এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে বিনীতাকে শান্ত থাকতে হয়েছে, নিজের ইমোশন চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে, আর আগে কয়েকবার নিজের মনে মনে বলে রিহার্সাল দিয়ে নিতে হয়েছে। মেয়ে প্রশ্ন করল “বাবা আর আসবে না?” উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না বিনীতা, গায়ত্রী বলল, “বাবা হয়তো আর আসবে না, কিন্তু আমরা সবাই তো আছি। আমরা সবাই তোমার কাছে থাকব, তোমার পাশেই থাকব।” এইবার বিনীতা বলল, “বাবা কত ভিডিও করেছেন সেগুলো দেখব আমরা, বাবার কত বই আছে সেগুলো পড়ব।” রঙিন চুপ করেই রইল। বিনীতার মনে পড়ল অরুণাভর লেখা চিঠিতে মেয়ের কথা - “রঙিনকে ব’লো আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে তাই চলে গেছি।” এগুলো মেয়েকে বলতে গিয়েও বলল না সে, “কাজ ফুরিয়ে যাওয়া” ব্যাপারটা সে কী ভাবে নেবে জানা নেই। আর এই ধারণা ও পরে কার ওপর কেমন ভাবে প্রয়োগ করবে সেটাও অজানা। ... ...
“ভাবি, স্কুল যাবেন না?” ঘড়ির দিকে তাকায় বিনীতা, “হ্যাঁ, যাব।… স্কুল থেকে ফিরে রঙিন যদি কিছু জিজ্ঞেস করে ব’লো বাবা অফিস গেছে।” বিসপাতিয়া মাথা কাত করে জানায় তাই হবে, তারপর চলে যায় ডাইনিং রুমের দিকে। বিনীতাও উঠে শোয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, খেয়াল হল চিঠিটা রয়ে গেছে টেবিলের ওপর বই-এর মধ্যে। ফিরে এসে সেটা আবার তুলে নেয়। বেড রুমের দিকে যাচ্ছিল বিনীতা, দেখে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিসপাতিয়া। “ভাবি, এখন কী করবেন?” বিনীতা উত্তর দিল, “অপেক্ষা।” ... ...
“আগে ম্যামথ, ডাইনোসর এরাও ছিল বিরাট বড় বড় প্রাণী। দাঁড়াও দেখাচ্ছি,” অন্য একটা বই এনে ওই দুই লুপ্ত হয়ে যাওয়া জন্তুর ছবি মেয়েকে দেখাল অরুণাভ। “এত বড় বড় অ্যানিম্যাল কোথায় থাকত?” “এখানেই থাকত।” “কুসুমবনিতে?” খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল রঙিন। হাসল অরুণাভ, “হ্যাঁ, কুসুমবনিতেও হয়তো ছিল। তবে ডাইনোসররা যখন ছিল, তখনও পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। ম্যামথের টাইমে অবশ্য মানুষ ছিল।” অবাক হল রঙিন, “মানুষ আসেনি মানে?” “আমাদের পৃথিবী তৈরি হতে অনেক অনেক বছর সময় লেগেছে, তারপর আস্তে আস্তে এসেছে গাছপালা, পোকামাকড়, মাছ, কচ্ছপ… ডাইনোসর… ম্যামথ… এই রকম করে করে সবার শেষে মানুষ।” “ডাইনোসররা কোথায় গেল?” অরুণাভ বলল, “একটা মিটিওরাইট... যাকগে, ওটা এখন বুঝবে না।” “না না, আমি বুঝব… বল না,” বায়না করল রঙিন। “আসলে… আসলে ওদের কাজ ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই চলে গেল।” “ওদের কী কাজ ছিল?” “অনেক কাজ - খাওয়া, ঘুমানো, মারামারি করা…” “কাজ ফুরিয়ে গেল, তাই চলে গেল…” উত্তরে ইসারায় হ্যাঁ বোঝাল অরুণাভ। রঙিন একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাজ ফুরিয়ে গেলে সবাই চলে যায়?” “সবাই নয়, কেউ কেউ যায়,” মেয়েকে বলল বাবা। দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি কখন বিনীতা এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, সে চুপচাপ বাবা-মেয়ের কান্ড দেখছিল। এই বার এগিয়ে এসে বলল, “রঙিন, একটা নতুন রান্না করেছি, টেস্ট করবে নাকি?” ... ...
