নামাযের এই সময়টুকু, জুমআর আযান শেষ হলে আরো আধঘন্টা পর মসজিদের সামনের এই রাস্তা, যে কেউ চাইলে নিজের করে নিতে পারে। প্রথম দিকে বিছানাটা ফাঁকা থাকে, অনেকটা জায়গা নিয়ে হেলে দুলে আয়েস করে বসেন মুসল্লিরা, চারদিকের গতিপ্রকৃতি ভীষন নিরীক্ষনে রেখে সময়সুযোগ বুঝে এক সময় রাস্তা জুড়ে বিশাল বিছানা পেতে দেন খাদেম। যতই মূল নামাজ এগুতে থাকে, ততই জায়গাগুলো কিনে নিতে থাকে মুসল্লিরা, প্রায় এক ঘন্টার জন্য, বিনে পয়সায়, কোন দরকষাকষি বা মল্লযুদ্ধ ছাড়াই । একদম শেষ মুহুর্তে, যখন খুৎবা হতে থাকে, তখনো মুসল্লিরা ওযুর পানিতে মাখামাখি হয়ে ভিজেলেপ্টে দৌড়ুতে থাকে, রাস্তার ধুলো আবর্জনা মাড়িয়ে আসতে থাকে দলে দলে, একটুকু ফাঁকা জমির জন্য তারা হাপিত্যেশ করে মরে, এই এখানে এক চিলতে জমিন বরাদ্দ পেলে দুনিয়ার আর কিছুই চাইবার নেই তাদের!
সৃষ্টিকর্তাই তো বলেছেন যে তিনি অঝোর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেন আর তারপর মাটিকে বিদীর্ণ করেন আর তাতে উৎপন্ন করেন শস্য, ফল বাগান ঘাস… আকাশ ছোঁয়া মিনার থেকে ভেসে আসা ঐশীবানী ঝংকৃত করে যাচ্ছিল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন দেয়ালগুলোকে… দশ বছরের মোরসালিন দেখতে পেল দূরে কে যেন তাকে ডাকছে, সে আজ নানাজানের দেয়া লাল পাঞ্চাবিটা পরেছিল, তার উপর একটা কটি চাপিয়ে দিয়েছিল মা, মাথায় জরির কাজ করা সোনালি বর্ডারের টুপি, মাপমত সাদা পায়জামাটা পাঞ্জাবির সাথেই ছিল শপিং বক্সে। মোরসালিন দেখল ঐখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা পরে ছিল, পরীক্ষার সময় যেমন থাকে প্রতিটি বেঞ্চে দুজন ছাত্রের মধ্যে… কিন্তু সেখানে যেতে কয়েকটি লাইন টপকাতে হবে…আবার তাকালো জায়গাটুকুর দিকে, রহস্যদ্বীপের দুহাত বাড়িয়ে তাকে এমন করে ডাকলো যে, তোয়াক্কা করল না উঁচু নীচু প্রণালিগুলোর, রুক্ষবাতাসের প্রবল ঝাপটা খেতে খেতেই এক সময় পৌঁছুলো।
তাকে দেখে লোকটি ছেড়ে দিল নিজের আরও খানিকটা জমি, যদিও যেটুকু জমি অবিক্রিত বা অবন্টিত ছিল তার পাশে, যথেষ্ট ছিল মোরসালিনের জন্য। তবে সঙ্গে সঙ্গেই মোরসালিন সেখানে বসতে পারলো না, তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কোমরে গুজে রাখা একটি কাপড় বের করলো লোকটি, ধূলো-ময়লায় জর্জরিত বিছানাটা পরিপাটি করে দিল সময় নিয়ে। লোকটির গায়ে একটা স্কিনটাইট হলদে গেঞ্জি ছিল, নীচের অংশ ঢেকেছিল কালচে সবুজ লুঙ্গি দিয়ে। লোকটির গায়ে অন্য ইবাদতকারীদের মত কোন সুগন্ধি ছিল না। তার মুখটা যেন একটা মূর্তমান ব্রাশ, ধারালো তন্তুগুলোর সন্নিবেশ খুব সাজানো, লোমশ পেশীবহুল শরীরখানার অস্তিত্ব বুঝে নেয়া যায় বুকচিত্র দিয়ে।
সে কি তার আব্বুর কোন বন্ধু? মোরসালিন না চিনলেও সে তাকে চিনেছে? বাবা ব্যবসায়িক কারণে ঢাকার বাইরে -বড় হওয়ার এই সুযোগটা তার মনকে সকাল থেকেই অশান্ত করে রেখেছিল। ফিরনি খেয়ে বেরুনোর সময় ঠোটে লেগে থাকা পানিটা যখন আঁচল দিয়ে মুছে দিতে যাচ্ছিলেন রওশান আরা, তখন ভীষন আপত্তি করেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। যখন দৌড়ুতে দৌড়ুতে পারি দিচ্ছিল গোটা বিশেক বাড়ির দৈর্ঘ্যকে, তখন ভাবতে পারেনি যে, মসজিদের সঙ্গে সঙ্গে দেখা পেতে চলেছে একটি অদ্ভুত লোকেরও। লোকটি একটুও সুস্থির হচ্ছিল না, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিল এদিক ওদিক, পেছনের কাতারে কিছু জায়গা পড়ে ছিল, সে দাঁড়িয়ে থাকা আরো কিছু মানুষকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল। মোরসালিনের মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগের ভর্তি পরীক্ষার কথা, অচেনা স্কুলটি দেখে দূর থেকেই ভয় লাগছিল, বিশাল দালানটা এত উঁচুতে, সে শক্ত করে মায়ের হাত চেপে ধরেছিল, কিন্তু বিশাল লৌহদ্বারের মধ্য দিয়ে তাকে একাই ঢুকতে হল, শত শত মানুষকে প্রথমবারের মত দেখতে দেখতে তার চোখ ভারী হয়ে আসছিল, এরপর যখন সে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হতবিহবল হয়ে পড়েছিল, কোথা থেকে একজন অল্প উচ্চতার দাঁড়িগোফে পরিপূর্ণ মানুষ তাকে একটি বিরাট হলঘরে নিয়ে যেয়ে একটি আসনে বসিয়ে দিল। তাকে দেখেও প্রশ্নটা জেগেছিল মোরসালিনের মনে, লোকটা তার বাবার বন্ধু নয়তো?
প্রায় ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ টের পেল তার ডান দিকের জমি সরে যাচ্ছে …. তাকিয়ে দেখতে পেল একটি লোক প্রায় তার হাটুতে লাগিয়ে আরো একটু আয়েস করে বসেছে … ডানের লোকটির দাড়ি ও চুল প্রথম লোকটির মত পুরোটাই কালো ছিল না, কিন্তু সে অনেকটা বেশী বয়সী ও সাদা দেখতে ছিল, আপাদমস্তক সাদা আলখাল্লা দিয়ে ঢাকা গুহা থেকে শুধু বিদ্যুত ঝলকের মত মুখখানি দেখা যাচ্ছিল, হাত ও পায়ে মোজা থাকায় তাদের চোখে পড়ছিল না, তার হাত বাধাই করে ছিল দামি পাথরের তসবিহ দিয়ে, একটি সুদৃশ্য রুপালি বক্স তার সন্মুখেই উপবিষ্ট ছিল, তাতে আতর ও অন্যান্য সামগ্রী চিকচিক করছিল। এছাড়া খুশবুর ফোয়ারা ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছিল তার গোটা শরীর থেকে – কিন্তু পবিত্র সুন্দর ও সমাহিত এই পরিমন্ডল ভীষন সঙ্ঘর্ষ করছিল অবয়বের সাথে, চোখে-মুখে তার রাজ্যের বিরক্তি, কুচকানো মুখরেখাগুলো ক্ষণে ক্ষণে বাঁক বদল করছিল।
সে উস্কোখুস্কো চোখে বারবার ডানে বায়ে চাইছিল, মনে হচ্ছিল এক বদ্ধ আটোসাটো ঘরে তাকে ঠেসে রাখা হয়েছে… একটি পোকা জায়নামায দিয়ে যাচ্ছিল, সে পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করল, তারপর প্রায় এক টিপে পিষে মারল যতটুকু দরকার ছিল, তার থেকেও বেশি জোর খাটিয়ে, এরপর আর একটি টিস্যু দিয়ে প্রয়োজনের থেকেও বেশী সময় নিয়ে মুছে নিল জায়গাটা। শেষমেষ ব্যবহৃত টিস্যু দুটিকে চোখের সামনে থেকে দূর করে দিয়ে তার দুই পাশে, সামনে ও পিছনে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করলো চোখ থেকে নির্গত রশ্মি দিয়ে - এমন একটা সীমানা যা লংঘনের সাহস প্রদর্শন করতে দেখা গেল না সেই অস্থায়ী ডাঙ্গার শরীকদের মধ্য থেকে কাউকে।
নামাজ শেষ হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে তোমাদের.... আল্লাহর অনুগ্রহে জীবিকা অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে…আকাশ-বাতাস-অট্রালিকা সব কিছুকে বিদীর্ণ করে চলছিল বয়ান … বায়ের লোকটি থেকেও ডানের লোকটি বেশী অবাক করছিল মোরসালিনকে। একটি কুকুর বদলে যাওয়া দৃশ্যপটে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অতি সন্তর্পনে পথ চলছিল তাদের সামনে পড়ে থাকা রাস্তার বেঁচে যাওয়া কিনারা দিয়ে, হাবভাবে তাদের কাছে-ধারে আসতে চলেছে মনে না হলেও ডানের মুরব্বী তাকে ঢিল ছুড়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেন…প্রাণীটি এক লাফে কিছুটা সরে গিয়ে পরে দাঁড়িয়ে পড়ল আর টানা দুই মিনিট ধরে চেঁচাল রাস্তার পূর্বকোণে এক সবজি বিক্রেতার ভ্যানের পাশে অবস্থান গ্রহনের আগ পর্যন্ত। সাদা লোকটা এবার ছোট্র মেকাপবক্সটিকে তার জমিনের নিশানা করে ছুটল তরুণ তরকারিওয়ালার দিকে, যে এত গোয়ার প্রকৃতির ছিল যে জায়গাটা ছেড়ে দিতে বললেও ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুরব্বীর একটি হাত সজোরে উপরে উঠে গিয়েছিল, কিন্তু বাঁধ সাধলো প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়া একটি রিকশা…ভীষন ক্রদ্ধ হয়ে তোলা হাতটি ঘুরিয়ে ছোকরা রিকশাওয়ালার মুখে তাক করতেই থেমে গেল সে রিকশা আরোহীকে দেখে - একজন সিঁদুর পরা মধ্য বয়সী মা ও তার ফুটফুটে কন্যা, হাতে শপিং ব্যাগ।
রাগে ফুটতে ফুটতে লোকটি যখন নিজের জমিনে ফিরে এলো, মোরসালিন বাদিকে কুকরে গিয়ে তার জন্য আরো কিছু জায়গা বরাদ্দ করল। অল্প সময় পরে সুন্নাত নামায শুরু হতেই দেখা গেল, সিজদাহ দেয়ার জন্য লোকটি যথেষ্ট জায়গা পাচ্ছিল না, ফলতঃ দেয়াল আবারো একটু একটু করে সরছিল, আর মোরসালিনও একটু একটু করে সংকুচিত হচ্ছিল, তবে ভূমিচ্যুত হওয়ার আগে বামের সেই বিচিত্র লোকটি আটোসাটো হয়ে তাকে জায়গা করে দিল। কিছুক্ষণ পর মোরসালিনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কি মনে করে তাকে উঠতে বলল, জায়গাটা এবড়েথেবড়ো ছিল, রাস্তা ভেঙ্গে গর্তে রূপ নিয়েছিল ঐ অংশটুকু… হলদে গেঞ্জি পরা লোকটা দূর থেকে একটা ভাঙা ইট এনে সে জায়গাটায় গুঁজে দিল। কিন্তু তাও যখন তারা দুজন দাঁড়ালো নামাযের জন্য, তখন গায়ে গা লেগে যাচ্ছিল, সিজদার সময় মাথা ঠোকাঠুকি এড়াতে বিশেষ কসরৎ করতে হল তাদের।
সুন্নত শেষ করে মূল জামাতের জন্য অপেক্ষা করছিল মুসল্লিগন। মাইক বেয়ে গমগমে সুরে ইথারে ছড়িয়ে পড়ছিল খতিব মহোদয়ের খুৎবা। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে এল, একটা দমকা হাওয়া ধানক্ষেতের মত ডাঙ্গাটিকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে লাগলো - মোরসালিন আর বায়ের মানুষটি আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল, ফলে আরো কিছুটা শূন্য জায়গা বেরুলো, আর ডানের লোকটির গিরা সুড়সুড় করে চেপে বসল সেখানে। কিছুক্ষন পর ঝমঝম করে পড়তে শুরু করল বৃষ্টির ফোঁটা। উপস্থিত মুসল্লিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো এই অসময়ের বৃষ্টিতে, কেউ কেউ অবশ্য খুশী হল, রহমতের বৃষ্টি ভেবে নিয়ে ভেজাটাকে উপভোগ করতে চেষ্টা করলো। এরই মাঝে এক হাতে পাদুকা ও অন্য হাতে প্রসাধনি বাক্সটি নিয়ে ডানের সেই মুরব্বি মত লোকটাকে দেখা গেল উঠে দাঁড়িয়েছে জায়গা ছেড়ে, মুসল্লিদের সামনের জল কবলিত কাপড়ের বিছানায় পদচিহ্ন এঁকে দিতে দিতে সে এক সময় মসজিদের সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
আসমান ও জমিন যে সৃষ্টিকর্তারই অধিকারে তা মানুষ বিস্মৃত থাকে প্রায় পুরোটা সময় … প্রকম্পিত কন্ঠে বয়ান তখনো চলছিল… ঝড়-ঝঞ্জা কবলিত বাইরের রাস্তার তুলনায় ভেতরটা যেন স্বর্গ, অতিকায় সব পাথরের স্তম্ভ ধরে রাখা ছাদ্গুলো যেন হিমালয় উচ্চতায়, চারদিকে মোটিফ, ক্যালিওগ্রাফি, চোখ ও মন দুটোই শীতল হয়ে যায়। সুগন্ধী হাওয়ায় মাতোয়ারা চারপাশ। নীচতলাটা দুটো কক্ষে বিভক্ত, একটি কক্ষ কাচে ঘেরা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, এর একবারে শেষ মাথায় রহস্যদ্বারের নিভন্ত আলোর মাঝে থেকে দেখা যাচ্ছে ধবধবে সাদা আলোর রোশনাই। বাইরে মুসল্লিদের কষ্ট হচ্ছে, তাই ভেতরের মুসল্লিদের কাতার বাড়ানোর অনুরোধ রাখা হল সেখান থেকে, সবাইকে এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসার কাতর আহবান জানানো হল। কিন্তু মাইকের ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে গহবর থেকে উঠে আসা আরবি বাংলা মিশ্রিত ভাঙা ভাঙা কন্ঠের এই আর্তি বয়ানের সাথে এমনি মিশে ছিল যে সমবেত মানুষের কাছে এই ডাক আলাদা অনুরনন তুলতে হিমশীম খাচ্ছিল।
এক পর্যায়ে রাস্তার লোকদের কেউ কেউ শোরগোল তুললে ছাদের নিচের লোকেদের কেউ কেউ পেছন ফিরে তাকায়, সম্ভাব্য সঙ্ঘাত এড়াতে কেউ কেউ একটা করে পা এগিয়ে দিতে শুরু করে, পরে অন্যরাও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাদের অনুসরন করে, কিন্তু এতে করে লাইনগুলো ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে। রাস্তার সেই মুরব্বি হঠাৎ লক্ষ্য করে তার আর তিনটি সারি পরেই সেই কাচের ঘর…ভাঙ্গা লাইনের মধ্য দিয়ে মস্তক ও পদের বিপুল কসরৎ চালিয়ে শরীরকে এঁকেবেঁকে এক সময় সে পৌঁছে যায় সেই আরাধ্য বন্দরে… কিন্তু কাচঘরের লাইনগুলো তখন সেট হয়ে গেছে, মুরব্বির জন্য একটি আসনও খালি নেই, কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে চোখজোড়া একে একে সে ফেলতে থাকে প্রতিটি আসনের দিকে, হঠাৎ দুই কাতার সামনে ডান পার্শ্বে একটি আসনের দিকে তাকিয়ে উল্লসিত হয়ে উঠেন, এক খর্বকায় লোক একটু সামনে ঝুঁকে বসেছিলেন, ফলে পেছনে ইঞ্চি কতেক জমিন …… সামনের কাতারগুলি দ্রতু মাড়াতে থাকেন মুরব্বি ….।
