এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • পর্বতের উপরে আমার রক্ষাকর্তা 

    SUBHAS CHANDRA Ganguly লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ২২ এপ্রিল ২০২৩ | ৮৫৫ বার পঠিত
  • পর্বতের উপরে আমার রক্ষাকর্তা
    সুভাষ চন্দ্র গাঙ্গুলী

    [ উত্তম পুরুষে উপস্থিত করা নিচের বিবরণটা ২০০১ সালের মে মাসে হিমালয় পর্বতমালা'র বহু উঁচুতে এক তীর্থকেন্দ্রে যাওয়ার অভিজ্ঞতাকে ঘিরে। ছোট বোন মালবিকা'র (সেনগুপ্ত) এই অভিজ্ঞতার কাহিনী তার মুখে শুনে তারই নিজের জবানীতে এই বিবরণী প্রস্তুত করে উপস্থিত করছি আমি, তার বড় ভাই সুভাষ চন্দ্র গাঙ্গুলী। সুদূর অতীত থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার কাজে স্ব-নিয়োজিত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর এক জনের জীবনদায়ী দরদের এই কাহিনী অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে, যদিও এমন এক নাড়িয়ে দেওয়া অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভাষার সীমাবদ্ধতা পুরোপুরি এড়ান সম্ভব নয়। এমন কারও কারও মনে হতেই পারে যে এই গোত্রের কাহিনী প্রায়ই ভুলে যাওয়া এমন এক বার্তা/বাণী বহন করছে যা উচ্চনিনাদে স্ব-ঘোষিত ভাবে জনতার মঙ্গলের জন্য নিবেদিত দল /সংগঠন ইত্যাদির মধ্যকার চালু পারস্পরিক বিতর্ক-তথা-বিবাদ-বিসম্বাদের আওতার বাইরে। ]

    খুব বেশী সময় কাটার আগেই আমি দেখছিলাম যে আমার পথচলার সঙ্গীরা আমাকে নিচে ও পিছনে ফেলে এক এক করে উপরের পাহাড়ের মোড় ঘুরে ঘুরে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছেন। এটা সত্যি সত্যিই যেন মহাভারতের পাণ্ডবদের সেই ঐতিহ্যের অনুসারী যেখানে তাঁরা তাঁদের বিখ্যাত শেষবিদায়ের অর্থাৎ ‘মহাপ্রস্থানের’ পথে এগিয়ে চলেছেন ― চলেছেন পেছনের দিকে না তাকিয়ে ও দৃঢ়ভাবে একেবারে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে , যদিও তাঁদের পরিবারের লোকেরা এক এক করে পথের পাশে পড়ে যাচ্ছেন। যে পথ ধরে চলছি সেটাকে মোটামুটি ওই মহাকাব্যিক পথেরই* অনুসারী বলে ধরা চলে, মানে, এটা হ'ল সমুদ্রতল থেকে ৩৫৬৪ মিটার উঁচুতে হিমালয় পর্বতের উপরের এক হিন্দু তীর্থস্থান পৌঁছাবার পথ। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই পথ বরফের নিচে চলে যায় যেখানে আর তখন একেবারেই ঢোকা যায়না। দিনকাল যে বদলে গেছে সে'তো বলার অপেক্ষা রাখেনা। নীচে সমতলে আমাদের পার্থিব বাসস্থান চিরকালের জন্য ছেড়ে আসার মানসিকতা আমাদের একেবারেই নেই । বরং ঘটনাটা হ'ল এই যে আমার সঙ্গীরা এরকম একটা উপলক্ষ্যকে দুটো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকেনঃ ভ্রমণ এবং ছোট ও বিশুদ্ধ একটুখানি ব্যবসা। উপরে শস্তায়, অতি শস্তায় উলের পোশাক-পত্তর কিনে নিচে নেমে এসে লাভ রেখে বিক্রি করা। নিজেদের যাতায়তের খরচ খানিকটা পরিমাণ উসুল করার জন্যই পাহাড়ে চড়ার ব্যাপারে আমার মত এমন আনপড় একজনকে সঙ্গী করা হয়েছে। কাজে কাজেই আমার কাছ থেকে আদায় করা অর্থের পরিমাণ অনুযায়ী থাকা খাওয়ার মানের ব্যাপারে আমার যা পাওনা তার চেয়ে অনেক খারাপ আমার কপালে জুটেছে। এসবই আমি বুঝতে পেরেছি যাত্রা শুরু হওয়ার পরে। এমন বিপদসঙ্কুল যাত্রার ব্যাপারে আমার কতটুকু ক্ষমতা আছে সে ব্যাপারে আমি অনিশ্চিত বোধ করছিলাম; কিন্তু এই যাত্রীদলের অতি সক্ষম নেত্রী আমাকে ভরসা দিয়েছিলেন যে তিনি সব সময়ে আমার পাশেই থাকবেন। তারপরেও তিনি ও তাঁর অন্য সঙ্গী-সাথীরা আমায় পথের উপর একলা ছেড়ে দিয়ে উপরে চলে গেলেন ।

