বিচারপতি ভার্মা কমিটির নানা সদর্থক প্রস্তাবনার মধ্যে থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব নতুন আন্টি রেপ বিলের বিলে গ্রহণ করা হয়নি, যেমন, ম্যারিটাল রেপকে বিলের আওতায় আনা, ‘আফস্পা’ য় পরিবর্তন আনা, যাতে করে ধর্ষণে অভিযুক্ত আর্মি অফিসারদের বিচার ও সিভিলিয়ান কোর্টে করা হয়, ইত্যাদি। এই দাবিগুলো পুরণের লক্ষ্যে আন্দোলন তো চালিয়েই যেতে হবে কিন্তু নতুন আন্টি রেপ বিলে নারীদের সমানাধিকার নিয়ে যথার্থভাবেই অনেক দাবি উঠে এসেছে, অথচ এই বিলের সেই দাবিগুলির বিরুদ্ধেই মিডিয়ার একাংশে এখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ক্যাম্পেন চালান হচ্ছে, এবং ঘোষিতভাবে নারীবিদ্বেষী সংস্থাগুলি এই ক্যাম্পেনের মদতদাতা। এখানে কিছু তথ্য তুলে ধরা হল, টিভিতে সম্প্রচারিত নানা বিতর্কে প্রচারিত নানা মিথের ধোঁয়াশা কাটাতে হয়তো সাহায্য করবে এই তথ্যগুলি।
আমরা সসংসদের সকল সদস্যকেই অনুরোধ করব তাঁরা যেন এই বিলটিকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে এটিকে আইনের রূপ দান করেন; সেই আইন এই দেশের যৌন জুলুমের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১নং মিথকথাঃ এই বিল আদতে পুরুষ বিরোধী।
ঘটনাঃ না, এই যৌন নির্যাতন বিরোধী বিল আদৌ পুরুষ বিরোধী কোনো ইস্তাহার নয়। আমাদের বাবা, ভাইয়েরা, স্বামী – এরাও কি পুরুষ নন? না কি এনারাও এই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল নন? এই বিল তো আসলে ধর্ষণকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে, পুরুষদের সমর্থনে তাই কোনো অস্বস্তির কারণই নেই। এই বিলের একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের সমাজ থেকে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, পথে ঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করা বা প্রকাশ্যে নগ্ন করে হাঁটানো ইত্যাদি দূর করা।
আর আমরা এটাও জানি যে পুরুষেরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, অ্যাসিড অ্যাটাক পুরুষদের উপরেও হয়। তাই এই বিল শুধু মেয়েদেরই রক্ষার কথা বলে না, বরং যৌন অত্যাচারের শিকার সব মানুষেরই কথা বলে। তা হোক, আমরা সব সংসদের সদস্যদের আবার অনুরোধ করব, তাঁরা যেন বন্দী পুরুষদের উপর সমকামী ধর্ষণকেও এই আইনের রক্ষাকবচের আওতায় আনেন। ৩৭৫ ও ৩৭৬(২) এই আইনে তাঁরা যেন নির্যাতিতদের ‘ব্যাক্তি’ হিসাবেই গণ্য করেন,শুধু নারী হিসেবেই নয়।
২ নম্বর মিথকথাঃ সহবাস সম্মতির বয়স কমিয়ে ১৬ করা হলে ধর্ষণ,বেশ্যাবৃত্তি ও নারী চালান আরো বেড়ে যাবে।
ঘটনাঃ এই সম্মত সহবাসের আইনী বয়স কিন্তু ১৬ বছরই ছিল, সেই ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু করে একটানা ৩০ বছর। হঠাৎ করে, মাত্র নয় মাস আগে, কোনো রকম আলাপ, আলোচনা বা বিতর্কের মধ্যে না গিয়েই সরকার একটি নতুন আইন চালু করেন, Protection of Children from Sexual Offences Act, May 2012 নামে এবং কলমের এক খোঁচায় সম্মতির বয়স বাড়িয়ে ১৮ করে দেন। JVC কমিটি এই সংশোধনী ধারাটির বিরোধিতা করেন ও সম্মতিসুচক সহবাসকারীদের অযথা দণ্ডনীয় অপরাধী হিসেবে গণ্য না করার সুপারিশ করেন।
না, সম্মতিসুচক সহবাসের বয়স ১৬তেই ধরে রাখার মানে এইই নয় যে অল্প বয়সে বা বিয়ের আগেই যৌনসংসর্গকে অনুমোদন করা বা উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কোনো ভাবেই এই আইন অপ্রাপ্তবয়স্কদের কোনো শিক্ষা দিচ্ছে না। বরং এই আইন মোতাবেকে এইটাই ঘটছে যে, সম্মতিসূচক সহবাসের জন্য কোনো কিশোর কিশোরীকেই তৎক্ষণাৎ অপরাধী মেনে গারদে ঢোকানো হচ্ছে না। এই ‘সম্মতির বয়স’এর মানে এইটাই যে কোনো কোনো কিশোর বর্তমানে ১৮ বছরের কমবয়েসি কোনো মেয়ের সাথে সহবাস করলেই সে অপরাধী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এবং ঘটনাটিকে বিধিসম্মত ভাবে ধর্ষণের আওতাতেই ফেলা হচ্ছে।
ভারতীয় সমাজ আদৌ চায় না যে এইসব অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের সম্মতিসূচক যৌন সংসর্গের জন্যও অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হোক বা কোনো কিশোরকে এইজন্য ধর্ষক হিসেবে সাজা পেতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক তরুণই এর ফলে জেয় হতে পারেন। কেউ কোনো নালিশ ঠুকলেই এইসব ছেলে মেয়েরা শুধুমাত্র সম্মত সহবাসের দরুনই গারদে বা কোনো ‘হোম’এ আটকা পড়ে যাবে।
তাই আমরা চাই সম্মতির বয়স যেন ষোলতেই ফিরিয়ে আনা হয়। এমন তো নয় যে আঠারো থেকে ষোলতে সম্মতির আইনি স্বীকৃতি দিলেই ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাবে। বরং এর ফলে অল্পবয়স্কদের জীবন ও তাদের মতামতের উপর আইনের কড়া বাঁধন কমবে। এই সব ছেলে মেয়েদের নিজেদের যৌন জীবনের ক্ষেত্রে এটা হবে তাদের মৌলিক অধিকার। তাই আমরা চাই সহবাস সম্মতির আইনি বয়সসীমা আবার ষোলতেই ফিরিয়ে আনা হোক।
কেন বিয়ের ন্যূনতম বয়স আঠেরোই থাকবে কিন্তু সহবাস সম্মতির বয়স হবে ষোল?
বিয়ের বয়স আঠারোতেই রাখা উচিৎ। বিয়ে করাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এতে জড়িয়ে থাকে অনেক পারস্পরিক দায়িত্বের প্রশ্ন। কিন্তু একটাই বয়সবিধি দিয়ে জীবনের সব কিছু দায়িত্বের মীমাংসা করা যায় না। বহু সমীক্ষা করে দেখা গেছে, নগর ও গ্রামীণ ভারতে প্রথম যৌন সংসর্গ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১৬-১৮ বয়সসীমার মধ্যেই হচ্ছে। এই বিষয়ে মা বাবার দুশ্চিন্তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের আইনের গণ্ডীর বাইরে যেতে হবে। স্কুলে, বা মা-বাবার সাথে সরাসরি যোগাযোগে বা পরিবারের মধ্যেই এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে।
সম্মতির বয়সসীমা ষোলতে নামিয়ে আনলে কি নারী ও শিশুদের জোর করে পতিতাবৃত্তিতে ঢোকানো সহজ হবে?
এই কথাটা মনে রাখতে হবে যে ধর্ষণের সংজ্ঞাই হচ্ছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহবাস। সেক্ষত্রে সম্মতির বয়স আঠেরো না ষোল হল, সেটি সম্পূর্ণভাবেই অপ্রাসঙ্গিক। জোর করে বেশ্যাবৃত্তিতে মেয়েদের ঢোকানোর সাথে মেয়েদের সম্মতির অবকাশ কোথায়? বিচারপতি ভার্মা তাঁর রিপোর্টে দেখিয়েছেন পুলিশের যোগসাজসেই এই ধরনের বেচাকেনা চলে। নতুন বিলে সেটির বিরোধিতা করে একটি আইনি পথনির্দেশও রয়েছে।
তিন নম্বর মিথকথাঃ দর্শকাম (Voyeurism) ও পিছু নেওয়া (stalking) আইনের ফাঁদে পড়ে যাবে অনেক নির্দোষ পুরুষ।
দর্শকামের অপরাধ, যেমনটি ৩৪৫ ধারায় লেখা আছে, সেটি খুবই সুনিদৃষ্ট এবং এর আওতাও যথেষ্ট আঁটসাট। ফলে এর অপব্যবহারের নতুন কোনো বিপদের সুযোগ নেই। আর এটা তো সকলেই জানেন আমাদের গ্রামে গঞ্জে বা শহরের প্রান্তিক মানুষদেরের আলাদা করে স্নানঘরের বিলাসিতার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এর ফলে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বা বাইরে স্নান করতে গেলে মহিলা ও শিশুরা প্রায়ই যৌন আক্রমণের শিকার হন। কেউ যদি সেই ব্যক্তিগত মুহূর্তের কোনো ছবি সেই মহিলার অগোচরে তোলেন তবে সেটি আইনতঃ অপরাধ। প্রতিটি ব্যাক্তিমানুষের গোপনীয়তার রক্ষাও এক অধিকার, ও তার আইনি স্বীকৃতি যথেষ্টই রয়েছে।
পিছু নেওয়া বা Stalking: মহিলাদের কাছে এটি একটি দারুণ ভীতিকর অপরাধ। বারবার পুরুষদের পিছু নেওয়ায় উত্যক্ত ও শঙ্কিত হয়ে অনেক মহিলাই পড়াশুনা বা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। প্রিয়দর্শিনী মাট্টুর ধর্ষণ ও খুন হওয়ার ঘটনাতেই বোঝা যায় এই পিছু নেওয়া, ঠিক সময়ে বন্ধ না হলে, মারাত্মক ফল দিতে পারে। এই স্টকিং যারা করে তাদের অনেকেই তাদের শিকারের উপর অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে। এই পিছু নেওয়ার বিরুদ্ধে আইন কঠোর হলেই ভবিষ্যতের এরকম ঘটনা কম ঘটতে পারে। এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে বর্তমান আইনি ব্যবস্থায় যে ফাঁক থেকে গেছে নতুন আইনে সেটি আর থাকবে না। শুধুমাত্র যখন কেউই এই পিছু নেওয়া বার বার করতে থাকবে, সে প্রকাশ্যে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমেই হোক, তখনই সে এই অপরাধে দোষী বলে গণ্য হবে।
অনুবাদ ঃ দীপ্তেন
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
এই লেখাটি তৈরি হবার সময় সহবাস সম্মতির বয়স কমিয়ে ১৬ করার কথা হয়েছিল, আজ সংসদে সেটি খারিজ হয়ে গিয়ে ১৮ বছর বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।