মেয়েদের টেনে বার করে আধখ্যাঁচড়া আলো দেখাচ্ছি, স্বাধীনতার ছোঁয়া অনুভব করাচ্ছি - ছেলেরা কী পাচ্ছে?
বাড়ি যখন ঢোকে ওয়ার্কশপের মসলিনের স্বপ্নজাল নিয়ে - অন্য মানুষের মন তো কংক্রিটের জাল!
কিভাবে মিলবে?
মেয়েটি শিখে যাচ্ছে বাড়িতে স্বাধীন আর স্বনির্ভর হবার ফর্মুলা। হঠাৎ এক সুন্দর সকালে তো বাড়ির পরিবেশ পাল্টাবে না! আমি ২/৩-টে ওয়ার্কশপ করার পর মেয়েদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি বাড়িতে অশান্তি/ঝগড়া।
মেয়েদের মনে হতাশা বাড়ে। বাস্তবের সাথে মিল নেই।
সেফোরা কসমেটিকস আমাদের দুটো ওয়ার্কশপ স্পন্সর করেছিল । আমি একজন রোহিঙ্গা মহিলাকেও নিতে পারিনি। মোট ১৬ জন ইরাকি, ইরানি ও আফগানি মহিলা ছিল।
সেফোরার দেওয়া জিনিস পেয়ে আবার খুশি।
বাড়ি গিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছিলাম।
পরে কোন একদিন জানতে চেয়েছিলাম যে - এত সাজতে ভালবাস, গেলে না কেন?
সেফোরা স্টোর বলে দিয়েছিল যে বাচ্চাসহ ঢুকতে দেবে না। এবার বররা তো বাচ্চা দেখবে না।
কারো কারো বর যদিও বউদের শপিং মলের সেফোরা স্টোরে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু শপিং মলের ভেতরের পরিবেশে স্বচ্ছন্দ নয়।
বলল “সব লোকজন কেমনে তাকায়। শরম লাগে”।
লোকজনও কী করবে! ওরাও তো তাকাবেই। কোন নিয়মকানুন নেই। বাচ্চার দল এখানে ওখানে দৌড়াচ্ছে। খাবার ছুঁড়ে ফেলছে এদিক ওদিক। চিৎকার। দৃষ্টিকটু তো বটেই।
শিক্ষা চাই। চাই শিক্ষা। নিয়মানুবর্তিতা। ভাল খারাপ বোঝার ক্ষমতা।
সেই যে মহিলাদের নিয়ে প্রথম লাইব্রেরি গেলাম। ভগবান! বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই গেলাম। লাইব্রেরিতে তো বাচ্চাদের আলাদা জায়গা আছে। ভাবলাম ওখানে খেলবে বাচ্চারা।
দু সপ্তাহ আগেই লাইব্রেরিয়ানকে বললাম আমাদের ওয়ার্কশপ এর কথা। বুক করা হল স্লট। কাজ শুরু করব কি - কান্নাকাটি, দুধের বোতল ছোঁড়া, এক দুবছরের বাচ্চা শুধু কোলা খাবে। বইয়ের জায়গায় খাবার নেওয়া যায় না। ওখানেই চিপস, বিস্কুট - যাচ্ছেতাই। এর মধ্যে এক মা পড়ার টেবিলে বাচ্চা শুইয়ে ডায়পার পাল্টাচ্ছে। দুর্গন্ধ । কয়েকটি বাচ্চা বুকসেলফের সব বই ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে।
লাইব্রেরিয়ান মাইকে ইংরেজিতে ঘোষণা করছে। সে ভাষা আবার এরা বোঝে না। ওদের ভাষা লাইব্রেরিয়ান জানে না। যা তা অবস্থা। কোন বাচ্চা তারস্বরে কাঁদছে।
আমিও ভেতরে ভেতরে কাঁদছি। কী করব! আমার আরেক কলিগ আসমা আর ইন্টার্ন কারমিসা ছিল সঙ্গী। আমরা তিনজন ঘেমে গেছি।
~~~~
আরো একবার বলছি - এ সবই আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা - আমার মত করে অনুভব করা, নম্বর দেওয়া।
আমার এই কাজের কথা যে কজন আগে থেকে জানতেন আর মাঝে মাঝে আমার থেকে কিছু ঘটনার কথা শুনে বলতেন যে লিখছি না কেন। অবশেষে লিখতে শুরু করলাম ঠিকই, কিন্তু সায়নের সঙ্গে মতবিরোধ হচ্ছে! সায়ন শুধু বলে নির্লিপ্ত হও, লেখার সময় বিচ্ছিন্ন হও। কিন্তু আমি আমার পুরো অস্তিত্ব নিয়ে জড়িয়ে গেছি - আমি কী করে আমাকে এর থেকে আলাদা করব? আমার ক্লায়েন্টদের কেউ কিছু বললে মনে হয় সেটা আমার গায়ে লাগে, এই অস্বস্তি, অপমান, এই অপরীকরনের সমান অংশভাগ আমারও।
কখনো মনে হয় জীবনের কোথায় কোন বাঁক কীভাবে যুক্ত, সত্যিই কী কোন গ্র্যান্ড ডিজাইন আছে এসবের!
