করোনা নিয়ে গবেষণার জন্য এমন এক ব্যক্তির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হল, যিনি রোগ নির্ণায়ক ময়নাতদন্তের (প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি) দাবিতে লড়াই করেছেন। মৃত্যুর পর এমন সম্মান কজন পান? ২০১৩ সালে গণদর্পণের স্মরণিকায় ব্রজ রায় লেখার শুরুতে পল রোবসনের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন। ‘’মানুষ অনতিক্রম্যকে অতিক্রম করে, তাই-ই তার ইতিহাস”। এক যুক্তির পৃথিবী গড়ে তোলার লড়াই। একের পর এক সামাজিক বাধা, জীর্ণ লোকাচারের বেড়া অতিক্রম করা। মাত্র একুশ বছর বয়সে (১৯৫৭ সালে) যিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হচ্ছেন, তিনিই পঞ্চাশ বছর বয়সে মরণোত্তর দেহদান আন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করছেন। টাইম বোমা তৈরিতে পারদর্শী, জেল থেকে মুক্তির জন্য হিংসায় বিশ্বাস করেন না বলে মুচলেকা দিতে অস্বীকার করা ব্যক্তিই চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে মরণোত্তর দেহদানের অন্যতম পথিকৃৎ হচ্ছেন। রাজনৈতিক বন্দি হয়ে আদালতে নিজেই নিজের সওয়াল করার সময়ে যিনি সরকার পক্ষের উকিলকে তাক লাগিয়ে দেন, তিনিই আবার ব্রেন ডেথ বা প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি নিয়ে প্রচার করতে গিয়ে চিকিৎসকদের সম্ভ্রম আদায় করে নেন। অথচ অর্থের অভাবে চোদ্দ বছর বয়সে (১৯৫০ সাল) ব্রজ রায়কে লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছিল। কারণ স্বাধীন দেশে দশ টাকা বার্ষিক ফি চালু করেছিল সরকার। তিনিই আবার ছাব্বিশ বছর বয়সে ব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ করে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসে পাশও করে যান। সব মিলিয়ে এক বর্ণময় জীবন। কিন্তু লক্ষ্যহীন নয়। ব্যক্তিমালিকানাহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নে লালিত সেই লক্ষ্য। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মার্ক্সবাদের প্রতি ব্রজ রায়ের আস্থা অটুট ছিল।
১৯৩৬ সালের ৩০ নভেম্বর কলকাতায় ব্রজ রায়ের জন্ম। শৈশবে বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁরা চলে যান গোবরডাঙ্গায়। দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বেড়ে ওঠা। ছোলা, ঠোঙ্গা বিক্রি করে বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৪৮ সালে তাঁরা আবার গোবরডাঙ্গা থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। লেখাপড়া ছাড়ার পর রুজি রোজগারের জন্য তিনি হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। তাঁকে সেসময়ে হোটেলে এঁটো বাসন ধোওয়ার কাজও করতে হয়েছিল। দেশের স্বাধীনতার আসল চরিত্র নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন। তারই সঙ্গে বেড়ে চলেছে বাম রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ। ১৯৫৩ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই ভারতীয় গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে গণনাট্যের সম্মেলনে যোগ দেওয়ায় বেসরকারি কোম্পানির চাকরি চলে যায়। প্রবল আর্থিক অনটনে চাকরিটা ছিল তাঁর বড় সম্বল। ক্ষমা চাইলে চাকরিটা হারাতে হত না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে চাকরি যাওয়াকে তিনি গর্বের বলেই মনে করেছিলেন। আবার গণনাট্যের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমতও হতে পারছিলেন না। শৃঙ্খলার নামে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি। ১৯৬০ সালের ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট। ব্রজ রায় তখন ডাক বিভাগে কাজ করেন। ধর্মঘট সফল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু পাঁচদিনের মাথায় সেই ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়। নেতৃত্বের এই আপসকামী মানসিকতা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। দলের নির্বাচন কেন্দ্রিক কর্মসূচি, সংসদীয় রাজনীতির সারবত্তা নিয়েও তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। নিজের মনে জন্ম নেওয়া নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছিলেন তিনি।
