দাদাদের কীর্তি
তামিমৌ ত্রমি
১৯৮০ র ২৪ শে জুলাই। কলকাতা শহরের রাজপথ জুড়ে এক বিরাট অভিমানী অজগর ধীর ও মৌন সর্পিলতায় এগিয়ে চলেছে। তার মাথার মণি আজ নিভে গেছে যে! মণির নাকে তুলো, দু চোখ বোজা, দুটো সেলোটেপ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে আর কোনদিন বেরিয়ে আসবে না মণিময় উল্লাস-প্রভার হাসিঝিলিক। গোটা কলকাতা ভেঙে পড়েছে পথে। মহিলারা বারান্দায় ঝুঁকে শেষ ফুল ছোঁড়ার অপেক্ষায় মলিনবিধুরা। গৌরীশ্বর, সুপ্রিয়াকান্ত সুচিত্রামোহন বঙ্গবাসীরমণ তাঁর তাবত সাম্রাজ্য ফেলে চললেন মথুরায়..
আমার মা বলেন উত্তম কুমার আলুর মতো। ভাজা কর, তরকারিতে দাও, দম কর, সেদ্ধ খাও, যেকোন সব্জির সঙ্গে তাল মেলাতে বল, তরকারির বহর বাড়াতে ভেজাল দাও- সবেতেই তার মায়াকাড়া স্বস্তিদায়ক অনাবিল অথচ রাজেশ্বর উপস্থিতি।
এখন প্রশ্ন হল, মায়াঞ্জন গেলেন মথুরায়.. বৃন্দাবনের, থুড়ি, বাংলার হবে কী? বলাকা হয়ে নীড় থেকে আকাশে উড়াল দেওয়ার চেনা রাস্তাটা তাদের চিরতরে হারিয়ে গেল। কিন্তু তাদের হৃদয়ে এখনও যে সেই ঠোঁটের কোণে চেপে রাখা সিগারেটের ফুলকি যমুনার ঢেউয়ে চন্দ্রিমার মতো জ্বলে। তাদের বুক পুড়ে যায়, লোনামতো কি যেন একটা রাতের অন্ধকারে চোখের কোলে ঠেকে। চক্ষে তখন তাদের তৃষ্ণা আর প্রশ্ন... এবার কে? এবার কীভাবে...
সেই বছরই সাত রাজা ধন মানিক সমেত পেঁটরায় যাবতীয় 'কীর্তি' নিয়ে 'দাদা' প্রবেশিলেন অঙ্গনে। দাদার ডাকে সাড়া দিতে কারোর তো বয়ে গেলই না বরং এমন একটা ডাকের অপেক্ষাতেই ছিল বাঙালী। জাতটা যেন বেঁচে গেল। আবার একজন সুদর্শন, সরল, অনাবিল হাসির পরম্পরাবাহিত, বিড়ম্বিত হলেও সত্যের কক্ষপথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হওয়া এক আপাদমস্তক ভদ্রলোক পেয়ে বাংলা আনন্দে ঝঙ্কৃত হয়ে গেল।
আবার শুরু হোরিখেলা। এল রে এল রে এল হোলি এল রে ... আবীর ফাগে মথিত হল বায়ু... আবার হাওয়ায় প্রেম প্রেম অপলাপ।
যারা ছেলে মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট না হলে 'কোন ভবিষ্যৎ নেই' বলে স্ট্যাম্প দাগিয়ে রীতিমতো সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝখানে চীনের প্রাচীর গেঁথে দিতেন.. তারাও তিন বার বিয়ে পাস করতে না পারা কেদারের ভক্ত হয়ে পড়লেন। তরুণ দাদা 'দাদা'র সঙ্গে বুক পর্যন্ত আমাদের বরফজলে মন্ত্রজপসহ কেঁপে কেঁপে চান করিয়ে প্রেমিকার হবু বরের স্যুটকেস বইয়ে জুতো পরিস্কার করিয়ে আমাদের চোখে গঙ্গা পদ্মা এনে প্লাবনবিপ্লব ঘটালেন - আমরা ভেসে গেলুম।
তত্ত্বের চশমা আঁটা আতশ কাচের তলায় এ কীর্তিস্তম্ভকে কাটাছেঁড়া করলে সে হোত এক গুরুভার প্রবন্ধ সন্দেহ নেই, সে হয়তো কোনদিন জন্মও নেবে দু মলাটের নিষ্ঠুর কাঁথায়..
