এসে গেল পুজোর "জয়ঢাক" আমার একটি গল্প নিয়ে। নিচের লিংকে ক্লিক করলেই পড়া যাবে।
পুজোর অগ্রিম শুভেচ্ছা নিয়ে পড়ুন "বাসা বদল", জীবনে কখন কী যে হয় কে বলতে পারে?
https://joydhakweb.in/golpo8212/?fbclid=IwAR1YJAF98P_LawfjvvZYKcJ6dq_QkOfILytk1Od7zS_NOaIIGXTBHzJCKNA
ওপরের লিংকে ঢুকে পড়লে - পত্রিকায় গল্প পাঠের আমেজ মিলবে - নচেৎ ছবি-ছাবাহীন নীরস গল্পটি এখানেও পড়তে পারেন।
১
শনিবার রাত্রে হাওড়ায় ট্রেনে চেপে পরের দিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ শিল্টনগঞ্জ স্টেশনে নামল বোঁচা আর পল্টু। স্টেশনে তাদের রিসিভ করতে এসেছিল পিন্টু, পল্টুর মাসতুতো ভাই। পিন্টু বেশ কিছুদিন হল বন দপ্তরে চাকরি পেয়েছে। নানান জায়গায় ট্রেনিং নিয়ে সে এখন এই শিল্টনগঞ্জ থেকে পঁয়ষট্টি-সত্তর কিমি দূরের চেতলা ফরেস্টে পোস্টেড। দিন পনের আগে এই পিন্টু পল্টুকে ফোন করে বলেছিল, “জঙ্গল যদি দেখতে চাস, আমার কাছে চলে আয়। যাওয়া আসার ভাড়াটুকু যোগাড় করে হাওড়ায় ট্রেনে চেপে শিল্টনগঞ্জ পৌঁছে যা। তারপর থেকে থাকা, খাওয়া এবং জঙ্গলে ঘোরাঘুরির সব দায়িত্ব আমার। এই সুযোগ মিস করিস না”।
বোঁচা আর পল্টু এই সুযোগ মিস করেনি, ট্রেনে রিজার্ভেশন পেয়েই পিন্টুকে ফোন করে জানিয়েছিল, “আমি ও আমার হাফপ্যাণ্টের বন্ধু বোঁচা, এই রোববার পৌঁছচ্ছি। তোর অনুমতি ছাড়াই বোঁচাকে সঙ্গে আনছি বলে, রাগ করবি না, নিশ্চয়ই”। পিন্টু উত্তরে হাসতে হাসতে বলেছিল, “তোরা আগে আয় তো, তারপর তোদের কী করি দেখিস, হুঁকোমুখো মর্কট!”
স্টেশনে নেবেই বোঁচা আর পিন্টুর পরিচয় পর্বটা বেশ ভালভাবেই মিটল এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওরা “তুমি” থেকে যখন “তুই”তে নেমে এল, বোঝা গেল, জঙ্গলের এই ট্রিপটা তিন বন্ধু মিলে খুব সহজেই জমিয়ে দেওয়া যাবে।
স্টেশন থেকে রিজার্ভ ফরেস্টের গেট অব্দি বাসে আসতে প্রায় ঘন্টা তিনেক লাগল। সে বাসে কেউ দাঁড়ায় না, সিটে তো বটেই, এমনকি বাসের মেঝেতেও সবাই বসে পড়ে। তাদের অনেকের সঙ্গেই একটা কি দুটো ছাগল, কিংবা ঝুড়ি ভর্তি মুরগি অথবা একসঙ্গে পা বাঁধা তিন-চারটে হাঁস। দুটো ছাগল তো বেশ কিছু লোককে ঢুঁ মারল বেশ কয়েকবার। তিনটে আবার নাদি ছাড়ল বাসের মধ্যেই। বিচিত্র সহযাত্রীদের এমন আচরণে বোঁচা আর পিন্টু বেশ মজা পাচ্ছিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল নিচু স্বরে। তবে পল্টুর ঠিক বরদাস্ত হচ্ছিল না। ওদের হাসি ঠাট্টার মধ্যে বেশ কয়েকবার বলল, “এভাবে মানুষ যায়?” আরো কয়েকবার বলল, “কোন ভদ্রলোকেরই এভাবে ট্রাভেল করা উচিৎ নয়, মোস্ট আনহাইজিনিক। শরীর খারাপ হয়ে যাবে!” পল্টু যত বিরক্ত হচ্ছিল, ততই ওরা মজা পেয়ে হাসছিল, হো হো করে।
বাস থেকে নেমে, ফরেস্টের গেট দিয়ে ঢুকেই বেশ অনেকটা ছিমছাম প্রশস্ত জায়গা। বাঁপাশে অফিস। সেখান থেকে ফরেস্ট বাংলোয় থাকার কিংবা ফরেস্টের ভেতরে ঘোরার জন্যে গাড়ি বুক করা যায়। ফরেস্টে ঢোকার সময় প্রায় ভোরের দিকে, কিংবা বিকেল চারটের পর। এখন যেহেতু একটা বাজছে, বেশ ফাঁকা। বনের ভেতরে যাওয়ার রাস্তার বাঁ পাশে গোটা বিশেক সাফারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে, ওগুলোই বুকিং হলে টুরিষ্টদের নিয়ে বিকেলে ঢুকবে। ডানদিকে একটা ছোট্ট সুন্দর সাজানো বাড়ি। সেখানে জঙ্গলের বিবরণ সহ অনেক ছবি-টবি আছে। ওই বাড়িতেই ছোট্ট একটা অডিটোরিয়ামও আছে, সেখানে ভিডিওতে ওয়াইল্ড লাইফের ছবি দেখানো হয়। মাঝে মাঝে সেমিনারও হয়। হাঁটতে হাঁটতে পিন্টু ওদের এসব দেখাচ্ছিল।
এসব পার হয়ে কোর-ফরেস্ট ফেনসিং-এর ধারে বন দপ্তরের কর্মীদের থাকার জন্যে নানান ধরনের কোয়ার্টার। পিন্টু ওদের নিয়ে সেদিকেই চলল। পিন্টু নিজের কোয়ার্টারে ঢুকে বলল, “আমার এখানে একটা বসার ঘর, একটা শোবার ঘর, সঙ্গে টয়লেট বাথরুম। একটু কষ্ট করলে শোবার ঘরে তিনজনেরই হয়ে যাবে, না হলে বসার ঘরের চৌকিতে একজন। যেমন তোদের ইচ্ছে!”
