নিজের নাম লেখা কার্ড দিয়েছিলো পরিস্থিতি। আইভরি ফিনিশের ওপর কালো টানা অক্ষরে লেখা। 'ব্ল্যাকআউট ডাইনিং'। নামটা মনের মধ্যে বেশ বড় মাপের একটা কৌতুহলের ঢেউ তোলে। শুধু নামে আজকালকার দিনে আর কী-ই হয়? পরিচয় চাই না একটু? তা পরিচয়ও দিয়েছিলো বই কি। নাহলে লোকে আসবে কেন ওর কাছে? নামেই অনেকখানি বলা আছে, তবু কনসেপ্টটা বোঝা দরকার। এটা একটা রেস্টুরেন্ট যেখানে তোমাকে খেতে দেওয়া হবে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে। ইন্দ্রিয়দের মধ্যে আমরা সচরাচর সবথেকে বেশি যাকে কাজে লাগাই সেই চোখকে এখানে ইচ্ছে করেই অকেজো করে দেওয়া, যাতে খাবারকে পুরোপুরি বুঝতে তোমায় বাকি ইন্দ্রিয়দের সাহায্য নিতে হয়। "দেখবেন আজকাল", পরিস্থিতি বলে চলে, "আজকাল বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টে মানুষ খাবারের থেকেও খাবারের ছবি তোলার ওপরে বেশি মন দেয়। ইনস্টা-ওয়র্দি হলো কিনা। আমি যে খাচ্ছি তা সবাই জানলো কিনা। কিম্বা টেবিলে বসে সবাই যে যার ফোনের পর্দাতে বন্দি হয়ে থাকে। খাবার আসে, খাবার যায়। কেউ তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়না। এই অন্ধকারে কি আপনি খাবারকে 'খাবার' হিসেবে চিনতে শিখবেন? সেটাই দেখার। হা হা, স্যরি, সেটাই 'না দেখার'।" ... ...
আর একটি মিলনকাহিনীও আমার গোচরে আছে, অভয় দিলে বলি। সেবার লখনৌ থেকে ফিরছি, পুজোর সময়, কামরায় প্রচন্ড ভিড়। আমাদের এক পরিচিতের ওপরে দায়িত্ব ছিল টিকিটের, সে সেগুলির কনফার্মেশন না করেই আমাদের হাতে গুঁজে দিয়ে শেষ মুহূর্তে গা ঢাকা দিয়েছে। অথচ ফিরতেই হবে, উপায় নেই। অমৃতসর মেইল এর টিকিট পরীক্ষক মহবুব আলম, সহৃদয় হয়ে ব্যবস্থা করে দিলেন সকলের কোনোরকমে। দিলীপ কুমারের মতোই সুদর্শন, অমায়িক, মধুর লখনৌয়ি জবানের অধিকারী মহবুবের মুখে একটি গল্প শুনেছিলাম সেদিন। শোনাই। ... ...
সেই ঘনায়মান আঁধারে এক সময় বালুদা এসে বসে ছিল আমার পাশটিতে। নেশা মেশানো নীচু গলায় বলেছিল: দাদাবাবু, আমার বড় সপপন ছিলো লালন মুর্দাফরাশ হবে না। জিন্দা আদমি তুলবে... ইলাজের জন্য হাসপাতাল আনবে এম্বুলেন্স চাপিয়ে। .... হল না। শালা মর্গে ডিউটি পেল -- অ্যানাটমি ঘরেও নয়। সবাই বলে ওখানে পয়সা আছে। ডেড দের গায়ের আংটি -হার ঘুরিয়ে দিলেই হলো। আমি লেকিন হেরে গেলাম দাদাবাবু। ... ...
শুনেছিলাম, এই বসুশ্রীতেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর সত্যজিৎ রায়ের আলাপচারিতার গল্প। যদিও সত্যজিৎবাবুর ছবিতে শেষ পর্যন্ত ভানুর অভিনয়ের সুযোগ হয়নি, তবে দু’জনের পরিচয় অবশ্য ‘পথের পাঁচালী’র সময় থেকে। বসুশ্রীতে সেই ছবি দেখে মন্টু বসুর অফিস ঘরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন ভানু। সত্যজিৎও তখন সেখানে বসে। ভানু তাঁকে চেনেন না। পরিচয় হতেই ভানুর ভবিষ্যদ্বাণী, ‘‘মশাই, করেছেন কী! আপনি তো কালে-কালে কানন দেবীর মতো বিখ্যাত হবেন!’’ অনেকদিন পরে, এই বসুশ্রীতেই, সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’র প্রথম ‘শো’-য়ের শেষে বেমক্কা প্রশ্ন করেছিলেন কোনও সাংবাদিক। শুনে আমাগো ভানুর ঝটিতি জবাব, “লেখাপড়া না-জানলে উনি (সত্যজিৎ রায়) তাঁর ছবিতে পার্ট দেন না।” শুনে অপ্রস্তুত সত্যজিৎ রায় তখনই ‘না-না’ বলে ওঠেন। সবিনয় বলেন, আমি ওঁর খুবই গুণগ্রাহী। উপযুক্ত রোল থাকলে অবশ্যই ভানু বাবুকে নেব।” ... ...
গোদি মিডিয়া যখন এই সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে ফেলেছে, দেশদ্রোহী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কিন্তু পুরো ব্যপারটাকে পাত্তাই দিল না। ভারতীয় বাদে প্রায় সারা পৃথিবীর মিডিয়া রিপোর্ট করল যে ভারত হামলা করেছে ঠিকই, কিন্তু তা একটা ফাঁকা, পরিত্যক্ত জায়গায়, এবং কেউ হতাহত হয়নি। কোন জঙ্গি ঘাঁটিও ধ্বংস হয়নি, তবে দু-তিনটি পাইন গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ... ...
সূচীপত্র ... ...
অণুগল্প - ধরা যাক, আকাশে চাঁদ ফুটে আছে। কদমগাছের তলায় সেই আলো ডাবের শাঁসের মত ঘন। অদূরে ঝোপঝাড়। সেইখানে জোনাকির আলো। জ্বলছে, নিভছে। পাশেই ঝিল। চাঁদের আলোয় তা চকচকে। হাওয়া দিলে ঢ্যামনা সাপের মত জলের উপরিতল নড়ে। হাওয়া দিচ্ছে। নিঃশব্দে লক্ষ্মী পেঁচা উড়ছে। ইঁদুরেরা গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। আরও ধরে নেওয়া যায়, ঐখানে, চাঁদের ঐ গোলাকার থালা দেখে মানবেতর প্রাণীটি আবাক, আশ্চর্য্য হয়েছে। ... ...
বারো বছর কাটার পর হঠাৎ একদিন গভীর রাতে সুলতান দেখেন তাঁর শোবার ঘরে দুজন অতি সুন্দর যুবক এসে পরিচয় দিলেন রামোজি আর লক্ষ্মোজি নামে। তাঁরা রামদাসের মুক্তিপণ হিসেবে ছ'লক্ষ টাকার সোনার মোহর আর সুদ হিসেবে ছ'লক্ষ টাকার রূপোর মোহর নিয়ে এসেছেন। মোহরগুলিতে রামচন্দ্রের নিজের নাম ছাপা আছে। সুলতানের তো চক্ষু চড়কগাছ। এভাবে মাঝরাতে তাঁর শোবার ঘরে দুজন ঢুকলো কী করে? অন্যদিকে তিনি এই দুজন আগন্তুকের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। সুলতান রামদাসের মুক্তি পরওয়ানা স্বাক্ষর করে দিলেন। সেই রাতেই ঐ দুই যুবক কারাধ্যক্ষকে ফরমান দেখিয়ে রামদাসকে মুক্ত করে দিলেন। পরদিন সকালে হইহই ব্যাপার রইরই কাণ্ড। সুলতান ও রামদাস দুজনেই বুঝতে পেরেছেন ঐ দুজন যুবক কে ছিলেন? রাজা তো চমৎকৃত। আর রামদাসের বিলাপ বাধা মানেনা। তিনি বারবার বলছেন, রামলক্ষ্মণ ভক্তকে দর্শন না দিয়ে কেন যবন রাজাকে করুণা করলেন? ... ...
