০২. মহাশ্বেতা দেবীঃ ...মুন্ডাদের মধ্যে, আমি খেরিয়াদের মধ্যে যে ধরণের কাজ করি, সেরকম কাজ করার ছিল না। কিন্তু ওদের সংগঠিত করার ছিল। সেটা আমি সব সময় বিশ্বাস করি, ওরা নিজেরাই সংগঠিত হোক। মিনিমাম কতোগুলো কাজের ভিত্তিতে ওরা নিজেরাই সংগঠিত হোক। ওদেরকে পলিটিক্যাল ফোর্স বলে মনে করা হতো। সেটা সব সময় মিথ্যাও হয়নি। তাই...মুন্ডা গেল...অঞ্চলের দিকে মুন্ডা, ওঁরাও সব আর মাঝামাঝি তো সব চলছেই; ইঁট ভাটার শ্রমিক, সেসব ইনভেস্টিগেট করে লেখাটেখা, কংক্রিট কাজের মধ্যে আমি বেশী বলবো যে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ এ শব্দের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হল।
মেদিনীপুরের লোধাদের নিয়ে, ভারতবর্ষে ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ সরকার সমস্ত ভারতজুড়ে যত ফরেস্ট ট্রাইব, যত ছোট ছোট, যারা কালটিভেশন করে না, তাদের ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ বলে ঘোষণা করে। অল ওভার ইন্ডিয়ায় এটা আছে। দিল্লিতে একটা খুন হলেই সানসি ট্রাইব যেখানে থাকে-- সানসি কলোনিতে, ওখান থেকে ওদের ধরে নিয়ে আসে। আর চুরি-ডাকাতি হলেই ওরা বাওয়ালিয়া ট্রাইব ধরে। এটা হল দিল্লির কথা।
আমার পশ্চিমবঙ্গে মেদিনীপুরে আছে লোধা শবর, পুরুলিয়াতে আছে খেড়িয়া শবর। লোধাদের মধ্যে আমি অনেকদিন কাজ করি। ওদের কাগজে প্রতিশ্রুতি গভর্নমেন্ট যা দিচ্ছে, তা দেবে না কেন? কী প্রতিশ্রুতি? গভর্নমেন্ট কী দিচ্ছে? এগুলো নিজের খরচে হাজার হাজার ছাপিয়ে প্রচার করতাম। আরেকটা জিনিষ প্রচার করতাম, একটা প্রোফর্মা বানিয়ে প্রচার করতাম...ঘর কিসের তৈরি, পরিবারের সদস্য ক’জন, কী আছে, কী নাই, জমি আছে নাকি নাই, জমি থাকলে সেটা কী ধরণের জমি, জমির আয় কী, না পাট্টা- না বর্গা- না মরুভূমির জমি, স্কুলে যায় নাকি, কোন সাহায্য পায় নাকি, হেনতেন ইত্যাদি।
এগুলো করতে করতে গ্রাম-বাংলার প্রকৃত ছবিটা উঠে আসতে লাগল। এবং এগুলো দিয়ে গভর্নমেন্টকে অনেক অ্যাটাক করি। আমার পত্রিকার ‘লোধা সংখ্যা’ করেছি, ‘মুন্ডা সংখ্যা’ করেছি। তেমনি প্রয়োজনীয় ‘মুসলিম সমাজ ভাবনা’ও করেছি। ‘বন্ধ কলকারখানা সংখ্যা’ও করেছি। এরকম অনেক সংখ্যা করেছি। ‘ওঁরাও জাতি সংখ্যা’ করেছি। এখন খেড়িয়ার এই লোধাদের সঙ্গে কাজ করবার সময় পলিটিক্যাল ফ্রিকশন এড়িয়ে, সরাসরি কনফ্রন্টেশন হচ্ছে না, কিন্তু লড়াই চলছে। কন্সট্যান্ট লড়াই চলছে, এ চলছেই।