বোঁচা বলল, “পাগল নাকি? আমি বসার ঘরে যাচ্ছি না, রাত্রে কোন জন্তু জানোয়ার এসে তুলে নিয়ে যাবে। তার চেয়ে ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গেই থাকা ভাল, জানোয়ারেরা নিশ্চয়ই তাদের অফিসারকে জানে, কাজেই জেনেশুনে জানে মেরে ফেলবে না! কী বলিস, পল্টু?” পল্টুও বোঁচার কথায় সায় দিল, বলল, “দু ঘরে শুলে আড্ডা দেব কী করে? না না পিন্টু, তার চেয়ে তুই আমাদের একঘরে করে দে!”
পিন্টু বোঁচার পিঠে একটা জোর থাপ্পড় মেরে হাসতে হাসতে বলল, “তোরা চানটান করে ফ্রেশ হয়ে নে, আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যে অফিস থেকে আসছি। ফিরে একসঙ্গে খেতে যাবো”।
সেদিন বিকেলে পায়ে হেঁটে এবং পরের দুটো দিন পিন্টুর গাড়িতে চেপে বেশ ভালই জঙ্গল দেখা হল। নানা রকমের হরিণ, সম্বর, নেউল, গাউর, নীল গাই প্রচুর দেখতে পাওয়া গেল। আর পাখ-পাখালির তো শেষ নেই। পিন্টুকে পাখিদের বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি ভজকট নাম বলতে দেখে, বোঁচা বলল, “দ্যাখ পিন্টু, তোর ওই সায়েবি কেতার নাম ছাড়, যদি দেশী কোন নাম জানা থাকে তো বল। যেমন বুলবুলি, টিয়া, চন্দনা, হাঁড়িচাচা, দোয়েল...তোর ওই সব রেড থ্রোটেড্, গ্রে ব্রেস্টেড্, গ্রিন নেক্ড্...ওসব শুনে আমাদের লাভ নেই...”। পিন্টু হো হো করে হাসল, তার হাসির শব্দে বেশ কিছু ঘুঘু আর হরিয়াল সামনের থেকে উড়ে বনের গভীরে চলে গেল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “ওই দ্যাখ, ওগুলো ছিল ঘুঘু আর হরিয়াল”।
২
তৃতীয় দিন সক্কালবেলা, পিন্টু দুজনকেই ঠেলে তুলে বলল, আমাকে এখনি একবার ওদিকের ফরেস্টে যেতে হবে, চটপট রেডি হয়ে নে”। মিনিট পনেরর মধ্যে তিনজনে বেরিয়ে পড়ার পর, পল্টু জিগ্যেস করল, “ওদিকের ফরেস্টটা রিজার্ভ ফরেস্ট নয়?”
পিন্টু বলল, “না ওদিকে জঙ্গলের ভেতরে বেশ কয়েকটা গ্রাম আছে। গ্রামের লোকেরা সবাই আদিবাসী তো, এই অরণ্যে ওদের অধিকার আছে। কাজেই ওদিকটা রিজার্ভ নয়”। জঙ্গলের পায়ে চলা সরু পথ ধরে হাঁটতে ভালই লাগছিল। নানা ধরনের পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ। কতরকমের পোকা আর প্রজাপতি যে উড়ে বেড়াচ্ছে তার আর ইয়ত্তা নেই। তিনজনের কেউই কথা বলছিল না। পিন্টু আগে আর পিছনে ওরা দুজন, চারদিক দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল বনের গভীরের দিকে।
প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর তারা কয়েকটা খড়ে ছাওয়া মাটির এলোমেলো ঘর দেখতে পেল। পিন্টু বলল, ওটাই আদিবাসীদের একটা গ্রাম। গ্রামের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আর বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওদের দেখে এগিয়ে এল। বৃদ্ধরা নমস্কার করল পিন্টুকে। পিন্টুও সকলকে হাতজোড় করে নমস্কার করল। কথাবার্তাও হল পিন্টুর সঙ্গে। পিন্টু বাংলাতেই কথা বলছিল, ওরা বলছে স্থানীয় ভাষায়। বোঁচা আর পল্টু ওদের ভাষার কিছু কিছু বুঝতে পারছিল, কিন্তু অধিকাংশই বুঝতে পারছিল না।
গ্রামের পাশ দিয়ে আবার জঙ্গলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পল্টু পিন্টুকে জিগ্যেস করল, “এই গ্রামে কী শুধু বুড়োবুড়ি আর এই বাচ্চারা থাকে? বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা কোথায়?”
পিন্টু হাসল, বলল, “ওদের বাবা-মায়েরা খুব ভোরে বেড়িয়ে যায় রোজগারের সন্ধানে। পুরুষেরা যায় শহরের দিকে কোন কাজের খোঁজে। মেয়েরাও যায়। তবে মেয়েরা দল বেঁধে বেশির ভাগ যায় জঙ্গলে। জঙ্গল থেকে জ্বালানির জন্যে শুকনো কাঠ-কুটো যোগাড় করে। বুনো ফল, কন্দ, মূল, শাক-টাক যোগাড় করে আনে। পুরুষদেরও কেউ কেউ জঙ্গলে যায়, শিকার করতে কিংবা নালা থেকে মাছ ধরতে। শেষ দুপুরে ওরা ঘরে ফেরে, তারপর রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া...”।
বোঁচা বলল, “শিকার করতে যায়, মানে? জঙ্গলে শিকার করা মানা না?”
