালে ইউরোপের একটা বিরাট ম্যাপ টাঙানো ছিল, সেটাতে আমরা প্রায়ই খুব উত্তেজিতভাবে খুঁটিয়ে দেখতাম যে কত কম খরচে আমাদের ইচ্ছেমতো জায়গায় কতদূর আমরা যেতে পারি। প্রথমে ঠিক হল ব্রাসেলস যাব, কিন্তু পরে এই প্ল্যানটা বাতিল করা হল। দুজনেই একমত হলাম, বেলজিয়ানরা খুবই নীরস। যেখানে প্রায় একই খরচে আমরা লুক্সেমবুর্গ যেতে পারি। আমরা যথেষ্ট মাতাল হয়েই ছিলাম, লুক্সেমবুর্গকেই সকাল ছ’টায় যাবার মতো আদর্শ জায়গা বলে আমাদের মনে হল। ব্যাগপত্তর কিছুই গোছালাম না; আমাদের দুজনেরই নেওয়ার মতো দরকারি জিনিস বলতে ছিল টুথব্রাশ, ট্রেন ধরার তাড়াহুড়োয় যেটা নিতে আমরা ভুলে গেছি।
ক ঘন্টা বাদে আমরা বর্ডার পেরোলাম, তারপর গালা বার্নিশ করা, গদি আঁটা একটা ট্রেনে চেপে বসলাম যেটা আমাদেরকে অপেরা বুফর দেশে নিয়ে যাবে, যাকে দেখার জন্য আমি বড়োই উৎসুক। দুপুরের দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম, ঘুমঘুম একটা হতবুদ্ধিকর অবস্থায়। স্বদেশী ওয়াইনে গলা পরিষ্কার করে ভরপেট লাঞ্চ সেরে, তারপর সোজা বিছানায়। সন্ধে ছ’টা নাগাদ ঘুম ভাঙলে দুলকি চালে বাইরে হাঁটতে বেরোলাম।
শান্ত, ছড়ানো, সহজগম্য একটা জায়গা, সবখানে জার্মান মিউজিক বাজছে; লোকজনের মুখেচোখে গোরুর মতো এক পরম সুখী ছাপ।
স্নো হোয়াইটের সাথে বন্ধুত্ব হবার আগে সময়ই যেন কাটছিল না। স্নো হোয়াইট হল এখানকার স্টেশনের কাছের একটা ক্যাবারের প্রধানতম আকর্ষণ। লম্বা হলুদ চুল আর প্রাণময় একজোড়া নীল চোখের স্নো হোয়াইটের বয়েস মোটামুটি পঁয়ত্রিশ। মাত্র এক সপ্তাহ ধরে ও এখানে আছে আর এরমধ্যেই বেচারা বোর হতে শুরু করেছে। আমরা মদ খেলাম একসাথে, ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ ওয়ালজ ড্যান্স করলাম, অর্কেস্ট্রার দলকে ড্রিঙ্কে আপ্যায়নও করলাম, সবকিছু মিলে যেটা বিল এল সেটা অভাবনীয় এবং হাস্যকর। তারপর ওকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানালাম। ভালো একটা হোটেলে ঠিকঠাক ডিনারে মাথাপিছু খরচ পড়ল মোটামুটি সাত কি আট ফ্রাঙ্কের মতো। স্নো হোয়াইট, আদপে একজন স্যুইস, মুখ ফুটে পয়সাকড়ি সে চাইতে পারে না, অথবা হতে পারে খুব বেশিই ভদ্র। ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা — ঠিক সময়ে কাজে যাওয়া। আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বেরোলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। শহরের প্রান্ত বরাবর হাঁটতে হাঁটতে অচিরেই একটা বাঁধ দেখতে পেলাম সামনে, ওখানে দুজন মিলে ওকে জাপ্টে ধরে যা যা করবার করে ফেললাম। একটা ককটেল ড্রিঙ্কের মতো ও দুজনকেই নিল। বেশ মিনতি করে বলল সন্ধের পর যেন ওর সাথে অবশ্যই একবার দেখা করি; ওর এক বন্ধুর সাথে আমাদের পরিচয় করাবে যাকে আমাদের খুব পছন্দ হবে বলে ওর মনে হয়। ক্যাবারে অবধি ওর সঙ্গে এসে, শহরটাকে আরও ভালো ভাবে দেখার জন্য আমরা রওনা দিলাম।
