সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সুন্দরবন অঞ্চলকে তছনছ করে দিয়েছে। পাশের জেলায় দিঘা, মন্দারমনি, তেজপুরের উপকূলবর্তী এলাকাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা আর ত্রাণবণ্টন ব্যবস্থার খতিয়ান নেওয়ার কাজ জোরকদমে চলছে। প্রভাবিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের দিনযাপনের দুর্দশা, জীবিকার সংকট, নদীবাঁধের ভাঙন, চাষের জমির ক্ষতি ইত্যাদি মিলিয়ে সংকটের তালিকাটি অতি দীর্ঘ। এইসব প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলির সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে উঁকি দিতে পারে যে, এই ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলি পশ্চিমবঙ্গের অতি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র, ঘরের কাছে চট করে ঘুরে আসার পক্ষে মধ্যবিত্ত বাঙালির আদর্শ জায়গা। যদিও অতিমারীকালে মানুষের বেড়ানো এখন সীমিত বা প্রায় বন্ধ, তবু ভবিষ্যত আশঙ্কা হিসেবে বলা যেতে পারে ইয়াসের বিধ্বংসী প্রভাব পর্যটন শিল্পের ওপরেও ব্যাপকভাবে পড়বে। ফল, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বহু মানুষের জীবিকা ও জীবনযাপনের সংকট। বর্তমানে পর্যটন শিল্প আমাদের জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে ভারতবর্ষে পর্যটন শিল্পের আয়তন ছিল ১৯৪ বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় আয়ের ৬.৮%। সে সময়ে এই শিল্পে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩৯.৮ মিলিয়ন, অর্থাৎ মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮%। এই হারে বৃদ্ধি পেলে পর্যটন শিল্পের আয়তন ২০২৮ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে, যা জাতীয় আয়ের প্রায় ৯.৯%।
পর্যটন সংক্রান্ত এইসব সংখ্যা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এই প্রশ্নটা আমাদের মাথায় আসতে পারে যে, আমাদের অতি পরিচিত, পুরাতন ও প্রিয় ‘দেশভ্রমণ’ ব্যাপারটা ‘শিল্প’ হয়ে উঠলো কবে থেকে আর কেমন করে। ছোটবেলায় রচনা-বিচিন্তা জাতীয় বইতে ‘দেশভ্রমণের উপকারিতা’ বিষয়ে প্রবন্ধ পড়েননি এমন বাঙালি আমাদের প্রজন্মে বিরল। নানা দেশ দেখা আর নানান মানুষকে জানা ছিল দেশভ্রমণের মূল টান। বদ্ধ ঘরে না থেকে জগৎটাকে দেখার উদ্দেশ্য ছিল জানতে চাওয়া, ‘কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে’। সেই ভ্রমণে ছিল কৌতূহল, সেই যাত্রায় ছিল অনিশ্চয়তা আর কষ্টসাধন। আমাদের শৈশব-কৈশোরের পাঠে হাতছানি দিত হিমালয়, পালামৌ কিংবা অনেক দূরের চাঁদের পাহাড়। মহাভারতের শেষ পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে নানা লেখকের হাত ধরে অতি দুর্গম যাত্রায় আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি দেবতাত্মা হিমালয়ের পথে পথে, বিগলিত করুণা জাহ্নবী-যমুনার স্রোত ঘেঁষে, মায়াবতী আশ্রমের পাকদণ্ডী ধরে। এমনি করেই জেনেছি সমুদ্রের গল্প, রামায়ণের সূত্রে সেতুবন্ধ রামেশ্বর, কিংবা বিহারী দত্তের বাণিজ্য যাত্রায় সমুদ্রে ঝড়ের বর্ণনা। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ বলতে বলতে অনুভব করেছি জঙ্গলের গন্ধ। দিবাবসান, অরণ্য-প্রকৃতি ধরনের সহায়িকা পাঠের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছে আরণ্যক আকর্ষণ। আরো চিনেছি পর্বতগুহায় চিত্রময় অপরূপা অজন্তা, মরুভূমির দেশের সোনার কেল্লা। সে দেখার তালিকা অন্তহীন। এরা সবাই মিলে গল্প বুনে গেছে স্বপ্নের দেশের। বাবা-মায়ের সাধ্য সীমিত, সুযোগ অপ্রতুল, বেড়াতে যাওয়া তখন বিরল। অথচ ভ্রমণকাহিনির সাহচর্যে সেই ছবিগুলি আঁকতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। অনেক পরে চিনেছি জেফরি আর্চারের কল্পনায় সেই হাঙ্গেরিয়ান প্রফেসর-কে, যিনি কোথাও না গিয়েও বহু শহরের অনুপুঙ্খ বর্ণনা নির্ভুল দিয়ে দিতে পারেন। বিদেশের নাম জানার শুরু শিশু পত্রিকার পাতায়। তারপর ধীরে ধীরে দেব সাহিত্য কুটিরের অনুবাদ সাহিত্যে। একের পর এক দেশের ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠেছে, মনে মনে ডানা মেলে ঘুরে বেড়িয়েছি সারা দুনিয়া।
পর্যটনের আনুকূল্যে সারা পৃথিবী আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। একদিকে পরিবহণ ব্যবস্থায় যুগান্তর, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের আর্থিক সাচ্ছল্য বৃদ্ধি। সেই থেকে তৈরি হয়েছে ট্রেন-প্লেন-হোটেলের চাহিদা, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে জোগান। বাজারে উৎপাদন, বিক্রি আর ভোগ যখন চলছে তখন বেড়ানোকে শিল্প বলতে তো আর বাধা নেই। বৃহৎ পুঁজি লগ্নি হচ্ছে এই শিল্পে। বৃহৎ কর্মসংস্থান। কতদিন আগে এই বদলের শুরু হয়েছে? বলা যেতে পারে মোটামুটি নয়ের দশক থেকে, মানে প্রায় বছর তিরিশেক। নানারকম আর্থ-সামাজিক বদলের মধ্যে দিয়ে এসেছে ভ্রমণের প্রতি প্রবল আগ্রহ। পারিবারিক কাঠামো ছোট হয়ে গিয়েছে, আত্মীয়স্বজনের সম্পর্ক ক্রমশ ক্ষীণ হয়েছে, বেড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। এলটিসি-জাতীয় সুযোগসুবিধা আমাদের সাধ্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে নানান এজেন্সি, তাদের আকর্ষণীয় ‘প্যাকেজ’ সম্ভার নিয়ে। কাছে-দূরের জায়গায়, ছোট-বড়ো হোটেলে, বাস-ট্রেন কিংবা প্লেনে চেপে বেড়াতে যাওয়া এখন আমাদের নিয়মিত বিনোদন। হ্যাঁ, বিনোদন শব্দটা অনেক ভেবেই ব্যবহার করলাম। এই বেড়ানোগুলোতে ভ্রমণ কতখানি, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা কত তীব্র আর আমোদ-আহ্লাদ কতখানি, তা বলতে পারি না। চতুর্দিকে বিলাসবহুল রিসর্ট থেকে শুরু করে অগুনতি ছোট ছোট হোটেল গজিয়ে উঠছে। দিঘা মন্দারমণিতে অসংখ্য হোটেল, পর্যটন ব্যবসার রমরমা। এ কথা সত্য যে, এই সুযোগসুবিধাগুলো আছে বলে সাধারণ মানুষ স্বল্প ব্যয়ে বেড়াতে যেতে পারেন, দৈনিক একঘেঁয়েমির থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এও বললে হয়তো ভুল হবে না যে, আগেকার যুগে দেশভ্রমণে একটা লিঙ্গবৈষম্য ছিল। অজানাকে জানতে বা অদেখাকে দেখতে নিরুদ্দেশে যাওয়া একজন একাকী পুরুষ বেশ রোমান্টিক নায়কের মতো। অন্যদিকে মেয়েদের বেড়ানো আদৌ যদি হয়, তার ভিত্তি মূলত ছিল তীর্থ কিংবা বাপের বাড়ি। সে দিন পাল্টেছে, এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেড়াতে যাওয়া অনেক সহজ ব্যাপার। এক কথায়, সকলের জন্য ভ্রমণ এখন সহজসাধ্য ও সুলভ। সে কারণেই পর্যটন একটি বৃহৎ ও বর্ধমান শিল্প। পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, প্রশিক্ষণপ্রণালী এবং কর্মসংস্থান। এর পরিমাণ যে আগামীতে আরো বাড়বে তার অনুমানিক হিসেব আগেই দেওয়া হয়েছে।
পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবার মূল উপাদানগুলি হল রাত্রিবাসের জায়গা, খাদ্য ও পানীয়, বিনোদন, পরিবহণ, মনোরঞ্জক অনুষ্ঠান, আকর্ষণীয় এবং সাহসিক পর্যটন। এই তালিকার উপাদানগুলি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, এর মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম কতখানি হতে পারে আর এইসব ক্রিয়াকলাপের প্রভাব প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর কীরকম হতে পারে। দিঘার সৈকতে ঝাউবন নির্বিচারে কাটা হয়েছে হোটেল তৈরি করতে। সমুদ্রতীরের এই অপরিকল্পিত ও বেআইনি নির্মাণশিল্প ক্ষতি করছে স্থলভূমির, ত্বরান্বিত করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গাছের শেকড় যে ভূমিক্ষয় রোধ করে, সে তো কোন ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়া আছে। মন্দারমনি, তাজপুরের ছবিও প্রায় একই রকম। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্য মাত্রায়। তবে মনে রাখা যেতে পারে, পর্যটনের থাবা সেখানেও বাদ পড়েনি। আজ যদি এই অঞ্চল ডুবে যায়, তাহলে কী ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ হল প্রকৃতিদত্ত প্রাচীর। নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কাটা মানে উন্নয়নের নামে ধ্বংসের ডাক। এই অঞ্চল ডুবে গেলেও তার জীববৈচিত্র্য জলের তলায় থেকে নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা প্রাকৃতিক বৃত্ত ও ভারসাম্য বজায় রাখবে। তাই একে রক্ষা করা আমাদের নিজেদেরই স্বার্থ। প্রাকৃতিক পুঁজি-সম্পদকে পর্যটনকেন্দ্র বানিয়ে আরো দ্রুত ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার অর্থ নিজেদের অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনা। অনেক জায়গা ভ্রমণ বা বিনোদনের জন্য ব্যবহার না করে কেবল তাকে রাখার জন্যই টিঁকিয়ে রাখতে হয়, যাতে তার প্রাকৃতিক গুণগুলি রক্ষা পায়। সেটাই ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা (intergenerational equity)। যেমন, আমাজনের ক্রান্তীয় অরণ্য কেবল পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবেই বাঁচিয়ে রাখা দরকার। যে কোন প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করার সময় তার ব্যবহারিক মূল্যের (use value) সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের মূল্যকে (existence value) গণ্য করতে হয়। এই যে প্রকৃতির অস্তিত্বকে গুরুত্ব দেওয়া, একে টিঁকিয়ে রাখা, এটা এক ধরনের ভবিষ্যৎমুখী নেতৃত্ব (stewardship), যা টেঁকসই উন্নয়নের (sustainable development) বিবেচনার মধ্যে পড়ে।
সমস্যার বিপদসংকেত শোনা যাচ্ছে পাহাড়েও। পুরো হিমালয় অঞ্চল আজ বিপদের মুখে। ধ্বস, ভূমিকম্প হয়ে উঠেছে নিয়মিত ঘটনা। অথচ তার মধ্যেই গড়ে তোলা হচ্ছে আরো পর্যটনকেন্দ্র যার অর্থ আরো বিলাস ব্যসন আর দেদার ফুর্তির মোচ্ছব। সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডের সাততালে এমনই এক পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করার প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে। সাততাল একটি অতি নিরিবিলি জায়গা, পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ। প্রতিবাদ হচ্ছে, যদিও জানা নেই শেষ পর্যন্ত এই পাখিরালয়টিকে পর্যটকের ভিড় থেকে বাঁচানো যাবে কিনা। সম্প্রতি লাক্ষাদ্বীপে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাবটি অন্যান্য রাজনৈতিক কারণগুলির সংগে যুক্ত হয়ে একটা বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছে।
ভরতপুরের কেওলাদেও ঘানা পক্ষী অভয়ারণ্যে লক্ষ করে দেখা গিয়েছে, ভ্রমণার্থীদের চাপে পাখিরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। পর্যটনের মরশুমে মানুষ কাছে এলে এদের উড়ে যাওয়ার দূরত্ব (flight distance) প্রচুর বেড়ে যায়। কী দেখতে যায় মানুষ! সবাই পক্ষীপ্রেমী! সচ্ছল শহুরে ভ্রমণার্থীদের নিছক আমোদ প্রমোদ, হুজুগ নয় তো কী! পাখি দেখা এখন শহুরে ধনাঢ্যদের একটি কেতাদুরস্ত শখ। করবেট কিংবা বান্ধবগড়ে গিয়ে বাঘ দেখা, কাজিরাঙায় হাতি চড়া, হ্যাভলক দ্বীপে সমুদ্রে ডুব কিংবা জয়সলমিরে উটে চড়ে মরুভূমির বুকে তাঁবু গাড়া, প্রকৃতিপ্রেমের নমুনাই বটে। সমস্ত প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ওলোটপালোট করে আমাদের আজকের দেশভ্রমণ আর অপার আনন্দ। এ কথা না মেনে উপায় নেই যে পরিবেশ ধ্বংসের দায় সম্পূর্ণই আমাদের। আমাদের দায়িত্ব কি কেবল পরিবেশ-পরিবেশ বলে চারটি বক্তৃতা দেওয়া আর ব্লগ লেখা? এ প্রসঙ্গে ইকো ট্যুরিজম নামের সোনার পাথরবাটিটির কথা না বলে পারছি না। এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ধ্বংসের মুখে পড়া পরিবেশ ও জীবজন্তুর সংরক্ষণ। সেই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের জন্য টেঁকসই জীবন ও জীবিকার সংস্থান। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এতে পরিবেশের ক্ষতি বেড়েছে বৈ কমেনি। আগে থেকেই ভঙ্গুর ভূমির ওপর পর্যটকের চাপে আরো ক্ষয় বাড়ছে, পশুপাখির শান্ত জীবনে ব্যাঘাত ঘটছে, এমনকি স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে পর্যটক-প্রিয় স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করার কাজও একটি প্রচলিত পেশা। প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আদিবাসী সমাজের মাঝে অনুপ্রবেশ করে আমাদের শৌখিন ‘পভার্টি ট্যুরিজম’ করা মানেও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা, তাদের প্রথাগত টেঁকসই জীবনযাপনকে বিপজ্জনক করে তোলা। বারাটাং দ্বীপে দ্রষ্টব্য বস্তু হিসেবে জারোয়া প্রদর্শনকে প্রকৃতির প্রতি ও মনুষ্যজাতির প্রতি চরম অপরাধ।
আমাদের দেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে পরিবেশ রক্ষার নিয়মাবলি কতখানি পালন করা হয় তা আলাদাভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। সবচেয়ে বেশি বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে যে দুটি ভোগের ক্ষেত্র, তা হল পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবা। বার্ষিক প্রায় ২৮৯,৭০০ টন বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয় হোটেল থেকে। তার মধ্যে প্রায় ৭৯,০০০ টন শুধু খাদ্যদ্রব্যজাত। ভারতে মোট বর্জ্য পদার্থের প্রায় ২১% আসে পর্যটন ক্ষেত্র থেকে। গড়ে দৈনিক ১৩৪ মেট্রিক টন বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে আমাদের দেশের রিসর্টগুলি। বিভিন্ন দ্বীপে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় পর্যটকরা প্রায় দ্বিগুণ প্রদূষণ ও বর্জ্য উৎপন্ন করে। তর্ক হতে পারে, ভারী শিল্প অনেক বেশি বর্জ্যপদার্থ তৈরি করে। ঠিক, কিন্তু তার কারণ, মাত্রা ও ধরন আলাদা। সে আলোচনা অন্য পরিসরে করা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটাই ভোগকেন্দ্রিক। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা আমাদের আচরণ ও জীবনযাত্রা পরিবর্তনের (behavioural and lifestyle change) কথা খুব জোর দিয়ে বলছেন। তাই এই প্রশ্নগুলি সুধী পাঠকের সামনে রাখা। জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা মূলত মনুষ্যকেন্দ্রিক (anthropocentric)। তাকে শোধরানোর দায় তাই মানুষেরই। পর্যটনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রধান সমস্যা পরিবেশের মান (environmental standard) বজায় না থাকা, অতিরিক্ত ভ্রমণার্থীর চাপ (footfall), বেআইনি ও অপরিকল্পিত বিস্তার ইত্যাদি। উন্নত দেশেও পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি অর্থকরী। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বভ্রমণ যেভাবে বেড়েছে, তাতে আল্পসের চূড়ায় গেলেও চেনা ভাষায় কথা শোনা যায়। বিপুল অর্থব্যয় করা আমাদের ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ এখন সেসব দেশের আয়ের একটি বড় সূত্র। কিন্তু পরিচ্ছন্ন বিদেশেও যে পর্যটন থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা হচ্ছে, তা গত বছর লকডাউনের সময় ভেনিসের স্বচ্ছ খালের ছবি দেখে আমরা সবাই জেনে গেছি। এ ছাড়া লম্বা পাড়িগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। আলাদা করে হিসেব করা যায় এই পুরো কার্যকলাপের কার্বন পদচিহ্ন (carbon footprint)। সে সংখ্যা দেখলে ভয় বাড়বে বৈ কমবে না।
সারা বিশ্ব এখন ঘুরছে, তবে কিসের ঘূর্ণিপাকে তা জানা নেই। পরিবেশ বাঁচানো নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে, অনেক চাপানউতোর, নানা রকমের দোষারোপ। পরিবেশ ভাবনার প্রসঙ্গ এলে পর্যটন শিল্প নিয়েও ভাবতে হবে বই কি! সীমিত ও দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া সমাধান নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, বহু মানুষের জীবিকা ও কর্মসংস্থান এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক কথা। কিন্তু শুধু পরিষেবা-নির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশ আদৌ কতখানি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, সে একটা মৌলিক প্রশ্ন। পর্যটনের মতো একটি পরিষেবা-ভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিক প্রগতি পরিকল্পনা হিসেবে সঠিক কিনা তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। অন্যদিকে পরিবেশকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যে সম্পূর্ণ অর্থহীন, তা নিয়ে আজ কোনো দ্বিমত নেই। প্রাথমিক ভূমিকা এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের। পরিবেশ সমস্যার সমাধান করার জন্য অনুশাসন ভিত্তিক (command and control) নীতি নির্ধারণ করা যায়, আবার কর-ভর্তুকির মতো অর্থনৈতিক (economic instruments) নীতিও ব্যবহার করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুয়ের মিলিত নীতিই বেশি কার্যকরী হয়। পরিবেশ সংক্রান্ত নানারকম সমস্যার সমাধানে এগুলি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তেমনি ভাবে পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম আর অর্থনৈতিক হাতিয়ার যুগ্মভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সঠিক নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব যদি হয় সরকারের, ব্যবহারিক দায় অবশ্যই নাগরিকের। নাগরিক সমাজের সচেতনতা আর সরকারি সদিচ্ছা একসঙ্গে থাকলে পরিবেশ রক্ষা দুরূহ হলেও হয়তো অসম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বেড়ানো যদি সীমিত হয়, আবার যদি গল্পবইয়ের পাতায় ডুব দিতে হয়, যদি মনে মনে ছবি এঁকে দেখতে হয় অজানা সুদূরকে, তাতে খুব কি ক্ষতি হয় আমাদের?
এই লেখাটা সময় নিয়ে পড়ব বলে তুলে রেখেছিলাম। বেশ কিছু ব্যপারে খুবই একমত। যে পর্যটন রাত বারোটা অবধি গাঁক গাঁক করে ডিজে আর নাচকে ক্যাম্পফায়ার বলে চালায় তা একেবারে চাই না। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের নামেও বেশ কিছু ভয়ংকর জিনিষ হয়ে চলেছে। একটা যেমন 'চাদর ট্রেক'। ট্রাক ভর্তি লোকজন গিয়ে চাদরে হেঁটে বরফকে নোংরা কালো বানিয়ে একটা আখাম্বা হনুমান মুর্তি কি ভারতের পাতাকা বসিয়ে তার সামনে ছবি তুলে এক বীভৎস ব্যপার।
ওদিকে আইএমেফ না কারা যেন বলেছে ভুটান তার প্রকৃতিকে মোটেই ব্যবহার করছে না। ভুটান তো পর্যটক সংখ্যা কন্ট্রোল করে। বেশ করে।
অনেক আগের ভ্রমণকাহিনীগুলো যেমন জলধর সেন বা প্রবোধকুমার সন্যাল বা এমনকি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখায়ও আমরা দেখি হিমালয়ের অনেক জায়গাতেই পায়ে হেঁটে বা খুবজোর ঘোড়া কি খচ্চরে চড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এখন তো দেখছি কেদারনাথের গুহা মানে তাতে এসি আছে। তা তার সরাসরি প্রভাব তো হিমালয়ের উপরে পড়ছেই।
আবার অন্যদিকে অধিকাংশ রিমোট্ জায়গার লোকজন এত গরীব স্বাস্থ্য পরিসেবার এত ভয়ানক অবস্থা যে একটু কিছু পরিকাঠামো হলে ভালই হয় মনে হয়। এই নাথাঙ উপত্যকায় যে হোমস্টেতে ছিলাম তার মালকিন স্বামী মারা যাবার পর এই হোমস্টের কল্যাণেই সারা বছর মোটামুটি খেয়েপরে বাঁচতে পারেন।
তো এইসব নানারকম আর কি।
@দ,
মনোযোগ দিয়ে পড়া ও আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আসলে উন্নয়নের অর্থনীতি বড়ো গোলমেলে ব্যাপার। উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ হওয়ার দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে , কর্মকুশলতা তৈরিতে। আর সেই পথে আসবে আর্থিক বিকাশ। Endogenous growth theoryতাই শেখায়।
অন্যদিকে ধনী দেশেও আজ পর্যটন শিল্পের রমরমা। আজকের খবর অস্ট্রেলিয়া গোঁসা করেছে। গ্রেট ব্যারিয়ার রীফকে IUCN বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে বলে। দেশে পর্যটন থেকে আয় বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলার , কর্মরতের সংখ্যা ৭০ হাজার আর পর্যটকের সংখ্যা বছরে ৫ মিলিয়ন।
প্রকৃতির মূল্যে অর্থনৈতিক বিকাশ- বদলাতে আমাদের হবেই। সম্প্রতি দাশগুপ্ত কমিটি রিপোর্ট অন বায়োডাইভার্সিটি আবারও সেই ঘন্টাটাই বাজিয়েছে।
পর্যটন শিল্পের ক্ষতিকর দিকটা কিন্তু উঠে এসেছে আরো ডিসপজেবল ইনকাম বাড়ার জন্য। যদি এমনটা হতো যে সকলের আয় শুধু মাথাপিছু মাসিক খরচ প্লাস একটা ছোট মার্ক আপ এতেই সীমাবদ্ধ থাকত , তাহলেই সুখের পায়রার দল আবার হাওয়া হয়ে যেত। আর জেনুইন ভ্রমনার্থী রা টিকে থাকতেন। বেড়ানো অনেকটা চোখ খোলে। হয়ত পরিবেশের প্রয়োজনে তাতে লাগাম পড়াতে হবে। কিন্তু অনেকটা মুক্ত আকাশ কেড়ে নেওয়া হবে তাহলে!
' করবেট কিংবা বান্ধবগড়ে গিয়ে বাঘ দেখা, কাজিরাঙায় হাতি চড়া, হ্যাভলক দ্বীপে সমুদ্রে ডুব কিংবা জয়সলমিরে উটে চড়ে মরুভূমির বুকে তাঁবু গাড়া, প্রকৃতিপ্রেমের নমুনাই বটে।'
এগুলোতে কী কী ক্ষতি হয় বা হতে পারে, একটু বিস্তারিত হবে? আর এগুলো প্রকৃতিপ্রেম কেন হবে না? মানে নাও হতে পারে, কিন্তু হতেও তো পারে?
