ছেলেবেলার ঈদে হৈচৈ ছিল আনন্দের মূল উৎস। আব্বা মাদ্রাসা শিক্ষক হলেও ঈদে দামী পোশাক আমাদের দিতেন না। ঈদে নতুন লুঙ্গি পাঞ্জাবী পেতাম, তাও বড়ই সাদামাটা।
অন্য বন্ধুদের জিন্স দেখে মনে দুঃখ হয়। তখন পাঞ্জাবির এখনকার মতো নিত্য নতুন ডিজাইন ছিলনা। পোশাকের আনন্দ সেরকম না হলেও আমাদের আনন্দ ছিল মূলত বন্ধুদের সঙ্গে চাঁদ রাত থেকেই একসঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত হৈ হুল্লোড় আর বাজী পোড়ানো কেন্দ্রিক। এই ঈদেই আমরা স্বাধীন ভাবে অনেক রাত অবধি বাড়ির বাইরে কাটাতে পারতাম। বড়দের চোখ রাঙানি ছিলনা। পাসের গ্রামের সামসুল আলম সৌদি থাকতো। সে বড় সাইজের বাইনোকুলার এনে তা দিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করেছিল এক বছর। ঐ যন্ত্রটা একবার দেখার আনন্দ আজও অনুভব করি।
এই সব টুকটাক আনন্দের সঙ্গে আর একটি বিষয়ের জন্য ঐ দিনের অপেক্ষা সারা বছর করতাম। ওপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঢিলা ও বাজি যুদ্ধ ।
ঈদের দিন নামাজের পর কোলাকুলি করে মনে প্রচুর আনন্দ পেতাম। বড়দের কদমবুচি করে (পায়ে হাত দিয়ে হাতে চুমা, অনেকটা প্রণাম) নিজেকে শুদ্ধ মনে হত। তবে ঈদীর মত সচ্ছলতা আমাদের ছেলেবেলায় আসেনি। খাওয়া দাওয়া তখনও আমার তেমন আনন্দের উৎস ছিল না। এখনকার মত রকম রকমের পদ তখন ছিলনা। চালের আটার রুটি, সেমাই আর কষা মাংসই ঈদের পদ হিসেবে কমন ছিল। কখনো সখনো লাচ্ছাও হত।
নিজে যত বড় হলাম ছোটোবেলার আনন্দও তত কমতে লাগলো। আস্তে আস্তে জায়গা করে নিল রকমারি পদ। আমাদের আব্বা-চাচাদের নিয়ে যৌথ ঈদের খাওয়া চলে আসছে আমাদের ছোটোবেলা থেকেই। বেশ কয়েক বছর বড় হাঁড়িতে আমরা ভাইয়েরা ঈদের আগের রাতে যৌথ রান্না করতে শুরু করেছি।
গত বছর আমরা চারটি স্পেশাল পদ রেঁধেছিলাম। এই সুযোগে পরিবারের সদস্যদের সকলেই রান্না শেখার সুযোগ হয়ে যায়। আর খাওয়ার থেকে বানাবার মজাটাই আমাদের বেশি হয়। গতবারের চারটি পদ ছিল - দুধ ডিমের হালুয়া, কিমা কলিজা, ইষ্টু ও সীর কুরমা।
এবার কিন্তু অল্প সময়ে যোগার ঠিকমত না করতে পারায় মাত্র দুটি পদ রেঁধেছি। মূলত আমি ও আমার চাচাতো ভাই বরকত ঈদের রান্নার দায়িত্ব নিই। বরকত পড়াশোনা বেশি করে উঠতে পারেনি। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ও অনেক বছর কাজ করেছে। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফ্রি রান্নার কাজ করে। আসলে রান্নার বিষয়ে ওর একটা আবেগ কাজ করে। আমি ওর সহকারী হিসেবে কেনাকাটা থেকে ঈদের রান্না যায় খাওয়া অবধি থাকি। বড় দালানে বিছানা পেতে বাড়ির সকলে একসাথে খাওয়া দাওয়া হয়।
যত অন্য আনন্দ কমে আসছে আমরা তত খাওয়াকে আঁকড়ে ধরছি।
যেহেতু "সীর কুরমা" একেবারে নতুন পদ, বানাবার পদ্ধতি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।
#উপকরণ
১) দুধ ২কেজি
২) চিনি ২৫০গ্রাম (প্রয়োজনে কমবেশি করতে পারেন)
৩) চারুলী ৫০গ্রাম (এক বিশেষ বাদাম)
৪) পেস্তা ৫০গ্রাম
৫) কাজু ১০০ গ্রাম
৬) আলমন্ড ১০০ গ্রাম
৭) কিসমিস ৫০ গ্রাম
৮) খুরমা খেজুর ৫০গ্রাম
৯) কেসর ১/২ গ্রাম
১০) সেমাই ৫০ গ্রাম
১১) ঘি ৫০ গ্রাম
১২) এলাচ ৬-৭ পিস
#পদ্ধতি
প্রথমে কাজু ও আলমন্ড কুচি কুচি করে কেটে রাখুন।
খুরমা কুচিয়ে রাখুন।
কিসমিস জলে ভিজিয়ে রাখুন। একেবারে শেষে মেশাতে হবে। নাহলে দুধ কেটে যেতে পারে।
সমস্ত উপকরণ আলাদা আলাদা রাখবেন।
একটি হাঁড়িতে দুধ দিয়ে ফোটাতে দিন। কাঠের হাতা দিয়ে লাগাতার নাড়া দিতে থাকুন। এলাচ ফেলে দিন। দুধ ফুটে গেলে আঁচ কমিয়ে দিন যাতে দুধ উতলে না যায়। এবার ঐ দুধে কেশর দিয়ে দিন।
দুধ যখন কমে ১কেজি ৬০০গ্রাম মত হয়ে যাবে ওতে চারুলী দিয়ে দিন। এরপর ১০০গ্রাম কমলে কাজু পেস্তা আলমন্ড দিয়ে দিন। আরও ১০০ গ্রাম কমলে চিনি দিয়ে দিন। এই পুরো প্রক্রিয়া চলাকালে হাতা দিয়ে লাগাতার নাড়তে হবে। সর পড়া ও নিচে পুড়ে যাওয়া (ধরে যাওয়া) থেকে বাঁচতে। এবার কুচানো খুরমা দিয়ে দিন।
দুধ যখন ১৩০০গ্রাম হয়ে যাবে একটি কড়াইয়ে ঘি দিয়ে সেমাই কুচি করে ভেজে দুধে ঢেলে দিন।
লাগাতার নাড়াতে থাকুন।
এবার কিসমিস দিয়ে দিন।
কিছুটা কমলে নামিয়ে নিন। ইচ্ছে হলে কেসের সামান্য রেখে নামাবার সময় দিতে পারেন। ভালো ফ্লেবার পাবেন। স্বাভাবিক ঠান্ডা হলে পরিবেশন করুন । পরিবেশনের সময় কাজু পেস্তা পেষ্ট ছড়িয়ে দিতে পারেন। অনেকে ফ্রিজের ঠান্ডা "সীর কুরমা " পছন্দ করেন।
বানিয়ে খেয়ে ভালো লাগলে জানান!