এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ডাক্তারজ্যেঠুরা

    Siddhartha Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ জুলাই ২০২১ | ৩০৩৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • ডাক্তার জ্যেঠু   © সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় 


                ★


    আপনাদের মধ্যে যাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে ষাট কিংবা সত্তরের দশকে --- ডাক্তার জ্যেঠুদের নিশ্চয়ই ভুলে যাননি ! সেই আপাত গম্ভীর মানুষটি --- যিনি একবার নাড়ি টিপলে, জিভ দেখলে, কিংবা পেটের ওপর আঙুল দিয়ে ঠুক ঠুক করলেই রোগবালাই পালাই পালাই করত ।

    নাটক নভেল সিনেমায়ও তো তাঁদের দেখা মিলত আকছার।

    বনফুলের অগ্নিশ্বর অথবা হাটে-বাজারে র ডাক্তারবাবুই হোন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরোগ্য নিকেতনে কিংবা রমাপদ চৌধুরীর বনপলাশির পদাবলীর পাতাতেই থাকুন -- তারা থাকতেন স্বমহিমাতেই ।

    কাবলিওয়ালার ঝোলা যেমন হিং-সুর্মার গন্ধে আমোদিত হতো, এই সব ডাক্তার জ্যেঠুদের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ --- না, ব্রিফ কেস নয় -- কালো বা বাদামি চামড়ার হাতে ঝোলানো গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুললেই ছড়িয়ে পড়ত স্পিরিট -- টিংচার আয়োডিন আর ইউকিলিপ্টাস অয়েলের মিশে যাওয়া একটি ঘ্রাণ।

    আর তখনই মনে হত -- এই তো আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি। মা আজ বিকেলেই খেলতে যেতে দেবেন।

    ডাক্তার জ্যেঠুরা এমনই ছিলেন।

          ★



    শোনা যায়, সেকালে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে ডাঃ প্রকাশকালি ভট্টাচার্য নামে এমনই এক সর্বজনপ্রিয় কিন্তু দাপুটে পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন।
    স্যার আশুতোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ এমন কি এলগিন রোডের বসু-বাড়ির তা-বড় মানুষদের স্বাস্থ্যের প্রাথমিক দেখভাল করতেন তিনি।
    আরও একটু শুনুন সেই ডাক্তারবাবুর কথা।

    ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের ছোট দাদাও থাকতেন ওই অঞ্চলেই। সেই বাড়ির পুত্র কন্যাদের কাছে বিধান চন্দ্র ছিলেন শুধুই "বিধান কাকা" আর প্রকাশকালীবাবু ছিলেন "ডাক্তার জ্যাঠা"।
    বিধানবাবু নিজে নাকি সেই ঘরোয়া ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে, তার প্রেসক্রিপশন ইত্যাদি দেখে বেশ খুশিই হয়েছিলেন।



    এই ডাক্তার জ্যেঠুরা বাড়ির সকলের খবর রাখতেন। অসুস্থ মানুষটিকে দেখতে এসে, বাড়ির অন্যান্য দেরও ভাল থাকার পরামর্শ দিতেন। বারান্দায় বসে দু-চামচ চিনি দেওয়া চা পান করতে করতে প্রেসক্রিপশন লিখতেন। ওষুধের দাম আর রুগীর আর্থিক সঙ্গতির তাল মিলিয়ে দিতেন ।

    আবার এমনও হয়েছে যে প্রাজ্ঞ রুগির কাছ থেকে নবীন চিকিৎসকটি চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়েছেন ।

    বাংলা সাহিত্যের রস সম্রাট শিবরাম চক্রবর্তী মশাই শুনিয়েছিলেন সেই গল্প।

    একবার অসুস্থ হওয়ায় পাড়ার অল্পবয়স্ক জেনারেল ফিজিসিয়ানটি তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। ডাক্তার তো শিবরাম বাবুর বিরাট ভক্ত। একথা সেকথার পরে সে জিজ্ঞেস করে বসল -- পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখলেই পালায় নয়তো কান্না জুড়ে দেয়। কিছুতেই TABC র টিকা নিতে চায় না। (TABC ছিল তখনকার দিনের টাইফয়েড রোগের টিকা। হাতে ইনজেকশন দিতে হতো এবং বলা বাহুল্য, বেশ ব্যথা লাগতো)। তো, শিবরাম চক্রবর্তী তাকে পাড়ার প্রতিটি ছেলে মেয়ের নাম ধরে ধরে তাদের প্রিয় লজেন্স-টফির নাম বলে দিয়েছিলেন। হাতে ইনজেকশনের সঙ্গে সঙ্গে হাতে নাতে লজেন্স !