লেখার বেশ কিছু অংশে সহমত হয়েই প্রশ্ন রইল।
@ স্বাতী
ঠিক কথা। এক জায়গায় থাকতে থাকতে মন ছোট হয়ে যায়। তাই তো পথে চলা।
তবে কয়েকদিনের দেদার ফুর্তিতে অমৃত কুম্ভের সন্ধান আছে কিনা সে কথাটাই ভাবায়।
প্রকৃতি আর অর্থনীতির ভারসাম্য আনাটাই চ্যালেন্জ। কঠিন তো বটেই।
@ পাই
সংক্ষেপে বলতে গেলে ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে পড়ে
প্রকৃতি ও জীবজন্তুর বাসস্থানের ধ্বংস
প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ
পরিবেশ দূষণ-প্লাস্টিক, শব্দ, বর্জ্য ও নিকাশী
জীবজন্তুর ওপর অত্যাচার
পর্যটকের ভিড় ও তার কার্বন পদচিহ্ন
স্থানীয় সংস্কৃতি বদলাতে থাকা
পর্যটকদের দ্বারা নানা অপরাধমূলক কাজকর্ম
কখনো কখনো স্থানীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি
শুধু পর্যটনের ওপর নির্ভরশীলতা এবং অন্যান্য জীবিকার উন্নতি না হওয়া
ইত্যাদি।
‘প্রকৃতি প্রেম’ সম্পর্কিত মন্তব্যে আসলে বলতে চাইছিলাম, এগুলো কজন প্রকৃত অর্থে দেখতে যান আর কতজন হুজুগে। সত্যিকারের ভ্রমণার্থী তো নিশ্চয় আছেন। অস্বাচ্ছন্দ্য হুজুগে মাতা হুল্লোড়বাজদের নিয়ে।
মন্তব্যের জন্য অজস্র ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। পর্যটন আর প্রকৃতির এই দ্বন্দ্ব আজকের নয়। আর উদাহরণ খুঁজতে ভিন রাজ্যে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের কাছেপিঠের জেলাগুলোয় খোঁজ নিলেই দেখা যাবে। অথচ পর্যটন সারা বিশ্বের দ্রুত উন্নতি করা একটি ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। বিশ্বের জিডিপি-র ১০ শতাংশ তার অবদান। তবে আশার কথা, রাষ্ট্রপুঞ্জ এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। কী ভাবে প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র আর পর্যটন এক সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখা যায়। অন্য মন্তব্যে দু’টো লিঙ্ক দিচ্ছি। যা থেকে কিছুটা ধারণা করেছি।
https://www.unep.org/explore-topics/resource-efficiency/what-we-do/responsible-industry/tourism
https://www.unep.org/news-and-stories/story/tourism-can-help-sustain-biodiversity
@ পাই
সংক্ষেপে বলতে গেলে ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে পড়ে
প্রকৃতি ও জীবজন্তুর বাসস্থানের ধ্বংস
প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ
পরিবেশ দূষণ-প্লাস্টিক, শব্দ, বর্জ্য ও নিকাশী
জীবজন্তুর ওপর অত্যাচার
পর্যটকের ভিড় ও তার কার্বন পদচিহ্ন
স্থানীয় সংস্কৃতি বদলাতে থাকা
---
কিন্তু সে দেখতে গেলে তো পৃথিবীর সর্বত্রই, মানুষের অস্তিত্বই এই সব কারণে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। আর ওইসব অঞ্চলে জনজাতিদের জন্যেও কিছুটা হলে তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
বরং, পুরোপুরি ধ্বংং স আটকানো হলে, এনক্রোচমেন্ট বন্ধ হলে ভাল।
বর্জ্য না ফেলা, জঙ্গল কেটে রিসর্ট না বানানো, এগুলো আইন করে বন্ধ করার দাবি, যেখান্র আইন আছে,তা যথাযথ ভাবে লাগু করা, এগুলো নিয়ে বলা দরকার, কিন্তু একেবারেই যাওয়া যাবেনা তো নয়, বিলুপ্তপ্রাত স্পিসিস সংরক্ষণের ক্ষেত্র বাদে।
ভারসামাই ( এ কী রে বাবা, ম এ য ফলা লেখা যায়না কেন!!) চাবি।
কাজিরাংায় হাতির পিঠে চড়ে কি জিপে গ্ণডার দেখতে চাইলে, বা হ্যাভললে ডুব দিতে চাইলে, পরিবেশের সেরকম ক্ষতি না করেও করা যায় মনে হয়। নইলে বলতে হয়, নেহাতই প্রকৃতিপ্রেমী কেউ প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার জন্য চুপচাপ কোথাও বসে থাকলেও তাতে প্রকৃতির ক্ষতি হবে।
স্কেল এফেক্ট।
কাজিরাংায় তো প্রচুর পর্যটক যান। মোটামুটি ওভারস্যাচুরেটেড৷ মানে আর কিছু স্কেল এফেক্ট হবার নেই। এই এত লোকের হাতির পিঠে চড়ে গণ্ডার দেখায় ( একটা সীমার পর কিন্তু হাতি বা জিপ পাওয়া যায়না, মানে, গেলেও পাওয়া যাবেনা। মানে মাক্সিমাম ওখানে যত জিপ বা হাতিতে ঘোরা আলাও করা হয়েছে, তার থেকে বেশি দেওয়া হয়না) পরিবেশ প্রকৃতির কী কী ক্ষতি হয়েছে, কোন স্টাডি আছে?
লেখাটা ভালো লাগল। বহু আগে ২০০৩ সালে জগদলপুরে চিত্রকোট গিয়েছিলাম এবং চারপাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। স্থানীয় কিছু মহিলা কিছু আতা নিয়ে বসে আছেন পর্যটকদের অপেক্ষায়। এছাড়া আর কোত্থাও কিচ্ছু নেই। ভয়ংকর সুন্দর। প্রকৃতি ওইরকমই হওয়া উচিত। জানি না বর্তমানে সেই জায়গার কী হাল। উত্তরাখণ্ডর একটা অংশ মানে কুমায়ুন এমনিতে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করেছে নিজেদের মতো। নাগরিক অত্যাচারের চিহ্ন খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু সাততালকে ওভাবে আখাম্বা গড়ে তোলা খুবই খারাপ হবে। তবে বছর দুয়েক আগে লিটল রণ ঘুরে এসেছি এবং বুঝেছি প্রকৃতিকে উপভোগ কীভাবে করা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সবাই তো দেখি নিজেরা যান বা যেতে চান, চুপচাপ নিরিবিলি সৌন্দর্য উপভোগ করবেন বলে, কিন্তু সবাই সেটা চাইলে বা করলেই তো ভিড় হয়ে যাবে। এতো প্যারাডক্সিকাল চাওয়া হয়ে যাচ্ছে!
না হচ্ছে না। ভুটান যেমন নাম্বার অব ট্যুরিস্ট কন্ট্রোল করে সেইটে করা জরুরী।
লোকজনের বেড়ানো দুরূহ করে তোলা, কমানোর থেকে সেক্ষেত্রে নানা জায়গায় সীমিত পর্যটন গড়ে তোলা মনে হয় ভাল।
1) কাজিরাঙার ন্যাশনাল হাইওয়ের উল্টো দিকে কার্বি আংলএর পাহাড়। বানের সময়ে কাজিরাঙা ভেসে গেলে সেখান থেকে জানোয়ারেরা উপরে উঠে যায়। এবারে গত কয়েকবছর ধরে দেখবেন জানোয়ারদের যাওয়ার জায়গা বন্ধ করে করে ওখানে কি পরিমাণে রিসর্ট হোমস্টে বেড়েছে । কোহরা চারিয়ালি ছাড়িয়ে, জঙ্গলের একদম মুখে রিসর্ট গড়ে উঠেছে। শুনলাম কতিপয় হোটেল মালিক আরো বেশি লোক টাঅনার জন্যে ওখানকার নদীর কোর্সটাকে (মরা দিহিং ) ঘুরিয়ে দেবার জন্যে তদবির করছেন।
2) নাম্বার কন্ট্রোল গোমুখেও করে। প্রত্যেকদিন ১৫০ বা দুশো জন। ঢোকার জন্যে উত্তরকাশী থেকে পারমিট করাতে হয় ।
3) "না, কালা পাল বাড়তি পয়সা চান না। লোকের কাছে নিজের কথা বলে বেড়াতেই তাঁর আগ্রহ। এই জঙ্গলদেশকে তিনি কবে থেকে চেনেন! এর কিনারা-ঘুপচি চেনেন। লোকে ভুলে যায়। হাতি-গণ্ডার-বুনো মোষ দেখে, বীয়ার-কাবাব খায়, জঙ্গল কাঁপিয়ে হ্যাঃ হ্যাঃ হিঃ হিঃ হাসে। গোলাপি রংয়ের টি-শার্ট, বেগুনী রংয়ের বারমুডা পরে জিপের পেটে, হাতির পিঠে চেপে ঘুরতে বেরোয়। চেঁচিয়ে বলে, এই মামণি, ঐ মন্টু -ঐ দেখ গন্ডার বাঁড়া ! বলে- আমার হাতিটা কী পাঁদলো মাইরি! কিম্বা বলে-দূর বাঁড়া, একটা কোনো জানোয়ার নেই, বালের জঙ্গল। এর চেয়ে আলিপুর চিড়িয়াখানা ভালো। তারপর গাড়ির ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। ভুলে যায়।জঙ্গলতরাইয়ের উত্তরবাংলা পড়ে থাকে। কালা পাল পড়ে থাকেন।"
দরকারী লেখা। পর্যটন পুরো বন্ধ না করে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, রিসর্ট, হোম স্টে ইঃ-র ছাড়পত্র কম দেওয়া - কন্ট্রোল, ব্যালেন্স . আর কোর এরিয়ায় ঢুকতে না দেওয়া, কোর এরিয়ার আয়তন বাড়ানো
সরকারী স্তরে সদিচ্ছা খুবই প্রয়োজন। বেসরকারী উদ্যোগে বেশিদূর এগোনো মুশকিল
আমার যা মনে হয়, মানুষ স্বভাবতই ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। এই লেখায় পর্যটনের সাপ্লাই সাইড নিয়ে আলোচনা হয়েছে, অর্থাত কিভাবে হোটেল, রাস্তা ইত্যাদি বানিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আর শুধু হোটেল না, টুরিজম ইন্ডাস্ট্রির বেড়ে যাওয়ার আরেকটা কারন হলো সহজলভ্য পরিবহন - আজকাল খুব কম খরচে আর খুব কম সময়ে নানান জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে, লোকজন দিব্যি সকাল বেলা গাড়ি বার করে অরোরা বোরিয়ালিস দেখে পরদিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। বা ধরুন উইকেন্ডে লঞ্চ ভাড়া করে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে স্কুবা ডাইভিং করে সোমবার সকালে অফিসে হাজির হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এই সাপ্লাই সাইডের উল্টোদিকে ডিম্যান্ড সাইডও সমান গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাত এইসবের যোগান আছে কারন টুরিজমের প্রচুর ডিম্যান্ড আছে - মানুষ ঘুরতে যেতে চায়, সে কাজিরঙ্গাই হোক কি তিতিকাকা লেক। তো ডিম্যান্ড কমানোর একমাত্র উপায় হলো দাম বাড়ানোর। টুরিজমের বিভিন্ন সেক্টরগুলোয় দাম বাড়ানো হোক - ধরুন কেউ টুরিস্ট ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করলে তাকে পাঁচশো ডলার ট্যাক্স দিতে হবে, বা প্লেনে ফার্স্ট ক্লাস ছাড়া টিকিট কাটতে পারবে না, বা নৈনিতালের এন্ট্রি পয়েন্টে মাথাপিছু কুড়ি হাজার ইকো ট্যাক্স জমা দিতে হবে। আর সমস্ত টুরিজমের জায়গাগুলোতে শুধুমাত্র পাঁচতারা রিসর্ট থাকুক, যেখানে দিনপ্রতি ডবল রুমের চার্জ পনেরো থেকে কুড়ি হাজার হবে। এরকম সবকিছুতে দাম বাড়ালে, বা বিভিন্ন দেশের সরকার নানারকম এন্ট্রি ট্যাক্স, টোল, ফি, ইত্যাদি চার্জ করতে শুরু করলে আপনা থেকেই পর্যটকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রন হয়ে যাবে। দাম বাড়ান, পর্যটন সীমিত করুন।
অপ্রিয় হলেও কথাটা ঠিক যে দাম সবচেয়ে শক্তিশালী economic instrument .