অনেক বছর আগে এক সকালে নিজের দেশের ভাল চাকরি ছেড়ে বিকেলের ফ্লাইটে ভাঙা পা নিয়ে এ দেশে চলে আসি এক বছরের মেয়ে নিয়ে। নানা জায়গা ঘুরে কানেটিকাটে সবে একটু থিতু হয়েছি। ওখানে এক সর্দার পরিবারের সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব। গুরমিত আর সুখদীপ, ষাটোর্ধ্ব ওঁরা, গুরমিতের বাবাও ওঁদের সঙ্গে থাকেন, নব্বইয়ের ওপর বয়স। উনি সাতচল্লিশে বাস্তুহারা হয়েছিলেন, তারপর ওঁর ছেলে গুরমিত আর বৌমা সুখদীপ, চুরাশির পর দেশ ছাড়ে। যেদিন কানেটিকাট ছেড়ে আটলান্টা আসব - মন খারাপ। কাঁদছি। সুখদীপজি বলেছিলেন - কাঁদিস না। হয়তো অন্যরকম কিছু অপেক্ষা করছে তোর জন্য আটলান্টায়! এই সুখদীপ আন্টির হাত ধরেই আমার আমেরিকার কমিউনিটি ওয়ার্কে হাতেখড়ি। আমরা স্যুপ কিচেন চালাতাম চার্চে। আমার কাজ ছিল ফ্রোজেন চিকেন কেটে ৪০/৫০ জন মানুষের জন্য মুরগির মাংস রান্না করা। আমি ছাড়া ঐ ভলান্টিয়ার দলের সবাই নিরামিশাষী। আমরা পরিবেশন করতাম না। ব্যুফে সিস্টেম। পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রবিবার প্রার্থনার পর নিজেদের সবচেয়ে ভালো পোশাকগুলি পরে যাঁরা লাঞ্চ করে অনেক আশীর্বাদ করে যান, তাঁদের বেশির ভাগ হোমলেস।
মনে পড়ে যায় অনেক বছর আগে মেদিনীপুর আউটস্টেশন করতে যাওয়া - হাসপাতালে স্ট্রেচারে মুমূর্ষু রোগিণী, পরনে সস্তার বেনারসি শাড়ি - বাড়ির বাইরে পরার মত ঐ একটা কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই।
স্কুল কলেজের পড়াশুনার সময় ঠিক করে পড়িনি। আবার যে পড়া শুরু করব সেটাও ভাবিনি - সেই স্যুপ কিচেন, ESL ক্লাস, ইউনিভার্সিটিতে পড়া, কলেজে কাজ, অদ্ভুতভাবে সেই নেপালি মহিলার সাথে পরিচয়, এই নন্ প্রফিট, রোহিঙ্গা - যাদের সাথে আমার ছোটবেলার আশেপাশের অনেক পরিবেশের প্রচুর মিল, সেই আবার ESL । আমার মা যেরকম কাজ করতেন সেইরকম কাজ। আবার, কিছুটা আমার বাবার পড়ানোর কাজের মতও।
দেশে আমার যখন কলেজ শেষ হয় - ঐসব টুপি পরা - গাউন পরা - স্টেজে হাঁটা - কিচ্ছু ছিল না । আটলান্টায় এসে দেখি কত কলেজের বিজ্ঞাপন। সুন্দর টুপি আর গাউন পরা স্টুডেন্ট। আমারও শখ চাপল। পড়ব - টুপি আর গাউন পরে স্টেজে হাঁটবো।
- কেন ঘটল একের পর এক মিলে যাওয়া সেইসব ঘটনা?