    সেই নবীন ডাক্তারের আর নাকি অসুবিধে হয়নি।

        ★

    শুধু চিকিৎসা নয়, সহানুভূতি, সহমর্মিতা আর সমব্যথা দিয়ে পারিবারিক চিকিৎসকরা যে কত অসুস্থ মানুষ নারীর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন .... কত ভুল ধারণার শিকড় উপড়ে ফেলেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

    এক ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল অনেক পাত্র এবং পরিবার ইত্যাদি দেখার পরে। হঠাৎই আবিষ্কার হল যে পাত্রের মায়ের হাতে "শাদা দাগ" র‍য়েছে। যতই জানা যাক না কেন যে সেটি গরম তেল ছিটে এসে পুড়ে যাবার দাগ -- মেয়েটির বাড়িতে বদ্ধমূল ধারণা যে -- এটি শ্বেতী এবং বংশানুগত। পারিবারিক চিকিৎসক মশাই অনেক নরমে গরমে বুঝিয়ে সমঝিয়ে তবে বর কনের চার হাত এক করলেন।



    এই ডাক্তারজ্যেঠুর কাহিনিটুকু বাকি থাকে কেন ?

    মানুষটি বড় আলাভোলা। রুগি অন্তপ্রাণ। অথচ রুগি দেখার ফি-জ আর বাড়ে না। ডাক্তার পত্নী অনেক অনুযোগ অভিমান নিয়ে চলে গেছেন বাপের বাড়ি। খুব দূরে নয় -- পাশের পাড়াতেই। এদিকে, পাড়ায় ঘোষবাবুদের মেয়ের বিয়ে। সেখানে তো আসতেই হবে... এসেছেনও। ডাক্তার জ্যেঠুর পাত্তা নেই। হয়ত আসবেন এক্কেবারে শেষের দিকে। বিয়েবাড়িতে একটি ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার গিন্নী -- " হ্যাঁ রে, তোর কেমন বর পছন্দ? উত্তমকুমারের মতো?"
    মেয়েটা একগাল হেসে উত্তর দিল -- " না গো জ্যেঠিমা। ডাক্তার জ্যেঠুর মতো বর চাই আমার। কত মানুষকে বাঁচাবে। সবাইকে হাসতে বলবে।"
    বলাবাহুল্য, সেই ডাক্তার জ্যেঠু অতঃপর সুখে ঘর কন্না করেছিলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ জুলাই ২০২১ | ৩০৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Anindita Roy Saha | ০১ জুলাই ২০২১ ১১:৫১495504
  • ডাক্তরজ্যেঠুদের সঙ্গে অবশ্যই ছিলেন কম্পাউন্ডার কাকুরা। তাঁরা  ইনজেকশন দিতে পাড়ার মোড়ে ঢুকলেই ছোটদের কান্নাকাটি। পরে অবশ্য মধুরেণ সমাপয়েৎ। 

  • B Banerji | 2402:3a80:a7e:91f6:0:4e:fabe:***:*** | ০১ জুলাই ২০২১ ১১:৫২495505
  • অপূর্ব 

  • Shampa Shuchismita Ray | ০১ জুলাই ২০২১ ১৬:২১495510
  • আমাদের ছিলেন দাদু-ডাক্তার আর কাকা-ডাক্তার। তাঁদের বড্ড মিস করি এখন। সেই গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ! 


    মন কেমন লেখা।


  • Kumarda | 2405:204:9216:ce04:d28b:1d8b:f61e:***:*** | ০১ জুলাই ২০২১ ১৯:৫১495513
  • Ei pariprekhite amar kichu abhigata ache jini amader samne eta niye esechen tar Pitridev kichuta er সামাতুল্ল সামাতুল্ল

  • মহুয়া দত্ত | 2401:4900:104e:95ad:0:66:a4bb:***:*** | ০৪ জুলাই ২০২১ ০৯:০২495592
  • কত এমন মানুষের কথা মনে পড়ে গেল। তখনকার ছোট্ট শহর দুর্গাপুরের হেলথ সেন্টারের ডাক্তার কাকুদের। খুব সুন্দর লেখা দাদা।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন