বাঁদিনামা
তামিমৌ ত্রমি
সারাদিন জঙ্গ লড়ার পর খুনখারাপিতে আকাশ ছিঁড়ে ফালা ফালা করে আফতাব আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পশ্চিমে ঢলে পড়বে।
এই রঙ্গীন আকাশটা ঢেকে যাবে হিজাবে। সুর্মা পরা চোখের মতো আসমানে তখন ঝিকমিক করবে সিতারার চুমকি। তখন এই ঘাসের উপর বসে কারোর চোখে কী চিকচিক করবে আতর?
যাঃ! চোখে আবার আতর চিকচিক করে নাকি? করে। ফোঁটা ফোঁটা আশনাই মিশিয়ে দিলে কান্নাও আতর হয়ে যায়।
ঐ কবুতরটা... এইমাত্র যে মকবরায় ডানাচুমু দিয়ে উড়ে গেল তার নীচে কবরের বিছানায় শুয়ে আছেন আমার দিল আমার জিগর... পরন্তপ পরওয়রদিগার আমার..
আমার?
আমি কে? আমি তো এই মকবরাকে ঘিরে যে ঘাসেদের সিপাহি প্রহরা, সেই ঘাসের পায়ে ঘুমিয়ে থাকা ধুলমিট্টিও নই।
আমি কে? সলমা? জরিনা ? মেহেরুন্নিসা?.. যে কেউ হতে পারি, আবার না-ও হতে পারি। তাতে কি ইতিহাসের কিছু যাবে আসবে? দাস্তানের যাদু শরবতের সোয়াদে কমতি ঘটবে কিছু?
আমি কেউ না। আমি তো স্রেফ একটা রবাব, যাকে বাজিয়ে ছিলেন নিজাম খান। ও, নিজাম খান বললে তো এ দুনিয়া তাকে চিনবে না, তামাম হিন্দুস্তান তাকে চেনে সুলতান সিকন্দর লোদী বলে। সিকন্দর বলে সিকন্দর! তার সময়ে সলতনৎ এর সীমা ছাড়িয়ে ছিল দূর, বহুদূরে... গোয়ালিয়র জিততে পারেননি জীবদ্দশায় কিন্তু মানসিংহের নিঃশ্বাস জব্দ করে এনেছিলেন প্রায়।
গোয়ালিয়র জয় আর বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য যমুনার তীরে একটা জলজ্যান্ত তসবিরই এঁকে ফেললেন.. আগ্রা। সে যে কি আশ্চর্য মায়ানগরী, তা যে দেখেছে সে-ই জানে। দিল্লির চেয়ে সে লাখোগুণে খুবসুরত যেন জন্নতের নুর বা আশিকের খোয়াব!
কান্না, ও কান্না তুমি কেন আতর হয়ে বও? কান্না মানে জল... আব...পানি... সেদিন রাতের খানাপিনা শেষে দাঁড়িয়েছিলাম হীরে জহরতের নকসাফুল কাটা সোনার জলপাত্র হাতে। সুলতানকে দিতে হবে হাত ধোবার জল... তিনি নীচু হয়ে দুহাতে নৌকো বানিয়ে দীঘি তৈরি করছিলেন আর ধীরে ধীরে কচলে নিচ্ছিলেন আতিশরঙ্গা গনগনে দুই হাত আর এই নাচিজের নরম দিল... এ অধম বুকে কোন কিছু কি ধক ধক করছিল তখন! মনে তো হয় না। সে তো মরেই গেছিল। দু চারটে না গাওয়া নাগমা বরফ হয়ে গেলে যেমন, তেমনই জমাট আকুতি নিয়ে সুলতানের দুই হাতকে গোসল করাচ্ছিল সে। হঠাৎ হাত ধুতে ধুতেই অন্যমনে একবার চোখ তুললেন সুলতান...
আর
চোখে চোখ আটকে গেল। পর্বতের উপর একটা পাখি এসে বসল।আর উঠল না। ঐ বিরাট পত্থর- দিল পর্বতের বুকে সে-ও পাথরের পাখি হয়ে স্তব্দ বসে রইল।
রইল তো রইল, তেমনি থেকে যেতে পারতো..
কিন্তু তা তো হওয়ার নয়।
এই দুনিয়ায় পাথরও চুর চুর হয়ে মিশে যায় মাটিতে একদিন। সুলতান চোখ নামালেন।পাখির তলা থেকে পাহাড় খসে পড়ল। জলপাত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
তখন আমার বুকের মধ্যে ময়ূর নাচছে। অন্ততঃ একবার তো চোখাচোখি হল.. জন্নতের সুখ অন্তত একবার তো এ পোড়া বাঁদির নসীবে...