রঙিনের ঘরে লুডো খেলতে বসেছে বাবা আর মেয়ে। খেলতে খেলতে হঠাৎই “আসছি” বলে উঠে গেল অরুণাভ, ফিরে এল তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে। তারপর ভিডিও ক্যামেরা অন করে রেকর্ড করা শুরু করল। “আমি আর রঙিন এখন লুডো খেলছি, তোমরা কেউ বিরক্ত করবে না।… রঙিন, চাল দাও… দেখি ছক্কা ফেলতে পারো কি না…” কমেন্টারি করতে লাগল সে। ছক্কা পড়ল না, পড়ল তিন। তবে খেলার মধ্যে ভিডিও ঢুকে যাওয়ার ব্যাপারটা রঙিনের দারুণ পছন্দ হল, বাবাকে আগে কোনও দিন ফোনে ছবি বা ভিডিও তুলতে খুব একটা দেখেনি সে। অরুণাভ খানিক ভিডিও করে, তাতে সব কিছুর ছবি তোলে - মেয়ের, লুডোর বোর্ডের, ঘরের নানা জিনিসের, নিজেরও; তারপর কিছুক্ষণ বন্ধ রাখে, আবার চালু করে। একটু পরে রঙিন জিজ্ঞাসা করল সে নিজে একটু ভিডিও করতে পারবে কি না। বাবা সম্মতি দিলে সেও ভিডিও করা শুরু করল। অরুণাভ উৎসাহ দেওয়াতে কমেন্টারিও শুরু করল সে, তবে বেশিক্ষণ পারল না, ক্যামেরা চলতে চলতে বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছিল সে, এমনিতেই তো বাবার মত কম কথা বলে সে। ... ...
হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল অরুণাভ; মুখ তুলে সবাইকে দেখল। “একটা রিকোয়েস্ট, এই প্যাকেট তোমরা খুলবে আমি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।” এক এক করে সবার হাতে গিফট আর মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিল এজিএম, এবার রামাকৃষ্ণানের নাম এল আভিধানিকভাবে ঠিক জায়গাতেই। আর তার বদলে একদম শেষে নাম এল সেক্রেটারি কবিতার। সবাই জিনিস পেয়ে গেলে অরুণাভ চলে গেল নিজের ঘরে। আর তার পরেই সবাই গিফট প্যাকেট খুলে ফেলল, দেখা গেল ভেতরে রয়েছে দামী কলমের সেট - প্রত্যেকের জন্য একই জিনিস। কিন্তু প্রতিটা প্যাকেটে ভাঁজ করা সাদা কাগজটা কি? ... ...
ইন্দ্রনীলের একটা কথা মনে পড়ে গেল বিনীতার; একবার সে ইঙ্গিত করেছিল যতদিন এই প্রোজেক্টের কাজ শেষ না হবে, ততদিন তার ভালমন্দ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতারোহীদের মত - এই অভিযাত্রীরা বেশিরভাগ সময়ে দুর্ঘটনায় পড়েন চূড়ায় আরোহন করার পর। তার একাধিক কারণ থাকে - শিখরে পৌঁছাতে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার পর তারা যখন নামতে শুরু করেন, ক্লান্তি তাদের গ্রাস করে, ফলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। অনেকেই আবার আত্মতুষ্টির শিকার হন, ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর একটা বিষয় হল সামনে কোনও বড় লক্ষ্য না থাকা। যে কাজ করার জন্য এত কষ্ট করা, তা শেষ হয়ে গেছে, এখন ফিরে যেতে হবে প্রতিদিনের গতানুগতিক জীবনে। এই মন খারাপ থেকেই আসে অবসাদ। ... ...
“থ্যাঙ্কস ডাক্তার, তুমি এসেছো। বাইরে তোমার গাড়ি দেখলাম। কখন এলে?” সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করে অরুণাভ। “এই তো, একটু আগে,” জবাব দেয় ইন্দ্রনীল। “তোমার চা-ও বলে দিই। একবারে হয়ে যাবে,” বিনীতা রান্নাঘরের দিকে যায়। “কেমন আছেন?” ইন্দ্রনীল জানতে চায়। “ফার্স্ট ক্লাস। রিপোর্ট কমপ্লিট, কাল সাবমিট করবো।” “বাহ... দারুণ খবর। তারপর?” বিনীতা ঘরে আসে, শোনে তার স্বামী বলছে, “ছুটি নেব। তোমায় তো বলেছিলাম ডাক্তার, কাজ শেষ হলে তারপর ছুটি নেব।” বিনীতা বলল, “ছুটি নেবে? ভূতের মুখে রামনাম। ক'দিনের?” অরুণাভ বলল, “দেখি... ... ...
ইন্দ্র স্লিপটা রেখে দেয়। বলে, “একটা কথা বলুন তো।” হঠাৎই অরুণাভর চোখমুখ উজ্বল হয়ে ওঠে, “বল… বল…” “ইয়োর অ্যাকশনস আর স্ট্রেঞ্জ। ইউ অ্যাকটেড লাইক আ ড্রাংক হোয়েন ইউ ওয়্যার নট সো। ইউ ডিড সামথিং ভেরি চাইন্ডিশ দ্যাট পিকনিক ডে। কী চান বলুন তো আপনি?” অরুণাভ বলে, “আমি কী চাই?” ইন্দ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। রোগী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আগাথা ক্রিস্টি বলেছিলেন, ‘জীবন যা যা ভাল জিনিস দিতে পারে তার মধ্যে একটা হল সুন্দর ছোটবেলা।’ আমি ছোটবেলাটা এক বার ফিরে পেতে চাই। আসি।” দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকায় সে। “অনেক দিন আমাদের বাড়ি যাওনি ডাক্তার। এস একদিন।” ... ...
বাবা-মায়ের কথা কাটাকাটি শুনতে অভ্যস্ত নয় রঙিন, মাকে একতরফা বকে যেতেই সাধারণতঃ দেখেছে সে। একটা পড়ার বই হাতে ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরের দরজায় কাছে এসে দাঁড়ায় সে। শোনার চেষ্টা করে কী কথা হচ্ছে, তবে হাতের পেনসিলটা পড়ে গিয়ে একটু শব্দ হয়। তাড়াতাড়ি পেনসিলটা তুলতেই সে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে ওই ঘরের দরজায়। “ভেতরে গিয়ে পড়ো, আমি একটু পরে আসছি।” মায়ের কথায় রঙিন ফিরে যায় পড়ার টেবিলে, তবে পড়ায় মন দিতে পারে না। ... ...
“এদিকে এস,” বিরক্তি লোকানোর কোনও চেষ্টাই করে না এজিএম। সমসের টেবিলের সামনে এগিয়ে এলে তার দিকে একরকম ছুঁড়েই দেয় ফ্ল্যাট ফাইলটা। “ডু ইউ অ্যাপ্লাই ইয়োর মাইন্ড হোয়াইল ওয়ার্কিং, সমসের? কী লিখেছ এখানে?” সমসের বুঝতে পারে না কী ভুল তার হয়েছে। অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে সেটা। “কী ভুল হয়েছে দেখতে হলে তো ফাইলটা তুলতে হবে, না কি?” বলে অরুণাভ। স্যারের এমন কণ্ঠস্বরের সাথে একেবারেই পরিচিত নয় সমসের, ফাইলটা ধীরে ধীরে হাতে তুলে নেয় সে, এবার কী করবে বুঝতে না পেরে অরুণাভর দিকে তাকায়। “পেজ নাম্বার থার্টিন, এনট্রি নামবার ফর্টি-টু, বার করো।” অরুণাভর আদেশ পালন করে সমসের, তবে ভুলটা বুঝে উঠতে পারে না। “স্যার, আমি… ঠিক…” “ডু ইউ নো দ্য ডিফারেন্স বিটুইন বাকেট হুইল এক্সক্যাভেটার অ্যান্ড বাকেট চেন এক্সক্যাভেটর?” ঢোঁক গেলে সমসের, “স্যার…।” “ইয়েস অর নো?” “ইয়েস স্যার।” “তো কী লিখেছ এখানে? ডোন্ট ইউ চেক হোয়াট ইউ রাইট? কে চেক করবে এ সব? ডু ইউ থিংক উই হ্যাভ প্লেন্টি অফ টাইম ইন আওয়ার হ্যান্ডস?” ... ...