ছোট একটা কাফেতে একজন বয়স্কা মহিলা জিথার বাজাচ্ছেন, আমরা ওয়াইন অর্ডার করেছি। জায়গাটা বেশ ঝিমোনো মনমরা, কিছুক্ষণের মধ্যেই চূড়ান্ত বোর হয়ে গেছি। যখন উঠতে যাব ঠিক এরকম সময়ে কাফের মালিক এসে ওর কার্ডটা দিয়ে বলল সে আশা করে আমরা নিশ্চয়ই আবার আসব। লোকটা যখন কথা বলছিল কার্ল তখন কার্ডটা আমার হাতে ধরিয়ে কনুই দিয়ে একটা খোঁচা দিল। পড়লাম কার্ডটা। জার্মানে লেখা আছে, ‘‘এখানে ইহুদি প্রবেশ নিষেধ’’। যদি পড়তাম ‘‘এখানে বার্গার পাওয়া যায় না,’’ আমার এতোটাও উদ্ভট লাগত না। লোকটার মুখের সামনে হেসে ফেললাম আমরা। ফরাসিতে, ওকে জিগ্যেস করলাম ইংরিজি বোঝে কিনা।
বলল হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, ‘‘একটা কথা বলি, যদিও আমি ইহুদি নই, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে আপনি একটা গাধা। আপনার আর কিছু নেই চিন্তাভাবনা করার মতো?
কোনও হুঁশই তো নেই আপনার... নিজের গুয়ের ওপরে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। বুঝলেন কী বললাম?’’ লোকটা পুরো ঘাবড়ে গিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এবারে কার্ল শুরু করল, ফ্রান্সে হলে একজন মস্তানের কাছে কার্ল এটার জন্য যথেষ্ট কদর পেত। ‘‘কে রে তুই ব্যাটা শুটকিমদন,’’ লোকটা এবার গলা চড়াতে শুরু করেছে। ‘‘আওয়াজ নীচে,’’ হুমকি দিয়ে কার্ল দু পা এগিয়ে গেল যেন গলা টিপে মেরেই ফেলবে বুড়ো ভামটাকে।
‘‘দুটো কথা শুনে রাখ : তুই একটা বোকচোদ, ফালতু।’’ আমাদের হাসির শব্দে লোকটা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে রইল। আমার মনে হয় ও হয়তো আমাদেরকে পাগল ভেবে থাকবে। মুখ খিঁচিয়ে লোকটাকে দেখে হাসতে হাসতে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। নেহাতই গর্দভ, মাথামোটা ছিল বুড়োটা, ফলে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ওর।
রাস্তায় একটু এগোতেই ঘুমচোখের এক পুলিশের দেখা পেলাম আমরা। কার্ল তার কাছে গিয়ে সসম্মানে ঝুঁকে হ্যাট খুলে তাকে অভিবাদন জানিয়ে ত্রুটিহীন জার্মানে জানাল যে আমরা কিছুক্ষণ আগেই ওই কাফে থেকে বেরিয়েছি যেখানে একটা বড়সড় মারপিট বেঁধেছে। কার্ল ওকে তাড়াতাড়ি যেতে বলল — কারণ এইখানে গলা নামিয়ে বলল, কাফের মালিকটা পুরো ক্ষেপে গেছে, মনে হয় কাউকে মারবে। অফিসারসুলভ আলস্যে কার্লকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুলিশ অফিসার কাফের দিকে রওনা দিলেন। রাস্তার কোণে একটা ক্যাব পেয়ে গেলাম আমরা; বিকেলে দেখে রাখা একটা বড় হোটেলের দিকে ওকে গাড়িটা চালাতে বললাম।