এমন সময়েই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক বিপ্লবী অনন্ত সিংহের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বিপ্লবী গণেশ ঘোষের কাছে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের গল্প শুনে ব্রজ রায় রোমাঞ্চিত হচ্ছেন। চলছে নতুন দল গড়ার ভাবনা। ১৯৬৫ সালে অনন্ত সিংহ, ব্রজ রায় প্রমুখরা রেভল্যুশনারী কাউন্সিল অব দ্য কমিউনিস্ট ইন ইন্ডিয়া (আর সি সি আই) নামে একটি বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। দলের দলিলে বলা হয়, কমিউনিস্টস আর প্রিডমিনেন্টলি ডমিনেটেড বাই রিভিশনিস্ট, বাট দ্য র্যাঙ্কস আর রেভল্যুশনারী। দল না চাইলেও বিপ্লবের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। সঠিক বিপ্লবী দল থাকলে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নয় সম্ভাবনা ধ্বংস হবে। ঠিক হয় দল প্রকাশ্যে কাজ করবে না। অন্য দলের ভেতর থেকে কাজ করবে। সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হতে পরের বছরেই ব্রজ রায় ডাক বিভাগের চাকরিতে ইস্তফা দেন । কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদও আর নবীকরণ করেন না।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলতে চলতেই ব্রজ রায়ের জীবনে আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। নাটক করার সুবাদে তৃপ্তি চৌধুরির সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল। ডাক বিভাগে কর্মরত তৃপ্তি চৌধুরিও ছিলেন বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ১৯৬৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ব্রজ রায় ও তৃপ্তি চৌধুরী পরস্পরকে জীবনসঙ্গী করেন। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে তাঁরা লিভ টুগেদারের সিদ্ধান্ত নেন। লেনিন- ক্রুপস্কায়ার মতোই বিপ্লবের স্বার্থে কোনো সন্তানের জন্ম না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সম্ভবত ব্রজ রায়-তৃপ্তি চৌধুরি প্রথম কলকাতায় লিভ টুগেদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তৃপ্তিদি ব্রজ রায়ের থেকে বয়সেও বড়। তাঁরা এঙ্গেলসের ‘দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’ বইটি পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পরিবার প্রথা, বিবাহ ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেবল আত্মস্থই করেন নি, সেই আদর্শকেই জীবনের পাথেয় করেন। ততদিনে ব্রজ রায়, অনন্ত সিংহের সঙ্গে তৃপ্তি চৌধুরীর সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিলেন। তৃপ্তি চৌধুরীও আর সি সি আই’র সঙ্গে যুক্ত হন।
অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ছদ্ম পরিচয়ে ঘন ঘন বাড়ি বদল এসবের জন্য অর্থ প্রয়োজন। অনন্ত সিংহ এর আগে অর্থ সংগ্রহের জন্য সিনেমায় টাকা বিনিয়োগ করেছেন। চলচ্চিত্র জগতের অনেক ব্যক্তিও গোপনে অর্থ দিতেন। দল সিদ্ধান্ত নিল অর্থের জন্য ডাকাতি করবে। ডাকাতি নিয়ে দলের মধ্যেই বিতর্ক উঠেছিল। লেনিনের ‘গেরিলা ওয়ারফেয়ার’ আত্মস্থ করা ব্রজ রায়ের ডাকাতি নিয়ে কোনো শুচিতা ছিল না। প্রথমে পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে ডাকাতি। অর্থ এল। এবার বিপ্লবের প্রস্তুতি। কিন্তু দলের মধ্যেই শুরু হল অস্ত্র প্রশিক্ষণ পিছিয়ে দেওয়ার খেলা। কারোর দাবি আগে আলোচনা, তারপরে প্রশিক্ষণ। আলোচনাতেই সময় কাটে। দলের কেউ কেউ হতাশ হয়ে নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানে আকৃষ্ট হচ্ছেন। অর্থ কমতে থাকছে। তারজন্য আবার ব্যাঙ্ক ডাকাতি। ব্রজ রায়, তৃপ্তি