সেই রাতটা মনে এল ইন্দ্রর। বৃষ্টি পড়ছিল খুব, বাজও পড়ছিল মাঝে মাঝে। তার মধ্যেই অনেক রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে এল সে। সন্ধ্যায় বাড়ি এসেও আবার যেতে হয়েছিল এক রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়াতে। ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢুকে দেখে বাইরের ঘরে সোফায় বসে আছে অঞ্জলি। ঘরে টিউব লাইট নয়, কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে। “এ কি! তুমি শোওনি কেন এখনও?” জিজ্ঞাসা করে ইন্দ্রনীল। “এত রাত করে কেউ এই অবস্থায়?” একটু বিরক্ত গলাতেই বলে সে। উত্তর দেয় না অঞ্জলি, অদ্ভুত ভাবে তাকায় স্বামীর দিকে। সে দৃষ্টিতে কী ছিল আজও জানে না ইন্দ্রনীল – ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, রাগ – সব কিছুই মনে হয় মেশানো ছিল তাতে। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়, ইন্দ্রনীলকে একরকম উপেক্ষা করেই সে উঠে চলে যাচ্ছিল শোবার ঘরের দিকে। ... ...
ওদিকে ফেরার পথে মনটা অশান্ত হয়ে আছে ইন্দ্রনীলের। স্বাভাবিক রাস্তায় না ফিরে এলোমেলো গাড়ি নিয়ে ঘুরতে থাকে সে, তবে শহরের দিকে যায় না। রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকান দেখতে পায় সে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে দোকানে যায় সে। ছোট্ট টিনের চালের দোকান, চারপাশে গাছপালা। নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চ। ইন্দ্র বেঞ্চে বসে এক গ্লাস চা নিয়ে। তার সামনে চাষের ক্ষেত। তার ওপারে সূর্য ডুবছে। চায়ে চুমুক দিয়ে সে ভাবতে থাকে চার দিন আগে আচমকা রাঁচী ছোটার কথা। শুধু বন্ধু নয়, আরও একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওই হোটেলে, যার কথা বিনীতাকে বলেনি সে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ার কারণ হলেন তিনি। ... ...
“খেলাটা খুব সোজা। আমি একটা সংখ্যা আপনাদের জানাবো। তারপর প্রথম জন বলবে তার ঠিক আগের সংখ্যাটা, তার একে একে অন্যরা আগের সংখ্যাগুলো বলতে বলতে যাবেন। এক জন ভুল বললে নতুন করে শুরু হবে নতুন ফিগার দিয়ে। এক রাউন্ড কমপ্লিট হলে লাইনের প্রথম জন চলে আসবে কন্ডাক্ট করতে আর আগের কন্ডাক্টর চলে যাবে কিউ-এর শেষে,” বুঝিয়ে বলল ইন্দ্রনীল। “ইয়ে আবার ক্যায়সা গেম হ্যায়? বহুত ইজি হ্যায়,” বলল বিনয়। “খেলেই দেখুন না,” হাসল ইন্দ্র। “আবার বলছি, আমি একটা নাম্বার বলব, বলে কুইকলি তিনটে তুড়ি দেব। তার মধ্যে আপনি প্রেসিডিং নাম্বারটা বলবেন। ঠিক বললে আবার আমি তিনটে তুড়ি দেব, তার মধ্যে আপনার পরের জন তার আগের নাম্বার বলবেন। এই ভাবে চলবে। ভুল হলে আউট, নো সেকেন্ড চান্স। দু’ মিনিটে একটা রাউন্ড শেষ হবে। ক্লিয়ার টু এভরি ওয়ান?” সবাই মাথা ঝাঁকাল। বিনয় বলল, “ইয়েস। হাম রেডি হ্যায়।” “ওকে,” বলে ইন্দ্রনীল মোবাইলে দু মিনিটে সময় সেট করে নিল। খেলা শুরু করার আগে সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। লাইনে প্রথমে রঞ্জিত, তারপর গায়ত্রী, বিনয়, অরুণাভ, রঙিন, বিনীতা আর কবিতা। “রেডি,” বলে ইন্দ্রনীল দ্রুত তিনটে তুড়ি দেয়, বলে, “টুয়েন্টি এইট।” বলেই ফের তুড়ি দিতে থাকে। “টুয়েন্টি সেভেন,” সামান্য ইতস্তত করে বলে রঞ্জিত। মাথা ঝাঁকায় ডাক্তার, তুড়ি “টুয়েন্টি সিক্স,” গায়ত্রীর জবাব। “টুয়েন্টি সেভেন,... না না… টুয়েন্টি এইট… ধ্যুৎ” বলে বিনয়। সবাই হেসে ওঠে, আফশোস করে সে। “মামু তুমি আউট,” বলে রঙিন। ... ...
সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হয় ইলিশ ভাজা আর ঝাল হবে। আর ফিলে করা আনা ভেটকি রেডি করে রাখা ছিল লাঞ্চ-এর শুরুতে ফ্রাই-এর জন্য। সেটা বরং পরিবেশন করা হবে হার্ড আর সফট ড্রিংকসের সাথে। কিছুক্ষণ পরের কথা। ফিশ ফ্রাই সহযোগে হুইস্কি খাচ্ছে সবাই। বিনীতাকে দেখা যাচ্ছে রান্নার জায়গায়। একটু দূরে ড্রাইভাররা গল্প করছে। ওদিকে ব্যাডমিন্টন খেলছে গায়ত্রী আর কবিতা। ফেদার দূরে চলে গেলে ছুটে গিয়ে নিয়ে আসছে রঙিন। নিচু হয়ে একটা শট মারতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যায় গায়ত্রী। কবিতা ছুটে আসে, “লাগেনি তো?” গায়ত্রী মাথা নাড়ে। তারপর উঠতে গিয়ে ফের বসে পড়ে। তার চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে ওঠে। মদের গ্লাস ছেড়ে দৌড়ে আসে রঞ্জিত। অন্যরাও আসে। গায়ত্রী বাঁ পায়ের গোড়ালি চেপে ধরে আছে। ... ...
রাতে খেতে বসেছে অরুণাভ, বিনয়, রঙিন। বিনীতা রান্নাঘর থেকে একটা পাত্র নিয়ে এসে টেবিলে রাখে। তারপর নিজে টেবিলে বসতে বসতে বিসপাতিয়াকে রুটি নিয়ে আসতে বলে। অরুণাভ বিনয়কে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি আছেন তো কয়েক দিন?” “সাত দিন, এক হপ্তা,” জানায় বিনয়। “গুড,” বলে অরুণাভ। বিসপাতিয়া ইতিমধ্যে ক্যাসেরোলে করে রুটি দিয়ে গেছে টেবিলে। সেখান থেকে সবাইকে রুটি দিতে দিতে বিনীতা বলে, “আর গুড ! সাত দিন ধরে ঘরেই তো বসে থাকবে। বললাম চল দু-দিন ঘুরে আসি, তাও তো…” অরুণাভ একটু জোরের সঙ্গে বলে, “বললাম তো কাজটা শেষ হলে যাব.....” বিনয় বলে, “নেহি নেহি, ইয়ে ঠিক নেহি হ্যায়। ঘুরতে যানা শরীরকে লিয়ে আচ্ছা হোতা হ্যায়।” বিনীতা বলল, “সে আর ওকে কে বলবে? কাজে না গেলেই বরং ওর শরীর খারাপ হয়।” রঙিনের এই সব কথা ভাল লাগছে না। সে মসুর ডালের বাটিতে চুমুক দিয়ে খানিকটা খেয়ে নিল। তারপর বলল, “আমায় আর একটু ডাল দাও।” বিনীতা রঙিনকে ডাল দেয়। অরুণাভ কিছু একটা ভাবছিল। এবার বলল, “এক দিনের জন্য কোথাও যাওয়া যেতে পারে। সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফেরা।” “হাঁ হাঁ, ইয়ে প্রস্তাব আচ্ছা যায়। চারদিকে তো বহুত সুন্দর সুন্দর জায়গা হ্যায়।… হামারা ভি এক প্রস্তাব হ্যায়।” সবাই বিনয়ের দিকে তাকাল, সেও সবার মুখের দিকে দেখে নিয়ে বলল, “পিকনিক মে গেলে কেমন হোগা?” ... ...
ইন্দ্রনীলের কোয়ার্টার প্রায় অন্ধকার। কেবল ছোট ঘরটায় একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে ‘ক্যাথেড্রাল' সিরিজের বাঁধানো ছবিটা। রকিং চেয়ারটায় চোখ বুজে বসে আছে ইন্দ্রনীল, হাতে হুইস্কির গ্লাস। রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে প্রায় অন্ধকার ঘরে - "তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে…” ছাদে একা বসে থাকা বিনীতার চোখে জল টলটল করছে, পাতা ফেলতেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। জলটা মুছে নিল সে, জীবনের সমস্যাগুলোও যদি এমন সহজে মুছে ফেলা যেত! বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। ... ...
মিনিট পনের পরে ফোন পায় বিনীতা। ডাক্তার তাকে চেম্বারে যেতে বলছে। বিনীতা ভেতরে গেলে ইন্দ্রনীল বলে, “বসুন ম্যাডাম। বলুন কী ব্যাপার? হঠাৎ জরুরী তলব?” অরুণাভর ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট দেয় বিনীতা। ইন্দ্র রিপোর্ট খুলে দেখে। “এটার তো তাড়া দিল না। যে দিন দেখাতে আসতেন সে দিন আনলেই হত,” বলে ডাক্তার। বিনীতা বলে, “আর একটা কাজ আছে। আমার সঙ্গে যেতে পারবেন? ঘন্টা খানেকের জন্য?” “কোথায়?” “আসলে ফ্ল্যাটটা দেখতে যাব, একটা চেকও দেওয়ার আছে। ওর যাওয়ার কথা ছিল, কাজে আটকে গেছে। বলল যদি আপনি যেতে পারেন।” ইন্দ্রনীল ঘড়ি দেখল। বলল, “ঘন্টা খানেকের ব্যাপার হলে অসুবিধে নেই। আসারও দরকার ছিল না, একটা ফোন করে দিলেই হত।” “ফোন করলে তো আসতেন না। বলে দিতেন ইমার্জেন্সি কেস আছে। সেদিন সিনেমাতেও তো এই কথা বলে এলেন না।” ... ...
ক্লান্ত পায়ে বিছানা থেকে ওঠে বিনীতা, হাউসকোট পরে নেয় ঠিক মত। বাথরুমের দরজা খোলে। বেসিনের কল থেকে চোখে মুখে ঘাড়ে জল দেয়, আয়নায় একবার মুখ দেখে। মনে পড়ে যায় কয়েকমাস আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হওয়া একটা কথা। অনেক দিন পরে রঙিনকে খাইয়ে দিয়েছিল অরুণাভ সেই দিন, পরে বিনীতাকে বলেছিল, “যে কোনও কাজ আমরা কোনও না কোনও দিন শুরু করি। খুব মেজর কিছু হলে প্রথম দিনের ঘটনাটা মনে থাকে, শেষ দিনেরটা থাকে না।” উত্তরে বিনীতা জানিয়েছিল, “বেশির ভাগ সময়ে তো জানাই থাকে না যে এই কাজটা এই বারই শেষ বার করছি।” বিনীতা তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে, বেসিনের কল থেকে জল পড়তে থাকে। ... ...
বিনীতার শান্ত স্বরে গায়ত্রীর উত্তেজনা কমে আসে। “ডাক্তার কি ব্যাচেলর?” “ডিভোর্সি।” “সেটার কারণ জানিস?” “ওয়াইফের দিল্লি পছন্দ, ওনার নয়। এই নিয়ে টানাপোড়েনের ফলেই ডিভোর্স।” “এটা একটা কারণ হল?” অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইল গায়ত্রী। “এটাই বলেছে। ভেরিফাই করার জন্য স্ত্রীর ফোন নম্বরও দিয়েছে।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে গায়ত্রী। তারপর জিজ্ঞাসা করে, “রঙিনের কথা ভেবেছিস?” বিনীতা বলে, “ওর জন্যই।” “মানে?” জানতে চায় গায়ত্রী। “রঙিনের বাবা অফিস আর কাজ আর বই ছাড়া কিছু বোঝে না। এত বছরের ম্যারেড লাইফে আমরা এক বার মাত্র বেড়াতে গেছি, কালিম্পং-এ। সেটাও বিয়ের পরপরই। আমার কথা ছেড়ে দে, মেয়েকেও তেমন সময় দেয়নি কখনও। আমার বা মেয়ের শরীর খারাপ হলেও সময় মতো ঠিক অফিস চলে গেছে। ফোন করে খবরও নেয়নি কেমন আছি আমরা। অসম্মান যেমন করেনি, তেমনি সম্মানও দেয়নি।…” ... ...