চাহিদা কমবে আমাদের সচেতন behavioural changeথেকে এটা কাম্য হলেও দুরাশা। তাই self-nudging এর জায়গায় policy nudging দরকার।
দাম বাড়ানো মানে শুধু বড়লোকদের বেড়ানোর লাইসেন্স দেওয়া। তার চেয়ে দাম এক রেখে সীমিত সংখ্যক পারমিট দেওয়া যেতে পারে
অরণ্যদা, সীমিত সংখ্যায় পারমিট কিসের বেসিসে দেবেন? মানে সেই পারমিট পাবার যোগ্যতা কি হবে? আর সীমিত সংখ্যার পারমিট কি বড়লোকরাই কুক্ষিগত করবে না?
আরেকটা প্রশ্ন, এই বেড়ানোর পারমিটগুলো কোথায় ইস্যু করা হবে? অরিজিনে নাকি ডেস্টিনেশানে? মানে ধরুন আমি চেন্নাই থেকে টাস্কানি বেড়াতে যেতে চাই। তাহলে পারমিটের জন্য কোথায় অ্যাপ্লাই করবো? চেন্নাইতে বসে, নাকি ইটালির এয়ারপোর্টে পৌঁছে? :-)
এই রে, আরও একটা প্রশ্ন পেয়েছে। পারমিট এনফোর্স করার জন্য কি টুরিজম পুলিশ গঠন করা হবে?
পারমিট কেলেঙ্কারী ধরার জন্য স্পেশাল গোয়েন্দাবাহিনী ও লাগবে তখন। ঃ-)
পারমিট হল ফার্স্ট কাম, ফার্স্ট সার্ভ। যেখানে কয়েকটা নির্দিষ্ট এন্ট্রি পয়েন্ট আছে, সেখানে তো করাই যায়, যেমন ন্যাশনাল পার্ক, রিজার্ভ ফরেস্ট ইঃ জায়গায়। করা হয়ও, আম্রিগার ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক-এ একসময় দিনে কটা গাড়ি ঢুকতে পারবে, তার সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
অবশ্য ভারতের বনবিভাগ কখনো যদি আম্বানি-আদানি-দের হাতে যায়, তখন হয়ত বড়লোকদের জন্য আলাদা পারমিট থাকবে - ফার্স্ট ক্লাস পারমিট, বিজনেস ক্লাস ইঃ :-)
আম জনতার জন্য ক্যাটল ক্লাস পারমিট । সে দিন খুব দূরেও নয় বোধহয়, লরেন তো সবই বিকিয়ে দিচ্চে
হ্যাঁ ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ পারমিট তো অনেক জায়গাতেই আছে। বোধায় তাজমহলেও ওই বেসিসে টিকিট দেয়। ডিজনিল্যান্ডেও কিছু কিছু রাইডে আছে, যদিও তার সাথে আবার ফাস্ট পাসও আছে। কিন্তু এরকম পারমিট দিয়ে কি টুরিস্টদের যাতায়াত আটকানো যাবে? আমার যেমন অনেকদিনের ইচ্ছে পেরুর Uyuni সল্ট ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার। তো এবার যদি পেরু সরকার বলেও যে দিনে একশোটা করে পারমিট দেওয়া হবে, তাহলেও আমাকে তো প্রথমে চেন্নাই থেকে পেরু পৌঁছতে হবে! :-)
শুধু বিরোধিতা করার জন্য প্রশ্ন করছি তা নয়, পারমিট সিস্টেম দিয়ে সারা পৃথিবীর টুরিজম আটকানো যাবে কিনা সেটা ভাবছি।
তুমি যদি পেরু ঘুরে এসে একটা সর্ষে লেখ, তাইলে তোমার বড়লোক ভ্রমণকারী হওয়ার অপরাধ মাপ করা যেতে পারে :-)
একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্রমণার্থীকে ঢুকতে দেবার কিথা বলা হচ্ছে। কাউকে ঠ্যাকানো ত নয়। ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উপরে ন্যাচারাল রিসোর্সের উপরে যাতে চাপ না পড়ে। নির্দিষ্ট সময়কালে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্রমণার্থী যেতে দিলে ওই জায়গায় প্রতিদিন কজন রাত্রিবাস করতে পারবে সেটা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। সেইমত প্রশাসন অহেতুক হোটেল হোমস্টে গজিয়ে ওঠা প্রতিরোধ করতে পারে।