    আমাদের যাত্ৰা শুরু কলকাতা থেকে ৪০ কিমি–এর মত দূরের মফঃস্বল শহর অশোকনগর থেকে। এখন আমরা যাত্রার শেষ ও সবচেয়ে দুর্গম অংশে রয়েছি ― গৌরীকুন্ড (যেখানে মোটরে চলার উপযুক্ত রাস্তা শেষ) থেকে কেদারনাথ মন্দির। আঁকাবাঁকা ক্রমাগত উর্ধগামী একটানা প্রায় চৌদ্দ কিমি হাঁটাপথ, যা কোথাও কোথাও খুবই খাড়া। এটা পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার/মানুষের পিঠে চড়ে পার হতে হয় ।

    অনেক ভোরে আমরা রওনা দিয়েছি। যাত্রার শুরু থেকেই আমার গোড়ালীতে একটা ব্যথা ছিল; অথচ বোকার মত আমি সেটাকে অবহেলা করেছি। আর বেখাপ্পা জুতোজোড়া সেই ব্যথাটাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে একেবারে শুরু থেকেই আমি খোঁড়াচ্ছিলাম। যখন খেয়াল হল যে ঘোড়ার পিঠে চড়েই আমার আসা উচিত ছিল ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ঘোড়া ভাড়া করা যায় একমাত্র যাত্রার শুরুতে বা শেষে, মাঝপথে নয়। কাজে কাজেই খোঁড়ান পা নিয়েই আমার ভারী শরীর ধীরে ধীরে উপরের দিকে টানতে টানতে চলতে লাগলাম। প্রতিটি পদক্ষেপই আরও আরও যন্ত্রণা’র হয়ে উঠছে। পথের একধারে রয়েছে মাথার উপরে ঝুলন্ত খাড়াই পাহাড়; অপর ধারে পাহাড়ের ঢালু, খাড়াই গাত্রতল শতশত মিটার নিচে সোজা নেমে গেছে। আর দুইধারের মাঝখানের পথ চওড়ার ধারে কাছে নয়। একই সাথে তা রুক্ষ ও প্রতিপদে চড়াই বা উৎরাই , অর্থাৎ প্রতিপদে নামছে বা উঠছে। প্রাণশক্তিতে ভরা পায়ে চলা তীর্থযাত্রীরা আমাকে পাশ কাটিয়ে উপরে এগিয়ে যাচ্ছেন। কম সক্ষমরা পশু বা মানুষের পিঠে চড়ে একইভাবে এগিয়ে চলেছেন। আর হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে পড়া এই আমি শূন্যদৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলেছি। যাত্রী পিঠে নিয়ে চলা একাধিক ঘোড়া কয়েকবার আমাকে পাশে ঠেলে দিয়েছে। কাজেই আমি যাতে পাহাড়ী পথের খাড়াই দিক ঘেঁষে চলি সেদিকে নজর রাখতে হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার পরপর পাশাপাশি গোটা কয়েক করে খাবার দোকান আর বসবার জায়গা আছে। এগুলোকে 'চটি' বলে। আমি প্ৰত্যেকটা চটিতেই খানিক্ষণ করে বিশ্র্রাম নিচ্ছিলাম এবং চিরকালের জন্য সেখানে বসে থাকার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করছিলাম।

    বহু উপরে মানুষজনকে হেঁটে-চলে বেড়ান পুতুলের মত লাগছে। আমাকে ওই অত উপরে ও আরও উপরে উঠতে হবে এটা ভাৱতেই ভয়ে আমার কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। আমার গোটা সত্তা যেন নি:শব্দে এই বলে আর্তনাদ করে উঠছে যে ''আমি পারবনা, আমি পারবনা''। রামোয়ারা চটি পর্যন্ত কমপক্ষে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি অন্তত: আমার সঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু তারপর থেকে আমার পা ফেলাটা ক্রমশ:ই বেশি বেশি করে প্রায় যেন এক মাতালের মত এলোমেলো হতে শুরু করল। আমার কাঁধে ঝোলান মালপত্তর (অল্প কিছু জিনিসপত্তর ভরা একটা ব্যাগ ও একটা বর্ষাতি) আরও আরও ভারী লাগতে শুরু করল। আমি প্রায় একটা স্বয়ংচালিত যন্ত্রের মত চলছি ─ কোথায় যাচ্ছি সে ব্যাপারে প্রায় কোন সচেতনতা ছাড়াই। অন্য নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যেমন, নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধে, গা গোলান ― এরকম সব। মাথার ভেতরটা যেন কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি 'গরুড়' চটি, মানে শেষ চটি ছাড়িয়ে এসেছি। সেখান থেকে অল্প কিছু দূরে, মানে গন্তব্যস্থল থেকে দুই বা তিন কিলোমিটার আগে হঠাৎ আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল। আমি উঁচু-নিচু রুক্ষ পার্বত্য পথের উপর ধপাস করে বসে পড়লাম ও বমি করতে শুরু করলাম। এইসময় নাগাদ পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। আমার সামান্য কিছু জিনিষপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে; আর তারই মাঝে গতিহীন আমি হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছি।

    আঁধার ঘেরা পাহাড়গুলো আঁধার ঘেরা আকাশের সাথে মিশে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাথা ঘিরে ঘিরে মেঘ জমতে শুরু করেছে। একটু পরেই বৃষ্টি নামতে শুরু করল। একেবারে বরফের মত ঠান্ডা জল ! এমনই শক্তিহীন দুর্দশা আমার যে, বর্ষাতিটা তুলে নিয়ে গা ঢেকে নেব সেটুকু ক্ষমতাও আর অবশিষ্ট নেই। কাজেই এক্কেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সপসপে করে ভিজে উঠে থর থর করে কাঁপতে শুরু করলাম। তীর্থযাত্রী ও ভ্রমণকারীরা যে যার গন্তব্যস্থলে অনেক আগেই পৌঁছে গেছেন। নজরসীমার মধ্যে এক জন মানুষও দেখা যাচ্ছেনা। আমার ভেতরটা একেবারে ফাঁকা লাগতে শুরু করল। এই শেষ ! এই শেষ ! মৌ (আমার বৌমা) আর বাবন (আমার ছেলে) জানতেও পারবে না ! পাহাড়ের লোকরা আমার অচেনা মৃত শরীরটাকে বহু নিচে বয়ে চলা গর্জনরত ― যা ক্রমে ক্রমে ঘিরে আসা অন্ধকারের ও বৃষ্টির মধ্যে খানিকটা ভুতুড়ে শোনাচ্ছে ― মন্দাকিনীতে ঠেলে ফেলে দেবে। কপালে যদি তা'ই লেখা থাকে তো তবে তা’ই হোক !