পিন্টু হাসল, বলল, “আমাদের জন্যে শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ওদের জন্যে কিছু কিছু শিকারের অনুমতি দেওয়া হয়। কারণ শিকার করাটা ওদের জীবন ধারণের জন্যে জরুরি। আর আমাদের শহুরে লোকেদের শিকার করাটা ছিল নিছক শখ মেটানো আর বাহাদুরি দেখানো! তাছাড়া যে সব প্রাণীদের সরকার ভার্মিন (vermin animal) ঘোষণা করেছেন, তাদের তো শিকার করাই যায়”।
“ভার্মিন? ভার্মিন আবার কী প্রাণী রে?” পল্টু জিগ্যেস করল।
“ভার্মিন কোন বিশেষ প্রাণী নয়। ভার্মিন সেই সব প্রাণীদের বোঝায়, যারা মানুষের এবং তার শস্য-সম্পদের ক্ষতি করে”, পিন্টু বলল, “পাখি, কীট-পতঙ্গ, জন্তুজানোয়ার সব কিছুই হতে পারে! আবার ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভার্মিনের সংজ্ঞাও আলাদা হতে পারে। আমাদের এই জঙ্গলে যেমন নীলগাই ভার্মিন নয়, কিন্তু বিহারের কিছু কিছু অরণ্যে নীলগাই ভার্মিন, তাকে শিকার করা যায়”।
বোঁচা জিগ্যেস করল, “এ জঙ্গলে কী কী প্রাণী ভার্মিন?”
পিন্টু বলল, “মেঠো ইঁদুর আছে, বাদুড় আছে”।
পল্টু বলল, “ইঁদুর না হয় বোঝা গেল, কিন্তু বাদুড় কেন?”
“সব বাদুড় নয়। ফলখেকো বাদুড়, যাদের ফ্রুট ব্যাট বলে। এরা আমাদের বাগানের ফল খেয়ে ক্ষতি করে যে, তাই ওরা ভার্মিন”।
বোঁচা বলল, “আদিবাসিরা ইঁদুর খায় শুনেছি, কিন্তু বাদুড় তো আর খায় না! বাদুড় শিকার করবে কেন?”
পিন্টু হাসল, বলল, “মানুষ যে কী খায় আর কী খায় না, তার হিসেব রাখা দায়। আদিবাসিদের সবাই না হলেও কেউ কেউ বাদুড় খান। শুনেছি বাদুড়ের মাংস নাকি খুব সুস্বাদু। অনেকের ধারণা, বাদুড়ের মাংস অ্যাস্থমা মানে হাঁপানির মহা ওষুধ! যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই!”
পল্টু নাক মুখ কুঁচকে বলল, “তাই বলে বাদুড়ের মাংস? ছ্যাঃ”।
পিন্টু হাসতে হাসতে বলল, “অমন ছ্যাছ্যা করিস না, পল্টু, বিশ্বের বহু দেশেই বাদুড় খাওয়ার চল আছে। তাঁরা শুনলে তোর ওপর রেগে যাবেন। কিছু দেশের শহুরে সুসভ্য মানুষেরা শুনেছি, হেঁটে চলে বেড়ানো যে প্রাণীকেই সোনামুখ করে চিবিয়ে খান – তেঁতুলে বিছে, টিকটিকি...”।
কথা বলতে বলতেই, সামনে একজন আদিবাসি লোককে দেখতে পেল তারা। খালি গা, পরনে ঢোলা হাফপ্যান্ট। একটু বেঁটে খাটো কিন্তু ভীষণ বলিষ্ঠ শরীর। তাঁর কাঁধের ঝোলাতে কিছু তির আর একটা ধনুক, হাতে ঝুলছে একটা মাঝারি সাইজের জাল, তার মধ্যে ছটফট করছে বেশ কিছু কালো কালো জীব।
পিন্টু লোকটাকে দেখেই বলল, “বোঝো বাদুড় নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছিল, এখন সেই বাদুড় শিকার করেই ফিরছেন ওই আদিবাসি ভদ্রলোক”।
লোকটি কাছাকাছি আসতেই কড়া গলায় পিন্টু জিজ্ঞাসা করল, “কী শিকার করেছেন, দেখি?” লোকটা জালটা সামনে এনে দেখিয়ে কিছু বলল, পিন্টু ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, যান”।
লোকটা চলে যেতে, পিন্টু হাসতে হাসতে বলল, “কী রে বোঁচা, বাদুড় টেস্ট করে দেখবি নাকি?”
“কাঁচা?”
“ধুর হতভাগা কাঁচা হবে কেন? রান্না করাতে হবে। রাজি থাকিস তো বল, আমিও আছি তোর সঙ্গে”।
“পল্টু, তুই?”
“ইসস্স্, এর পর তো তোরা মানুষও খাবি রে, হতভাগা! আমি ওসবের মধ্যে নেই। চিকেন খা, মাটন খা, তাই বলে বাদুড়? ঘেন্নাপিত্তি বলে কিচ্ছু নেই তোদের?”
পিন্টু বলল, “আরেঃ আমরা কী রোজ রোজ খাচ্ছি নাকি? সারা জীবনে হয়তো এই একবারই! তাই তো রে, বোঁচা?”
“এক্স্যাক্টলি। জঙ্গলে এসেছি যখন, একেবারে জংলীই হয়ে যাবো আজ”। পিন্টু ঘুরে দাঁড়িয়ে আদিবাসি ভদ্রলোককে ডাকল, “ভাইয়া, একটু শুনবেন?”