এ বড় সুখের সময় নয়। ঘাড়ের উপর এনআরসি, মাথার উপর ক্যা। আসামে বাংলা কোনঠাসা, উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। কাশ্মীর এখনও অবরুদ্ধ, নাগাল্যান্ডে বুটের শব্দ। এখনও পর্যন্ত ১১ টি রাজ্য এনপিআর মানবেনা জানিয়েছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার অনমনীয়। দেশভাগের পর গত সত্তর বছরে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় ইউনিয়নের সামনে এত বড় সংকট আর আসেনি। এ ঠিক উৎসবের সময় নয়। সেই জন্যই এ সময় উৎসবেরও। রাষ্ট্র যখন পিটিয়ে সমস্ত বহুত্বকে সমতল করে দিতে চায়, তখনই তো সময় বহুত্বকে উদযাপন করার। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন কিচ্ছু বদলাতে পারেনা দেখিয়ে দেবার। সংকটের মধ্যেই জন্ম হয় নতুন উচ্চারণের, স্ফুরণ হয় নতুন শব্দ, নতুন চিৎকারের, নতুন সৃজনের। এ সময় উৎসবেরও। উৎসব সংখ্যার। ... ...
টাকার চিন্তায় যখন পাগল পাগল লাগে, তখন মনে হয়, আমি বোধ হয় কাকীদিদা হয়ে যাচ্ছি। কাকীদিদা আমার মায়ের কাকীমা - প্রথমদিকে সত্যি টাকার দরকার ছিল, পরের দিকে ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত, মা কে তারা দিব্যি যত্নেই রেখেছে - তখনও দুপুরবেলায় বেরিয়ে পড়ত কাকীদিদা - বাসে চেপে, রিক্সায় এর বাড়ি তার বাড়ি- 'দিবি রে পঞ্চাশটা টাকা? খুব দরকার। সামনের মাসেই দিয়ে দেব'। অদ্ভূতভাবে মারা গিয়েছিল। কাকীদিদার ছোটো বাড়ি - একতলাই ছিল, বহুবছর পরে ছাদে একখানা ঘর তুলেছিল। বড়মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল সেই ছাদে ; কে যেন বলেছিল, মেয়ের বিয়ে দেখতে নেই না কি -কাকীদিদা তাই ছাদের লাগোয়া ঘরেই বসে ছিল , ছাদের দিকে দুটো জানলায় পর্দা টানা। ওদিকে বিয়ের আসরে মালাবদল, শুভদৃষ্টির সময় ছবি তুলছে সবাই; হঠাৎই কাকীদিদার এক বোনপো 'একি একি মেজমাসি জানলায় উঠে কী করছ' বলে চেঁচিয়ে উঠতে কাকীদিদা জানলার রড ছেড়ে ঘরের মেঝেয় ধড়াম করে পড়ল। ... ...
কখনও পূর্ণচাঁদের আলোয়, কখনও সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে একটা ঘোড়া ছুটে যায়। ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘকায় এক পুরুষ। তার হাতে বন্দুক, আর তার কোলে নাকি এক সুন্দরী নারী বসে থাকে। ঘোড়াছুটেযাওয়া ওই পথের দুপাশ জুড়ে ছড়িয়ে যায় জমাটবাঁধা অসংখ্য ধূলিপিন্ড। প্রতিটি খন্ডের ভেতরে গল্প শোনা যায়। সেই গল্প কাঁধে তুলে নেয় কোনও পাগল কিংবা প্রেমিক। লোকজীবনের হাটেমাঠে, সিদলমাখা গরম ভাতের সঙ্গে, পালাগানের আসরে সেই গল্প শোনে জাপান ঘোষ, পূর্ণিমা বর্মন, ইছুপ মন্ডল। ... ...
ঠিক তখনই মেঘ ফেটে যায় দুভাগে। ঝলমলিয়ে চাঁদ ওঠে আর দৃশ্যমান হয় সারা জগত, কাঁসাইয়ের ধারের প্রাচীন মন্দির, সাদা ফেনার হুল্লোড়, ধানের ক্ষেত আর বাতাসে মাথা নাড়ানো গাছের দল। কালো পর্দা সরিয়ে হঠাতই আবির্ভূত হয় এইসব আর রহস্যময় শতাব্দী প্রাচীন রূপের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চরাচর। কানু বৌকে ডাকতে ভুলে যায়, হয়তো ভুলেই থাকতো যদি না তার চোখে পড়তো নদীর মাঝখানে সাদা চরের কালো পলিথিন কুঁড়ের সামনে কার যেন আবছা ছায়া। প্রথমেই সে ভাবলো মাছচোর। বাবা ভৈঁরোনাথের দিব্বি, আজ ওকে ধরবই, এ কথা ভাবতেই লাঠিটা ঘরে রেখে এসেছে বলে দারুণ দুঃখ হলো কানুর। তবু হেই হেই থাম থাম চিৎকারে সাজোয়ান পা-জোড়া ছুটে চললো এক পাথর থেকে আর এক পাথরে, পড়তে গিয়ে টাল সামলে নিলো কতোবার। ... ...
আজকের সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের আলো অনেক বাদামি মিহি ধুলো-ধুলো হয়ে একদিন ছিল পুরোনো পৃথিবীর গায়ে, যখন এই এলাকায় কয়লার একটা খনি বেরিয়ে পড়ে, আর সেকারণেই গুরুত্বপূর্ণ যেদুটো মূল রেললাইন তার মাত্র কয়েকবছর আগেই পাতা হয়েছিল পুবে বকুলপুর আর পশ্চিমে গড়ানডাঙা দিয়ে, ব্রিটিশ সাহেবরা তাদেরকে জুড়ে দেয় একটা মিটারগেজ লাইনের সাহায্যে এবং ঝিনঝিনতলার উত্তরদিকে নদীর তীরে একটা বাংলোও বানানো হয় তখন। কিন্তু এখানকার কয়লা এত নিম্নমানের যে কিছুদিনের মধ্যেই সেই হুজুগ একদম ফুরিয়ে যায়, পরে স্মরণযোগ্য কালের ভেতর আর মাত্র একবারই ঐ মিটারগেজ লাইনটা ব্যবহার করা হয়েছিল যখন একটা ৪-৬-০ ইঞ্জিনে চড়ে ম্যাকফার্লঙ সাহেব এসে পৌঁছান এই বুড়ো ঝিনঝিনতলায়; অবশ্য তখনও বুড়ো ঝিনঝিনতলার নাম ঝিনঝিনতলা হয়নি, সে বুড়োও হয়নি। কোনো একদিন যখন বিকেলের হাওয়া খেতে বুড়ো ঝিনঝিনতলার কানাসাদা মেঘগুলো নদীর ওপর গিয়ে জমা হয়েছিল দলে দলে, সেরকম সময়ে সাহেব এসে পৌঁছেছিলেন এই অক্ষাংশে, দ্রাঘিমার পাড়ে, যেন এইসব পথে, পথের বাতাসে উত্তরসাগরের লবণাক্ত স্বাদ নিয়ে এলেন তিনি, আর নদীর ধারের বাংলোটা তখন জায়গায় জায়গায় একটু জীর্ণ হয়ে গেলেও দিব্যি বাসযোগ্য, সেইখানের নির্জনতা ম্যাকফার্লঙ সাহেবকে মুগ্ধ করল। ... ...
রাস্তায় এক অদৃষ্টপুর্ব দৃশ্য দেখে সে বিস্ময়ে স্থাণু হয়ে গেল। “গ্রে এ এ এ ট পামেলা সারকাস,গ্রে এ এ এ ট পামেলা সারকাস-----” রিকশায় বসে মুখে মাইক ধরে খুব হাসি হাসি মুখে এইরকম বলতে বলতে সিড়িঙ্গে রোগা কিন্তু এই মোটা গোঁপওলা একটা কাকু যাচ্ছে। তার লাল নীল বেগুনী সবুজ হলুদ খয়েরী জামাটা দেখে কুমু মোহিত না হয়ে পারল না,হ্যাঁ ,জামা হবে এইরকম। তার বাবা কাকাদের সাদা নীল ছাই ইত্যাদি বিচ্ছিরি রঙের ওগুলো আবার জামা নাকি? কাকুর পাশে জায়গা থাকলেও দুটো প্যাংলা মত ছেলে রিকশার পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলেছে,কাকুর জামার ঘাড়ের কাছে একতাড়া পাতলা কাগজ গোঁজা,সেই কাগজ থেকে একটা দুটো টেনে টেনে নিচ্ছে আর রাস্তার লোকদের হাতে দিচ্ছে । ... ...
এটা কিন্তু প্রথম টাইম মেশিন, হ্যাঁ মশায় ।” প্রোফেসর জনসন বেশ একটু গর্বের সঙ্গে তাঁর দুই সহকর্মীকে বললেন, “মডেলটা একটু ছোট করেই বানালাম, যদিও । তিন পাউন্ড পাঁচ আউন্সের বেশি ভারি জিনিসের ওপর এ পরীক্ষা চলবে না, আর অতীত বা ভবিষ্যতে বারো মিনিটের বেশি দূরে পাঠানোও যাবে না । তবে, এতে সত্যিই কাজ হয় ।” ছোট্ট জিনিসটা দেখতে অনেকটা ডাকঘরের সেই চিঠি ওজন করার যন্ত্রের মতন, তফাত শুধু এই যে, এক্ষেত্রে ওজন করার পাটাতনের নিচের অংশে খান দুই ডায়াল আছে । প্রোফেসর জনসন ধাতুর তৈরি একটা ছোট্ট ঘনক হাতে তুলে নিলেন । “একটা পেতলের ঘনক, এর ওজন এক পাউন্ড এবং দুই দশমিক তিন আউন্স । আমাদের পরীক্ষাটা হবে এর ওপরেই, প্রথমে আমি একে পাঁচ মিনিট ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেখাব ।” ... ...
ওরা থাকাকালীন শেষের দিকে প্রায় প্রতিরাতে শোনা যেত চেঁচামেচি। ওর বউয়ের অভিশাপ, মেয়ের অভিযোগ, কান্না। সেই সব অসুখী উচ্চারণে বাইরের স্ট্রিটল্যাম্পের পান্ডুর আলোয় রাত গ্রাউল করে, শ্বাপদের মত। মিগুয়েলের বিরুদ্ধে খুব সম্ভবতঃ এই পৃথিবীর সব আক্রোশ জমা হয়ে আছে তাদের। একসময়ে ভালো না বাসলে এই রকম ঘেন্নাও করা যায়না। ... ...
ব্রজঠাকুর তো ঈশ্বরচিন্তায় ডুবে থাকেন। সামান্য জমি জিরেত। কিছু ফলের গাছ। দোকানটা চালায় ভাগ্নে মোহন, আর সংসার চালায় মোহনের বিধবা মা শান্তি। শান্তিবালা আর ছেলে মোহন, বড়ো ভালো মানুষ ওরা। তবে এও ঠিক কোন অকূলে ভেসে যেতো যদি ব্রজগোপাল ঠাঁই না দিতো। তা ব্রজঠাকুরেরও তো বয়স হল। কে দেখে সংসার? হাঁপানি আর ভগবানের চিন্তা -এই নিয়েই জীবন। ব্রজঠাকুর বলেন তাঁর অলৌকিক দর্শনের কথা, চুপচাপ শুনে যান শান্তি। তাঁর মাথার উপর ছাদ। ছেলেটার খাওয়া দাওয়ার কষ্ট নেই। ব্রজঠাকুর বেলাবেলি খেয়ে শুয়ে পড়েন। বলেন আমি যোগনিদ্রা দেই। তো বেশ। দুপুরে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ী আসে মোহন। মায়ে পোয়ে খায়। জীবনে এতো শান্তি কখনো পায় নি শান্তিবালা। স্বামী ঘর থেকে বার করে দিলে ছোটো ছেলে নিয়ে লোকের বাড়ী বাস। এর বাড়ী, তার বাড়ী। বারবার ঠাঁই বদল। আশ্রিতের জীবন। অনিশ্চয়। দুর্ভাবনা আর অপমান। ... ...
প্রতিবারই এটিএম থেকে টাকা তোলার পর আচমকাই নিজে থেকে কিছুটা সতর্ক হয়ে যায় সুজয়। জায়গাটা এমনিতে দিনমানে জমজমাট বেশ কয়েকটা ব্যাঙ্ক ও তাদের এটিএম রয়েছে। সামনে অনেকটা পার্কিঙ এর জায়গা। ব্যাঙ্ক গুলো ছাড়াও বেশ কিছু বীমা কোম্পানি, শেয়ার কোম্পানির অফিস, মোবাইলের ঝকঝকে দোকান এমনকি ভালো রেস্তোরাঁও রয়েছে এখানে। কিন্তু সুজয়ের টাকা তোলার সময়টায় জায়গাটা বড় শুনশান হয়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পথে এখানে গাড়ি থামিয়ে টাকা তোলার সময় পার্কিং এ একটাও গাড়ি থাকে না। কচ্চিত একটা দুটো এটিএমে নড়বড়ে সিক্যুরিটি গার্ড থাকে, তারা গরমের দিনে এটিএমের মধ্যেই টুলে বসে ঝিমোয়। খুব একটা রাত্তির নয় যদিও, শহরে রাত সাড়ে ন’টা মানে সন্ধ্যাই। বাজার এলাকা এইসময়ে জমজমাট। এদিকের অফিস পাড়া যেন বড় বেশি ফাঁকা। ... ...
এই বাড়ির সামনের গলিটা থেকে বেরিয়ে বড়োরাস্তা ধরে একটু এগোলে রাস্তাটা আড়াআড়িভাবে আরেকটা রাস্তা কেটে দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ঐ চৌমাথা জায়গাটা একটু বাজার মত, চায়ের দোকান, মুদিখানার দোকান, সেলুন, ডাক্তারখানা — এইসব আছে, ডাক্তারখানাটার পাশে 'সুহাসিনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের' লাগোয়া একটা ছোট্টো কালী মন্দির; দুবেলা ঐখানে গিয়ে একটু ফুল-বাতাসা দিয়ে আসা — ব্যাস, এইটুকুই জয়প্রকাশের কাজ সারাদিনে, এইকাজটাই তিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে করে আসছেন। এছাড়া আর কোনো পার্থিব ব্যাপারের সঙ্গে তাঁর কোনো সংস্রব নেই, লোকেও মাঝেসাঝে যদি পুজোটুজো দিতে আসে তো এল, এছাড়া তাঁকে কেউ পাত্তা দেয়না। পুজোও কমে গেছে মন্দিরটায়, নমো নমো করে টিকে আছে; মন্দিরটার পিছনে একটা বটগাছ মাথার ওপর ঝাঁকড়ে রয়েছে ছাতার মতো, ফলে মন্দিরটার সারা গায়ে শ্যাওলা, অযত্নের ছাপ, দেয়ালগুলোর চুনখসে ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে পড়েছে এখানে-সেখানে, মফস্বল শহরের অন্যান্য বড়ো বড়ো চমৎকার মন্দিরগুলোর তুলনায় নেহাতই একটা উপদ্রব মাত্র। লোকের আর দোষ কি, খামখা পুজো দিতে আসবে কেন? তবু ঐখানটাতেই সারাজীবন জয়প্রকাশ পুরোহিত হয়ে রয়ে গেলেন, ঐখানটাতেই ঘন্টা নেড়ে টুং টুং করে গেলেন — ছেলের কথাটা মনে পড়ল তাঁর — লোকের কারোর মুরোদ বেশি হয়, কারোর কম, কিন্তু তা বলে তোমার মত নিমুরুদে বাপ যদি একপিস দেখেছি মাইরি! ... ...
মনোনকে হোক বা যাই হোক ওপরে যেতেই হবে, ব্যাগ নিতে হবে, আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করত হবে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। ওপরের ল্যান্ডিংএ পৌঁছনোর আগেই মনে হল সবাই সরে গেল, সামনের ঘরের দরজাটা আলতো করে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে তাতামির ওপর শুয়ে পড়লাম, ঘড়িতে সকাল ছটার এলার্ম দিয়ে রাখলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এত আতঙ্কের মধ্যেও ঘুমিয়েও পড়লাম। সকাল হল, বাইরে বের হয়ে গ্রামের একটি লোককেও দেখলাম না। বাস ঠিক সাতটায় এল। গতকালেরই চালক, সে যেন আমাকে দেখে আশ্চর্য হল না, হেসে বলল, ‘সুপ্রভাত’। ... ...