চৌধুরীরা টের পাচ্ছিলেন একটা অংশ ইচ্ছে করেই দেরি করিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশের হাতে দলের অন্যান্যদের ধরিয়ে দিতে চাইছে। অনন্ত সিংহও সবকিছু টের পাচ্ছিলেন। বাধ্য হয়ে ব্রজ রায়, তৃপ্তি চৌধুরী আর সি সি আই’র কাজ থেকে বের হয়ে আসেন। প্রচারের জন্য তাঁরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাইম বোমা বিস্ফোরণ ও লিফলেট ছড়িয়ে দেওয়ার পথ নিলেন। গোপনে চলল লিফলেট ছাপিয়ে বিলির কাজ। বিভিন্ন সিনেমা হলে টাইম বোমা বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। পরিকল্পনা এমনভাবেই করা হত যাতে প্রাণহানি না হয়। তাঁরা নিজেরাই টাইম বোমা বানাতেন। বোমা বানানোর দক্ষতা অর্জনে ব্রজ রায়কে বেগ পেতে হয় নি।
১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর ব্রজ রায় ও তৃপ্তি চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বোমা বিস্ফোরণের জন্য মামলা চলে। জেরার নামে ব্রজ রায়ের ওপর পুলিশ অকথ্য অত্যাচার চালায়। আর সি সি আই’র বিভিন্ন সদস্যকে ডাকাতির কেসে ধরা হতে থাকে। ১৯৭০ সালের ১০ জানুয়ারি অনন্ত সিংহকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭০ সালের জুন মাসে ব্রজ রায় ও তৃপ্তি চৌধুরী বোমা বিস্ফোরণের মামলা থেকে মুক্তি পান। তৃপ্তি চৌধুরী মুক্ত হলেও, ব্রজ রায়ের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা থাকায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় নি। আর সি সি আই’র আটক সদস্যদের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলার জন্য গঠিত হয় ফোর্থ ট্রাইব্যুনাল। ব্রজ রায় নিজের পক্ষে নিজেই সওয়াল করতেন। সওয়ালে তার আইনি মারপ্যাঁচ, এক্সপ্লোসিভ কেমিস্ট্রির জ্ঞানে অনেকেই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জেলের ভেতর শত্রুও বেড়েই চলছিল। আর সি সি আই’র বেশ কয়েকজন মুক্তি পেতে স্বীকার করার জন্য ছটফট করছেন। ব্রজ রায়ের যুক্তি ছিল অপরাধ করেন নি, স্বীকারের প্রশ্ন নেই। এদিকে তিনি নিজেই নিজের সওয়াল করাতে অন্যদের ছাড়া পেতেও অসুবিধা। তখন জেলে অনেক নকশাল বন্দি ছিলেন। তাঁরাও ব্রজ রায়দের পথের বিরোধী ছিলেন। ডাকাত বলে ব্রজ রায়দের তাচ্ছিল্য করতেন। আক্রমণও হয়েছে বেশ কয়েকবার। এখানে বলে রাখা ভালো যে, সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলতেন বলে আর সি সি আইকে অনেকে নকশাল বলে মোটা দাগে দেগে দেন। তা কিন্তু আদৌ ঠিক নয়। জেল কর্তৃপক্ষ, পুলিশের সঙ্গে ব্রজ রায়ের যে শত্রুতা থাকবেই তা বলবার প্রয়োজন হয় না। চলছিল মেরে ফেলার হুমকি। রুণু গুহনিয়োগীর সুনজরেও পড়েছিলেন। জেলের ডাক্তার হিসেবে ভাস্কর রায়চৌধুরী কৌশলে ব্রজ রায়কে বাঁচিয়ে দেন। ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে জনতা সরকার আসার পর রাজবন্দীদের মুক্তির কথা বলা হয়।কিন্তু শর্ত চাপানো হয়েছিল। মুচলেকা দিতে হবে যে, তিনি হিংসায় বিশ্বাস করেন না। ব্রজ রায় রাজি হন নি। তাঁর যুক্তি ছিল রাষ্ট্র সশস্ত্র হলে, নাগরিককে নিরস্ত্র থাকার কথা বলা যায় না। মার্ক্সবাদের ছাত্র হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র সম্পর্কে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা দুর্বলতা ছিল না। অবশেষে ১৯৭৭ সালের ১০ ডিসেম্বর অনন্ত সিংহ, ব্রজ রায়সহ ফোর্থ ট্রাইব্যুনালের বন্দিরা মুক্তি পান।
আট বছর কারাবাসের পর তিনি বন্দি মুক্তি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। সব রাজবন্দি তখনও মুক্তি পান নি। তারজন্য তিনি বিহারেও ছুটে যান।মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠন এ পি ডি আর’র সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সনদকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি। কারণ ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি। ব্যক্তিমালিকানা থাকলে যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না সে সম্পর্কে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এপিডিআর’র অনেকের সঙ্গেই মানসিক দূরত্ব তিনি টের পাচ্ছিলেন। অনেকেই তাঁকে ডাকাত বলে গণ্য করতেন।
