অস্পষ্ট অন্ধকারে চোখে কাপড় বাঁধা লোকজন চলাফেরা করছে ঠোক্কর খাচ্ছে, চোট পেয়ে পড়ে যাচ্ছে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। ঠাহর করলে দেখা যায়, ঠিক কাপড় নয়, চোখের ওপর সেই পর্দায় টিভির এক খবরের চ্যানেল চলছে, সে অনুযায়ী লোকে হাসছে আর গালাগাল দিচ্ছে।
এক চক্ষুষ্মান এসে দাঁড়ায়। ধাক্কা খায়, সে আপত্তি জানালেও কেউ তা শুনতে পায় না। সে চেঁচিয়ে ওঠে -
— চোখে কাপড় কেন?
এই প্রশ্ন করলে উত্তর আসে অন্তরাল থেকে, কর্কশ গলা, সর্দিবসা।
— জাননা, মূর্খ! চোখে কাপড় বাঁধা আমাদের শাস্ত্রসম্মত পরম্পরা, চোখের জলেই তো জাতীয় পাখির বংশবিস্তার… আর, হ্যাঁ, অত প্রশ্ন কীসের, অ্যা? প্রশ্ন করছ কাকে? আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জিতে আসা নেতাকে? এত সাহস হয় কোথা থেকে? লেখাপড়া শিখেই এই কাল হল! এই কে কোথায় আছিস? কেটলি না ব্রুস লী! দেখিস তো বেশি পয়সা কড়ি ঢালিস না আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। রাজ্যের অকৃতজ্ঞের দল সব ঘোট পাকাচ্ছে!
তোমার চোখের কাপড় কোথায়? অবিশ্বাসী! অন্ধের দেশে চলাচল করতে গেলে চোখ থেকে কাপড় খসলেই ঠোক্কর লাগে। ঢি ঢি পড়ে যায় চতুর্দিকে। বিন্দুমাত্র সহবত শিক্ষা নেই, প্রশ্ন করতে শিখেছে শুধু! বলি — পেরেছে কেউ এর আগে প্রতিবেশী দেশে প্লেন উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গাছ ফেলে আসতে? সারা বিশ্বে?
— পারেনি। মানছি মহামহিম। এর আগে কোথাও শুনিনি কেউ পরীক্ষার উত্তরপত্রে বিষ্ঠাত্যাগ করে আস্ফালন করেছে বলে। নেহাৎ সত্যি সত্যি আর ইস্কুল কলেজে যান নি তাই এটা হতে পারে নি। তবে হ্যাঁ, আপনার বাকি আস্ফালন গুলো অনেকটা এমনই।
যেমন ধরেন ওই নোটবন্দী খেলা — পারবে? কোনও সুস্থ মাথার লোক (গাঁজা ফাঁজা না খেয়ে) ভাবতেও পারবে না যে এভাবেও টাইট দেওয়া যায় নিজের দেশের জনতাকে। আর যা কারণ ঠাউরালেন তাতে হেসে খুন হই আর কি। গোলাপী খেলনা নোটের ভেতর থেকে মাইক্রোচিপ অবধি খুঁজে পেল টিভি অ্যাঙ্কর (এমন অ্যাঙ্কর থাকলে ১৯১১ সালে হিমশৈল অবধি দৌড়ে পালাত, টাইটানিক দেখে, ধাক্কা মারা তো দূরস্থান)। আর সেই সরল গোলগাল ফুচকার মতো যুক্তি, যা কিনা ফুটো না করিলে তাতে হায় মশলা আলু বা টকজল কিছুই ঢোকে না, এমন দুর্দম, অনমনীয়। কী? না এতে জাল নোট আটকাবে - পাড়ার রঙিন ফোটোকপি দোকানদার অবধি হেসে খুন, এই নোট আবার জাল করতে হয় নাকি? এ তো এমিনিই এত জ্যালজ্যালে। আবার ধরেন, এতে নাকি টেরোরিজম চুপসে এই অ্যাত্তটুকুন হয়ে যাবে। তা তো কই…
— হয়েছেই, কি বলেন? তা হয়েছে তো বটেই, টেররিস্টরা তো সব মরে ভূত। আর সেই ভূতের উপদ্রবেই দেখি যেন জঙ্গীহানা বেড়ে গেল বেশ কয়েকগুণ। কে না জানে, জীবিতের চেয়ে ভূতের ক্ষমতা অনেক বেশি।
— কিন্তু কালো টাকা?
— দেখেছেন একটাও কালো টাকা সে দিনের পর থেকে? সব গোলাপী, বেগুনি, কচি কলাপাতা রঙ চারিদিকে যেন মরশুমি ফুল আলো করে বসে আছে চারিদিকে। কালো টাকা একটাও দেখলেন নাকি?
— কিন্তু কাজ পাচ্ছে না বেকারেরা, রোজগার নেই, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। এত সমস্যা চারিদিকে…
— তবে, এই তো বুঝেছ। কিন্তু সমস্যা কি নেই? আছে তো, দিব্যি আছে, কী করে রেখেছে দেশটাকে দেখেছ? সত্তর বছর ধরে এত ময়লা করে গেছে যে শৌচালয় বানাতেই পাঁচ বছর গেল। আর তাই ওই কাপড় বাঁধা আছে চোখে, যাতে খিদে তেষ্টা কষ্ট কিচ্ছু নাই। টিভি সারাক্ষণ।
আর কি বলব, ওই পাজী প্রতিবেশী সারাক্ষণ উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। আর ওই শালওলাগুলোর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, না পাথর মারবে সেনার ট্রাকে, তা তো তাকে জীপে বেঁধে ঘোরাতেই হয়, নয়ত শিক্ষা পাবে কোথায় সে? তার চোখ পেলেট গান দিয়ে অন্ধ করে দিলেই তো সে না খুঁজে পাবে পাথর আর না দেখতে পাবে আর্মির যানবাহন।
— কিন্তু, এ কথা তো সত্যি, যে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি উপত্যকার মানুষের জন্য...
— মাথাখারাপ নাকি? কে ওদের লেখাপড়া শেখাবে? চাকরী? ওদের? জানেন, কী ভয়ংকর ওরা, তাই একেবারে ঝাড়েবংশে নিকেশ না করলে শান্তি নেই। আর তাতে প্রতিবেশী বলছে কি না - অত্যাচার চলছে? আমার রাজ্যের ছেলে, তাকে আমি মেরে ফেলি কেটে ফেলি, অন্ধ করে দিই, তুই কে এ নিয়ে মাথা গলানর? তবে হ্যাঁ, দলছুট কেউ যদি পেটে বা গাড়িতে আর ডি এক্স নিয়ে আক্রমন করে তবে প্রতিবেশী দেশ কিন্তু পার পাবে না, এই আমি বলে রাখলুম।
— কিন্তু তা সত্ত্বেও এতগুলো লোক বেঘোরে মরে যাচ্ছে।
— মরবে না? আজ না হলে কাল মরত, নয়ত কয়েক বছর পর। তবে দেখলেন, এরে কয় মূর্খের, থুড়ি মুখের মতো জবাব। ওরা ৪০ জন সিপাই মেরেছে, আমাদের বায়ুসেনা রাত সাড়ে তিনটের সময় কুয়াশা ঢাকা উপত্যকা পেরিয়ে গিয়ে এক হাজার কেজি, বুঝলেন এ ক হা জা র কে জি… বোমা ফেলে এসেছি। বোঝ ব্যাটা! দ্যাখ কেমন লাগে। এইবার সব ভোটগুলো দিয়ে দিন দিকি টপাটপ। আমার হয়েছে যত জ্বালা। সেদিন ওই পাহাড়ের পাশে জঙ্গলে কী সুন্দর আবহাওয়া, দিনভর হাড়ভাঙা শুটিঙের পরিশ্রমের পর পনীর পাকোড়ায় কামড় দিয়েছি কি দিইনি, ওই খবর! ভালো লাগে বলুন? এখন এই শুটিঙ এর লোকজন তো আজ ছেড়ে দিলে কালও আসবে, কিন্তু এই সময়ে সব ছেড়েছুড়ে ওই নিয়ে পড়লে এই কাজটা আর হবে না, এর মধ্যে বিদেশভ্রমণ আছে, দেশে নির্বাচনী সভা আছে, অন্য বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং, আর তাছাড়া গীতাতেও বলা আছে আজকের কাজ আজ শেষ করো। তাছাড়া আমি গেলেও তো সিপাই দের লাশগুলো জ্যান্ত হবে না। কিন্তু দেখুন “কঢ়ি নিন্দা” তো করেওছি। করিনি?
— কিন্তু খামোখা এখন লোক মারামারি কেন শুরু হ’'ল তা তো মাথায় ঢুকছে না….
— তবে হ্যাঁ, চুপিচুপি বলি, কিছু একটা হোক এটা আমিও চাইছিলাম, কাউকে বলেছিলাম কি? কি জানি বাপু, সাতকাজে থাকি, সব কিছু মনেও থাকে না ঠিক। তবে সত্যি কথা বলতে কি, মরতে হলে ওই সিপাই গুলোই কিন্তু ভাল। মাইনেপত্তর কম, পেনশন ক্ষতিপূরণও কম। আফটার অল দিনের শেষে সব টাকাই তো দেশের টাকা, করদাতার টাকা। তারপর ধরেন কিনা মিলিটারি অথচ ঠিক মিলিটারি নয়। লোকে কিছু বললে এটা তো বলব একজন সামরিকের ক্ষতি হয় নি, ওরা তো হাফ-মিলিটারি! ভালোই হয়েছে কি বলেন, দিন কয়েক আগে ব্যাটারা আবার মামলাও করেছে - মাইনে বাড়াও বলে। ইল্লি আর কি! কোথা থেকে সব যে আসে গ্রাম গঞ্জের লোক সব। বলে কি না - প্লেনে করে নিয়ে চলো পোস্টিং এর জায়গায়। ডিউটি করতে এসেছে না বেড়াতে? আমি শালা এদিকে “জোশ কই” “জোশ কই” বলে হাঁক পাড়ছি তার সাতদিন আগে থেকে, সারা দেশের লোক ঘাটের মড়া তা নিয়ে টুইটারে ট্রেন্ডিং করে সারা ফেলে দিল আর যাকে ডেকে মরি, তারই কোনও পাত্তা নেই। নিন্দুকে বলে বটে আমরা সরকারে থাকলেই জঙ্গী-জোশ মাথাচাড়া দেয়, তা আমি কি ওদের থোড়াই ডেকেছি? ওরা নিজে থেকে আসে, একটু হৈ-হুল্লোড় করে যায়। এবার ভোটের বাজার তো…. তাই আর কি…
তা কেউ বলতে পারবে না ভাই, কাজে অবহেলা করেছি কখনও। যুদ্ধ শুরু করার আগেই কেমন টুক করে শান্তি পুরস্কার নিয়ে এলাম বিদেশ থেকে। এলেম নিয়ে আবার প্রশ্ন করেন কোন সাহসে?
— তা দেখলাম বটে। এই আজ বিদেশের পুরস্কার, কাল আবার জাম্বো যুবরাজকে আলিঙ্গন, পরদিন দলিত সাফাইকর্মীর সাফ করা পায়ে জল ঢাললেন এ কী আর জানিনা ভাবেন। এ ছাড়াও কীভাবে প্রতিটি নির্বাচনী সভায় বলছেন “সাবধান, এ সঙ্কট দেশের সঙ্কট, এ নিয়ে কিন্তু একটুও রাজনীতি নয়”। সব ঝোল কোলে টেনে খেলেন!
— তব্বে!! দেখলেন, তার পরেই কেমন খেলা ঘোরালাম। রাতের অন্ধকার। তায় কুয়াশা, হ্যাঁ এই সময়টাই তো হাতুড়ি মারার সময় যাবতীয় হাতুড়ের। কী যেন নাম, হ্যাঁ লেসার গাইডেড মিসাইল - যাতে কি না ঠিকঠাক নাম ঠিকানা আগে থেকে লিখে রেখে দিলে অন্ধ লোকও লাটাই বেঁধে লক্ষভেদ করে দেবে। তা ওরা দেখলেন কী চমৎকার করে দেখাল। আমি তো লাইভ দেখছিলাম এক একটা মিসাইল পড়ছে আর পাশে স্কোর বোর্ডে দেখাচ্ছে ৭৮ -৭৯ - ৮০…. শেষ অবধি ২৯৮ ছিল বোধ হয়, তা ওরা তিনশো বলে দিল, আহতদের হাসপাতাল অবধি যেতে যেতেও তো দু'জন আরও মারা যাবে।
— কিন্তু…..
— আর আপনি কোন হরিদাস পাল যে প্রমাণ চাইছেন? রাতারাতি সব জঙ্গীস্কুলের এর ধ্বংশস্তুপ আর মৃতদেহ সরিয়ে ফেলে দিনের আলো ফুটলে ওরা কি না দেখাচ্ছে কিছুই হয় নি? শুধু আখাম্বা গর্ত? ইয়ার্কি পেয়েছে? সব মিথ্যে? এরপর তো বলবেন গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি মিথ্যে? ময়ূরের চোখের জল মিথ্যে? যত্তসব।
— আর কী চমৎকার বললেন সেদিন “দেশ সুরক্ষিত হাতে আছে”! শুনে তাবড় সাহসী লোকেরও গলা শুকিয়ে গেছিল আর বোধ হয় রক্ষা পেল না দেশবাসী।
তবে বলছিলাম কি, একেবারে ওদের দেশে আক্রমনের আগে একটু কূটনীতি ফিতি করে আসতেন না হয়। যেমন ধরুন না কেন, আমার পাশের বাড়ির এক ত্যাঁদর বাচ্চা যদি আমায় রোজ একটা করে ঢিল মারে, আমি না হয় তাকে হাতে নাতে ধরে কান মুলে দেব, নয়ত ওদের বাড়ি বয়ে বলে আসব - বাচ্চা সামলাতে। তা বলে কথাবার্তা নেই ওদের বাড়ি তাক করে পাটকেল মারাটা কি অসভ্যতা নয়?
— আর প্রতিবেশী দেশের অসভ্যতা চোখে পড়ল না আপনার? আমাদের বলে কি না ভাঙা বিগ প্লেন নিয়ে লড়তে হচ্ছে যা এমনিতেই সাতটা উঠলে ছটা আস্ত নামে আর একটা সাতটুকরো হয়ে। আর ওরা ষোল নম্বর বের করে কোন সাহসে? লাইসেন্স অবধি দেখানর প্রয়োজন মনে করে না।
তা বাপু কিছু যুদ্ধ হল সেদিন একের পর এক ওদের প্লেন ভেঙে পড়ছে এদিকে ওদের একটা হেলিকপ্টার।
— হেলিকাপ্টারটা আমাদের না?
— তাহলে ওটা বোধ হয় এমনি এমনি পড়ে গেছে, ও নিয়ে একটা কথাও যেন না হয়?
— আর আমাদের পাইলট ধরা পড়েছে ওদের হাতে…
— অ্যাঁ? কে বলল?
— ভিডিও এসেছে। কী মার মেরেছে….
— ঈশ, মেরেছে? এত সাহস? দেখাচ্ছি মজা! কে কোথায় আছিস? কী যেন আন্তর্জাতিক কনভেনশন আছে দেখ কী লেখা আছে!
— ওটা তো যুদ্ধবন্দী নিয়ে, এখন কি যুদ্ধ চলছে?
— ও? আর এটা যুদ্ধ নয়? আমি অবশ্য যুদ্ধ টুদ্ধ চাইনি কিন্তু। আমরা “নন-মিলিটারি” আক্রমন করেছি প্রতিবেশী দেশে ঢুকে। তা সেটা কি যুদ্ধ? “নন-মিলিটারি” লেখাটা কে পড়বে? তোমার সেকুলার বাপ?
— না, তা কেন, সবাই বলছে কি না, তাই… আর এটাও বলছে আগের দিন গভীর রাতে না কি আপনি প্লেন দিয়ে গাছ ফেলেছেন শুধু…
— গাছ না হাতি, সব কটা চক্রান্ত। বিরোধীদের কচুকাটা করব। এইবার। পেয়েছি ব্যাটাকে। ছিড়ে খাব। কাঁচা খাব। না খাব না, বরং ছড়াব।
— শুনেছেন, ওই পাইলটকে ছেড়ে দেবে বলেছে শুনলাম যে
— আবার কী হল? সে কী? ছেড়ে দেবে বলেছে? অ্যাঁ একেবারে আস্ত ছেড়ে দেবে?
—চা খাওয়ান দেখিয়েছে ভিডিওতে। যাই বলুন পাইলটের কিন্তু হেব্বি সাহস!!
— দেখলে? কেমন ভয় পেয়ে গেছে? একবার বলেছি শুধু ছেড়ে দাও নয়ত ভাল হবে না, তাতেই ল্যাজেগোবরে! কিন্তু পাইলটকে সাহসী বলছ কোন মুখে? এ হে, এটা তো ঠিক হল না। বোধ হয় ছাড়বে না দেখ। আরে তুই প্যারাশ্যুট নিয়ে লাফিয়েছিস, তোকে লোকে ঢিল মারছে? চারটে লোককে মারবি তো? মরে ফরে গেলেই দেখতিস কী করে দিতাম, ছারখার হয়ে যেত সব। সব শালা প্ল্যান গুবলেট করে দেয়। আরে বাঁচবি কেন? মরে গেলে দেখতিস কত বড় স্টাচ্যু করতাম। সি ফেসিং, কত পাখি হাগত বলতো!
কেউ যদি একটা কথা শোনে, আমার কি, আমি ফকির মানুষ, রাফায়েল খাব মিগ হাগব। সুযোগ পেলে হাঁড়ির হাল করে দেব ফের। না হলে নয় চলেই যাব অন্য ভাই বেরাদরের কাছে। আমার আর কী!!