সেই রাতে 'ডাক' এসেছিল। এই বাঁদি হয়েছিল মলিকা। আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়লেও এই বদনসীব এত অবাক হোত না যখন গরম ছাই দিয়ে তার শরীর আর ভ্রু থেকে বাড়তি লোম চেঁছে ফেলে দিল বিলকিস। বাড়তি লোম রাখা তো হারাম। এমনকি নাকের লোম অব্দি রাখতে নেই আমাদের। তাই লোম দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সাফসুতরো করে ফেলার অভ্যেস চিরকালের। তবু সাবধানের মার নেই, যে দু একটা লোম ইতিউতি উঁকি মারছিল,সেগুলোও পার পেল না। শাহী গোসলখানায় দুধ হলুদ আর চন্দন বাটা দিয়ে যখন এই অঙ্গ ঘষা মাজা করা হতে লাগল তখনও আমি ঘোরের মধ্যে আছি। এ-ও কি সম্ভব! গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো স্বপ্নিল জলে গোসল করতে করতে মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি আর দুনিয়ায় নেই। যারা আমার খিদমতগারি করছে তারা বুঝি ইনসান নয়, ফেরেস্তা।
গা মুছিয়ে দুধেল মসলিন কাপড়ে আমার শরীর মুড়ে নিয়ে আসা হল শাহী সাজঘরে। বাদাম আর চামেলি ফুলের পাপড়ি বাটার রূপটানে মুখ আমার হয়ে উঠল সোনার ফুলকাটা আয়নার মতো । নখ হেনা দিয়ে রঙ্গীন করা হল। মেহেন্দি রচিত হল হাতে পায়ে। মেহেন্দীর এই নকসার মতোই কি কারুকার্যময় আমার সুলতানের হৃদয়? আর কিছুক্ষণ। তারপরেই... কী হবে? কী হবে তারপর?
আমার আতর শরীরে রোমাঞ্চ খেলে গেল। পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হল, এক্ষুনি এখান থেকে পালিয়ে যাই। সম্ভব হলে দুনিয়ার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কেউ যেন আমাকে খুঁজে না পায়। এ কি জ্বালা রে বাবা। একজন মামুলি বাঁদিকেই শেষপর্যন্ত সুলতানের নজরে পড়ল! আর কি কেউ ছিল না এই হারেমে?
কাঁধে বিলকিসের হাতের ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠলাম। সামনেই রুপোর অপরূপ কারুকার্য করা সুবাস - দান। আমি কাপড় হাঁটু অব্দি উঠিয়ে দু পা ফাঁক করে দাঁড়ালাম তার উপর। সেখানে অজস্র চন্দন - গন্ধী ধূপ জ্বলছে। রুপোর সূক্ষ্ম জাল চুঁইয়ে সেই ধোঁয়া আমার গভীরতম প্রদেশকেও গন্ধে মাতোয়ারা করে তুলছে। বিলকিস রাবেয়া... আমারই দুই সহেলি আজ ধূপের ধোঁয়ায় আমার হেনা করা চুল শুকোতে ব্যস্ত। সুবাসিত হওয়ার পর রাবেয়া আমার অঙ্গে দিল সোনালি জরির কাজ করা দুধ সাদা জেলিক। তার উপর ফুলেল সোনার জরি চুমকি বসানো রেশমের সবুজ কাফতান, পরনে টুকটুকে লাল ঢোল্লা সালোয়ার। বিলকিস মাথায় পাকিয়ে পাকিয়ে জড়িয়ে দিল সবুজ ওড়নি, তাতে রক্ত ফোঁটার মতো চুনি বসানো সোনার ঝালর। কানে গলায় হীরে জহরতের জেবর। হাতে হীরের আংটি। চোখে সুর্মা। ঠোঁটে লালিমা। পায়ে সোনালি রেশমের চুনি পান্না বসানো জুতো।
তাজ্জব কি বাত! এত বড় ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল হেরেমের এই বাঁদি, যার বাঁদি মা তাকে জন্ম দিয়েই মরে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আম্মির সহেলি শায়রা খালা তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ না করলে সেও হয়তো দুদিন বাদে তার আম্মির কাছেই চলে যেত। শায়রা খালা তো বলে, আম্মি নাকি মরেনি, আমাকে জন্ম দেওয়ার পর ধাই যে দুধ এনেছিল মায়ের জন্য, তাতে নাকি কিছু মেশানো ছিল।
কে জানে এই অন্দুরানি, জেনানা মহলের অন্ধকারে হররোজ ঘটতে থাকা কোন না কোন পাপের ফল ... এই অধম সলমা, জরিনা বা মেহেরুন্নিসা সে রাতে মেহেবুবা সেজে বসেছিল চাঁদনীর মতো রূপোলি মশারির নীচে উথলোন দুধেল খাটে।
মাঝরাতের পাখিচিরুনি অন্ধকারের মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে উড়ে যেতেই সুলতান এলেন। ধবধবে পোষাক তার ধবধবে রঙের সঙ্গে এমন মিশেছে যেন দুধের সমুন্দরে দুধের জাহাজ বইছে। বিছানায় দুধ ঢেউ তুলে তিনি আমার প্রতি গাঢ় হলেন। চিবুক স্পর্শ করে ধীরে ধীরে ওঠালেন আমার মুখ। যেমন ফুলের ফোঁড় তোলে সূঁচ।
আবার চোখে চোখ। পর্বত ঘনিয়ে আসছে পাখির উপর। পর্বতের কোটরে কোটরে গরম নিঃশ্বাস....পাখি বুঝি দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে এবার। মওতের ঘনঘোরে চোখ বুজে আসে। মরতে এত আনন্দ আগে তো জানা ছিল না।
আহ! পাখির ঠোঁট ঠুকরে দিল কে? জ্বালা এত মধুর কেন? চিনচিনে ভিজে ঠোঁটে নোনতা রক্ত। ঠোঁটেও তবে গুলাব খিলখিলিয়ে ফোটে!
ওয়ক্ত, সুলতানের ঠোঁট আর হাত কখনো থেমে থাকে না। এই জিসমের যে অলিতে-গলিতে তারা সৈর করতে লাগল সেই গলিই হয়ে উঠল শাহী রাস্তা...সে রাস্তার ধারে ধারে গুলবাগিচা, সবুজ ঘাসের গালিচা,আর্শী আসমান, পেখম তোলা নীল কাফতান পরা মাহজাবিন মোর... সাজিন্দার, তবলচি, শরাব, ফোয়ারা, বুলবুলের নাগমা...
সফর শেষ হলে আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে সুলতান বললেন, 'তোমার চোখদুটোতে কি যেন আছে। কোহরার মতো ধোঁয়াটে, আবার ঝিলের মতো স্পষ্ট।'
হায় আল্লা, কথাটার মানে কিছুই বুঝলাম না কিন্তু কথাটা কি সুন্দর! কানে যেন কোয়েলিয়া গান গেয়ে গেল। দুনিয়ায় কে না জানে সুলতান কত বড় শায়র। শুধু যদি শায়র হয়েই জন্মাতেন, তাহলে তিনি শায়রদেরই সিকন্দর হতেন।
আবার এই মায়াবি মানুষটাই যখন তলোয়ার ধরেন তখন তিনি সাক্ষাত মওত। তলোয়ার তো সেই প্রথম থেকেই তার সঙ্গী। বাহ্লুল লোদীর মেজো ছেলে তিনি। বড় ছেলে বরবক কি এমনি এমনি সলতনৎ ছেড়ে দেবে? লাগল যুদ্ধ। শেষে সিকন্দরের হাতে হার মেনে বন্দী হয়ে তবে শায়েস্তা হলেন বরবক। বাহ্লুল লোদীর ভাইপো ইশা খানও কি কম চেষ্টা করেছিল আমীরদের নিজের দলে টানতে? সিকন্দর হিন্দু মায়ের ছেলে, তার রক্ত বিশুদ্ধ নয় এইসব বলে সে ক্রমাগত আফগান দরবারিদের একটা অংশকে খেপিয়ে তুলছিল। কিন্তু সেসব ধোপে টিকল না। অবশ্য সিকন্দরকে তখতে বসানোয় তার মা বিবি অম্বা'রও অবদান কিছু কম ছিল না।
সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতান সিকন্দর শাহ আমার মতো এক বাঁদির চোখে কি যেন খুঁজছেন। এ সুখ আমি রাখি কোথায়? ঝিলের মতো স্পষ্ট কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে চোখের কি মানে, তা আমার মতো মূর্খ কী বুঝবে? আমি তো শুধু জানি, আমার এই রক্তমাংসের চোখ দুটো শায়র সুলতানকে অন্তত একবার হলেও মুগ্ধ করেছিল, ভাবিয়েছিল। এই কথা মনে করে গর্বে বুকটা ফুলে উঠল, চোখ দুটো দুলে উঠল। চোখের কোলে জল ঠিকরে উঠল। শাহেনশাহ আমার টলটলে চোখদুটোতে আরো বুঁদ হয়ে গিয়ে বললেন, ' গুলরুখ নামে এক শায়র আছে। নাম শুনেছো? '
গুলরুখ? লালফুল, এটাই তো সুলতানের তখল্লুস না? হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ছে, কবে যেন সন্ধ্যেবেলা বিলকিস গল্প করছিল গুলরুখ ছদ্মনামেই সুলতান শায়েরী লেখেন।বিলকিসের সঙ্গে আসলে খাস খ্বোজাসর সুলেইমানের একটু মাখামাখি আছে তো, তাই সে অনেক ভিতরের কথা জানতে পারে।
খ্বোজাসর সুলেইমানই তো সুলতানের শয্যাগৃহের দেখাশোনা করে। তার বাছাই করা কিছু লোক ছাড়া সেখানে কেউ ঢুকতে পারে না। সে-ই সুলতানের বিছানা করে, নখ, চুল, দাড়ি কেটে দেয়, শোবার আগে বাদশাহের জল চেখে দেখে। সুলতানের ডান হাত সে। যদিও জেনানা দারোগা বাহিনীর কারো কানে যদি বিলকিস আর সুলেইমানের ইয়ের কথা যায়, তাহলে বড় মুশকিল। তারা জানিয়ে দেবে সরা - ঈ- পর্দাদারকে। আর সরা- ঈ- পর্দাদার যদি একবার সুলতানের মা বা খাস শাহ বেগম- কারোর কাছে কথাটা পাড়ে, তাহলে আর দুজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই খবরটা বিলকিস শুধু তাকেই জানিয়েছে। এখানকার কাক পক্ষীকেও বিশ্বাস নেই যে। হেরেমের বাতাসে বাতাসে ধোঁকা আর বেওয়াফাই। আচ্ছা সুলেইমান কখনো বিলকিসের ঠোঁট কামড়ে দিয়েছে? না না। তাহলে তো আমার চোখে পড়ত। না। ধরা পড়ে যাওয়ার মতো কাঁচা কাজ ওরা করবে না। তবে সেদিন সন্ধ্যেয় সুলেইমান বিলকিসের গালে চুমু খেয়েছিল, একথা সে আমার কানে কানে বলেছিল, খুব হাসছিল সেদিন বিলকিস, ওর চোখ মুখ থেকে যেন হাজার সূর্য্যের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল, আজ এই মুহুর্তে আমার মুখেও কি হাজার সূর্যমুখী ফুটেছে? বিলকিসের সেই সেদিনের মতো? সেদিনই গল্প করেছিল বিলকিস, সুলতানের তখল্লুস লাল ফুল মানে গুলরুখ। কিন্তু এই কথা মুখ থেকে বের করি সে সাধ্য আমার কই? ঠোঁট দুটো তো কেউ আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে।
সুলতান বললেন, 'সেই শায়র গুলরুখ কি বলে জানো? ফোঁটা ফোঁটা আশনাই মিশলে কান্নাও আতর হয়ে যায়..' ইয়া খোদা, সেই রাতের যেন ভোর হওয়ার তাড়া ছিল না। আরও কত কত কথা, শায়েরী, আমার মাথায় এত কিছু ঢোকে নাকি? আমার বুকে তো ঐ একটা কথাই তলোয়ারের মতো বিঁধে বসে আছে। ফোঁটা ফোঁটা আশনাই মিশলে কান্নাও আতর হয়ে যায়।
সেই আতরের গন্ধে ডুবতে ডুবতে সেই ঠোঁটের কামড়ের মধুর জ্বালা মেহসুস করতে করতে আমার জিন্দেগি কেটে গেল। সেই রাতের পর ঠোঁটের জ্বালা যখনই কমে এসেছে তখনই দাঁত দিয়ে চিরে নতুন জ্বালা তৈরি করেছি, নতুন রক্ত পুঁজ ঘায়ে ঠোঁট সাজিয়ে আর্শীতে মুখ রেখে খুঁজতে চেয়েছি - ঝিলের মতো স্পষ্ট আর কোহরার মতো ধোঁয়াটে কী যেন ছিল, কী যেন ছিল এই দুটো চোখে?
সেই প্রশ্ন আর কখনো উতলা করেনি সুলতানকে। আমার কোনদিন কোনও 'তলব' জোটেনি আর। তাঁর হাতে পানি দেওয়ার কাজটাও আর রইল না। গোটা একটা রাতের জন্য সুলতানের সান্নিধ্য পাওয়া খুশকিসমতকে অত ছোট কাজ করতে দেওয়া যায় নাকি আর? আমার জন্য সুসজ্জিত কামরা বহাল হল, মাসোহারার ব্যবস্থা হল, এ পরবে সে পরবে আশরফি, শাহরুখীও যে দু চারটে জুটত না... তা নয়। কিন্তু সোনার খাঁচায় সোনার শেকলে পা বাঁধা টিয়ার মতো আমার ঘরের চাবি খ্বোজাসরের কোমর বন্দী হল। হারেমে সাধারণ বাঁদি হিসেবে ঘোরা বেড়ানোর যেটুকু স্বাধীনতা ছিল, তা-ও হারালাম। কি ভালোই লাগত আমার বাজার করতে। হারেমের ভেতরেই সরগরম বাজার বসত। মেয়েদের দরকারি যাবতীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র সেখান থেকেই কিনে নিতাম আমরা। আমি আর বিলকিস দুজনে মিলে বাজারে যেতাম আর নতুন নতুন নক্সার কানের বালির খোঁজ করতাম। এখন আমার প্রয়োজনের জিনিস আমাকে আর গিয়ে কিনতে হয় না; সেসব আমার কাছেই চলে আসে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার তার অনেক বেশী পেয়ে যাই আজকাল শুধু হারিয়ে ফেলেছি রোদ, বৃষ্টি, মেঘ, ফোয়ারার জলে সূর্যাস্তের হাসিন রঙ্গিলা খিলখিল...
আর সুলতানকে। আমার কাছে আর তিনি ধরা দিলেন না। এক রাতের খোয়াব পরের ভোরেই মিলিয়ে গেল।
যেমন আজও ভোর। কত শান্ত, নির্জন। ঘাসেরা সবুজ। আকাশ নাজুকনীল। কে বলবে এই ভোরে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতার আফতাব চিরতরে অস্ত গেল? মাত্র কয়েক বছরই তো হল আমার সুলতান সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন। এরই মধ্যে বর্বর বাবর কাবুল থেকে এসে হিন্দুস্তান দখল করে বসল। সুলতানের প্রিয় পুত্র ইব্রাহিম আজ ভাঙ্গাচোরা মূর্তির মতো শুয়ে আছে ময়দানে আরও কত শত লাশের ভীড়ে।
পানিপত তাকে ফিরিয়ে দিল না। হিন্দুস্তানের ইতিহাস ইব্রাহিম লোদীর রক্তে পালক ডুবিয়ে নতুন করে লেখা হবে এইবার। ওয়ক্ত এইরকম সব আজব ভোরেদের বাক্স। ডালা খোলে। এক একটা ভোর বেরিয়ে পড়ে।কেউ জাগে। কেউ জাগে না।
কিন্তু তুমি ঘুমোও মেহবুব, প্রিয়তম আমার। আমার শায়র সুলতান। তোমার কবরে বাতি দিতে এসে 'সেই' রাতের কথা মনে পড়ে হাসতে হাসতে রোমাঞ্চিত হতে হতে তোমার সঙ্গে আজীবন বিচ্ছেদের কথা ভেবে পাথর হয়ে যেতে যেতে পানিপতের দুর্দশার কথা মনে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল। চোখ খুলে দেখি,
শুয়ে আছি।
আমি,
আমার বুড়ি ভবিষ্যৎ,
হিন্দুস্তানের তকদীর
অবশ্য বাঁদিদের কোন ভবিষ্যৎ হয় না, অতীত থাকে না, বর্তমান বলে কিচ্ছু হয় না। সে তো এই ঘাসেদের পায়ের ধুলমিট্টিরও অধম। তবু তো সেই ধুলো সুলতান এক রাতের জন্যও গায়ে মেখেছিলেন! তাতেই এই ধুলোমাটি ধন্য।
ধন্য ঐ কবুতরও.. যে এইমাত্র মকবরার চূড়ায় ডানাচুমু খেয়ে উড়ে গেল... তার নীচে ঘুমিয়ে আছেন তিনি... মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে তারে... মৃত্যু... যে একদিন সবাইকেই নিয়ে যাবে তার নিজস্ব সফরে... যা.... ঝিলের মতো স্পষ্ট ; কোহরার মতো ধোঁয়াটে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।