মৌসুমী বিলকিস— কবিতা লিখছেন স্যার?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত— ভীষণভাবে। তবে এই গত কয়েক মাস একটু কম হয়েছে। খুব বেশি লিখতে পারিনি। তবে লিখছি তো বটেই। কবিতা ছাড়া আমি বাঁচবো কী করে? গত বছর আমার শেষ কবিতার বই বেরিয়েছে, ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’। দে’জ থেকে আমার কবিতা সংগ্রহ প্রথম পাঠ বেরিয়ে গেছে। দ্বাদশ কবিতার বই ওদেরই দেব ঠিক করেছি। একটু সময় পেলেই কবিতা বেছে দিয়ে দেব।
মৌ. বি.— দ্বাদশ কবিতা গ্রন্থের নাম ঠিক করে ফেলেছেন?
বু. দা.— না। কালকেও নাম নিয়ে ভাবছিলাম। এখনও ঠিক করতে পারিনি। ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’ আমার একটা কবিতারই নাম। হতেও পারে এবারেও কোনও একটা কবিতার নামই দেব, দেখা যাক, যদি পছন্দসই নাম মাথায় না আসে।
মৌ. বি.— এক নম্বর থেকে বারো নম্বর কাব্যগ্রন্থ। কেমন এই চলা?
বু. দা.— এক নম্বর থেকে বারো, অনেকখানি জার্নি। পাল্টে গেছি আমিও, আমার কবিতার ভঙ্গি পাল্টেছে, রীতি পাল্টেছে, বিষয় বদলেছে। তাই… প্রথম যখন শুরু করেছিলাম কবিতা লেখার আনন্দে কবিতা লিখতাম। এখন তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে অনেক কিছু। বেঁচে থাকা, জীবনযাপন, জীবনযাপনের জটিল আবহগুলো, বিশ্বাসভঙ্গের কথা, প্রেমের কথা, অপ্রেমের কথা, ভালবাসার কথা, ভালবাসাহীনতার কথা- সব এসে পড়ে এবং খুব অদ্ভুত ব্যাপার হয়, যেমন ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’ বইয়ের একটা কবিতার নাম ‘ইলিশ মাছ’, শুরু হয়েছে একটা লোক বাজারে গেছে ইলিশ মাছ কিনতে। শুরু হচ্ছে একদম অন্যভাবে, খুব সাধারণভাবে শুরু হচ্ছে। শেষ হচ্ছে স্বপ্ন দিয়ে…সে দেখতে পাচ্ছে তার শেষ স্বপ্ন।
মৌ. বি.— স্যার, অনেকের মতোই আপনারও কি জীবনানন্দই প্রিয়?
বু. দা.— উউউউউ...(একটু ভেবে) আমার প্রিয় কবি একজন বললে ভুল হবে, বলা উচিত নয়। অনেকেই আছেন। বেশ কয়েকজন আছেন। তবে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে নিশ্চিত জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশ… তাঁর কথা মনে হয় না এমন সপ্তাহ আমার যায় না। বাংলা কবিতাকে যে জায়গায় উনি নিয়ে গেছেন… এত দূরে নিয়ে গেছেন… এত দূরে নিয়ে গেছেন যে সেটা ভাবাই যায় না! রবীন্দ্রনাথ যেটা পারেননি। যেটা ওঁর সমসাময়িক আর কোনও কবি পারেননি। প্রেমেন্দ্র মিত্র পারেননি, বুদ্ধদেব বসু পারেননি, উমম… আরও অনেক… সুধীন দত্ত পারেননি… কেউ পারেননি। উনি এঁদের চেয়ে একটু অগ্রজ। কিন্তু উনি কবিতাকে এত দূর অবধি বিস্তৃত করে দিয়েছেন ছাতার মতন তার তলায় দাঁড়িয়ে আছেন এখনকার কবিরা।
মৌ. বি.— স্যার, যতদূর জানি আপনার মা মিউজিকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই শব্দ শুনে অভ্যস্ত আপনার ছোটবেলার কান সিনেমায় কীভাবে ব্যবহার করেন?