মনে হয় কেউ আগের থেকেই সাজিয়ে রেখেছে রাস্তা! তবে এই রাস্তায় স্বচ্ছলতা নেই । ঐ যে বললাম আমি একজন লোভ, হিংসা সব নিয়ে তৈরি মানুষ। আমার হাত দিয়ে কত কত হাজার ডলার সাহায্য মঞ্জুর হয় ক্লায়েন্টের। অনেকের বাস্তবে এত না পেলেও চলে। কিন্তু এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করে ওদের স্টেটাস। এদিকে আমার অতি সামান্য মাইনে নিয়ে আরো ৫টা কাজ করে জোড়াতালি দিয়ে পড়া আর অন্যান্য খরচ চালাতে হয়। আসমা একদিন খুব দুঃখ করে বলেছিল “আমি জানি, অনেক ক্লায়েন্টের চাইতে তোমার দরকার অনেক বেশি। আমি দুঃখিত।”
অনেক ধনীরা ১০/১৫ হাজার ডলারের গাড়ি এমনি এমনি ডোনেট করে দেয়। আর যারা পায়, আসলে তাদের দরকারও নেই। সেইসব ক্লায়েন্টরা তাই ডোনেশনে পাওয়া গাড়ি বেচে দিয়ে দারুণ ঝকঝকে আরো দামি গাড়ি কিনে নেয়। যারা দেয়, ওরাও জানে যে এমনই হবে।
কিন্তু রিফিউজিও কোন সমসত্ত্ব ব্যাপার না - আমার ক্লায়েন্টদের দুর্দশা দেখে বুক ভেঙে যায়, মানুষের এমন অপমান দেখে মনে হয় হাজার হাজার বছরের মানবসভ্যতা অর্থহীন। প্রান্তেরও প্রান্তে থাকে অন্ত্যেবাসী ওরা।
~~~~
এই যে ক্লার্কস্টন লাইব্রেরি - আমাকে ছাড়া- আমার অনুভূতি ছাড়া একে নিয়ে লিখতেই পারব না।
লাইব্রেরি কার্ড করিয়ে দিলাম মহিলাদের। ছবির বই, লার্নিং সিডি, ভাল ভাল ছোটদের শিক্ষামূলক সিডি খুঁজে দিলাম বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। নেওয়ার দুদিন পরই সবাই নাকি সব ফেরত করে দিয়েছে। লাইব্রেরিয়ান ফোন করে জানাল।
পরের ভিজিটে জিজ্ঞেস করলাম - কেন এত তাড়াতাড়ি ফেরত করলে?
ঊত্তর এল কমিউনিটির ঐ নেতা যার কথা আগে বলেছিলাম, - যে আমাকে পছন্দ করে না, সে নাকি খবর পেয়ে সবাইকে বলেছে যে লাইব্রেরির সম্পত্তি নষ্ট হলে ফাইন হবে। পুলিশ আসবে। ব্যস।
অবাক হই - আমার প্রতিটি পদক্ষেপ কমিউনিটিতে রেকর্ড হয়। আর অবাক করা ভাবে সবাই পুলিশকে ভয় পায় - তীব্রভাবে অবিশ্বাস করে।
আমি এদেশে বাচ্চা নিয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত যখন নিলাম, তখন আমার একমাত্র ভরসা ছিল ৯১১ - আর আমার তত প্রিভিলেজড নয় এমন আফ্রিকান আমেরিকান সহকর্মীদের কাছে সারাক্ষন শুনি - যা কিছু হোক - Don’t dial 911 - রাস্তার অচেনা লোককে ডাকো, পুলিশকে বন্ধু মনে কোরো না!
~~~~
একটা প্রজেক্ট কে যে কতদিকে মেপে আর বিচার করে সাজাতে হয় - যত সূক্ষ্মসূক্ষ্ম মাপ - তার ফলাফলও তেমন চমৎকার।
আরো একবার বলছি - এ সবই আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা - আমার মত করে অনুভব করা, নম্বর দেওয়া।
এই যে ক্লার্কস্টন লাইব্রেরি মহিলা আর বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম - আমি ব্যতিব্যস্ত, আমার কলিগ, ইন্টার্ন সবাই । কিন্তু লাইব্রেরিয়ান, সিকিউরিটি আর অন্যান্য কর্মীরা ব্যালান্সড। লাইব্রেরিয়ান ঘোষণা করছেন ঠিকই। কিন্তু কোন উত্তেজনা বা কঠোর ভাষা নয়। সব কর্মীরা লণ্ডভণ্ড অবস্থা সামলাচ্ছে - কিন্তু বাচ্চাদের বকা তো দূরের কথা, ছুঁয়েও ওদের সরাচ্ছে না। আর আমি বাঙাল বাড়িতে বড় হওয়া বাচ্চা, আমার হাত পা নিশপিশ করছে, চীৎকার করে বকতে পারছিনা বলে গলা ব্যথা করছে।
একটা প্রবাদ আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। - কোন্ সঙ্গের প্রভাব বেশি সেটাই ঠিক করে আমাদের ভবিষ্যত। সেদিন ঐ লাইব্রেরিয়ান এই বাঙালকে ছাপিয়ে গেছিল।
আমাকে বলল “ Calm down. Don’t worry. We will manage. If you try to control like this it will not work. Don’t go behind them . They will follow you. “
কী দক্ষতার সাথে পরের ১৫ মিনিটে বাচ্চাগুলোকে ওরা সামনে নিল। আমার চোখে চোখ পড়লেই আমি চোখ পাকাচ্ছি - আর অমনি জুসের বোতল, দুধের বোতল, কোলার বোতল চোষা বন্ধ করে চেঁচিয়ে আমার দিকে হাত তুলে সিকিউরিটিকে ডাকছে।
প্রায় ৪০ মিনিট পর সন্ধি হল যে সিকিউরিটি গার্ড বাচ্চা দেখবে । কারমিসা দরজায় দাঁড়িয়ে সিকিউরিটির প্রাথমিক কাজ করবে।
সেদিন অনেক কিছু শিখলাম। অনুধাবন করলাম। ধৈর্য শব্দটার সাথে হাতে কলমে পরিচয় হল।
যে মেয়েরা কোনদিন খাতা কলম ধরেনি, ওদের অক্ষরের সাথে পরিচয় করানো - স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছে নিজের টাইপ করা অক্ষর - নিজের নামের বানান করতে পারছে। অদ্ভুত। দেড় ঘন্টা চলল। ওরা সবাই গাড়ি চালাতে চায়। পরীক্ষা দিতে চায় ।
আমাদের আছে একটি প্রোগ্রাম - যার নাম “শেফস ক্লাব”।
এই ক্লাবের/প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হল যেসব মহিলারা রান্না করতে ভালবাসে, নিজের দেশে রান্নাবান্না করে উপার্জন করতে পারত বা করার স্বপ্ন - তাদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
কিন্তু আমার জন্য খারাপ খবর হল ঐ প্রোগ্রামে আমার কোনও ক্লায়েন্টকে জায়গা দেওয়া হয় না।
আমার ক্লায়েন্টরা দেখতে গরিব, চেহারা - স্বাস্থ্য - গায়ের রং - পোশাক আশাক - চলন বলন - কোন কিছুই ঠিক মার্কেটিং-এর উপযুক্ত নয়। প্রথম দর্শনে ভক্তি আসেনা- এমন টাইপ। কী করে হবে ? কী দেখে বড় হয়েছে ওরা?
আর এদিকে শেফস ক্লাবের যারা মেম্বার - ওরা দেখতে অপ্সরা। যেমন চেহারা, তেমন গায়ের রং, উচ্চতা, ফ্যাশন সম্পর্কে সাঙ্ঘাতিক জ্ঞান। ব্রান্ডেড জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ, লেটেস্ট মডেলের সব ইলেকট্রনিক গেজেটস।
ওরা কুর্দিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, ইজিপ্ট , ইরান - ওসব জায়গার রিফিউজি।
আরব, সোমালিয়া, ইরানি ক্লায়েন্টদের সাথে আফগানিদের ভীষণ রেষারেষি।
২০১৯ - আমার দেখা প্রথম রমজানে ফুড ডিস্ট্রিবিউশনে বিএমডাব্লিউ, অডি, মার্সেডিজ চড়ে লোক আসছে ডোনেশন নিতে। যেমন পোশাকের জৌলুস, তেমন গয়না। মহিলারা সবাই বোরখা আর হিজাব। শরীরের যতটুকু দেখা যায় দামিদামি মণি-মুক্তো-হিরে। চড়া মেকআপ। আপাদমস্তক ব্র্যান্ডেড। তখনো রোহিঙ্গা ক্লায়েন্ট আমি দেখিনি।
আমার জ্ঞানের পরিধি যতটা জানে রিফিউজি শব্দকে - তাকে গরিব হতে হবে। আমার রিফিউজি কলিগ আর এই ডোনেশন নিতে আসা মানুষদের সাথে ঐ সংজ্ঞার কোন মিল নেই।
রোহিঙ্গা ক্লায়েন্টরা ওদের ধারেকাছে আসতে পারবে না। আফগানি, ইরানি ক্লায়েন্টের বাড়ি ঢুকলে সুন্দর গন্ধ। দারুন সব চায়ের সেট। অসাধারণ চা, পেস্তা, বাদাম, বিরিয়ানি, ফিরনি।
রোহিঙ্গা ক্লায়েন্টের বাড়ি জুতোর জঙ্গলের পাশে রান্না, দুর্গন্ধ ভরা ঘর। দম বন্ধ হয়ে আসে। জুতোর পাশে বসি। পানের পিকের পাশে বসি। নিজেও পান খাই।
চেহারা, গায়ের রং - কিরকম যে প্রভাব পড়ে, আমার জীবন দিয়ে দেখা। আমার, এমনকি আমার সদ্যোজাত মেয়ের গায়ের রং নিয়েও নানান রকম কুৎসিত অপমানজনক আচরনের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। সেসবকে উপেক্ষা করার জোর আমার ছিল, কিন্তু যখন এসব হয়েছে তখন সেসবের প্রভাব আর স্ট্রেস এড়াতে পারিনি তাও সত্যি। যাদের সেই জোর নেই, যারা এসবের সামনে নিরুপায় এবং যাদের এসব নাক সিঁটকানো লোকেদের দাক্ষিন্যেই থাকতে হয়, তাদের অপমান তাই মজ্জায় মজ্জায় বুঝতে পারি। এখন মনে হয় এসব শুধু বাঙালীদের নয়, অন্তত পুরো দক্ষিন এশিয়াই এই রোগে আক্রান্ত।
আমার কুর্দিস্তানি কলিগ আমার রোহিঙ্গা সাথীদের কোনও ঝকঝকে প্রোগ্রামে অন্তরভুক্ত করে না, শেফস্ ক্লাবের সদস্য হতে দেয়না।
সত্যিই হতদরিদ্র এই রোহিঙ্গারা। শিক্ষা, চেতনার যে সুযোগ ওরা পায়নি তার ব্যবস্থা করা তো সমাজেরই কাজ। সেসব বোঝাতেই থাকতে হবে, ক্লান্ত হলে হয়তো সরে আসবো।
- কিন্তু উপেক্ষা, ব্যঙ্গ, তাচ্ছিল্য, ঘৃণা?
একবার ওদের রান্না খাওয়া যায় না? কমার্শিয়াল কিচেনই তো ব্যবহার করব। সব নিয়মকানুন মানতে হবে। নজরও রাখা হয় যাতে হাইজিন মানা হয়। তবু নানা অজুহাতে ও ঢুকতে দেয়না। রাগে আমার চোখ ফেটে জল আসে।
রোহিঙ্গা মহিলাদের ওপরও রাগ হয়। কীভাবে যে গ্রুম করব - জানিনা। একটু জোরগলায় কথা বললেই হয় মন খারাপ করে আর তা না হলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। নাকের ডগায় অভিমান। আর আমার সঙ্গেই অভিমান! তবু যখন শুনি “আপু গাড়ি চালাইতে পারলে আমিও পারুম। আপু, পারুম তো তোমার মত কাজ করতে?” তখন মনে হয়, পারতে হবে।
কিন্তু পদে পদে বাধা। এই দেশের সামান্য প্রয়োজন - ড্রাইভার্স লাইসেন্স। কী করে হবে? লিখিত পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হবে। আর জর্জিয়াতে কোন ইন্টারপ্রিটেশনের ব্যবস্থা নেই। আলাবামা, ফ্লোরিডা, সাউথ ক্যারোলাইনা - এই তিনটে রাজ্যে যেতে হয়।
ইংরেজি জানে না। ইন্টারপ্রিটেশন? ইন্টারপ্রিটেশন কার জন্যে? যারা নিজের ভাষাটা অন্তত লিখতে পড়তে পারে। আমার সাথীদের কোন লিখিত স্ক্রিপটই নেই। ইন্টারনেট ঘাটলে রোহিঙ্গা স্ক্রিপট দেখা যায়। আজ পর্যন্ত ৬ থেকে ৭০ - কোন বয়সীদের কাছে শুনিনি যে ওরা ওদের ভাষায় কোন লেখা দেখেছে।
আর একদম পড়া লেখা না জানলে কী করে গাড়ি চালাবে? বেসিক ইংরেজি না জানলে তো রাস্তার সাইন পড়তে পারবে না! ওদিকে ওসব রাজ্য থেকে দোভাষীর সাহায্যে পাশ করে আসা লোকেদের শর্টকাট পদ্ধতির কথা পুলিশের কানে গেছে - কমিউনিটির কারা অন্য রাজ্য থেকে লাইসেন্স করেছে পুলিশ তা ট্র্যাক করে।
বিশ্বাস আছে; এক বুক আশা, দু চোখ ভরে স্বপ্ন - এইসব তো আছেই - কিন্তু বাস্তব?
বাড়ি যাচ্ছে অনেক স্বপ্ন নিয়ে! কিন্তু বরের কাছে প্রকাশ করতে গিয়ে হাসির খোরাক, অক্ষমতা নিয়ে ব্যঙ্গ। আমি তো ছেলেদেরও দোষ দিতে পারি না। ছেলেদেরও তো বেসিক এডুকেশনের দরকার? ওদের পূর্বপুরুষ যেভাবে মহিলাদের সাথে নিয়ে জীবন চালিয়েছে, ওরা তো সেটাই দেখে অভ্যস্ত।
আবার সব ছেলে, সবার বাড়ির পুরুষরাও কি একরকম? কত পুরুষ ক্লায়েন্ট আসে ওদের বাড়ির আদরের বউদের নিয়ে। ওরা চায় ওদের বাড়ির মেয়েরাও কিছু করুক।
সেই লাইব্রেরি। লাইব্রেরির গল্প আরেকবার বলে নিই। আমার মেয়ের দেড় বছর বয়স থেকে লাইব্রেরি যাই। আটলান্টা আসি যখন তখন নতুন জায়গার লোকাল লাইব্রেরিতে কার্ড করাতে গিয়ে দেখি পাশের নোটিশ বোর্ডে লেখা “ESL class schedule”।
আমি বরাবরই একটু গায়ে পড়া। যা দেখি তাতেই হামলে পড়ি। জিজ্ঞেস করলাম লাইব্রেরিয়ান এলিজাবেথকে “কী ব্যাপার ওটা?”
আমি ভেবেছিলাম যে বাচ্চাদের জন্য কিছু হবে। এরপর ও যখন বুঝিয়ে বলল যে ESL কী- আমার মনে হল নিজের জন্য গিয়ে দেখি।
কী সুন্দর সে প্রোগ্রাম! আমি ভারত ছাড়া ১৭ টি দেশের মানুষের সাথে মিশতে পেরেছি। ঐ প্রোগ্রামে ঢুকেই আমার মাথায় পড়ার ভুত চেপেছে।
পরে এই কমিউনিটিতে কাজ করে যোগসূত্র খুঁজে পেলাম ঐ ESL এর সাথে রিফিউজি আর ইমিগ্রেন্টের কী সম্পর্ক! ঐ ক্লাসে সবাই পরিচয় দিতো যে কে কবে কোন দেশ থেকে এসেছে। কিন্তু রিফিউজি বা ইমিগ্রেন্ট শব্দ শুনিনি ।
কাজ করতে করতে জানলাম যে পুরো আমেরিকার স্টেট আর ফেডারেল প্রোগ্রাম হল এই ESL - সব্বার জন্য। এদেশে এসেছ, স্বচ্ছন্দ বোধ করার জন্য ভাষাটা শিখে নাও। প্রতিটি লাইব্রেরি সহ বিভিন্ন চার্চ, কলেজেও এই প্রোগ্রাম চলে।
বাচ্চারা যায় না । কারণ ওদের তো স্কুলই বাধ্যতামূলক। একটু বড় বয়েস হলে যেতে পারে। কিন্ত ঐ স্কুল কলেজেই আলাদা ক্লাস থাকে।
আমার ক্লার্কস্টন এলাকার লাইব্রেরিয়ান ও কর্মীরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ৬০ টিরও বেশি ভাষায় কথা বলা মানুষের সাথে ওদের সড়গড় থাকতে হয় । আমার মেয়ে অবশ্য ঐ লাইব্রেরির ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে খুসি হয়না। ওর ঐ লাইব্রেরিই পছন্দ হয় না । কারণ জানতে চাওয়ায় বলেছিল “ Books are different.“
বুঝলাম এলাকাভিত্তিক বইয়ের সংগ্রহ আলাদা। কে কেমন রিকুইজিশন দিচ্ছে, আদৌ দিচ্ছে কিনা, কোন এলাকায় কতটা বাজেট সেসবও আছে।
আমি জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেছি এক বছর। লার্নিং এন্ড টিউটেরিয়াল সেন্টার সবার জন্য খোলা। ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী হতে হবে - এমন কোন শর্ত নেই। বিনামূল্যে পড়ানো হয়। ঐখানে বিনামূল্যে পড়েই আমি কলেজে ঢোকার জন্য পরীক্ষাগুলো পাশ করেছি। ক্লার্কস্টনেও একটি জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির শাখা আছে। Associate Degree পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর মেইন ক্যাম্পাস।
হামিদা আর ওর মেয়ে - আরেকদিকে দিলারা আর ওর মেয়ে ফাতিমা - কোন মিল আছে?
হামিদা ভাবতে চায় - হামিদার মেয়ে সুযোগ পেয়েও ভাবতে চায় না।
এদিকে দিলারার কড়া শাসন - ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করতে হবে। বড়ছেলে আহসানকে কাজে যেতে দিল। কিন্তু ফাতিমাকে দেবেনা । সমাজ নাকি বাজে বলবে যদি মেয়ে রোজগার করতে বেরোয়। আমি বেশ কিছু চাকরির ব্যবস্হা করে দিয়েছিলাম - এখনো রাজি করতে পারিনি।
লেখা তো নানারকমই হয়-
নির্লিপ্ততা একটি বৈশিষ্ট্য বটে, কিন্তু সব নয়। আপনার এই জড়িয়ে যাওয়া, আপনার আবেগ লেখাটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। এই ধারাবাহিক দীর্ঘদিন মনে থাকবে।
যাদের নিয়ে কাজ তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া তো খুব বড় গুণ তবে লেখককে নিজের অস্তিত্ব ও দূরত্ব রেখে যাচাই করতে হয়।খুব কঠিন কাজ সেটা
আপনার লেখা পড়তে পড়তে চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছিলাম
লেখাটা অনবদ্য হচ্ছে। সত্যি সত্যি চোখের সামনে যেন ওদের দেখতে পাচ্ছি, কখনো কখনো ওদের ওপর খুব রাগও হচ্ছে, কখনো কখনো ওদের জন্য খারাপও লাগছে। আপনার স্ট্রাগলটা আর এই ভেতরের আমেরিকাটা মন ছুঁয়ে যাচ্ছে