তৃপ্তি চৌধুরীরা ততদিনে গণদর্পণ নামে সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে তুলেছেন। চলছে নাট্যচর্চা। কিন্তু অনেকেরই শুধু নাট্যচর্চার মধ্যে আটকে থাকার জন্য অস্বস্তি হচ্ছিল। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তো আরও বড়। রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগে, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় পরিচয় অনুসারেই একজন ব্যক্তির মরদেহের বিনষ্টি হয়। কিন্তু যিনি নিজের ধর্ম পরিচয় মানেন না, বস্তুবাদী তাঁদের ক্ষেত্রে এমন হবে কেন? অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরও জীবনাবসানের পর সাম্প্রদায়িক পরিচিতির তকমা জোটে। তাছাড়া একজন ব্যক্তি এই সমাজেই বেড়ে ওঠেন। তাহলে মৃত্যুর পর তাঁর দেহ কেন সমাজের হবে না? মৃতদেহের অধিকার পরিবারকে দেওয়ার অর্থই হল ব্যক্তিমালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়া। বিজ্ঞানী জে বি এস হলডেন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ১ ডিসেম্বর ভুবনেশ্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মরণোত্তর দেহ অন্ধ্রপ্রদেশে দান করা হয়। ব্রজ রায়সহ গণদর্পণের পাঁচজন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুরু হল আরো মানুষকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা। তাঁরই সঙ্গে ব্রজ রায় ছুটে বেড়ান স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ। তৈরি হল মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্র। ১৯৮৬ সালের ৫ নভেম্বর জে বি এস হলডেনের ৯৫তম জন্মদিবসে ৩৪ জনের মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে এক সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হল। ব্যক্তিমালিকানা ও ধর্মীয় পরিচিতির বিরুদ্ধে জেহাদই এমন এক সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল ।
অঙ্গীকারপত্রে সই করানোর পাশাপাশি চলে বস্তুবাদের চর্চা। প্রতি বছর হলডেন স্মারক বক্তৃতা, ১৯৮৬ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে গণদর্পণ শুরু করল পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত স্মারক বক্তৃতা। ১৯৮৮ সাল থেকে গণদর্পণের পত্রিকা মুখপত্র গণদর্পণ প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকার প্রচ্ছদে লেখা থাকত ‘গণদর্পণ চায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে চিন্তায় এবং আচরণে বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তির প্রতিষ্ঠা’। তৃপ্তি চৌধুরীর সম্পাদনায় পত্রিকাটি কয়েক বছর আগে পর্যন্তও প্রকাশিত হয়েছে।এইসব কাজেই ব্রজ রায় বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আইন না হওয়ার জন্য দেহদানের কাজ বাধার মুখে পড়ছিল। অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও আইন না থাকার অজুহাতে জ্ঞানাঙ্কুর গাঙ্গুলি ও বরেন দাঁ’র মৃতদেহ গ্রহণ করা হয় নি। হাল ছাড়েন নি ব্রজ রায়রা। গণদর্পণ আইনের খসড়া করে। ১৯৮৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে একটি আইন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। গণদর্পণ খসড়া আইনটি সরকারকে দেয়। এই খসড়া করতে ব্রজ রায়ের প্রধান ভূমিকা ছিল। এমন সময় আসে বহু প্রতীক্ষিত দিন। ১৯৯০ সালের ১৮ জানুয়ারি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে দান করা হয় সুকুমার হোম চৌধুরীর মৃতদেহ। রাজ্যে প্রথম।
অবশেষে ১৯৯৪ সালে ভারতে কার্যকরী হয় দ্য ট্রান্সপ্লানটেশন অফ হিউম্যান অরগ্যান অ্যাক্ট। আইন তৈরিতে গণদর্পণের খসড়াটি সহায়ক হয়েছিল। আইন হলেও বাধার শেষ নেই। মৃত্যু সম্পর্কে বহুযুগ ধরে চলে আসছে কুসংস্কার, ইহলোক, পরলোক, জন্মান্তরের ধারণা। প্রশাসক ও চিকিৎসকদের একাংশের অনীহা ও উদাসীনতাও আইন কার্যকরী করার ক্ষেত্রে বড় বাধা। বহু বিদ্রুপ, উপেক্ষা, অপমানেও ব্রজ রায় দমে যান নি। ব্রজ ডোম ডাককেও তিনি উপভোগ করতেন। চূড়ান্ত অব্যবস্থায় দেহ দান করতে গিয়ে অনেককেই হেনস্থার শিকার হতে হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন যে, গণদর্পণ এবিষয়ে উদাসীন। কিন্তু ব্রজ রায়রা চেয়েছেন আন্দোলনে সবাই সামিল হোক। দায়টা একা গণদর্পণের নয়। এমনকি যিনি অঙ্গীকার করেছেন তাঁর বাড়ির লোকেরও দায় রয়েছে। কারণ দায়টা সামাজিক।
গ্রামের ছোট আলোচনাসভা থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় স্থানে সেমিনার সর্বত্র ব্রজ রায় ছুটে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশেও একাধিকবার গেছেন। আন্দোলনকে সামাজিক রূপ দিতে গণদর্পণ বন্ধু সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্ক কান্ডের মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির অঙ্গ মূমুর্ষূর দেহে প্রতিস্থাপনের প্রচার করেছেন। স্বাভাবিক ও মস্তিষ্ক কান্ডের মৃত্যুর পার্থক্য নিয়ে সচেতন করেছেন। ব্রেন ডেথে মৃত্যুকে আবশ্যিক করতে আইন করার জন্য দরবার করেছেন। এবিষয়ে তাঁর অর্জিত জ্ঞানে বহু চিকিৎসকই অবাক হয়েছেন। ব্রেন ডেথে মৃত ব্যক্তির প্রত্যঙ্গ অন্যের দেহে স্থাপনের বিচারে আমাদের রাজ্য অনেক পিছিয়ে। এনিয়ে তাঁর কম আক্ষেপ ছিল না। কিন্তু দমেন নি। ২০১২ সালে প্রথম রাজ্যে এধরনের প্রতিস্থাপন সফল হয়। তার আগে প্রতিস্থাপন হলেও সেই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। এখন আমাদের রাজ্যে একের পর এক মৃতদেহ থেকে প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটছে। সাফল্যের জন্য ব্রজ রায় তথা গণদর্পণের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। অগ্নিদগ্ধ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে স্কিন ব্যাঙ্ক জরুরি। ব্রজ রায় সেব্যাপারেও অনেক চেষ্টা করেছেন। আমাদের রাজ্যে ২০১৩ সাল থেকে এই স্কিন ব্যাঙ্ক কাজ শুরু করে। প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সির জন্য তাঁর লড়াই ইতিহাস মনে রাখবে। অজানা রোগে মৃত ব্যক্তির দেহ ময়না তদন্ত করলে রোগের উৎস জানা যায়। একে বলে ভেষজের ব্যাকরণ। ১৩৪১ সালে ইটালির পাদুয়াতে ধর্মের রক্তচোখকে উপেক্ষা করে প্রথম এই অটোপ্সি হয়েছিল। অথচ আমাদের দেশে একটিমাত্র মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া কোথাও এর ব্যবস্থা ছিল না। ব্রজ রায়ের স্পষ্ট মত ছিল অসম্পূর্ণ জ্ঞান নিয়েই বছর বছর দেশে নতুন চিকিৎসক হচ্ছেন। অনেক চিকিৎসকই তাঁর এই কথায় বিরক্ত হয়েছেন, অনেকে আবার মানতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলাও করেছিলেন। ২০০১ সালে সেই মামলায় হাইকোর্ট মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া এবং চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানোর প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সির ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু আজও তা কার্যকরী হয় নি। অনেকেই বলেন যে, আজ আর ডাক্তারি শিখতে শব ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজন নেই। প্রযুক্তির সাহায্যেই সব শেখা যায়। তাই মরণোত্তর দেহদানেরও নাকি প্রয়োজন নেই। হাতে কলমে শেখার গুরুত্ব তাঁরা অস্বীকার করেন। অস্বীকার করেন প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সির প্রয়োজনীয়তা। প্যাথলজিকাল অটোপ্সির জন্য মরণোত্তর দেহ আবশ্যক।
ব্রজ রায়দের লড়াই থামে না। একের পর এক বাধা পেরোতে হয়। ব্রজ রায় মনে করতেন, আদর্শ কমিউনিস্ট হতে গেলে একজন ব্যক্তিকে নিজের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়। জীবনচর্যায় নিরন্তন চাই সেই বোধের অনুশীলন। অনাড়ম্বর জীবন যাপনই কেবল নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি ছিলেন সেই আদর্শের সৈনিক। আন্দোলন যাতে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার কাজ থেকে সরে না আসে, সরকারি বা বিদেশি অনুদান নির্ভর সংগঠনে পরিণত না হয় সে বিষয়েও শেষদিন পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। কারণ এন জি ও’র নামে অরাজনীতির রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করতেন। অভ্যাসবশত আমরা অনেকেই এমন শব্দ ব্যবহার করি, ভাববাদী ধারণা থেকেই যেগুলির জন্ম। কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে প্রয়াত শব্দটি আমরা প্রায়শই ব্যবহার করি। কিন্তু তাঁর এই শব্দে আপত্তি ছিল। শব্দটির সঙ্গে চলে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। যাওয়া মানেই তো গন্তব্যস্থল রয়েছে। তাঁর মতে মৃত্যুর পর ইহলোক থেকে পরলোকে যাওয়ার ধারণা থেকেই মৃত ও প্রয়াত কে সমার্থক করা হয়েছে। তাই এই শব্দের ব্যবহার মানে, পরলোকের ধারণাকে মেনে নেওয়া। আমরা অনেকেই ভাগ্যবাদী না হয়েও সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য এসব কথা ব্যবহার করি। তাঁর সামনে কেউ এসব শব্দ ব্যবহার করলেই তিনি আপত্তি করতেন। অভ্যাস ভাঙ্গাই তো এগিয়ে চলার শর্ত। সারা জীবন তিনি পথ খুঁজে এগিয়ে গেছেন, অনতিক্রম্যকে অতিক্রম করে। মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরসূরীরা সেই কাজই করলেন। করোনায় মৃত্যুর পর তাঁর দেহ রোগ নির্ণায়ক ময়নাতদন্তের কাজে লাগলো। গণদর্পণের কমরেডদের প্রচেষ্টা ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সদিচ্ছা ছাড়া একাজ হত না। প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সির জন্য তাঁর লড়াই কয়েক কদম এগিয়ে গেলো। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেই রাজ্যের প্রথম মরণোত্তর দেহদান হয়েছিল আর সেখানেই হল প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি। দুটি ঘটনার সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন ব্রজ রায়। এভাবেই এগিয়ে চলে ইতিহাস।
আমি সৌভ্রাত্র, আমি ও আমার গিন্নি মারনোত্তর দেহ দান করতে চাই
আমার ফোন নম্বর হলো, ৯৮৩৬১১৩৬২৩
সৌভ্রাত্রবাবু এখানে যোগাযোগ করুন।
http://www.ganadarpanindia.in/
আর খোলা পাতায় এভাবে ফোন নম্বর দেবেন না।
অত্যন্ত সুলিখিত, জরুরি স্মরণ। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির তরফে, এবং ব্যক্তিগতভাবেও, ব্রজ রায়ের স্মৃতি ও কর্মকান্ডের প্রতি রইল আন্তরিক শ্রদ্ধা।
খুব খারাপ একটা ব্যাপার হলো আমার বাবার দেহ দান করা যায় নি,২০১৭ সালে ২১শে জুলাই, বাবার brain death হয় ১৮ তারিখে। কিন্তু আমার হাজারো প্রচেষ্টা সহ কেউই সাড়া দান নি। মৃত্যুর পর কি donate করা যায় না? শুধু চোখদুটি করা গিয়েছে একটি বেেসরকারি সংস্থা এ
খুব ভালো , এই সময়ে র একটি প্রয়োজনীয় লেখা। ধন্যবাদ।
খুব ভালো লেখা। ব্রজদার সাথে পরিচয় উৎস মানুষের আড্ডায়।
সৌভ্রাত্রবাবু আপনি ওয়েবসাইট থেকে অঙ্গীকারপত্র ডাউনলোড করে নিতে পারেন। প্রত্যেকের জন্য দুই কপি পূরণ করে তারপর স্বাক্ষর করতে হবে। আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিচ্ছি। আপনার বাবার ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক। ব্রেন ডেথে মৃত্যু কি ঘোষিত হয়েছিল? হলে প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলির কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যুতেও মেডিক্যাল কলেজে anatomy বিভাগে দেহদান করা যায় - মৃন্ময়
সুজিৎ ভট্টাচার্য : মৃন্ময় বাবুর লেখা পড়ে ঋদ্ধ হলাম l একই সঙ্গে ব্রজ রায়ের ঘটনা বহুল ও বিপ্লবী জীবন যাপন ও সঙ্গিনী তৃপ্তি চৌধুরী র অনন্য সহযোগ যা অজানাই ছিলো আমার, নতুন করে করলো l
একজন অসাধারণ মানুষ সম্পর্কে অপূর্ব লেখা ।