বু. দা.— ‘যুক্ত ছিলেন’ বললে বেশি বলা হয়ে যায়। মা পিয়ানো বাজাতেন- এই আর কী। তাঁর সেই সুরের জ্ঞান, তালের জ্ঞান আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আজ সিনেমা করতে গিয়ে বুঝেছি এই তালের জ্ঞানটা কী দরকারি! মাত্রা জ্ঞান না থাকলে সিনেমা করা যায় না। তালজ্ঞান না থাকলে সিনেমা করা যায় না। তো এই তাল এবং মাত্রার জ্ঞান আমার ভয়ঙ্কর প্রখর। আমি গাইতে পারি না, কিন্তু তাল দিতে পারি। এটা দরকার, খুব দরকার। এটাকে আমি আমার সম্পদ বলে মনে করি।
মৌ. বি.— সিনেমার আবহ এবং সংগীত বিষয়ে আপনার কাছে জানতে ইচ্ছে করছে।
বু. দা.— দুটো এক জিনিস নয়। আবহ এবং সংগীত। সংগীত বলতে অনেকে আবার বোঝেন শুধু গান। শুধু সংগীত গল্পে সাহায্য করে অনেকে মানতে চান না। আবহ একটা ট্র্যাক, মিউজিক আরেকটা ট্র্যাক। এই দুটো ট্র্যাককে মিক্সিং-এর ব্যাপারটাই কিন্তু শব্দের পক্ষে খুব জরুরি, শব্দগ্রাহকের পক্ষে জরুরি, যে উপলব্ধিটা তিনি আরোহণ করেন পরিচালকের কাছ থেকে, কী ভাবে মেশাতে হবে, কী ভাবে মেলাতে হবে। আমার ছবিতে আবহ যেমন আছে সুরও আছে। সুর, আবহ কখনও মিশে যাচ্ছে, কখনও আলাদা হয়ে থাকছে।
মৌ. বি.— আপনার ফিল্মের সঙ্গে স্যার, দেশীয় সুর বিশেষত লোকসুরের আশ্চর্য সংযোগ দেখা যায়।
বু. দা.— আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকের ভয়ঙ্কর ভক্ত। প্রত্যেক দিন শুনি… আজ সকালেও শুনেছি কিছুক্ষণ… যেটা আমাকে খুব ঋদ্ধ করে। যখন খুব মন খারাপ লাগে, ভাবনার দিশা পাই না বা ভাবতে চাই তখন ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিক আমাকে অন্তত খুব প্রাণিত করে। কিন্তু মিউজিক ডিরেকশন দিতে গেলে জানতে হবে সিনেমার চরিত্রটা কী। সিনেমার চরিত্র বুঝে মিউজিক দিতে হবে। সেখানে ফোক থাকতেই পারে। দেশীয় মিউজিক তো থাকবেই। আবার মিউজিকের কোনও দেশ হয় না। তাই না? তো সে অর্থে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের জ্ঞান থাকা খুব ভাল। খুব জরুরিও।
মৌ. বি.— ব্যারক মিউজিক? বাখ? (খুব ভয়ে ভয়ে প্রায় অস্ফুটে জানতে চাই। বিরক্ত হওয়ার বদলে বলতে থাকেন)
বু. দা.— বাখ হলেন তালের রাজা। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের… সে কত বছর আগে!... প্রায় পাঁচশ বছর আগে বাখের জন্ম। চার্চে বসে যে অর্গানটা উনি বাজাতেন সেই অর্গানের ছবি দেখেছি জার্মানিতে গিয়ে, তখন সেটা ছিল সাউথ জার্মানি এবং ওঁর বাড়িতে গেছি।
কিন্তু মুশকিল হল কী… বাখের পর আরও অনেকেই আছেন বিথোফেন, মোৎজার্ট, ভিভালডি… আরও সবাই আছেন। এঁদের মুশকিল যেটা হল, ওয়েস্টার্ন মানুষ এঁদের একসঙ্গে ট্যাগ করতে শুরু করলো।
মৌ. বি.— আপনার ফিল্ম অনেক পুরস্কার পেয়েছে…
বু. দা.— পুরস্কারের থেকে অনেক এগিয়ে থাকে সিনেমা। ভারতবর্ষে সত্যজিৎ রায়ের পর বোধহয় আমি এত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি। তাঁর মতো আমিও পাঁচ বার স্বর্ণকমল পেয়েছি বেস্ট ফিল্মের জন্য, দু বার বেস্ট ডিরেক্টরের জন্য। কিন্তু এগুলিকে কখনোই মনে হয়নি আমার প্রাপ্তি… ভেনিস থেকে আরম্ভ করে আরও অনেক…। কিন্তু কখনোই মনে হয়নি এগুলোর জন্য ছবি করছি। আমি ছবি করছি সিনেমার জন্য। সিনেমাই আমার কাছে আসল ব্যাপার। কিন্তু, অ্যাওয়ার্ড পেলে কী সুবিধা হয়? কতকগুলো ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হয়। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। আমার ছবির মূল বাজার বিদেশ। দেশে হইহই করে আমার ছবি চলে – এটা আমি বলতে পারি না। এটা বললে মিথ্যাভাষণ হবে।
ক্রমশ...
দুরত্ব, গৃহযুদ্ধ, নিম অন্নপূর্ণা, বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা, এছাড়া তাঁর আর কোনো ছবি খুব একটা চলেছে বা আলোচিত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সংবেদনশীল পরিচালক ছিলেন। ফেস্টিভ্যাল কেন্দ্রিক হতে গিয়ে দর্শকরা বঞ্চিত হয়েছে।
বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত ।...মেঘে ঢাকা তারা এক শিল্পী আমাদের এই প্রচার সর্বস্য সেলেব জগতে কিন্তু কি অদ্ভুত বিনয়ী কথা বার্তা ।..একটুও ইগো নেই ।..নেই কোথাও অহমিকা ।...সাবলীল ভাবে নিজের শিল্প কে ।..সৃষ্টি কে ব্যক্ত করছেন ।...এই তো শিল্পী ।...এই তো কাছের মানুষ !!!