সৃষ্টিকর্তা কি বলেননি যে তোমরা জমিনে লুকোনো খাদ্যসমূহ অন্বেষণ কর? … মাইক থেকে ভেজে আসছিল অস্পষ্ট স্বরে। এর মধ্যে একটি লোক সাথে করে আনা ছাতা সামনে রাখলে তা থেকে পড়া কয়েক ফোটা জল ফের মনোযোগ নষ্ট করে মুরব্বির, ভীষন বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে পরে সে, আর বসবে না বলে পণ করে। এদিকে বৃষ্টি আরো শক্তিশালি হয়, কাকভেজা হয়ে রাস্তার বাকী মুসল্লিরা ভেতরে ঢোকার জন্য হাঙ্গামা করতে থাকে, খাদেমের কাছ থেকে পরিস্থিতির গুরুত্ব অবহিত হয়ে সভাপতি মহোদয় নিজেই এবার হাতে তুলে নেন মাইক্রোফোন… আর একটি, আর এক বার, কাতার বাড়ানোর জন্য সমবেত নামাযীদের জন্য রাখেন উদাত্ত আহবান। ফলে আবার শুরু হয় বিশৃঙ্খলা…চলে কাতার ভাঙা, গড়া … এই সুযোগে সেই ধবধবে সাদা ফর্সা ঋজু দেহের মুরব্বি একবারে সামনের কাতারে নিজের জন্য এক চিলতে জায়গা পেয়ে যান…
পুস্তকেই তো বলা হয়েছে কেউ যদি অনাবাদী জমিন আবাদ করে, তার জন্য রয়েছে সওয়াব… এখন একদম মিম্বরের সামনেই রয়েছে সে…স্রষ্টার এত বড় জমিনে জায়গা পাওয়া বুঝি কি সবাইকে দিয়ে হয়? এর জন্য বুদ্ধি, ক্ষীপ্রতা, সজাগ দৃষ্টি দরকার হয় শক্তিমত্তার পাশাপাশি… বেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন মুরব্বি… জায়গাটা এত মধুর লাগে তার কাছে! খোশবুর রোশনাই মনে হয় এখান থেকেই ছেটানো হয়! পবিত্র এক শিহরনে তার দুচোখ বয়ে নিদ নেমে আসতে চায়!
অন্যদিনের থেকে বেশী নামায পড়লেন তিনি, কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে আছে শরীর-মন। বসা অবস্থাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনের মূল ফটকের দিকে চাইলেন। অন্যদিন এই সময়ের মধ্যে পুরো ময়দান ফাঁকা হয়ে যায়, কিন্তু আজ প্রচন্ড ভীড় দেখতে পেলেন মূল ফটকে… উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে উকি মেরে আৎকে উঠলেন- সামনের রাস্তা পুরো নদী হয়ে গেছে। এরপর অনেকক্ষন ধরে একটি বাহনের জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু এই ঘোর বর্ষনে রিকশা ভ্যান গাড়ি ঘোড়া কারো চিহ্নটা পর্যন্ত মিলল না। পরে নিরুপায় হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন জুতো খুলে নিয়ে। খুব বিমর্ষ হয়ে পায়ের নীচের নোংরা পানিগুলোকে দেখছিলেন, হঠাৎ আবিষ্কার করলেন অদূরেই হেটে চলেছে মোরসালিন ও ঐ রোমশ গোয়ার চাষা চামার শ্রেনীর ঐ লোকটা, পাশাপাশি, হাতে হাত ধরে।
চারদিক হিমশীতল আবহাওয়া…বৃষ্টিতে ধুয়ে রাস্তার দুই ধারের বাড়িঘরগুলো কুয়াশাপুরিতে রুপান্তরিত হয়েছে, হাতের কাছে থেকেও যেন অনেক দূরে তারা। কেমন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে মোরসালিনের, বাড়ি পৌছুনোর এক তীব্র তাড়া অনুভব করছে সে, ঐ তো মাত্র বিশটি বাড়ি পরেই তাদের বাড়ি, যেখানে তাদের স্থায়ী নিবাস, যেখানে তারা থাকবে চিরটা কাল, কেউ আনন্দে, কেউ দুঃখের অমানিষার মধ্যে! পরীক্ষা শেষে বাড়ির ফেরার মত তীব্র এক উত্তেজনায় টগবগ ফুটতে থাকে মোরসালিন।
..........
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।