আর বিহারে, একদিকের সিংভূমের বিহারে, ইত্যাদি করতে, করতে, করতে, করতে, উড়িশ্যার কেওনঝড় আদিবাসী অঞ্চলে, করতে, করতে, যখন লোধাতে এলাম, তখন লোধারা আমাকে বলল...আমি দশ বছর কাজ করার পর আমাকে বলে, ‘আপনি এলে শুনেছি আপনার কিছু হবে না। কিন্তু আমাদের ওপর অত্যাচার আসবে।’ আমি তখনই বুঝলাম, লোধা মেয়েরা আগে তীর-ধনুক নিয়ে লড়তো-টড়তো...লোধারা ভয় পেয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘আমি আর যাব না।’ লোধারা আজও আমার কাছে আসে, তাদের প্রত্যেকটা প্রয়োজনে আসে। সাধ্যমত প্রতিকারের চেষ্টা করি। কিন্তু লোধা বেল্টে আমি আর ঢুকি না।
আর লোধাদেরকে সাঁওতালরাও মারতো। ক্রিমিনাল ট্রাইব, তার জন্যই ’৮৬ সালে একবার ‘ট্রাইবাল ইউনিটি ফোরাম’ গঠন করতে। পশ্চিমবঙ্গে ৩৮টা আইডেন্টিফাইড গোষ্ঠি আছে। লাস্ট কর্মক্ষেত্রে দেখলাম, পুরুলিয়ায় খেরিয়া শবর। যারা লোধা থেকে সংখ্যায় কম, অন্য ট্রাইবের সঙ্গে থাকে না, দূরে দূরে পাহাড়-ডুমরীতে থাকে, জমি নেই এবং ক্রিমিনাল ট্রাইব বলে। যেমন, ’৭৭-৭৯ এর মধ্যে মেদনীপুরে বাম ফ্রন্ট পাওয়ারে আসার পর ৩৭ জন লোধাকে গণহত্যা করা হয়, ’৮২ সালে ছয়জনকে।
এই ছয় জনের পর লুকিয়ে যেতে হয়, ভেতরে ঢুকতে হয়, ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট লিখতে হয়, প্রচুর লড়াই করতে হয়; ওদের নিয়ে আসতে হয় কলকাতায়। আন্দোলন, হেনতেন করার পর কিছু কিছু লোধা কাজ করে। কিছু কিছু ‘লোধা ডেভোলপমেন্ট সেল’ অ্যাকটিভ হল, ওদের পার্টি সংগঠনের মধ্যে ঢুকাচ্ছিল ইত্যাদি।
খেড়িয়াদের মধ্যে যখন কাজ করতে আরাম্ভ করি, একেবারে শুরুতেই করি, রেজিস্ট্রি করে। তখনই আমি ঠিক করেছিলাম, এফসিআর নেব না। এফসিআর নিয়ে কাজ করাতে আমার খুব বিশ্বাস ও আগ্রহ ছিল না। কারণ এফসিআর ফান্ডেড অনেক সংগঠন দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে। অন্যত্রও দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গেও দেখেছি। খুব একটা মনে হয়নি যে ও রকমভাবে কাজ করতে পারবো। চাইনি...কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে, তখন তাদের জীবনে জীবন, অনেকদিন ধরেই যুক্ত ছিলাম, আরো বেশী যুক্ত হতে হয়েছে। উপন্যাস লেখা এবং একই সঙ্গে লিখতেও হয়েছে। লেখার প্রয়োজন থাকে, কিন্তু লেখার জন্য একটা দূরত্ব খুব সাহায্য করে। যেমন, ‘কৈবর্ত খণ্ড’ বা ‘বেনেবৌ’ বা ‘ব্যাধখণ্ড’ ইত্যাদি লেখার সময় একটা দূরত্ব এতে কাজ করেছে।
আখতারুজ্জমান ইলিয়াসঃ এ তো সময়ের দূরত্বই অনেক।
মহাশ্বেতাঃ সময়ের দূরত্ব। কিন্তু সেটা হচ্ছে ইতিহাসকে এভাবে দেখানো...চিরকালই এইটে ছিল, শোষক আর শোষিত, সবটাই তার ইতিহাস।
ইলিয়াসঃ আপনি যে দূরত্বের কথা বলছেন, এটি নিশ্চয়ই ঠিক। তো শবরদের সঙ্গে যে যোগাযোগটা ঘটছে, সেটা তো খুবই অন্তরঙ্গ, তাই না? এদেরকে নিয়ে কি উপন্যাস লেখা সম্ভব?
মহাশ্বেতাঃ একেবারেই সম্ভব না।
ইলিয়াসঃ ধরুন, চার-পাঁচ বছর পর?
মহাশ্বেতাঃ কোনদিন যদি পার্সপেক্টভ পাই তবে; আমি গল্প লিখেছি কিছু কিছু।
ইলিয়াসঃ হ্যাঁ, গল্প লিখেছেন।
মহাশ্বেতাঃ কিছু কিছু গল্প লিখেছি। আর এবার আমার ‘বর্তিকা’র সংখ্যাটাও হবে ‘খেড়িয়া শবর সংখ্যা’, কিছু স্ট্যাটিস্টিক্স...। আমি তো বিশ্বাস করি, ওদের নিয়ে কথা বলানোতে। কাজেই ওদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কী কী আচার-প্রথা পালন করে, তার ভেতর থেকেই অর্ধেকটা বেরিয়ে আসে। কী বক্তব্য, কী ব্যাপার ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব কোনদিন লিখবো নাকি জানি না। তবে ‘টেরর...’ নামে যে উপন্যাস লিখেছি, সেটা আমার সমস্ত ট্রাইবাল অভিজ্ঞতার অ্যাবস্ট্রাক্ট বলা যেতে পারে। তারমধ্যে সব ট্রাইবাল এক্সপেরিয়েন্সটাই বলা হয়েছে। সেই এক্সপেরিয়েন্সটাই আমি নতুন করে পাচ্ছি, রাজশাহী থেকে বদলগাছি, পাহাড়পুর থেকে অনতিদূরে মাধবপুর গ্রামে। সেখানে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, মিজ, মাহালি সবাই থাকে। সে অসম্ভব অবস্থা। রাস্তা থেকে দেড় মাইল দূর, তারা ধানক্ষেত থেকে মাটি তুলে মাটির রাস্তা করেছে। ঘরের দেয়াল-টেয়াল মোটামুটি পরিস্কার। চাল একেবারে গলে পড়েছে। দুটো মজা পুকুর আছে, তাতে ওরা স্নান করে, কাপড় কাচে, বাসন মাজে। আরেকটা লর্ড ক্লাইভের সময় ছিল না, কিন্তু ওই ধরণেরই একটা ভারতবর্ষের প্রথম টিউবওয়েল বসানো আছে। তার যেমন চেহারা, তেমনি আকৃতি।
ইলিয়াসঃ বহু প্রাচীনকালের টিউবওয়েল...।
মহাশ্বেতাঃ বহু প্রাচীনকালের টিউবওয়েল, শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্যের কোন ব্যবস্থা নেই, জীবিকার কোন ব্যবস্থা নেই। এখানে ভূমি সংস্কারের বালাই নেই। কাজেই ওরা যে বলে, অতক্ষণ আমি ছিলাম না। জমি মনে হয় অপরের জমি চষে। কিছুটা তো কারো কারো গৃহ সংলগ্ন খানিকটা থাকতে পারে। সবজি-টবজি করে, এই রকম। কাজেই একই রকম অবস্থা। মানে আনন্দ পাবার কিছু নাই।
ইলিয়াসঃ না, আনন্দ পাবার কিছু নাই।
মহাশ্বেতাঃ তবে লেখার প্রয়োজন আছে, ইতিহাসে এদের স্থাপন করার জন্য...যেটা মুন্ডাদের বেলায় হয়েছিল। আর সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে দুটো উপন্যাস... ‘শালগিরার ডাকে’, যেটা বাবা তিলকামাঝির ১৭৮৫ থেকে ১৭৯০ সালের উপন্যাস। সেটাতে আছে ‘সিধুকানুর ডাকে’। কিন্তু যেটা মনে হচ্ছে, সেদিনও বোধহয় আলোচনা করেছিলাম...উমর সাহেব রয়েছেন [সংলাপে যোগ দিয়েছেন, বাম তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর]...এই যে আদিবাসী বিদ্রোহগুলা হয়েছে, সশস্ত্র বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সেগুলো কোথাও স্বাধীনতার লড়াই হিসেবে স্থান পায়নি। তাদের একটা আলাদা করে রাখা হয়েছে। ...
[চলবে]
অরিন্দম,
আগের পর্বটির লিংক দেওয়া হয়েছে, "পর্ব ১" এ ক্লিক করলে পাবেন
https://sarbojonkotha.info/pdf/sk-10-akhtarujaman-elias-71-76.pdf