

'কাদামাটির হাফলাইফ' -- একটি অনন্যসাধারণ রচনা। অনন্যতা নামকরণে। হৃদয়ে বিরাজ করা ভাবনা নির্বাচনে। অনবদ্য জীবনকথা উচ্চারণে। বৈঠকি মেজাজে সত্যোচ্চারণ করার অভূতপূর্ব ভঙ্গিমায়।
১১৬ পর্বে বিন্যস্ত জীবনে জীবন যোগ করার অবিস্মরণীয় সাহিত্যকর্ম 'কাদামাটির হাফলাইফ' সাহিত্যকর্ম তো বটেই, অন্তত আমার নিবিড় পাঠ অনুভবে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে ষোলআনা একাত্মতায়। আমরা জানি কোনো প্রচারধর্মী, রাজনৈতিক, সামাজিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থেকে জাত হতেই পারে না প্রকৃত সাহিত্য। ভাবে ভাষায় ও রূপে তার নির্মাণ এক 'হয়ে ওঠার' বৃত্তান্ত। মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের কথায় : " A poem Should not mean / But be." ইমানুল হকের 'কাদামাটির হাফলাইফ' ঠিক তেমনই গ্রামবাংলার নির্ভেজাল ও 'কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা'-র সার্থক সাহিত্যরূপ।
লেখক ইমানুল এই বইটিতে রোমন্থন করেছেন সেইসব স্মৃতি-অনুষঙ্গ যা বর্তমান সময়ে বড়ই দুর্লভ। সুজন ইমানুল ফ্ল্যাশব্যাক মোডে নিজের লেখনীকে চালনা করে লিপিবদ্ধ করেছেন বিগত তিন-চার দশকের গ্রামবাংলার আটপৌরে ও আন্তরিক যাপন সমৃদ্ধ কথা ও কাহিনি। বইটি পড়তে কোনো ক্লান্তি আসে না। বইটির ৩৫৮ পাতা যেন আমাদের 'এই তো সেদিন ছিল' জীবনেরই প্রতিলিপি। 'আজও চোখে ভাসছে দ্যাখো' ছবি। যা এখন নেই, বস্তুত যা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই বইটির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই মা-মাটি-স্বদেশ ও ফেলে আসা জীবনের একান্ত অকৃত্রিম মুহূর্তগুলিকে। আমাদের 'পরাণ যাহা চায়'। ইমানুল পেরেছেন নিজের কথাকে সবার কথা করে তুলতে। ইমানুলের কাদামাটি চারিয়ে যায় প্রতিটি পাঠকের হৃদয়-প্রকোষ্ঠে। তাঁর জীবন-দীঘিতে বঁড়শি ফেলে হারিয়ে যাওয়া তাল তাল সুদিন তুলে আনার পবিত্র রোমন্থন-প্রয়াস পাঠকের চিত্তেও ঘাই মারে। প্রতিটি পর্বে ইমানুল দেখিয়েছেন কাদামাটি লেপা বা কাদামাটি সম্পৃক্ত তাঁর অর্ধজীবনের পরম স্বস্তিতে গুজরানো সেই :দিনগুলি রাতগুলি'। মাননীয় পাঠকবর্গ অনুভব করেন : 'পরস্য ন পরস্যেতি মমেতি ন মমেতি চ'। যা লেখকের একান্ত অনুভব ছিল, তা হয়ে গেল তাবৎ পাঠকেরও। লেখক ইমানুলের অবিসংবাদিত কৃতিত্ব এখানেই।

ইমানুল হক তাঁর কাদামাটির চারণায় তাঁর চোখে দেখা ও অনুভূত আশৈশবের নানা ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রাখর্য অতুলনীয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তিনি 'কল্লোলিনী তিলোত্তমা' কলকাতা মহানগরীর একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও সাহিত্যিক হয়েও সেই একান্ত সরলতার দ্রব্যের আড়ম্বরহীন আন্তর-বৈভবে পরিপূর্ণ কাদামাটির কাহিনি লিখেছেন, কখনো বা :হৃদয় খুঁড়ে বেদনা' জাগিয়ে দিয়ে --আসলে খাঁটি জীবনের উল্লাসে বিভোর হয়ে অনুভব- সহোদর সকলকে আনন্দমুখর জীবনের সুযোগ্য-অংশভাগী করতে চেয়েছেন। নাগরিক যাপনের প্রায় 'সব পেয়েছি'-র প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করেও ইমানুল বারবার তাকিয়েছেন 'মাটির পৃথিবী পানে'। আর তাঁর হাঁটি হাঁটি পায়ে ফেলে আসা সেই পুষ্পক সময়ের লিখন-চারণায় হয়ে উঠেছেন যথার্থই মালাকার।
ইমানুলের কাদামাটিতে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রায়না এলাকার জন্ম গ্রাম ও তৎসংলগ্ন অজস্র গ্রাম আর রাজার শহর বর্ধমান শহরের অজস্র প্রসঙ্গ এসেছে। স্মৃতিঘন ইমানুল তাঁর পরিবারের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের ভোলেননি। হিন্দু-মুসলমান হিসেবে কাউকে তিনি দেখেননি, তাঁর কাছে সবাই যে শুধুই মানুষ, নাড়িতে নাড়ি বাঁধা কুটুম তা বেশ বোঝা যায়। আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীত-দৃশ্য সমূহ ভাষারূপ দিতে গিয়ে ইমানুল গ্রামে প্রচলিত বহু আঞ্চলিক শব্দ, বাক্যবন্ধ, লোকভাষা ব্যবহার করেছেন পরম মমতায়। বাবা-মায়ের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ইমানুল কার্যত স্মৃতিকথা বলার আঙ্গিকে এক জলজ্যান্ত তথা সকলের কাঙ্ক্ষিত জীবনের মহাভাষ্য রচনা করেছেন।
পরিশেষে বলব, ইমানুল হকের 'কাদামাটির হাফলাইফ' বাংলাসাহিত্যের এক বিশিষ্ট রচনা। আরামপ্রদ সুবাতাস। যথার্থই মহার্ঘ। একঘেয়ে যাপন জনিত তিতিবিরক্ত জীবনে যেন 'দারুচিনি দ্বীপ'। সকল প্রিয় পাঠকবন্ধু, বইটি সংগ্রহ করে পড়ুন, এক অনাঘ্রাত অথবা নিরুদ্দিষ্ট আনন্দের খোঁজ পাবেনই।
তৌহিদ হোসেন | 42.***.*** | ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:১৩527361