সামরিক ক্রয়-বিক্রয়ের পরিভাষায় অফসেট শব্দটির অর্থ এক ধরনের ক্ষতিপূরণ। মোট কাজের একটা অংশ এই ক্ষতিপূরণ বাবদ যন্ত্রাংশ নির্মাতা সংস্থা দিয়ে থাকে ক্রেতা দেশের কারিগরি উন্নতিকল্পে। আরও বিস্তারিতভাবে বললে, এ-ক্ষেত্রে প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ এই ক্ষেত্রে লভ্যাংশ বিনিয়োগ করে, যাতে উপভোক্তা দেশ সেই যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে। বহু দেশই সামরিক ক্ষেত্রে এই ধরনের অফসেট চুক্তি করে। অফসেটের পরিমাণ দেশভেদে বদলে যায়।
২০০৫ সালে ইউপিএ সরকার ডিফেন্স প্রোকিয়োরমেন্ট প্রসিডিয়োর (ডিপিপি) বা প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত বিধিতে নতুন সংশোধনী এনে, ভবিষ্যতে উচ্চপ্রযুক্তির অস্ত্র বা বিমান কেনাবেচায় মোটা অঙ্কের মূলধন খরচের ক্ষেত্রে অফসেট পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৭-এ মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফটের কেনার টেন্ডার ঘোষণার সময়ে ৫০ শতাংশ অফসেটের কথা বলা হয়েছিল। মোদীর নতুন চুক্তিতেও এই অর্ধেক অফসেটের কথাই বলা হয়েছে।
অর্থাৎ নতুন বিল অনুসারে দ্যসল্ট অ্যাভিয়েশন মোট চুক্তিমূল্যের অর্ধেক বিনিয়োগ করবে। ভারতীয় মূল্যে তার পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ ডিপিপি অনুসারী। এই কারণে মূল নির্মাতা দেশকে (এ-ক্ষেত্রে ফ্রান্স) একজন অফসেট পার্টনার খুঁজে নিতে হবে। ডিপিপি অনুযায়ী এই পার্টনারের ব্যাবসায়িক অস্তিত্ব ও নির্মাণ অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।
২০০৭-এ স্থির হয়েছিল, যে-সংস্থাই বরাত পাক, হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডকেই অফসেট পার্টনার হিসেবে নিতে হবে। মোদীর চুক্তিতে বাদ পড়ল এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নাম। বদলে দ্যসল্ট পার্টনার হিসেবে বেছে নিল রিলায়েন্স অ্যারোস্ট্রাকচার লিমিটেড নামক সংস্থাকে। এই সংস্থা অনিল অম্বানীর সংস্থা রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড-এর ভরতুকিভোগী। এই দুই সংস্থার যৌথতায় তৈরি হল দ্যসল্ট রিলায়েন্স অ্যারোস্পেস লিমিটেড।
এখানে আরেকবার স্মর্তব্য, রিলায়েন্স অ্যারোস্ট্রাকচার লিমিটেড তৈরি হয়েছিল চুক্তি সম্পাদনার দু-সপ্তাহ আগে। অর্থাৎ ডিপিপি সনদের অভিজ্ঞতার বিষয়টি এখানে লঙ্ঘিত হল। রাফাল যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন রিলায়েন্স অ্যারোস্ট্রাকচার লিমিটেড নামক সংস্থার অস্তিত্ব ছিল শুধু কাগজে-কলমে!
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শুধু রিলায়েন্স অ্যারোস্ট্রাকচার লিমিটেডই নয়, অনিল অম্বানী রাতারাতি খাড়া করেছে রিলায়েন্স ডিফেন্স সিস্টেম লিমিটেড নামক একটি সংস্থা। এই সংস্থাটি যৌথভাবে কাজ করবে থালেস নামক একটি ফরাসি সংস্থার সঙ্গে। থালে রাডার-সহ এই ধরনের নানা যন্ত্রাংশ বানায়। বলাই বাহুল্য, এ-কাজেও অনিলের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এই সূক্ষ্ম কারিগরি দক্ষতা তো দূরের কথা, অনিলের সংস্থার কোনও সামরিক জিনিস তৈরি করারই অভিজ্ঞতা নেই!
রাফাল অফসেট পরিকল্পনার চারটি দিক রয়েছে। দ্যসল্ট মূল বিমানের য্ন্ত্রাংশগুলি তৈরি করবে। রাডার-সহ আনুষঙ্গিক য্ন্ত্রপাতি তৈরি করবে থালেস। রাফালের ইঞ্জিনটি তৈরির দায়িত্বে রয়েছে স্যাফরন এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনস। মিসাইল সরবরাহের দায়িত্বে থাকবে এমবিডিএ নামক সংস্থা। এই চার সংস্থার মোট অফসেট ব্যয় নীচে দেখানো হল—
দ্যসল্ট: ১৫ হাজার কোটি টাকা
থালেস: সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা
স্যাফরন: সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা
এমবিডিএ: ৩ হাজার কোটি টাকা
অর্থাৎ সর্বমোট অফসেট মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে অনিল অম্বানীর হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা দুই সংস্থাকে ফরাসি সংস্থা দ্যসল্ট ও থালেস এই আনুমানিক ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাইয়ে দিচ্ছে অফসেটের দরুন। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানানো জরুরি, নরেন্দ্র মোদীর শীর্ষবাছাই অনিল অম্বানীর সংস্থাগুলির এই মুহূর্তে বাজারে দেনার পরিমাণ ১ লক্ষ ২১ হাজার কোটি টাকা। এ-কথা অনিল অম্বানীর সংস্থাই ঘোষণা করেছে। অনিল অম্বানীর একটি সংস্থা রিলায়েন্স নাভাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং, যারা মূলত জাহাজ বানানোর বরাত পায়, এতটাই ঋণগ্রস্ত যে বকেয়া আদায় করতে ঋণদাতা সংস্থাগুলি তাদের ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুনাল পর্যন্ত দৌড় করিয়েছে। প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধার এই কোম্পানি মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সম্পত্তি বিক্রয় করে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট অনিল অম্বানীকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভর্ৎসনা করে। বহুদিন অপেক্ষার পরে প্রাপ্য টাকা বুঝে নিতে আদালতে গিয়েছিল সুইডিশ টেলিকম সংস্থা এরিকসন। শীর্ষ আদালতের একাধিক নির্দেশ সত্ত্বেও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া দেনা মেটাতে পারেননি অনিল অম্বানী। সেই নির্দেশ অমান্য করার জন্যেই অনিল অম্বানীর গ্রেফতারি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল সুইস টেক জায়েন্ট এরিকসন।
হ্যাঁ, এখন অনেকেই বলতে পারেন, দেউলিয়া হতে বসা অনিল অম্বানীর সংস্থা রাফাল চুক্তির মধ্যে দিয়ে পুনরুজ্জীবন পেতে পারে।
ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফ্রান্সিস হল্যান্ডের আমলে ৩৬টি যুদ্ধবিমান ক্রয়ের এই নয়া রাফাল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপরেই তিনি এক-একটি ফরাসি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নরেন্দ্র মোদীর সরকার বলপূর্বক তাঁদের বাধ্য করেছে অনিল অম্বানীর সংস্থাকে পার্টনার হিসেবে এই প্রকল্পের অংশীদার করতে। ব্যবসার স্বার্থে এই চুক্তিটি হাতছাড়া করতেই এই গা-জোয়ারি মেনে নেন তাঁরা। ফ্রান্সিস হল্যান্ডের এই দাবি দ্যসল্ট সংস্থার মুখপাত্র মেনে নিতে চাননি। কিন্তু ফাঁস-হওয়া তথ্য থেকে পরিষ্কার, সংস্থার বহু কর্মকর্তা চাননি, ভারতীয় অফসেট পার্টনার হিসেবে অনিল অম্বানীর সংস্থাকে বেছে নেওয়া হোক। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, এই চুক্তির প্রাক্-শর্তই ছিল, রিলায়েন্সকে শরিক হিসেবে নিতে হবে।
এদিকে মোদী সরকারের প্রতিনিধিরা, বিজেপি-র নেতারা বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ান, রাফালে অনিল অম্বানীর সংস্থাকে অন্তর্ভুক্তিকরণ একান্তই দ্যসল্টের সিদ্ধান্ত। ভারত সরকারের নাকি এই সিদ্ধান্তে কোনও ভূমিকাই নেই। দ্যসল্ট কেন এমন অনভিজ্ঞ দেউলিয়া সংস্থাকে শরিক হিসেবে অগ্রাধিকার দেবে, যারা অতীতে এমন কোনও কাজ করেনি? দ্যসল্টের তরফে এই অস্বস্তিকর প্রশ্ন সবসময়েই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
মোদী সরকার, বিজেপি নেতা, পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া ২৪ ঘণ্টা রাফাল নিয়ে মিথ্যে খবর ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। প্রায়ই মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হচ্ছে এমন তথ্য যে, ৭০ শতাংশ অফসেট বিনিয়োগ অনিল অম্বানীর কাছে যাচ্ছে–এ-কথা ঠিক নয়। এই অর্থ অনেকগুলি সংস্থার মধ্যে বাটোয়ারা হবে। এই দাবি পুরোপুরি ভুয়ো। দ্যসল্টের লাইসেন্সে শরিক হিসেবে রিলায়েন্স অ্যারোস্পেস লিমিটেড-এর কথাই লেখা আছে। অন্য কোনও সংস্থাকে যদি কোনও কাজের বরাত দেওয়াও হয়, তবে তা এই চুক্তির অংশ নয়, বলা ভালো, তখন তা অনুচুক্তি হিসেবে গণ্য হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাসক-ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি বলছেন, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ইয়ারবকশিদের লুকোতে এই ধরনের কাঁচা মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে।