রাজনীতির খোলা ময়দান, ইন্টারনেটের খোলা রাজনৈতিক সিনেমা। এই নিয়ে আমরা একটি সিরিজ প্রকাশ করছি। খোলা ইন্টারনেটের রাজনৈতিক সিনেমাগুলি কী? কেমন হচ্ছে তারা? এই লেখাটি 'বামৈস্লামিক' বিষয়ক। সিনেমাটি সাম্প্রতিক। গুরুচণ্ডালি এবং লেট ৬৬এর যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত।
বামৈস্লামিক নামক শর্ট ফিল্মটি দেখার আগেই যেটা চমকপ্রদ, সেটা হল নামকরণ। আপাত-স্ববিরােধী এবং ভিন্ন মেরুর দুটি তত্ব, কীভাবে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হচ্ছে! কিন্তু, একটু পরেই বােঝা যায় ফিল্মটির প্রণেতাদের বক্তব্য। ডানপন্থী চিন্তা ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাদক ককটেলের প্রতি এক অবজ্ঞামিশ্রিত উপহাস । চরিত্ররা নিজের নিজের দলের মুখ, বাম আর ইসলামিকদের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে রাষ্ট্রবিরােধী ছায়া৷ ভারতের ইতিহাস কীভাবে 'বিজাতীয়'দের দ্বারা কর্তিত ও মর্দিত হয়েছে, সেই থিয়ােরীতে তারা নিঃসংশয়। এই অথিরবিজুরী সময়ে, যখন ইতিহাস বদলানাে একটা বিশেষ পন্থা, ‘পােস্ট-টুথ’ এর জমানা আগতপ্রায়, সেখানে, খুব সহজভাবে জাস্টিফাই করা হয়েছে ইতিহাস বিকৃতি, ইতিহাস বিচ্যুতির দোহাই দিয়ে। রাজনৈতিক দিক থেকে, এটি একটি খিল্লিমাত্র, কিন্ত এর উপস্থাপনা অনন্য। যে চরিত্ররা আজকের বিদ্বজন, যারা আজকের শাসকের কণ্ঠ ও বুদ্ধি, তাদের কুযুক্তির মধ্যেই রয়েছে বিদ্রুপের বীজ।
শুরুতেই আবহে আজানের সুর। গম্বুজ আর মিনার নিয়ে মুসলিম স্থাপত্য। অন্তত আমরা এই ছবি দেখার আগে তাই জানতাম। তারপর দেওয়া হয় ঐতিহাসিক কৈফিয়ত। মধ্য এশিয়ার সুদূর প্রান্তর থেকে বাবরের দিল্লি আক্রমণ। হিন্দু গরিমার সেখানেই অবসান। এইখানে পরিচালক, যুদ্ধে পরাজিত ও পলাতক ইব্রাহিম লােদীর সাথে আজকের ভারতের লৌহপুরুষের নামের অন্ত্যমিল খুঁজে পেয়েছেন এবং ঘােষণা করেছেন যে আজকের গেরুয়া-বিজয় সেদিনেরই প্রতিশােধ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া চীন - মঙ্গোলিয়ার সামীপ্য, যা কিনা নিশ্চিত ভাবেই বামেদের কুমতলবের দিকে নির্দেশ করে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, মহাগুরু যাদব, অকাট্য যুক্তিজাল বিস্তার করেন। কেজিবির এজেন্ট তাদের দূরপ্রসারী চিন্তার সূত্র ফাঁস করে দেন, আর ভারতভূখণ্ড যে আদিতে হিন্দুদের, এই তত্ত্ব ক্লিয়ার হয়ে যায়। শহর, প্রান্তর সবই, বাম-মদতে ইসলামীদের হাতে নাম পাল্টে ফেলে। বাবরি মসজিদ তৈরি হয়, যা কিনা পরিচালকের চোখে, ১৯৯২ সালে মুক্তি লাভ করে।
এর পর হাজির সুর শাহ - যাকে আমরা এতদিন শের শাহ বলে জানতাম। কিন্তু জানতাম না যে তিনিই হিন্দু রাগসঙ্গীতের জনক। পরে মুঘলরাই যে গভীর ষড়যন্ত্র করে এই কৃতিত্ব আত্মসাৎ করে তানসেনকে বিখ্যাত করে সেকথা জানা গেল। তাই হয়ে গেল আজানের মূল সুর। সুর শাহ র মৃত্যু ছিল এক পরিকল্পিত উগ্রবাদী অপারেশন। বাম চক্রান্ত এখানে ও ছিল, হিন্দু সভ্যতা কে অপদস্থ করতে। আর ছিল আজকের আইসিসের পূর্বজরা - সুর শাহ রাম (ভগবান) ভক্ত ছিলেন এবং বামৈস্লামিকদের হাতেই হত হন। তাঁর বংশধরই আজকের মূখ্য রাজপরিকর।
আগ্রা ছিল আসলে অগ্রদেশ, সেখানে যে তেজঃ মহল নামক মন্দির ছিল, শাহজাহানের হাতে সেটাই তাজমহলে রূপান্তরিত হয়। এর পেছনেও কেজিবি ছিল। স্থাপত্য হিসেবে ইসলামিক তকমা পেলেও, আসলে তাজমহল হিন্দুদেরই অবদান । এই নিয়ে গেরুয়া শাস্ত্রী বিশেষভাবে নিশ্চিত, কারণ, শিবলিঙ্গের সাথে মিনারের সাদৃশ্য। এদিকে ঔরঙ্গজেবের আমলে, পবিত্র কাশীকে। যে বেনারস নাম করে দেওয়া হয় আর বােকাদের নাম যে রামছাগল তা ‘রাম’ কে হেয় করার জন্যেই এটাও প্রতিষ্ঠিত । মহাভারতের গরিমা ধ্বংস করে, অর্জুনের তৈরী নলিনী দেবীর মন্দির ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়। এই পুরাে সময় বাম – কেজিবি জোট ওখানে সক্রিয় ছিল। তারাই মন্দির সংলগ্ন জলা বুজিয়ে রাস্তা বানিয়ে দেয়। এমনকী এর ওপর লেনিনমুর্তি নির্মাণও তাদের কীর্তি। লেনিনের মুখাবয়বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইসলামিক মুখটা গ্রাফিকালি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সব কীর্তি ফাঁস হয়ে গিয়ে, আজকের কমলা শাসকদলের মহাপুরুষদের হাত ধরে,। হিন্দুর বিজয় রথ চলেছে গড়গড়িয়ে, ধুলাে উড়িয়ে, বুক কাঁপিয়ে। হিমালয়ের শৃঙ্গ থেকে শিবের লিঙ্গ, পতপত করে উড়ছে নারাঙ্গবর্ণ ধজা। ছােট করে, এটাই সিনেমাটির উপজীব্য। পুরােটাই কাল্পনিক, ব্যাঙ্গাত্মক অর্থে বানানাে। জ্বলজ্বল করতে থাকা ডিফ্লেমার ও যেন দর্শকের দিয়ে চেয়ে মুচকি হাসে।
কিন্ত যেটা প্রণিধানযােগ্য, সেটা অন্য বিষয়। চলচ্চিত্রে রাজনীতির ভাষা নতুন নয়, সেটা হতে পারে ন্যারেটিভ কিম্বা ফর্মহীন চিত্রকল্প । পরিসর হতে পারে বৃহৎ বা সঙ্কুচিত । কিন্তু সফল। রাজনৈতীক ছবি সেটাই যেটা আঙ্গিকের মধ্যে বাধা পড়ে যায় না, সহজ কথায় মূল জায়গায় থেকেও টাইপকাস্ট হয়ে যায় না। বামৈস্লামিক সেই অর্থে এক ভিন্নধর্মী প্রয়াস। শ্বেতকেশ সমালােচক একে চ্যাংড়ামি বলে উড়িয়ে দেবে, ‘ভক্ত’রা গাল দেবে খুব, কিন্তু স্যাটায়ারের ছোঁয়াটা অগ্রাহ্য করতে পারবে না। বিশেষত, আজকের ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে, চারপাশের চলমান ঘটনার প্রবাহে, এর মিল খুজে বেড়াতে হয় না, দৈনিক পত্রিকার খবর থেকে এক যদৃচ্ছ চয়নই যথেষ্ট। পতাকার তিনটে রঙ মিলিয়ে গিয়ে একটা রঙ হয়ে যাচ্ছে, ওপরের রঙটা গ্রাস করে নিচ্ছে বাকীগুলাে, এমন সময় এটা একটা ক্ষীণ স্বর যদিও একটি সীমাবদ্ধ বৃত্তের মধ্যে, তবুও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ইতিহাসের গেরুয়ায়ন । স্বঘোষিত ঐতিহাসিকদের, স্বকপােলকল্পিত মতবাদের আস্ফালন। আরও যেটা দেখার, সেটা হল কৌশলী হাস্যরস, যা কি না আপাত ছ্যাবলামির মােড়কে, সপাট । চরিত্ররাও সুপরিকল্পিতভাবে সামগ্রিক বক্তব্যর সাথে মানানসই। যেমন যাদববংশীয় অধ্যাপক যে গােবলয়ের লােক, তার পােশাক, উচ্চারণ দেখে সন্দেহের অবকাশ থাকে না । হিন্দু ধর্মের তিনি ধজাধারী, তাই অহিন্দু কার্যকলাপের প্রচণ্ড সমালােচক। আজকের ভারতে, এই ধরনের বুদ্ধিজীবি প্রতিদিন দেখি টিভি চ্যানেলে । গলায় অবজ্ঞামিশ্রিত অভিমান, আর মুখে অজ্ঞাত বই এর রেফারেন্স। চশমার আড়ালে সবজান্তা ভাব স্পষ্ট আরও সুব্যক্ত চরিত্র হল কেজিবি এজেন্ট মিশকা মহীউদ্দীন নামের মধ্যে রুশ ছোঁয়া, কথা ় বার্তায় ‘গুরু' ভাব, ইতিহাসের গতিপথে সবকিছুতেই ওদের হাত, সব ঘটনার তারা নিয়ন্তা। ভারতভূমিতে হিন্দুতব খর্ব করেছে তারা যুগে যুগে । ইসলামিক ষড়যন্ত্রে এরাও অংশীদার । সহজভাবে শত্রুদের চিহ্নিত করা হল। আপাত অনুপস্থিত ন্যারেটিভের আড়ালে, রয়েছে ধর্ম আর রাজনৈতিক আনুগত্যের এক সরলরৈখিক অনমিতি। দেশপ্রেম আর গেরুয়া রঙের সর্বসমতা, যা প্রচারিত হচ্ছে আজকের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষ্যে, তার প্রতি ‘বামৈস্লামিক’ একটা চূড়ান্ত উপহাস। একবর্ণের ভারতবর্ষ সৃষ্টির যে চেষ্টা চলেছে, তার প্রতি এক কৌতুকমিশ্রিত দৃষ্টি । সিনেমা হিসেবেও এটা একটা আধুনিক ধারার পন্থী – কিছু বিছিন্ন ঘটনাকে চুটকি আর মিত্রাক্ষরের মধ্যে দিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। দেশের রাজা যদি এই ছবির ভাষা বুঝতে পারে তাহলে ৫০০ দিন হাজতবাস নিশ্চিত। আগাগােড়া, আবহসঙ্গীত অভিনব । শুধু শ্রুতি নয়, প্রয়ােগেও ছবির মর্মের সাথে সুসঙ্গত। আজানের সুর থেকে হিন্দুস্থানী ধ্রুপদ সবই জায়গামত ব্যবহৃত হয়েছে। পরিচালকের নিজের গলা খাপ খেয়ে গেছে স্পিরিটের সাথে । সব মিলিয়ে, রাজনৈতিক ছবি হিসেবে এটা অন্য ধরনের, শ্লেষ ও দ্ব্যর্থক শব্দপ্রয়ােগ, যেখানে সর্বত্র অন্তঃসলিলা ় সম্পাদনা যথাযত, সাড়ে সতেরাে মিনিটে মূল কথাটা বলা হয়ে যায়। অনর্থক জ্ঞানদা কথাবার্তা নেই, স্রেফ মজার ছলে বলা কথা। বিপ্রতীপে, একমাত্র বলা যেতে পারে একটা কেন্দ্রীয় কাঠামাে থাকলে ভালাে হতাে। একজন সূত্রধর, যে কিনা পুরাে প্রয়ােগটা এক গ্রন্থিতে বেঁধে রাখত। কিছু ক্ষেত্রে অভিঘাত হয়েতাে আরেকটু বেশী হতাে।
সবশেষে যেটা বলার, যে ব্যঙ্গের শৈলীটা একেবারেই নব্য-আধুনিক, এবং তাই অভিনব । মেদবর্জিত প্রযােজনা । এমন কথা যা অনেক মানুষের স্বার্থের সাথে যুক্ত, তা সহজ ভাবে বলার ক্ষেত্রে পুরাে নম্বর পাবে ‘বামৈস্লামিক'। রাজ্যে ও দেশে, শাসকদলের কীর্তিকলাপ আরও অনেক এই ধরনের প্রয়াসের নিশ্চয় সুযােগ করে দেবে। এইরকম স্বল্পদৈর্ঘ্য।অথচ স্পষ্ট প্রভাব রাখা ছবি, আরও দেখতে পেলে ভালই হবে ৷৷