৩
আদিবাসি ভদ্রলোকের সঙ্গেই কথা বলতে বলতে ওরা আর একটা গ্রামে এসে পৌঁছলো। সকালে যে গ্রামের ভেতর দিয়ে ওরা এসেছিল, এটা সেই গ্রামটা নয়। পিন্টুর সঙ্গে ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে ওরা বুঝল, উনি প্রথমে বাদুড়গুলো ছাড়াবেন, তারপর নিজের পরিবারের জন্যে কিছুটা রেখে বাকিটা বেচে দেবেন। কত করে দাম জিগ্যেস করতে চোখ ছোট করে একগাল হাসলেন, কিছু বললেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা খাবেন নাকি? শহরের লুকেরা এসব খায় না! খুব ঘেন্না করে। তাঁদের গ্রামেও সবাই খায় না। তবে খেতে মুরগির থেকে খারাপ কিছু নয়। পিন্টুরা খেয়ে দেখতে চায় শুনে, ভদ্রলোক আবার হাসলেন, ভাঙা বাংলায় বললেন, “পয়সা লাগবেক নাই, এট্টু দুব তুদের”।
এই কথাবার্তা আর বাদুড় খাবার হুজুগটা পল্টুর মোটেই ভালো লাগছিল না। গ্রামের মধ্যে ঢুকে সে একটা বড়ো শিরিষ গাছের ছায়ায় বসল। পিন্টু আর বোঁচা ভদ্রলোকের বাড়ির সামনের একটা বাঁশের বেঞ্চে বসল। ভদ্রলোক জালের ঝোলা বাইরে রেখে ভেতর থেকে বঁটি, ছুরি আর বড় একটা অ্যালুমিনিয়মের থালা নিয়ে এলেন। তারপর দরজার বাইরে একপাশে বসে, ঝোলার থেকে একটা একটা করে বাদুড় বের করে, ছাড়াতে লাগলেন। আর ছাড়ানো মাংস ভাগা দিয়ে রাখতে লাগলেন থালাতে। পল্টু এসব দৃশ্য দেখবে না ভেবেও বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল ওদিকে। কলকাতার দোকানে মুরগি এবং ছাগল কাটা সে দেখেছে, সেই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এর এমন কিছু তফাৎ নেই। কিন্তু মানুষের লোভ আর হিংস্রতা দেখলেই তার কেমন অস্বস্তি হয়। খাদ্য হিসেবে মানুষের জন্যে এত কিছু রয়েছে, কিন্তু তাও শুধুমাত্র জিভের স্বাদ পরিবর্তনের জন্যে মানুষের প্রাণীহত্যার কোন সীমা নেই!
আদিবাসি ভদ্রলোক মোট এগারোটা বাদুড় কাটলেন, মাংস হল অনেকটাই। ঝোলার মধ্যে আরো দুটো বাদুড় রয়ে গেল, সেগুলো না কেটে উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন।
পিন্টু বলল, “ও দুটো কাটবেন না?”
আদিবাসি ভদ্রলোক বললেন, নাঃ ও দুটা খেতে নেই। অমঙ্গল হয়, অশুভ।
“অশুভ? কী হয় খেলে?”
“সেটি বুইলতে লারবেক, বুড়াদের মুখে শুনেছি, খাঁইতে লাই!”
“ওঃ তাই বুঝি? কী দেখে বুঝলেন, যে ওদুটো অশুভ?” আদিবাসি ভদ্রলোক জালের ঝোলা থেকে একটা বাদুড়ের মুণ্ডু টেনে বের করে বললেন, “ই দ্যাখেন, দু কানের পাশে ইটার সাদা সাদা রোঁয়া রইয়েছে বটে...ইগুলান ভাল লয়, খুব খারাপ!”
বোঁচা চাপা গলায় পিন্টুকে বলল, “যত্তো সব অন্ধ কুসংস্কার। শোন না, ওকে জিগ্যেস কর তো, ওদুটো নিয়ে উনি কী করবেন?”
পিন্টু ভদ্রলোককে জিগ্যেস করাতে, ভদ্রলোক বললেন,“ও দুটাকে আমি জঙ্গলে ছেড়ে দিব, কিন্তু উয়াদের ডানা ভেঙে গ্যাছে, উড়তে লারবে। এমনিতেই মরে যাবে...পরে শ্যালে খেঁয়ে ফেলাবে...”!
বোঁচা পিন্টুকে বলল, “ওই দুটোকেই আমাদের জন্যে ছাড়িয়ে দিতে বল। মাংসের জন্যে আমাদের থেকে পয়সা না নিলেও, ওঁর কোন লস হবে না”।
পিন্টু বলল, “কিন্তু ও যে বলল, ওগুলো অশুভ, খেলে শরীর খারাপ হয় যদি?”
বোঁচা বলল, “তুইও তেমনি...কানের পাশে যদি ঘা-টা কিছু দেখাত, তাও বুঝতাম। কানের চারপাশে কিছু সাদা লোম রয়েছে বলে, সেগুলো অশুভ হয়ে যাবে? তুইও ওঁদের কথায় বিশ্বাস করে গেলি?”
“তা নয়। তবে...! তুই কী বলছিস? ও দুটোই আমাদের জন্যে ছাড়িয়ে দিতে, বলব?”
“আলবাৎ। একে বাদুড় তার ওপরে আবার অশুভ...এমন জিনিষ ছেড়ে দেওয়ার কোন মানে হয় না”!
পিন্টু বলাতে আদিবাসি ভদ্রলোক কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বারবার একই অমঙ্গল আর ভীষণ খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার কথা বলছিলেন। অবিশ্যি ঠিক কতটা অমঙ্গল বা খারাপ হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারলেন না। বারবারই বললেন, বাবা-দাদুদের মুখে শুনেছেন, “ইগুলান খাঁইতে লাই”। কিন্তু পিন্টু এবং বোঁচার জোরাজুরিতে শেষ অব্দি তিনি ও দুটো বাদুড়ও ছাড়ালেন, কিন্তু ছাড়ানো মাংস অ্যালুমিনিয়মের থালায় রাখলেন না। কাঁচা বড়ো একটা শালপাতায় মুড়ে পিন্টুর হাতে দিয়ে যা বললেন, তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, “কাজটা ঠিক করলেন না, বাবু। এখনও বলছি এ মাংস খাবেন না”।
পিন্টু আর বোঁচা হাসল, বলল, “ভাববেন না, আমাদের কিচ্ছু হবে না”।
পল্টু বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল। ওরা ফিরতে উঠে দাঁড়াল। ওদের কথাবার্তা সে কিছুই শুনতে পায়নি, জিগ্যেস করল, “ভদ্রলোক বার বার মাথা নেড়ে কী বলছিলেন, রে?”
বোঁচা খুব তাচ্ছিল্য করে উত্তর দিল, “ও শুনে তুই কী করবি? চ, ঘরে যাই। দুপুরের খাওয়াটা ভালই জমবে। কিন্তু রান্না কে করবে, পিন্টু? তোদের মেসের কুকতো এই মাংস দেখলেই ভিরমি খাবে, রান্না করবে?”
পল্টু একটু খোঁচা দিয়ে বলল, “রান্না করার দরকার আছে? কাঁচাই খেয়ে ফেল না, ভাতে মেখে!”