লেকিন আভি মুড নেহি হ্যায়। কারণ আজ রোববারের হৃদয়টা হাফ বয়েলড। কোমল কুসুম দর দর নির্ঝর যুক্তির আতস কাচটা প্রবল তোড়ে সরিয়ে ফেটে ফেটে গলে পড়তে চাইছে, নুন মরিচে হোরি খেলতে চাইছে।
এক্ষণে সেই কুসুমতাতেই চামচ আর চোখ ডুবিয়ে স্বাদমথিত হতে হতে মনে হচ্ছে এই, তখনো দাদারা আমাদের দাদার মতোই ছিল। সে বিড়ম্বিত নায়ক কেদার দাদাই হোক আর সবজান্তা কাঠিবাজ কাঁঠালী কলা ভোম্বল দাদাই হোক, এরা আমাদের চেনা দাদা ছিল। এদের সিক্স প্যাকের জড়োয়া জাঁকজমক ছিল না। এদের স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরে আড়াআড়ি বুক চেরা মস্তানির দাগ দেখানোর দায় ছিল না। এরা এখানে মারলেও লাশ শ্মশানে লুটিয়ে পড়ার কোনরকম সম্ভাবনা ছিল না। প্রেমিকাদের নিয়ে বিদেশে গিয়ে মোটর বাইকে চাপিয়ে ষাঁড়ের মতো গাঁক গাঁক প্রেম করার মতো পয়সা তাদের দুঃস্বপ্নেও ছিল না। তখন অয়নদের মতো ভাইরা ছিল। মিষ্টি দুষ্টু জানলার গ্রিল ধরে এপার ওপার লজ্জালতানো প্রেম, দাদার নির্বুদ্ধিতায় রাগ,দাদার অপমানে ক্রোধ, দাদার সরলতায় মুগ্ধতা..
আর সবচেয়ে বড় এবং গোপন কথাটি হল সেই প্রেম আমাদের বড্ড চেনা। সেই পাড়ার ফাংশানে চোখে চোখে আলো লেগে যাওয়া, কয়েক সেকেণ্ড থম... তারপর চোখ নামিয়ে নেওয়া। কি যেন ঘটে যাচ্ছে ভেতর ভেতর! গাছেদের যে পাতারা ঝরে যাচ্ছে তারা কাদের দীর্ঘশ্বাস! জানলা দিয়ে গলে যাওয়া ঢিল বাঁধা চিঠির মান অভিমান, কার স্কুলের গেটের উলটো দিকে ঠিক ছুটি হওয়ার সময়টা নির্নিমেষ আকাশ দেখা... সরস্বতী পুজোয় 'বিদ্যাস্থানে ভয়েবচ' আওড়াতে আওড়াতে চাঁদমালা থেকে একটু দূরে ভেজা চুল হলুদ শাড়ি সবুজ কলকার নিবিড় টঙ্কার, পাটভাঙা ধুতি পাঞ্জাবীর পলকা কেঁপে কেঁপে ওঠা নায়ককে দেখে নিজেও শিরশিরে হয়ে যৌথ ম্যালেরিয়া, সচন্দন গন্ধপুষ্পের অঞ্জলি বাণী বন্দনার হাঁস অব্দি পৌঁছোনোর আগেই কোন সুগন্ধী এলোকেশীতে যে খসে পড়ল!
বড্ড চেনা আমাদের। এইসব কিছু। আমাদের পাড়ার যে দাদা তিন বারের চেষ্টায় বিয়ে পাস করতে পারল না আর একদিন অমোঘ জানালার গরাদ ধরে দেখল, তার ছুঁড়ে দেওয়া অঞ্জলি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সেই ভিজে এলোকেশী বেনারসী পরে নত এবং ক্ষতনেত্রকিরণসম্পাতে এগিয়ে গেল ফুলে সাজানো এমবাসাডরের দিকে... তার চলে যাওয়া যেন হোরিখেলা শেষ হওয়ার পর রঙেজলে মথিত ক্লেদাক্ত বিছিয়ে থাকা উদাসী রাস্তার ছাই... তা আমাদের সেই দাদা যখন 'কীর্তি' দেখতে গেলেন তখনও অব্দি তিনি হেরোই ছিলেন - কিন্তু বাড়ি যখন ফিরলেন, জিতে গলায় রীতিমতো মেডেল ঝুলিয়ে ফিরলেন। তিনি না পারলেও তারই মতো কেউ তো পেরেছে মানসীকে চরণ ধরাতে! পিয়ানো বাজাতে বাজাতে নিজেও কান্নাসুরে বেজে উঠে বড়লোক পাত্রকে 'কেউ' তো করেছে প্রত্যাখ্যান!!
ভিজে চোখ তাজা হাসি আর কল্পিত অহমিকা নিয়ে আমাদের দাদা কিংবা দাদারা পিঠ ফিরে অন্তত সেই রাতটা ঘুমিয়ে পড়তেন ভোরের তারায় জাগবেন বলে...
জিতা রহো বহন বা বেটি!
সত্তরের গোড়ায় আমরা সবাই অমন দাদা ছিলুম। সরস্বতী পুজো ছিল আমাদের ভ্যালেন্টাইন ডে। একটু আলাদা করে কথা বলতে পারলে বা আলগা হসি ছুঁড়ে দৌড়ে পালালে আমাদের গোটাদিন কেন গোটা সপ্তাহ হলিউড জলিগুড হয়ে যেত।
আজ সে কথা অবান্তর। আজ কে পয়ার ছন্দে কবিতা লিখতে চায়?
সেইতো। সেই দাদাদের কীর্তি সেলুলয়েডে কেমন করে যে গিরিতে পরিণত হল, সে এক অন্য গল্প। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই দাদা আপনাকে।
ভালো লাগলো। এসব অবিশ্যি আমার একেবারে ছোটোবেলার গল্প, তাও সেই আশির শেষ আর নব্বুইয়ের শুরুর মাঝের মফস্বল খুব বেশী পাল্টেছিলো কী? জানি না। মনে হয় যেন তারপরে হুপহুপ করে সব পালটে গেলো। বা হয়তো না। সব-ই ভ্রম। কে জানে।
আমার মনে হয় সেই 'দাদা'রা ঘুমিয়ে আছে আজও এই 'দাদা'দের অন্তরে.. সরস্বতী পুজো তো সেইরকমই আছে। একশন প্যাকড সিনেমার অনুকরণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার চরিত্রগুলো বদলে গেল। দাদারাও।
সুন্দর লেখা, পুরনো কথা মনে পরাল । তরুণ বাবু-র ঐ সিনেমাটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল
হ্যাঁ, তখন জনপ্রিয় হয়েছিল সিনেমাটা.. ধন্যবাদ
বেশ লিখেছেন। শেষের পানচ্ লাইন খুব ভাল।
অনেক পুরনো কথা মনে করিয়ে দিলেন। আটের দশকের দাদারা সব কোথায় ছিটকে গেল, আহা সোনালী শৈশব!
অসংখ্য ধন্যবাদ। সত্যিই সে সব দাদারা গ্রহানুপুঞ্জের মতো ছিটকে কোথায় যে গেল
অসংখ্য ধন্যবাদ। সত্যিই সে সব দাদারা গ্রহানুপুঞ্জের মতো ছিটকে কোথায় যে গেল