
ন্যাড়া লেখকের গ্রাহক হোনআজ থেকে বত্তিরিশ বছর আগে রঞ্জনদার লেখা পড়ি প্রথম। দেশ পত্রিকায় 'বাঙালির বাঙালোর' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বুদ্ধিতে আর উইটে ভরপুর এক অতি স্বাদু, মুচমুচে, আরবান লেখা। ভাল লেখা পড়লে কেটে রাখতাম। এ লেখাও সংগ্রহ করেছিলাম। আজও আছে। লেখকের নাম ছাড়া আর কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। দেশ পত্রিকার আপিসে গেলে হয়ত পাওয়া যেত। তার বছর কয়েক পরে দেশে ছাড়লাম।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি। আমি মাস্টার্স থিসিস শেষ করার ছুতোয় ম্যাটল্যাবে জব চালিয়ে তেড়ে চ্যাট করি ক্যালকাটা অনলাইন নামক একটি অধুনালুপ্ত সাইটে। সেখানে আলাপ হল ড্যানিদা বলে একজনের সঙ্গে। জানা গেল তাঁর আসল নাম রঞ্জন ঘোষাল। ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। "আপনিই কি দেশের লেখাটা লিখেছিলেন?" এমত প্রশ্নে পরিচয়। জানতে পারি রঞ্জনদার বহুমুখী গুণের কথা। যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু চালান মারীচ নামের এক অ্যাড-তথা-ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। একা নয়, স্ত্রী সঙ্গীতা ঘোষাল ও আরেক ইঞ্জিনিয়ার - ইনি আইআইটি-র - উৎকল মহান্তির সঙ্গে। রঞ্জনদা আর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের, জানা গেল, সঙ্গে মামাতো-পিসতুতো ভাই। তার ঠিক আগেই "আবার বছর কুড়ি পর" নামক মহীনের কভার বেরিয়ে মহীনের ঘোড়াগুলি আবার কলকাতার যৌবন-সার্কিটে নাম ফাটাচ্ছে। তারপরে বেরোল রঞ্জনদাও একজন ঘোড়া। নবনীতার বসনমামা গল্পের রঞ্জনও নাকি এই রঞ্জনদা!
রঞ্জনদার গল্প বলার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। একদিন চ্যাটরুমে ইংরিজি হরফ বাংলা লিখে ('বাংলিশ'), তাও দু-চারলাইন করে ইনস্টলমেন্টে, বলছিলেন ওনার নিউ ইয়র্কে এসে হার্টের অসুখে পড়ার গল্প। চ্যাটরুমে পিন পড়লে শব্দ শোনা যায়। এরপর সাতানব্বই সালে যখন পরবাস শুরু হল, একবার চাইতেই গল্প দিলেন প্রথম সংখ্যাতেই। তারপরেও।
নাটকেও গতায়াত ছিল অনায়াস। ব্যাঙ্গালোরে যাবার পরে 'মারীচ সংবাদ'-এর ইংরিজি অনুবাদ মঞ্চস্থ করেছিলেন। পরে রিঙ্কুদির সঙ্গে যুগ্মভাবে ইংরিজিতে অনুবাদ করেছিলেন মনোজ মিত্রর 'সাজানো বাগান'। আমার দেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ওপর স্ক্রিপ্ট লিখে একক অভিনয় করলেন ২০১২ সালে।
পরে সাড়ে তিন বছরের ব্যাঙ্গালোর বাসে চাক্ষুষ আলাপ হল ওনার সঙ্গে। রিঙ্কুদির সঙ্গেও। আমাদের বাড়ি ছিল পশ্চিমদিগন্তে, প্রায় ব্যাঙ্গালোরের বাইরে। সেখান থেকে রঞ্জনদার বাড়ি চলেছি। সে এক নাটক। কন্নড় ড্রাইভার, যে আমাদের সঙ্গে দিব্যি হিন্দিতে বাতচিত চালাচ্ছিল, তাকে মোবাইলে রঞ্জনদা বাড়ির ডিরেকশন কন্নড়েই দেবেন। ফলে ব্যাঙ্গালোর টিভি স্টেশন থেকে ইয়েলো সাবমেরিনে যেতে বার কুড়ি ফোনাফুনি হয়েছিল।
রঞ্জনদা গুণ আর গল্পের ভান্ডার। ওনার সেই সাবেক 'ইয়েলো সাবমেরিন' বাড়িতে - যার সাতটি লেভেল - খেতে বসেছি। সঙ্গীতাদি পরিবেশন করছিলেন। যেই বলেছি, 'আপনিও বসে পড়ুন, আমরা নিজেরা নিয়ে নেব'খন', রঞ্জনদা বললেন, "আমাদের বাড়িতে পরিবেশনই রীতি, পাছে কেউ বেশি নিয়ে ফ্যালে।' আমার ডডনং জ্ঞান নিয়ে কেন যে খাপ খুলতে গিয়েছিলাম! বলছিলাম দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্দাক্রান্তায় লেখা - 'ইচ্ছা সম্যক ভ্রমণে, কিন্তু পাথেয় নাস্তি / মন উড়ুউড়ু, পায়ে শিকলি, একি দৈবের শাস্তি' - আমার জানা একমাত্র বাঙলা মন্দাক্রান্তা। রঞ্জনদা তাৎক্ষণিক শুনিয়ে দিলেন বাঙলায় মন্দাক্রান্তা, সঙ্গে সত্যেন দত্তর সঠিক মন্দাক্রান্তার ব্যবহার ইত্যাদি। এখন কবিতাটা ভুলে গেছি, কিন্তু সেদিন বুঝেছিলাম ওনার পড়াশুনো আর জ্ঞানের পরিধি। এটাও বুঝেছি, 'সখী, দার্শনিক ও সচিব' হিসেবে সঙ্গীতাদি না থাকলে রঞ্জনদা রঞ্জনদা হয়ে উঠতে পারতেন না।
রঞ্জনদার মধ্যে একটা অতি নাটকীয়তার ব্যাপার ছিল। স্বাভাবিক শোম্যানত্ব। একেই বোধহয় ইংরিজিতে ফ্ল্যামবয়েন্স বলে। লম্বা দাড়িতে রামধনু রং লাগিয়ে ঘুরতেন। আমার মেয়ে নাম দিয়েছিল রেনবো-জ্যাঠা। জিগেস করলাম, "একবার ডাই করলে কদিন থাকে রং?" বললেন, "ডাই আবার কী? ওয়াটার কালার। রোজ সকালে রং করি।" শুনেছি সৃজিত, অনুপম এনারা বাংলা সংস্কৃতি জগতের নক্ষত্র হয়ার আগে ইয়েলো সাবমেরিনের জল-হাওয়া খেয়ে বেড়েছেন। এ আমার ব্যাঙ্গালোর প্রবাসের আগের কথা। রঞ্জনদার স্বাভাবিক আকর্ষণশক্তি ছিল। ওনার ব্যাঙ্গালোর বাসের প্রথম দিকে, ব্রিগেড রোডের দিকে কোন এক দোকানে উৎকলদার সঙ্গে প্রথম আলাপ। আলাপেই আড্ডা জমে গেল। সেই আড্ডা স্থানান্তরিত হল রঞ্জনদাদের বাড়িতে। এমনই আড্ডা যে উৎকলদাকে সে রাত্তিরে বাড়িতে থেকে যেতে বললেন রঞ্জনদারা। উৎকলদা বাড়ি গেলেন আড়াই বছর পরে। এ গল্প রঞ্জনদাই বলেছিলেন। তাও ওনার কলেজজীবনে যশোদাভবনের কোন এক পরিবারে চাকর সেজে কদিন থাকার গল্প ওনার মুখে শোনা হয়নি।
এদিকে রোগের জাহাজ। নিউ ইয়র্কে হার্টের ব্যামোর গল্প নিজেই বলেছিলেন। আর অনেক আধি-ব্যাধি ছিল। দৃষ্টিশক্তি প্রায় খুইয়ে বসেছিলেন। একজন পড়ুয়া লোকের পক্ষে সে যে কী দুঃসহ সম্যক আন্দাজ করা শক্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা যাবার পরে ব্যাঙ্গালোরে একটা স্মরণসভা করেছিলেন। নিজের লেখা পড়ার মতন দৃষ্টিশক্তি নেই বলে আমাকে বললেন পড়ে দিতে। কিন্তু রঞ্জনদার লেখায় চোরা উইট পাঠে ধরা একেই শক্ত, তার ওপর আমার মতন লোক, যার পাঠ-ঠাটে একেবারেই অভ্যেস বা বিশিষ্টতা নেই, তার পক্ষে অসম্ভব। একবার আমাদের বাড়িতে এলেন। যাবতীয় উপাদেয় রান্না বর্জন করে খেলেন দই-ভাত, স্বাস্থ্যের কারণে। তবে একটা গল্প পড়েছিলেন প্রায় চোখের কাছে পাতা ধরে।
ফেসবুকে বাংলায় অণুগল্প জনপ্রিয় করার জন্যে রঞ্জনদাই প্রায় একক কৃতিত্বের ভাগী। দীর্ঘ সময় ধরে একের পর এক অণুগল্প লিখে গেছেন ফেসবুকে। তৈরি করেছেন পাঠককুল। সেই ডিঙি চড়ে ভেসেছেন ভালমন্দ লেখকেরা। এমনকি আমার মতন ভালমন্দর ঊর্দ্ধের অকিঞ্চিৎকরেরাও। সেই অণুগল্পর সংকলন বেরিয়েছে একের অধিক। লেখক হিসেবে, এবং তার চেয়েও বড় কথা দীর্ঘদিন পেশাদারীভাবে ভিশুয়্যাল মিডিয়া নিয়ে কাজ করার ফলে প্রকাশকের ওপর, প্রকাশনের কোয়ালিটির ওপর চাহিদা ছিল অনেক। অন্ততঃ একটা ক্ষেতের প্রকাশকের সঙ্গে ওনার চাওয়া-পাওয়ার (আর্থিক নয়) চাপান-উতোরের কিছুটা সাক্ষী আমি।
আমি ব্যাঙ্গালোর ত্যাগের পরে যা যোগাযোগ সবই ফেসবুকের মাধ্যমে। ফোনে কথা হয়েছে মেরেকেটে বার পাঁচেক। আমি ফেসবুক ত্যাগ করেছি আজ প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। তার পর থেকে আর কোনরকম কথাবার্তাই হয়নি। এর মাঝে মি-টুতে অভিযুক্ত হয়েছেন রঞ্জনদা। শুনেছি ফেসবুকের খোলা পাতায় অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা-প্রার্থনা করেছেন। তারপরে কী হয়েছে জানিনা। শুনেছি তারপরে তাঁকে আর ফেসবুকে দেখা যায়নি। হয়ত কাল নয়, রঞ্জনদা তখনই মারা গেছেন।
দেখা হবে রঞ্জনদা।
i | 14.203.***.*** | ১০ জুলাই ২০২০ ১৩:১৫95054
মেহনের ঘোড়া | 13.25.***.*** | ১০ জুলাই ২০২০ ১৬:৩৪95062নেপোলীনার ফস্সা গালে ঘষে দিয়ে দাড়ি,
মিচকে বুড়ো দিলো সাগরপাড়ি।
সৎজঙ্গী বাপখানা তার চাড্ডি আসার শকে,
লেখা ছেড়ে আবোলতাবোল বকে।
b | 14.139.***.*** | ১০ জুলাই ২০২০ ১৬:৪৫95063অসম্ভব ভালো লিখেছেন। একটা মানুষকে কাছ থেকে চেনার গল্প। খুব ভালো লাগলো পড়ে।
debu | 170.213.***.*** | ১০ জুলাই ২০২০ ২৩:০২95067
রঞ্জন | 122.18.***.*** | ১১ জুলাই ২০২০ ০৮:১২95075@ন্যাড়া,
সকালে মেঘলা আকশ। এই লেখাটি পড়ে মনটা অন্যরকম ভালো হয়ে গেল।
দারুণ লেখাটা। অসাধারণ মুন্সিয়ানায় চরিত্র-চিত্রণ। নতুন করে জানলামও অনেক কিিছু।
b | 14.139.***.*** | ১১ জুলাই ২০২০ ১১:৪৬95082
Kushan | 2401:4900:3149:87c1:258d:e828:a36a:***:*** | ১১ জুলাই ২০২০ ১৪:৪০95102লেখাটা যদিও কিছুটা ব্যক্তিগত জায়গা থেকে লেখা, তবুও ভালো লাগলো।
স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ১১ জুলাই ২০২০ ১৭:২৬95112
aranya | 162.115.***.*** | ১২ জুলাই ২০২০ ০৭:৩৩95148
dc | 103.195.***.*** | ১২ জুলাই ২০২০ ০৮:১৪95150