পিন্টু হাসল হো হো করে, বলল, “তুই খুব রেগে গেছিস মনে হচ্ছে! চল চল অনেক দেরি হয়ে গেল, কোয়ার্টারে ফিরি। রান্না আমাকেই করতে হবে, বোঁচা। কুকের থেকে আদা, পেঁয়াজ, রসুন, নুন-মশলাটা যোগাড় করে নেব, বাকিটা আমাকেই সারতে হবে!”
৪
নটরাজদার চেম্বারে গিয়ে ছুটির কথা বলতেই, নটরাজদা শেয়ালের মতো খ্যাঁক করে উঠলেন, “এই তো এখনো তিনদিন হয়নি সাতদিনের ছুটি নিয়ে কোন জঙ্গলের থেকে ঘুরে এলি! আবার ছুটি? আবার বুঝি বাদুড়ের মাংস খেতে যাবি? অফিস-টফিস ছেড়ে দিয়ে ওই জঙ্গলে গিয়েই বসে থাক না! যখন যা খুশি করে বেড়াবি, কেউ কিচ্ছু বলতে যাবে না!”
ধমক খেয়ে নীলাব্জ একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “তুমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছো না, রাজুদা। গত পরশু থেকে পিঠে আর মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কী হয়েছে কে জানে! গতকাল ডাক্তার দেখালাম, তিনি পরীক্ষা-টরীক্ষা করে বললেন, তেমন কিছু তো বুঝছি না, মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। বিচ্ছিরি রকমের ঠাণ্ডা লাগলে অনেক সময় এমন হয়। ওষুধ তেমন কিছু দেননি, বলেছেন, কটা দিন একটু রেস্ট নিতে”।
নটরাজদা কটমটে চোখে নীলাব্জর চোখে চোখ রেখে বললেন, “রেস্ট নিবি তো? একটা বেস্ট অপসন দিচ্ছি, শোন। চাকরি থেকে ইস্তফা দে, তারপর লম্বা রেস্ট, রেস্ট অফ ইয়োর লাইফ...”।
নীলাব্জ তাও ছুটির দরখাস্তটা নটরাজদার দিকে আরেকটু ঠেলে দিয়ে বলল, “রাজুদা, প্লিজ! দুটো দিন সময় দাও। তার মধ্যে যদি ঠিক হয়ে যাই, জয়েন করে যাবো। আর নাহলে ফিরে এসে তোমাকে আর এ মুখ দেখাব না”।
এই কথায় নটরাজদা একটু নরম হলেন, একটু চিন্তা করে বললেন, “দেখছিস তো কোম্পানি খরচ কমাতে দিন দিন লোক কমিয়ে দিচ্ছে। আমার টিমে তোকে নিয়ে মোটে চারজন তো রয়েছিস। তার মধ্যে তুই যদি বার বার ছুটি নিস, আমি অন্যদের কী জবাব দেব? আর ওপরওয়ালাকেই বা কী যুক্তি দেব, বল?”
“এর পরে অন্ততঃ ছমাস কোন ছুটি নেব না, রাজুদা। প্রমিস। পিঠের আর মাথার ব্যথাটা খুব কষ্ট দিচ্ছে, শান্তিতে না পারছি, শুতে, না পারছি বসতে। হাঁটাচলা করলেই মাথার মধ্যে ঝমঝম করছে। রোদ্দুরের মধ্যে চোখে কেমন যেন ঝাপসা দেখছি। ঠিক কী যে হয়েছে বুঝতে পারছি না... কটা দিন রেস্ট নিলে যদি...”।
নীলাব্জর ছুটির দরখাস্তে সই করতে করতে নটরাজদা বললেন, “যা প্রমিস করলি, সেটা যেন মনে থাকে। তা নইলে সত্যি সত্যি কড়া স্টেপ নিতে বাধ্য হবো! আজকাল চাকরির হাল তো জানিস, এটা গেলে আর পাবি না। সারা জীবন ঝুলে থাকতে হবে!”
অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নীলাব্জ ছুটির দরখাস্তটা জমা দিল এইচ আর ডিপার্টমেন্টে। তারপর লিফ্ট ধরে সোজা নিচে। সত্যি সত্যি তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। সারা শরীরে একটা চিনচিনে যন্ত্রণা যদি সারাক্ষণ চলতে থাকে, ভালো লাগে? কোন কাজে মন বসে? তার ওপর আর একটা উপসর্গ হয়েছে, রোদ্দুরে কিংবা বেশি আলোতে বেরোলেই চোখে ঝাপসা দেখছে। চোখ কুঁচকে ছোট করে তাকাতে হচ্ছে! সানগ্লাস পরে স্টাইল করার কথা কোনদিনই ভাবেনি, কিন্তু এমন চললে বাধ্য হয়েই তাকে, সানগ্লাস কিনে চোখে লাগাতে হবে।
বাড়ির দিকে যাওয়ার রুটের একটা বাস পেয়ে নীলাব্জ উঠে পড়ল। এ সময় উল্টোদিকের বাসে, মানে পার্কস্ট্রিট থেকে বাড়ি ফেরার বাসে, ভিড়টা বেশ কমই থাকে। যদিও সিট খালি নেই, কিন্তু বেশ আরামে দাঁড়ানো গেল। ধাক্কাধাক্কি বা গুঁতোগুঁতির মধ্যে পড়তে হবেনা। পার্কস্ট্রিট থেকে তার বাড়ির স্টপ অনেকটাই দূর। নীলাব্জ একধারে জুত করে দাঁড়াল, দুহাতে মাথার ওপরের রড ধরে। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম আছে। বাসটা মাঝেমাঝেই ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে ব্রেক মারছে, আর সেই ধাক্কাটা নীলাব্জকে সামলাতে হচ্ছে দুইহাতে ব্যালান্স করে। নীলাব্জ ভয় পাচ্ছিল, এতে তার পিঠে আর কাঁধের ব্যাথাটা আবার বেড়ে না যায়! কিন্তু তা হয়নি, বরং দুহাতে টাল সামলাতে গিয়ে কাঁধে যে টানটা পড়ছিল, তাতে তার বেশ আরামই হচ্ছিল। হঠাৎ কী খেয়াল হতে সে আশেপাশে দাঁড়ানো এবং সিটে বসা লোকগুলোর দিকে তাকাল, কেউ তাকে দেখছে কিনা। নাঃ দেখছেনা, সামনের সিটে বসা দুজন তো গভীর ঘুমোচ্ছে। মাথা ঝুঁকে পড়েছে কোলের কাছে! নীলাব্জ নিশ্চিন্ত হয়ে দুহাতে বাসের রড ধরে ঝুলে পড়ল, পা দুটো একটু তুলে নিল বাসের মেঝে থেকে। আঃ গোটা শরীরটা যেন আরামে জুড়িয়ে গেল। কাঁধের কিংবা পিঠের ব্যাথার অনুভব তো দূরের কথা, কোনদিন যে তার অমন ব্যাথা ছিল, সেটাও মনে হচ্ছে না এখন। সেই সঙ্গে মাথার ভার ভার ব্যাপারটাও ছেড়ে যাচ্ছে। আরামে নীলাব্জ চোখ বন্ধ করল।
কতক্ষণ ওভাবে ঝুলছিল নীলাব্জ খেয়াল করেনি, তার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ভেঙে গেল কন্ডাকটার ভাইয়ের ডাকে। কন্ডাকটার ভাই তার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, বলল, “টিকিটটা লিন তো! কোতায় লাব্বেন কোতায়?” বাসের মেঝেয় পা দিয়ে নীলাব্জ পকেট থেকে টাকা বের করে বলল, “একটা শাঁখারিপাড়া, পার্ক স্ট্রিট থেকে”।
“এর মধ্যে তো কত সিট খালি হয়ে গেল, বসলেন না কেন?” খুচরো পয়সা আর টিকিট দিয়ে কণ্ডাকটারভাই বাসের অন্য দিকে যেতে যেতে বলল, “কত আজব কাণ্ড যে দেখবো রে, ভাই। লোক সিটে বসেই ঝিমোয়, ইনি আবার বাসের রডে ঝুলে ঝুলে ঘুমোচ্ছেন!”
নীলাব্জ মনে মনে হাসল, তারপর নিচু হয়ে জানালা দিয়ে দেখল, বাস এখন হাজরা মোড়ের কাছাকাছি, তার স্টপেজ আসতে এখনো অন্ততঃ আধঘণ্টা! নীলাব্জ আগের মতোই দুহাতে আবার ঝুলে পড়ল, বাসের মেঝে থেকে পা দুটো সামান্য তুলে। দুএকজন তার দিকে অবাক হয়ে দেখছিল, কণ্ডাকটারভাইও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকেই দেখছিল। নীলাব্জ সে সব দেখেও, চোখ বুজে আরামের সমুদ্রে যেন ডুব দিল!
৫
বাস থেকে স্টপেজে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে নীলাব্জর গায়ের এবং মাথার ব্যথাটা আবার ফিরে এল। অসহ্য লাগছে। দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে তাকাতেও পারছে না। চোখে ঝাপসা দেখছে এবং চোখ কড়কড় করছে। অসময়ে বাড়ি ফিরতে দেখে নীলাব্জর মা খুব অবাক হলেন, বললেন, “কীরে বোঁচা, হঠাৎ বাড়ি চলে এলি? ব্যথা কী আরও বেড়েছে? কোথায় কোন জঙ্গলে গিয়ে এ কী বিপদ বাধালি, বাবা? এভাবে অফিসে নিত্যি ছুটি নিলে, চাকরিটা থাকবে তো?”
মায়ের কোন কথারই উত্তর দেওয়ার মতো কোন জবাব নেই নীলাব্জর কাছে। দোতলায় নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “তুমি অত চিন্তা করো না তো মা। আমি একটু ঘুমোবো, এখন আমাকে বিরক্ত করো না”।
সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে নীলাব্জর মা জিগ্যেস করলেন, “কিছু খাবি?”
“নাঃ। এখন শুধু ঘুমোবো”। শরীরের যন্ত্রণায় এখন কথা বলতেও ভালো লাগছে না, নীলাব্জর। নিজের ঘরে ঢুকেই দরজায় ছিটকিনি দিল। তারপর চটপট জামা প্যান্ট ছেড়ে নীল বারমুডা আর আকাশী টি শার্ট গায়ে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা লোহার হুক। পাখার ব্লেডের সীমানা থেকে অনেকটাই দূরে।
ওটার দিকে তাকিয়ে তার মাথায় অদ্ভূত একটা মতলব এল। বিছানায় উঠে বসে আন্দাজ করে দেখল, টেবিলটা টেনে তার ওপর চেয়ার চড়ালে, তার যা হাইট ওই হুকটায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। বিছানা ছেড়ে উঠে, পাখার সুইচটা অফ করল, তারপর দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে, মায়ের কাপড় শুকোতে দেওয়ার লম্বা নাইলনের দড়িটা খুলে নিল। মায়ের শাড়ি-টাড়ি কিছু দড়িতে শুকোতে দেওয়া ছিল, সেগুলো বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঘরে এসে টেবিলটা টানল হুকের ঠিক নিচে। টেবিলের জিনিষপত্র মেঝেয় নামিয়ে, তার ওপর চেয়ারটা চড়িয়ে দিল। এবার কাঁধে নাইলনের দড়ি নিয়ে সাবধানে উঠল চেয়ারে। হাতের সামনেই সেই হুক। হুকের মধ্যে দড়ির এক প্রান্ত ঢুকিয়ে ফেলে দিতেই, দু ফেরতা হয়ে দড়ি সরসরিয়ে নেমে এল নিচেয়। নীলাব্জ চেয়ার ছেড়ে টেবিলে নামল, তারপর আন্দাজ মতো হাইটে দড়ির দুটো মুখ শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তার কাজ শেষ। টেবিল চেয়ার যথাস্থানে সরিয়ে দিল। ফ্যানের সুইচ অন করে এল আবার। তারপর ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে, দড়ির গাঁটটা দুহাতে ধরে ঝুলতে লাগল দড়ি ধরে। পা দুটো দুলতে লাগল মেঝে থেকে সামান্য ওপরে।
আঃ কী আরাম, শরীরের সব যন্ত্রণা কোথায় উধাও হয়ে গেল। তার দু চোখ ঝামড়ে নেমে এল ঘুম!
দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে নীলাব্জর ঘুম ভাঙল, মায়ের গলা শুনতে পেল, “ও বোঁচা, দরজায় খিল দিয়ে এ কেমন ঘুমোচ্ছিস, বাবা? উঠে দরজাটা খোল, একবার। কতক্ষণ ধরে ডাকছি...সাড়া দিচ্ছিস না কেন?” নীলাব্জ দড়ির গাঁট ছেড়ে নেমে এল মেঝেয়। টেবিলের জিনিষপত্র মেঝেয় রেখেছিল, সেগুলো সে সময় তোলা হয়নি। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে, দরজার ছিটকিনি খুলল।
দরজা খোলা পেয়ে এবং ছেলেকে দেখে নীলাব্জর মা স্বস্তির শ্বাস নিলেন, বললেন, “ওফ কী চিন্তাতেই ফেলেছিলি, বাবা! ডেকে ডেকে গলা চিরে গেল, দরজা বন্ধ করে এভাবে কেউ ঘুমোয়”? নীলাব্জর মা ঘরে এসে ঢুকলেন, “লাইটটাও জ্বালিসনি...” বলেই ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিলেন। এলইডি বাল্ব, বেশ জোরালো আলো। ঘরে আলো যতক্ষণ ছিল না, নীলাব্জ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল, এখন বেশ কষ্ট হচ্ছিল তাকাতে।
নীলাব্জ জিগ্যেস করল, “কটা বাজছে গো?”
“সাড়ে আটটা। চা খাবি তো? চা করে আনছি। মুখেচোখে জল দে।”
মা বেরিয়ে যেতে লাইটটা নিভিয়ে, মোবাইলটা হাতে করে, বিছানায় বসল নীলাব্জ। স্ক্রিন আনলক করে দেখল, তিনটে নাম্বার থেকে মিস কল এসেছে। পল্টুর দুটো, নটরাজদার একটা, আর পিন্টুর আটত্রিশটা! পিন্টুর কী হল, এতবার ফোন করেছিল কেন? মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না। পাশে রেখে দিল ফোনটা। তারপর চুপ করে বসে ঘরের চারদিক দেখতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরেই মা এলেন দরজায়, হাতে চায়ের কাপ।
“ঘরের আলো নিভিয়ে ভূতের মতো বসে কী ভাবছিস বল তো? কী হয়েছে কি তোর বোঁচা?” হাত বাড়িয়ে মা আবার সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। নীলাব্জর দিকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে করতে বললেন, “হ্যারে কী হয়েছে, বল তো? তোর মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন? গাল ভর্তি দাড়ি...আজ দাড়ি কামাসনি? অফিসে যাওয়ার সময় তো দেখলাম কামিয়েছিস। তোর কী হয়েছে রে বোঁচা, আমাকে খুলে বল, বাবা?”
একটু বিরক্তি নিয়েই নীলাব্জ বলল, “কী আবার হবে? কিচ্ছু হয়নি মা। বাবা ফিরেছেন?”
“তোর বাবার আজ ফিরতে দেরি হবে। তোর মেজকাকার শরীর খুব খারাপ, দেখতে গেছে। কাল পারলে সময় করে একবার যাস না, বোঁচা, মেজকাকা তোকে খুব ভালোবাসে। তোকে দেখলে খুব খুশি হবে...ওটা কী রে?” হঠাৎ চমকে উঠে নীলাব্জর মা বললেন। কথা বলতে একদমই ভালো লাগছে না, তবু নীলাব্জ জিজ্ঞাসা করল “কোনটা”?
“দড়িটা...ওখানে কী করতে এনেছিস? তাই বলি, আমার কাপড়চোপড় বারান্দার রেলিংয়ে কে রাখল?” তারপরই হঠাৎ নীলাব্জর কাঁধে হাত রেখে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বললেন, “তোর মতলবটা কী বলতো? নাইলনের দড়ি এনে ঘরের সিলিং থেকে ঝুলিয়েছিস। সেই দুপুর দেড়টা থেকে এই রাত আটটা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস! তোর রকম সকম আমার ভালো লাগছে না, বোঁচা। কী হয়েছে আমায় খুলে বল, সোনা। আমার কাছে লুকোস না। হ্যারে নেশা টেশা কিছু শুরু করিসনি তো?”
এবার একটু জোর করেই নীলাব্জ বলল, “মা, তোমার এত প্রশ্নের উত্তর দিতে ভাল লাগছে না। জানই তো শরীরটা ভাল নেই। অন্ধকারে চুপ করে শুয়ে থাকতে ভাল লাগছে। তার জন্যে তুমি এত সব ভেবে নাও কেন”?
নীলাব্জর মা একটু রাগ এবং কিছুটা অভিমান করে বললেন, “বেশ নিজের মনেই থাকো। চাটা দিয়ে গেলাম, খেয়ে আমায় ধন্যি করো”, দরজার কাছে গিয়ে আবার বললেন, “বাবার সামনে অমন মুখ নিয়ে কথা বলো না যেন। জানই তো তোমার বাবা কেমন ব্যতিব্যস্ত মানুষ...”। বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
নীলাব্জ উঠে গিয়ে ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে, চায়ের কাপটা হাতে নিল। কাপটা মুখের কাছে আনতেই, উৎকট এক গন্ধে তার যেন বমি পেল! কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে, ছাদে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেল। অন্ধকার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অনেকটা ভালো লাগছে, কিন্তু শরীর আর মাথার ব্যাথাটা আবার ফিরে আসছে টের পেল। ফোন আনলক করে, পিন্টুর নাম্বারে ডায়াল করল। বার পাঁচেক রিং হওয়ার পর, ওপার থেকে পিন্টু বলল, “কী রে, কী করছিস?”
“শরীরটা ঠিক নেই, ছাদে পায়চারি করছি”।
“শরীরে কী? ব্যথা? মাথায়, দুই কাঁধে আর পিঠে?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তুই কী করে জানলি?”
“আয়নায় মুখটা দেখেছিস?”
“কেন বলতো? সকালে শেভ করার সময় দেখেছিলাম।”
“এখন একবার দেখে নিস। আর পারলে এখনই বেরিয়ে পড়!”
“কোথায়?”
“আমার এখানে। যত শিগ্গির আসতে পারবি, ভালো হয়ে যাবি”।
“কলকাতায় বড়ো বড়ো ডাক্তার থাকতে, তোর ওই জঙ্গলে গিয়ে ভালো হবো?”
“এ অসুখ সারানো কলকাতার ডাক্তারদের কম্মো নয়। ভালো চাস তো, চটপট চলে আয়”।
“কিন্তু ট্রেনের রিজার্ভেশন? চাকরি? আমার বস নটরাজদা বলে দিয়েছে, এবারের ছুটি দুদিনের বেশি হলেই, চাকরি নট...”
“গুলি মার তোর চাকরিতে আর রিজার্ভেশনে। জীবনটা আগে, নাকি চাকরিটা? কথা বলতে ভালো লাগছে না, চলে আয়। খুব দেরি হবার আগেই, বেরিয়ে পড়...রাখছি”।
পিন্টু কেটে দিল ফোনটা। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলাব্জ কিছু ভাবল। তারপর নিচেয় এসে, বাথরুমে গেল। লাইট না জ্বেলেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হল, ভয়ও পেল খুব। দ্রুত ঘরে এসে বারমুডার পকেটে পার্সটা ঢোকাল। কাঠের আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে, গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিল। তারপর আবার ছাদে গেল।
পিন্টু ঠিকই বলছে, ওকে আবার সেই জঙ্গলেই ফিরতে হবে। যত শিগ্গির সম্ভব। সদর দরজা দিয়ে বেরোতে গেলে, মা দেখে ফেলবেন, হৈ চৈ করে পাড়ার লোক জড়ো করে ফেললে কেলেঙ্কারি...। সামনে যখন রয়েছে ওই আমগাছের ডাল, তখন ছাদ থেকেই...
৬
শিল্টনগঞ্জ শহরের সীমানা অনেকটা ছাড়িয়ে বাস যখন দুপাশে জঙ্গল নিয়ে ছুটতে শুরু করল, নীলাব্জ ভীষণ আরাম অনুভব করল। ওফ্ কী শান্তি! তার যন্ত্রণাহীন শরীরটা এখন খুব হাল্কা। ইচ্ছে করলেই সে যেন উড়তে পারে। চাদরের আড়াল একটু সরিয়ে নীলাব্জ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। দেখছিল উল্টোদিকে দৌড়ে চলা গাছপালা, ঝোপঝাড়। বাতাসের ঝাপটায় জঙ্গলের ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগল, কানে আসছিল ঝিঁঝিঁর একটানা আওয়াজ। এই ছুটে চলা বাস, আশেপাশে, সামনের মেঝেয় বসে থাকা সহযাত্রীদের সবাইকেই তার অবান্তর মনে হল। সে এখানে কেন? এ তো তার জায়গা নয়!
বাসের জানালার গরাদের ফাঁকগুলো যথেষ্ট নয়। নীলাব্জ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, তার পাশে বসা আদিবাসি মহিলা এখন ঢুলছেন। আশেপাশে সামনে মেঝেয় বসা সকলেই কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। পিছনের দরজাটা এমন কিছু দূরে নয়। নীলাব্জ মনস্থির করে নিল, তারপর লাফ দিয়ে এক ঝটকায় বেরিয়ে পড়ল বাসের পিছনের দরজাটা দিয়ে! মুক্তির এমন আনন্দ সে কখনো কোনদিন পায়নি!
অনন্তপুর স্টপেজ আসতে বাস দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার ধারে। কন্ডাক্টার বাস থেকে নেমে চেঁচাতে লাগল “অঁন্তপুর...অঁন্তপুর...”। তন্দ্রা ভেঙে আদিবাসি মহিলা দেখলেন, তাঁর পাশের সিটে কেউ নেই। সিট থেকে মেঝেয় লুটোচ্ছে চাদরটা। মহিলা চাদরটা গুছিয়ে সিটে তুলতে গিয়ে দেখলেন, মেঝেয় পড়ে আছে একটা নীল বারমুডা। তার পকেটে একটা পার্স। অবাক হয়ে তুলে নিলেন। চাদর তুলে দেখলেন, আকাশী একটা টি শার্ট পড়ে রয়েছে! মহিলা ভীষণ ভয়ে আর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ই দ্যাখ গ কণ্ডাক্টর...এ বাবুটো প্যাণ্ট জামা, মানিব্যাগটো ফেইল্যে কুথায় চলে গেল, বটে”?
জঙ্গলের মধ্যে গাছের ছায়ায় ছায়ায় এলোমেলো কিছুক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে নীলাব্জ একটা গন্ধ পেল। ওই গন্ধটা তার চেনা নয়, কিন্তু ওই গন্ধে ভীষণ আনন্দের একটা অনুভূতি হচ্ছিল! গন্ধটা কোনদিক থেকে আসছে, অনুমান করে সে সেইদিকে দৌড়তে লাগল। গন্ধের তীব্রতা বাড়ছে... বাড়ছে তার আনন্দের অনুভূতি। ছোট্টবেলায় স্কুল ছুটির পর গেটের ধারে সে দাঁড়িয়ে থাকত মায়ের অপেক্ষায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অনেকটা দূরে সে যখন মাকে দেখতে পেত, তাকে নিতে মা আসছেন, ভীষণ আনন্দ হত। এখন ঠিক সেই অনুভূতি!
জঙ্গলের ভেতরে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে, সে ঢুকে পড়ল, বিশাল এক মহুয়া গাছের কোটরে... শান্তিতে পা মুড়িয়ে কোটরের দেওয়াল আঁকড়ে সে ঝুলতে লাগল।
পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “যাক, এসে পড়েছিস? ভালোই হল!” চেনা গলা শুনে, নীলাব্জ ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখল, কানের কাছে সাদা রোঁয়া নিয়ে সেও ঝুলছে! তারই মতো, ওপরে পা...নিচেয় মাথা! তারপর মহানন্দে দুলতে লাগল দুজনে!
..০০..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।