আমরা তিন দিন লুক্সেমবুর্গে কাটালাম, মনের সাধ মিটিয়ে মদ খেয়ে, জার্মানির অসাধারণ অর্কেস্ট্রা শুনে আর লোকজনের ম্যাদামারা, নির্বোধ জীবন দেখে, যে জীবনের থাকার কোনও মানেই নেই, বস্তুত গোরু ভেড়ার মতো ছাড়া তার অস্তিত্বও নেই কোনও। স্নো হোয়াইট ওর বন্ধুর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, ও লুক্সেমবুর্গেরই মেয়ে। মেয়েটা বামন। আমরা চীজ বানানো নিয়ে, সেলাইকর্ম নিয়ে, স্বদেশী নাচ নিয়ে, কোল মাইনিং নিয়ে, এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট নিয়ে, অভিজাত বড়লোকদের নিয়ে, মাঝেসাঝে হওয়া ওদের ছোটখাট অসুখবিসুখ এইসব নানান কিছু নিয়ে কথা বললাম। একদিন একটা গোটা বেলা আমরা পাফেন্ডালে কাটালাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন সেই উপত্যকায় হাজার বছরের শান্তি যেন তার প্রভাব বিছিয়ে রেখেছে। যেন ঈশ্বর খুঁজে বের করে রেখেছেন মানুষের জন্য একটা অভিজ্ঞান, যখন তার অনিবারণীয় রক্তপিপাসা শান্ত হবে, যখন সে কলহে বিবাদে ক্লান্ত, এইখানে সে শান্তি আর আরাম খুঁজে পাবে।
সত্যি বলতে কী, জায়গাটা বেশ সুন্দর। ছিমছাম গোছানো, বেশ নিশ্চিন্ত, লোকজনও হাসিখুশি, নম্র, ভদ্র।
তবু, কেমন যেন একটা পচা গন্ধ। একটা অচল অবস্থার গন্ধ। এখানকার লোকজন যে এত ভালো, যা আসলে নিষ্ক্রিয়তামূলক, যা তাদের চেতনার রোঁয়াগুলোকে আরও ভোঁতা করে দিচ্ছে।
রুটির কোন পিঠে মাখন লাগানো আছে তা জানার জন্য সবাই এখানে বড়ই উদ্গ্রীব। রুটিটা কিন্তু তারা বানাতে পারে না, তাতে মাখন লাগাতে পারে।
আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গেছি। এই থলথলে জায়গায় বেঁচে থাকার চেয়ে প্যারিসের একটা উকুন হয়ে মরাও মনে হয় শ্রেয়।
‘‘চলো ফিরে গিয়ে গনোরিয়া ফনোরিয়া কিছু একটা বাধানো যাক,’’ কার্লকে ওর জড়তা কাটাতে বেশ উত্তেজিত হয়ে আমি বললাম।
‘‘কী? কী বলছ?’’ জড়ানো চাপা গলায় কার্ল বলল।
‘‘হ্যাঁ,’’ আমি বললাম, ‘‘এবার চলো এখান থেকে, ফালতু জায়গা একটা।
লুক্সেমবুর্গ হল ব্রুকলিনের মতো। যত মজা তত বিষ। তারচেয়ে ক্লিশিতে ফিরি চলো, আবার হুল্লোড় করি। মুখ থেকে এখানকার বিটকেল স্বাদটা মুছতে হবে।’’
আমরা যখন প্যারিস পৌঁছলাম তখন প্রায় মাঝরাত। শিগগিরি খবরের কাগজের অফিসে গেলাম, আমাদের বন্ধু কিং যেখানে জুয়াড়ি কলামের দায়িত্ব সামলায়।
ওর থেকে আরও কিছু ফ্রাঙ্ক ধার নিয়ে আবার ছুট লাগালাম।