    হঠাৎ আমার কানের কাছে অতি নরম ও মরমী সুরে ''মাইজী'', এই শব্দটা বেজে উঠল ! আমার আচ্ছন্নতা হঠাৎ কেটে গেল। তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ীয়া এক যুবা পিঠের উপর এক ঝুড়ি চাপিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার নিজের ভাষার সাথে হিন্দী জড়িয়ে কিছু কথা বলছে, যার বেশির ভাগটাই আমার ওই ঝিমুনিমার্কা ও একই সাথে চূড়ান্তভাবে বিস্ময়মাখানো অবস্থায় আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু তার কন্ঠস্বর এমনই মমতামাখানো যে আমাকে সে’যে সাহায্য করতে চাইছে সেটা একেবারে জলের মত পরিষ্কার। খাঁটি এক দেবদূত যেন শূন্য থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হ'ল। যেন ধড়ে আমার প্রাণ ফিরে এল। সে প্রথমে আমাকে তার ঝুড়িতে বসতে রাজি করাল যাতে সে আমাকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমার ভারী শরীর কি সে সহজে বইতে পারে ! সুতরাং আমি নেমে পড়লাম। বাকিটা পথ সে আক্ষরিক অর্থেই আমার 'হাত ধরে ধরে নিয়ে গেল'। অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার অতি ধীরে ধীরে পা ফেলার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগল এবং যখন যখনই আমার পা ফস্কে যাচ্ছিল সে সামলে নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখছিল। সেই আধো অন্ধকার আর বৃষ্টি'র মধ্যে অপরিচিত পথ দিয়ে কিছু টাকাপয়সা সহ হাঁটতে হাঁটতে আমি খানিকটা নিরাপত্তাহীন বোধ করছিলাম। তা নিয়ে আমি কিছু না বলা সত্ত্বেও কি করে যেন সে আমার মানসিক অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করে থেকে থেকে আমায় ভরসা দিচ্ছিল যে ভয় করার মত কিচ্ছু নেই ও আমি আমার যাবার জায়গায় নিরাপদে পৌঁছে যাব। আমার গন্তব্যস্থলে না পৌঁছান পর্যন্ত সে আমার সঙ্গ ছাড়ল না। এক আশ্রয় থেকে আর এক আশ্রয় ― এভাবে ঘুরে ঘুরে আমি আমার সঙ্গীদের খুঁজে বার করলাম।

    যদিও পারিশ্রমিক হিসেবে আমি তাকে যা দিলাম তাতে সে স্পষ্টত:ই সন্তুষ্ট হল, আমার ঐ ভাঙাচোরা অবস্থায় আমি আমার বিপুল ও গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ তাকে উপযুক্তভাবে জানাতে পারিনি। এমনকি তার নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমার এই ত্রুটির জন্য আমি গভীর অনুশোচনা বোধ করি। এই লেখাটা আমার সেই অনামা প্রাণরক্ষাকর্তার কাছে প্রকাশ্যে মাথা নত করে আমার বিনীত নিবেদন; যদিও তাঁর নিজের সেকথা জেনে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ইনি এমন একজন প্রাণরক্ষাকর্তা, যিনি তাঁর জীবনদায়ী দান চাইবার অপেক্ষা না রেখে, আর পাঁচটা কাজের মতই নির্লিপ্তভাবে করলেন। একই সাথে এই লেখা একজন সহ-নাগরিকের সভ্য আচরণ ও গভীর মমতার এই মাথা নত করে দেওয়া নিদর্শনের অভিজ্ঞতাকে অন্যদের সাথে ভাগ নেবার একটা চেষ্টা। এটা খেয়ালে রাখা প্রয়োজন যে, যে মানবগোষ্ঠী থেকে এই সহ-নাগরিক এসেছেন, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা'র কারণে তাঁদেরকে যতটা’না সম্ভ্রমের চোখে দেখা হয় তার চেয়ে বেশী দেখা হয় করুণার চোখে।

    জানা থাকুক বা না থাকুক আমি প্রায় নিশ্চিত যে এমন কাহিনী এই প্রথম বা এই শেষ হতে পারে না। কিন্তু এমন কাহিনী আমার জানার বাইরে যদি কেউ শুনে থাকেন তো তা বার বার বলার অপেক্ষা রাখে। এই একই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে যে ঘোড়ায় চড়ে ফেরার পথে চোখে পড়ল সেই একই সৌজন্য, সাহায্যকারী মনোভাব (মন জয় করার কোনরকম মনোভাব মুক্ত), যা এমন এক মর্যাদাবোধ ও মানবিকতাবোধের প্র্রতিফলন, যার সামনে আমরা সবাই মাথা নোয়াই। এইসব মানুষদের কেবলমাত্র 'বঞ্চিত' বলার বদলে 'পশ্চাদপদ' বলা (যা কোন ‘বঞ্চিত’ অঞ্চলকে সঠিকভাবেই 'পশ্চাদপদ' বলা থেকে আলাদা) কতটা সঙ্গত? উপরে যে মানবিক গুণগুলির আত্মপ্রকাশ আমরা দেখলাম তাকে কি এক উচ্চস্তরের ‘সভ্যতা’র সূচক বলে মনে হয় না?

    একটা মজার দূরকল্পনা:

    সাংস্কৃতিক-তথা-সামাজিক একটু দূরকল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়ে এমন একটি দৃশ্যের কথা কি ভাবা যায়, যেখানে বৃহৎ-তথা-বাজারী-তথা-‘জনপ্রিয়’ সংবাদপত্র জগতের কোন এক কাগজের কোন একদিনের প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনামে বর্তমান ধরনের চালু সংবাদগুলোর জায়গায় উপরের ধরনের সামাজিক অর্থবাহী ঘটনাগুলির সংবাদ (যা খোঁজার মত খুঁজলে বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের কোন না কোন জায়গায় পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বলেই ধরা যেতেপারে ) জায়গা করে নেবে? তাহলে '' .......আজকের দিনের বাণিজ্য-সেবক বা পার্টিপোষিত সংবাদপত্রের অস্তিত্ত্ব দু:সহ হযে ওঠে'' (সাংবাদিকতা, ইতিহাস, সাহিত্য ─বুদ্ধদেব বসু, সাহিত্যচর্চা, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭০০৭৩)। বৃহৎ শিল্পজগৎ ও নানা ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক মহলের নানা চেহারার পৃষ্ঠপোষকতায় এই চালু সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় উপস্থিত করা নানা ঘটনার উপস্থাপিত বিবরণের সামগ্রিক চেহারা বা সুর যে কেমনটি তা সব সংবাদপত্র পাঠকেরই কমবেশী জানা ─ যেমন, দলীয় রাজনীতির আঙিনায় কানফাটান চড়া গলায় ''একমাত্র আমরাই ঠিক/ভাল'' এই সুরে পারস্পরিক গালি-গালাজ, ক্ষমতাদখলের লড়াই, (যা বহুসময় হিংসাত্মক চেহারা নেয়), নানা দলীয় কেচ্ছা ইত্যাদির খবর। এরই সাথে সাথে প্রথমপাতার শিরোনাম দখল করে এইধরনের খবরও: মানুষের মধ্যে পারস্পরিক নিষ্ঠুরতা বা অন্য নানা অমানবিকতার উদাহরণ।

    ফুটনোট :

    আরও ঠিক করে বললে, মহাকাব্যিক এই কল্পকাহিনী গড়ে উঠেছে এমন আর একটা তীর্থস্থান নিয়ে যাকে আমাদের গন্তব্যস্থানের, অর্থাৎ 'কেদারনাথ মন্দির'-এর একরকম কল্পিত যমজ বলা যায়। এর নাম 'বদরীনাথ মন্দির'। এই দুটি তীর্থস্থানকে একসাথে 'কেদার-বদরী' বলার চল খুব বেশী, যার ফলে 'কেদার-বদরী' দুটোর বদলে একটা জায়গার নাম বলে মনে হতে পারে।

    সংযোজন:

    উপরের চরিত্রের ঘটনার উপস্থাপনা বৃহৎ-তথা-বাজারী-তথা-‘জনপ্রিয়’ সংবাদপত্র জগতের কোন কাগজের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনামে না এলেও (যে কথা’র উল্লেখ উপরে করা হয়েছে) সৌভাগ্যক্রমে ভেতরের কোন একটা পাতার কোন একটা কোণে বিরল হলেও কখনও কখনও জায়গা করে নেয়। একটি ইংরেজী সংবাদপত্রের ভেতরের পাতার এক কোণে প্রকাশিত সমধর্মী ও স্মরণীয় একটা টুকরো খবরের (যা বেদনাভরা অশ্রুসজল চোখে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নুইয়ে আনে) বাংলা অনুবাদ নিচে দিয়ে দেওয়া হ’লঃ

    হিমাচল প্রদেশে একজন সতর্ক বাসচালক নিজের প্রাণহারানো’র আগে যাত্রীদের প্রাণ বাঁচালেন

