রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সাবেক প্রচারক, ভারতীয় জনতা দলের (বিজেপি) সদস্য ও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার সম্প্রতি বলেছেন, ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ চাইলে এক হয়ে যেতে পারে। তিনি দুই জার্মানির এক হওয়ার নজির দেখিয়েছেন। বক্তব্যটা উনার ব্যক্তিগত নয়, এটা হিন্দুত্ববাদের অভিলাষ।
হিন্দুত্ববাদ নিয়ে কথা বলার আগে বিভ্রান্তি এড়াতে একটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখা ভালো। হিন্দুত্ববাদ হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্ম না। এটা আধুনিক জামানার একটা বর্ণবাদী রাজনৈতিক আদর্শ।
হিন্দুত্ববাদীরা একটা খাঁটি 'ভারতীয় সংস্কৃতিতে' বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, এই সংস্কৃতি শুদ্ধভাবে 'দেশি'। এর ওপর কোনো ধরণের 'বহিরাগত' প্রভাব নেই।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষ বলে যে অঞ্চলটি পরিচিত ছিল, আজকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যার অংশ; তাকে হিন্দুত্ববাদীরা 'অখণ্ড' ভাবে। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব তারা স্রেফ রাজনৈতিক বাস্তবতার খাতিরে মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের অভিলাষ 'অখণ্ড ভারত' ফিরিয়ে আনা।
হিন্দুত্ববাদীরা 'অখণ্ড ভারতের' সম্প্রদায়গুলোকে দুভাগে ভাগ করে:
১) 'দেশি' — হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়
২) 'বহিরাগত' — মুসলমান আর খ্রিস্টান
হিন্দুত্ববাদীরা মনে করে, সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু না হলেও ভারতীয় হওয়া সম্ভব, সেইসব সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য যেগুলো 'উৎসগতভাবে' দেশি। বুদ্ধ, নানক, মহাবীর : এঁরা সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু নন। কিন্তু যেহেতু এঁরা ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে জন্ম নিয়েছেন, তাই হিন্দুত্ববাদীদের চোখে এঁদের অনুসারীরাও ভারতীয়।
মুসলমান আর খ্রিস্টানরা হিন্দুত্ববাদীদের চোখে ভারতীয় না। কেননা ক্রিশ্চিয়ানিটির 'উৎস' ফিলিস্তিন, ইসলামের 'উৎস' আরব। দুটোই ঐতিহাসিক ভারতবর্ষ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।
তাই মুসলমান আর খ্রিস্টানদেরকে 'বহিরাগত' ভাবে হিন্দুত্ববাদীরা। ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে মুসলমান (আরব ও তুর্কি) আর খ্রিস্টান (পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ) দের আগমন পরবর্তী সময়টাকে তারা একটা অন্ধকার যুগ হিসাবে দেখে। তারা 'ভারতীয় সংস্কৃতির' একটা স্বর্ণযুগে বিশ্বাস করে।
হিন্দুত্ববাদীদের এই বর্ণবাদী রাষ্ট্রপ্রকল্প ঐতিহাসিকভাবে সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন।
প্রথমত, দুনিয়ার সব মানুষই আফ্রিকা থেকে উৎসারিত হয়েছে, এই বৈজ্ঞানিক তথ্য মেনে নিলে 'দেশি'/'বহিরাগত' বিভাজনটাই ভেঙে পড়ে। অত পেছনে না গিয়েও বলা যায়, বিদ্যায়তনিক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত আর্য অভিবাসন তত্ত্ব অনুসারে, আর্যভাষী পশুপালক গোষ্ঠীগুলো বাইরে থেকে ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে এসেছিল। ফলে 'খাঁটি ভারতীয়' বলে আসলে কিছু নাই, এই অঞ্চলের সব মানুষই কমবেশি বহিরাগত।
দ্বিতীয়ত, আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের খ্রিস্টানরা পর্তুগীজ-ওলন্দাজ-ফরাসি-ইংরেজ না, মুসলমানরাও আরব-তুর্কি না, এঁরা এখানকার মানুষ। নানান সময়ে নানান কারণে এঁদের বাপ-দাদারা ধর্ম পাল্টেছেন, ক্রিশ্চিয়ানিটি বা ইসলাম বরণ করেছেন। কিন্তু এঁরা তাতে বহিরাগত হয়ে যাননি, হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-আদিবাসীদের মত এঁরাও আজকে ভারতীয়, পাকিস্তানি, ও বাংলাদেশি পরিচয়ের সমান দাবিদার।
তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ভারতবর্ষ অঞ্চল ছিল, রাষ্ট্র না। আজকে ভারত নামে যে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র দেখি, তা গঠিত হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে। ফলে হিন্দুত্ববাদীরা যে 'অখণ্ড ভারত' গড়তে চায়, তা আসলে তাদের সাম্রাজ্যিক অভিলাষ মাত্র।
মুসলমান বা অন্য কোনো সম্প্রদায়গত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে পরাস্ত করা যাবে না। কেননা পরিচয়বাদী রাজনীতি একটা আরেকটাকে শক্তিশালী করে। হিন্দুত্ববাদকে পরাস্ত করতে পারে স্রেফ গণতান্ত্রিক রাজনীতি।
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যত সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন সবাইকে নিজ নিজ দেশের সমমর্যাদাপূর্ণ নাগরিক হিশাবে প্রতিষ্ঠা করা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করাটাই কেবল পরিচয় প্রশ্নের সুরাহা করবে। তিন দেশেই এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা কর্তব্য। এই ক্ষেত্রে ন্যুনতম ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
হিন্দুত্ববাদের 'অখণ্ড ভারত' প্রতিষ্ঠার দুঃস্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে, নাকি সমগ্র উপমহাদেশ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটবে; ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশিদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জুলাই ২৬, ২০২২
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।