আমি এমন একটা মুডে ছিলাম যে সামনে আসা প্রথম বেশ্যাটাকেই তুলব। ‘‘ওর যা আছে, পাঁচড়া-ফাচড়া সব নেব,’’ ভাবছিলাম। ‘‘ভালো মতো একটা গনোরিয়া তো ইয়ার্কির জিনিস নয়।
লুক্সেমবুর্গের মাগীগুলো সব কেমন মাখন মাখন।’’
কার্ল নতুন করে আবার গনোরিয়া বাধাতে আগ্রহী নয়। ওর হ্যান্ডেলে এরমধ্যেই চুলকুনি শুরু হয়ে গেছে, আমাকে বলেছে ও। যদি সত্যিই এটা গনোরিয়া হয়, তাহলে কে দিল ওকে এটা, বের করার চেষ্টা করছে কার্ল।
‘‘আরে, তোমার যদি হয়েই থাকে তো আরেকবার হলে তো ক্ষতি নেই কোনও,’’ মহাফূর্তিতে বললাম। ‘‘ডবল গনোরিয়া বাধাও আর বিদেশে ছড়িয়ে দাও। গোটা ইউরোপে সংক্রমণ! মুমূর্ষু শান্তির চেয়ে ছোঁয়াচে যৌন রোগ ঢের ভালো। আমি এখন জানি কী সেই জিনিস যা পৃথিবীকে সভ্য করেছে : পাপ, ব্যাধি, চুরি, মিথ্যে কথা, লাম্পট্য। যাই বলো, যতোই সিফিলিস হোক ফরাসিরা কিন্তু সত্যিই দারুণ লোক।
আমাকে কখনও আর কোনও নিরপেক্ষ দেশে যেতে বলো না। আর কোনও গোরু কি মানুষ দেখতে বলো না।’’
এমন এক লঙ্কাবাটা সেক্স চেপেছিল আমার যে কোনও নানকেও রেপ করে দিতে পারি।
এরকম অবস্থায় আমরা সেই ছোট্ট নাচঘরটায় ঢুকে পড়ি, যেখানে আমাদের পরিচিত একটা মেয়ে থাকত। তখন সদ্য মাঝরাত পেরিয়েছে আর একটু মৌজের জন্য আমরা একেবারে হ্যাংলা হয়েছিলাম। বারে তিনটে কি চারটে বেশ্যা আর দু একজন মাতাল, ইংরিজি বলিয়ে অবশ্যই। ধুরানি খুব সম্ভবত। আমরা একটু নাচানাচি করলাম আর তারপরেই বেশ্যাগুলো আমাদের জ্বালাতে শুরু করল।
ফরাসি বারে পাব্লিকলি একজন যা করতে পারে তা আশ্চর্যের। একজন ফরাসি বেশ্যার কাছে ইংরিজিভাষী যেকোনও পুরুষ অথবা নারী, নিকৃষ্ট শ্রেণিবাচ্য। একটি ফরাসি মেয়ে কখনও বিদেশিদের জন্য শো’তে নিজেকে দাঁড় করাবার মতো নীচু কাজ করবে না, তারচেয়ে বরং কায়দাকানুন শিখিয়ে একটা সীলমাছকে সভ্য করা যাতে পারে।
আদ্রিয়েন, সেই নাচঘরের মেয়েটা, ড্রিঙ্কের জন্য বারে চলে এল। দু পা ছড়িয়ে একটা উঁচু টুলে ও বসেছিল। একহাতে ওর এক বন্ধুকে ধরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ওর পাশে। একটুবাদেই আমার হাত চলে গেল ওর জামার ওপর। এইভাবে ওর সাথে যখন খেলছি ও নেমে এল দাঁড় থেকে, আর আমার কাঁধে হাত রেখে চুপিসাড়ে আমার প্যান্টের চেন খুলে হাত নিয়ে এল বিচির ওপরে। মিউজিশিয়ানরা তখন ঢিমে তালে ওয়ালজ বাজাচ্ছে, চারপাশে নিভু নিভু আবছা আলো। আদ্রিয়েন আমাকে নিয়ে গেল ফ্লোরের দিকে, আমার প্যান্টের চেন হাট খোলা, শক্ত করে ধরে ও আমাকে একেবারে ফ্লোরের মাঝখানে নিয়ে এল যেখানে মুহূর্তের মধ্যে আমরা পুরো সার্ডিন মাছের মতো বাক্সবন্দী হয়ে গেলাম। ওখানটায় এত ভিড় যে স্পট থেকে আমরা সরতেই পারলাম না। আদ্রিয়েন আবার আমার খোলা চেনের কাছে এল, আমার ডান্ডাটা বের করে লাগিয়ে দিল ওর ফুটোর মুখে। এটা নিদারুণ যন্ত্রণা ছিল।
তার মাত্রা আরও বাড়াতে, ওর আরেক বন্ধু আমাদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল, খপ করে ধরে ফেলল আমার বাঁড়াটা। সেই মুহূর্তে আমার পক্ষে আর ধরে রাখা সম্ভব ছিল না — ফিনকি দিয়ে ওর হাতেই সব বেরিয়ে গেল।
স্রোতবাহিত আমরা যখন বারে ফিরে এলাম, কার্ল একটা মেয়ের কাছে গুটিসুটি মেরে এককোণে দাঁড়িয়ে, আর মেয়েটাকে মনে হচ্ছে মাটিতে নুয়ে পড়েছে একেবারে। বারের লোকটা দৃশ্যত বিরক্ত। ‘‘এটা মদ খাওয়ার জায়গা, কারুর বেডরুম না,’’ লোকটা বলছে। কার্ল ঢুলুঢুলু চোখে তাকাল, ওর মুখে তখন রুজ মাখা, টাই সরে গেছে, জামার বোতাম খোলা, চোখের ওপর চুল নেমে এসেছে। ‘‘এরা কেউ বেশ্যা নয়,’’ বিড়বিড় করে বলল, ‘‘এরা নিম্ফোম্যানিয়্যাক।’’
কার্ল ওর শার্টের পেছনটা টেনে টুলে বসতেই বেরিয়ে পড়ল সামনের খোলা চেন। মেয়েটা তখন কার্লের চেন লাগাতে বসল। তারপর হঠাৎই মত পালটে আবার টেনে খুলল, কার্লের ডান্ডাটা বের করে সামনে ঝুঁকে তাতে চুমু খেল। স্পষ্টতই, এটা সহ্যের সব সীমা পেরিয়ে গেছিল। গুটিগুটি পায়ে ম্যানেজার এসে বলে গেল হয় আমাদের ঠিকমতো আচরণ করতে হবে নইলে মারধোর পড়বে। মেয়েদের ওপর উনি যদিও রাগ দেখালেন না; শুধু একটু ধ্মক দিলেন ওদের, যেন এই এরা সব দুষ্টু বাচ্চাকাচ্চা।
আমরা তখুনই বেরোতে চাইছিলাম, কিন্তু আদ্রিয়েন বারবার করে জোর করে যাচ্ছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া অবধি যেন থেকে যাই।
আমাদের সাথে যেতে চায় বলল।
শেষমেশ যখন ক্যাব ডাকা হল এবং তাতে সবাই চেপে বসলাম দেখা গেল আমরা পাঁচজন রয়েছি। কার্ল একটা মেয়েকে নামিয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু সেটা কে তা ঠিক করতে পারল না। রাস্তায় আমরা স্যান্ডউইচ, চীজ, অলিভ আর ক’ বোতল ওয়াইন কেনার জন্য থামলাম।
‘‘কত টাকা পড়ে রয়েছে আমাদের কাছে দেখে মেয়েগুলোর মন ভেঙে যাবে,’’ কার্ল বলল।
‘‘ভালো হবে,’’ আমি বললাম, ‘‘আমাদের ফেলে ভাগবে হয়তো তখন। ভীষণ ক্লান্ত আমি। স্নান করে সোজা বিছানায়।’’
ফিরতে না ফিরতেই জামাকাপড় ছেড়ে আমি স্নানের দিকে চললাম। মেয়েগুলো রান্নাঘরে টেবিল সাজাচ্ছিল। আমি জাস্ট বাথটবে ঢুকে সাবান লাগাচ্ছি, এমন সময় আদ্রিয়েন আর আরেকটা মেয়ে বাথরুমে এল।
ওরা ঠিক করল যে ওরাও স্নান করবে। আদ্রিয়েন ঝট করে জামাকাপড় খুলে টাবে নেমে এল। অন্য মেয়েটিও জামা খুলে টাবের পাশে এসে দাঁড়াল। আদ্রিয়েন আর আমি মুখোমুখি বসেছিলাম, দুজনের পা পরস্পরের পায়ে জড়ানো। অন্য মেয়েটি টাবের ওপর ঝুঁকে আমার সঙ্গে খেলতে শুরু করল। আমি গরম জলে আরামে শুয়ে বাঁড়ার চারপাশে ওর সাবান মাখা হাতের নড়াচড়া নিতে থাকলাম। আদ্রিয়েন তখন নিজের ফুটো নিয়ে খেলছিল, যেন বলছিল — ‘‘ঠিক আছে, কিছুক্ষণ ওটা নিয়ে ওকে খেলতে দাও, সময় এলে তখন কিন্তু আমি কেড়ে নেব ওটা।’’
কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল একহাতে স্যান্ডউইচ আর একহাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে আমরা তিনজনেই টাবে রয়েছি। কার্ল দাড়ি কামাবে বলে ঠিক করেছে। ওর মেয়েটা বেসিনের ধারে বসে বসে গল্প করছে আর কচমচিয়ে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য মেয়েটা উঠে গিয়ে একবোতল রেড ওয়াইন নিয়ে ফিরে এল, আর আমাদের ঘাড়ের ওপর ঢেলে দিল। বাথটাবের সাবান মাখা জল মুহূর্তে পারম্যাংগানেটের রঙ হয়ে গেল।
এ সময় আমার যেকোনও কিছু করতেই ইচ্ছে করছিল।
মনে হল পেচ্ছাব করার ইচ্ছে হচ্ছে। শান্ত নির্বিকারভাবে পেচ্ছাব করতে লাগলাম। মেয়েগুলো এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। স্পষ্টতই আমি এমন কাজ করেছি যা ঠিক নয়। এবারে হঠাৎ করেই ওরা আমাদের ওপর সন্দিহান হয়ে উঠল। আদৌ আমরা ওদের পয়সাকড়ি দেব তো? যদি দিই, কত? কার্ল যখন সোল্লাসে জানাল ওর কাছে ভাগ করে দেবার মতো তিন ফ্রাঙ্ক রয়েছে তখন একটা মহা শোরগোল পড়ে গেল। তারপর ওদের মনে হল, আমরা মস্করা করছি — বাথটাবে পেচ্ছাব করার মতো এটাও নেহাতই একটা ছেঁদো মজা। কিন্তু না, কাতরভাবে জানালাম যে সত্যিই টাকা নেই। ওরা দিব্যি কেটে বলল এরকম ওরা কখনও শোনেনি; এটা অবিশ্বাস্য, ভয়ঙ্কর, অমানবিক।
‘‘জংলি হূণ এই লোকদুটো,’’ একটা মেয়ে বলল।
‘‘উঁহু, ইংরেজ। অসভ্য ইংরেজ,’’ অন্য মেয়েটি বলল।
আদ্রিয়েন আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ওদের ক্ষোভ মেটাতে। বলল, ও আমাদের অনেকদিন ধরে চেনে আর আমরা ওর সাথে সবসময়েই ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করেছি; ওর সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরনটা ভেবে কথাটা আমার কানে অদ্ভুত এক ঘোষণার মতো শোনাল। যাই হোক, ওর কাজের জন্য বরাবরই ওকে নগদে টাকা দিয়ে দিয়েছি, ভদ্রলোক শব্দটির এরচেয়ে বেশি তাৎপর্য নেই।
ও ভীষণভাবেই চেষ্টা করছিল পরিস্থিতিটাকে ঠিক করতে। আমি প্রায় ওর চিন্তা শুনতে পাচ্ছিলাম।
২১. অরেঞ্জ (Orange/Aurenja) : দক্ষিণপূর্ব ফ্রান্সের একটি অঞ্চল। প্রাদেশিক তথা আঞ্চলিক উচ্চারণে এই জায়গাটির নাম অরেঞ্জা বা অরেঞ্জো।
২২. অভিনু (Avignon) : দক্ষিণপূর্ব ফ্রান্সের একটি অঞ্চল।