    সঞ্জীব কুমার
    সিমলা, ৩ এপ্রিল

    এখান থেকে ২২০ কিমি দূরে হিমাচল প্রদেশে সিরমোউর জেলার পাঁওতাসাহেব-এ এক বেসরকারি বাসের সতর্ক চালক তাঁর হৃদযন্ত্র আক্রান্ত পর একেবারে ঠিক সময়মত ব্যবস্থা নেওয়ায় ১৫ জন যাত্রীর প্রাণ রক্ষা হয়।

    চালক রাস্তার ঝোপ-ঝাড়ের দিকে বাসের মুখ ঘুরিয়ে দেন; নইলে বাসটা রাস্তা থেকে সরে গিয়ে সোজা অপর দিকে নিচে এক গভীর খাদের মধ্যে পড়ত ও বহুজনের মৃত্যু হ’ত। ওখানকার পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট বীর বাহাদুর জানান যে ঘটনাটা ঘটেছে শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায়, যখন বেসরকারি বাসটা পাঁওতাসাহেব থেকে সতাউন-এর দিকে যাচ্ছিল।

    বীর বাহাদুর স্টেটসম্যানকে জানান, “পাঁওতাসাহেব থেকে সতাউন-এর দিকে যাওয়ার পথে রাজবন চেকপোস্ট-এর কাছাকাছি এসে অশোক কুমার (৪৬) নামের এই বাসচালকটি হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সবচেয়ে খারাপের আশংকা থেকে অশোক বাসটিকে নিচের গভীরখাদের দিক থেকে উল্টো দিকের ঝোপ-ঝাড়ের দিকে ঘুরিয়ে দেন। ফলে বাসটি ঝোপ-ঝাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে আটকে যায়”।

    বাহাদুর জানান, পাঁওতাসাহেবে কামরাও তহশীল-এর ভানেদি গ্রামের মানুষ অশোককে চিকিৎসার জন্য একেবারে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে মৃত বলে জানান হয়।

    পুলিশ জানায়, সমস্ত যাত্রীরাই এই দুর্ঘটনা থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছেন এবং এই ঘটনার উপর আরও তদন্ত চলছে।

    [স্টেটসম্যান, শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২০]

    উপরের খবরের মূল ইংরেজী ভাষ্য:

    Alert bus driver saves lives of passengers before death in HP

    SANJEEV KUMAR
    SHIMLA, 3 April

    Timely action and alert thinking of a driver of private bus in Paonta Sahib in Sirmaur district of Himachal Pradesh, around 220 km from here, saved the lives of 15 passengers after he suffered heart attack while driving. The driver turned the bus towards bushes on the roadside, otherwise the vehicle would have veered off the road and fell into deep gorge which might have resulted in many casualties.

    Deputy Superintendent of Police, Paonta Sahib Bir Bahadur said the incident took place on Friday evening when the private bus was on its way to Paonta Sahib from Sataun . “The driver identifies as Ashok Kumar(46) was on his way to Paonta Sahib from Sataun when he suffered heart attack near Rajban Check Post. Fearing worst, Ashok turned the bus towards forest away from deep gorge which led to the private bus stopping after colliding with bushes,” Bir Bahadur told The Statesman. Bahadur said, Ashok, a resident of Bhanedi village in Kamrau tehsil in Paonta Sahib, was rushed to hospital for further medical treatment where he was declared dead on arrival Police said all the passengers escaped unhurt in the accident and further investigations were on.

    [ The Statesman, Saturday,03 April, 2020]
    https://www.readwhere.com/read/download/clip/9e5d7524-e8f0-45eb-9f0a-b5a3a15aa807
    ________________________________________________________________
    Copyright (c) 2023 by Subhas Chandra Ganguly. This is an open access article distributed under the terms of the Creative Commons Attribution-Noncommercial-No Derivative License (see http://creativecommons.org/licenses/by-nc-nd/3.0/us/), which permits anyone (if he/she so wishes) to share this article, provided (1) the distribution is only for noncommercial purposes, (2) the original author and the source are attributed, and (3) no derivative works including any alterations are made. For any distribution, this copyright statement should also accompany the article without any alteration and in its entirety, and the publication history should also accompany the article.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২২ এপ্রিল ২০২৩ | ৮৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন