এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • গদ্য সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে আশীষ লাহিড়ীর সঙ্গে খোলামেলা আড্ডাঃ পর্ব ১

    রূপক বর্ধন রায়
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৬৩৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
    ছবিঃ রূপক বর্ধন রায়

    এক অর্থে কবিতা অনুবাদের হয়তো কোনো মানে নেই…


    'ওয়াইট হাউজ'-এর একতলার প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁপাশে যেখানে সোফা, চেয়ার ইত্যাদি গোলচে করে সাজানো, যাঁর আরও বাঁপাশে দেওয়াল ঘেঁষে একটা বহুদিনের অব্যবহৃত লেখাপড়ার ফোল্ডিং টেবিল, সেখানেই বসে আড্ডাটা জমে গেল। সদ্য কাগজের মোড়ক খোলা চিকেন রোলে তারিয়ে তারিয়ে কামড় দিতে দিতে বলছিলেন তিনি; তিনি অর্থাৎ এই পোড়া দেশের পোড়া কালেও বিজ্ঞান ও যুক্তির পক্ষে 'অবিরত দ্বৈরথে' যাঁর মনন-চিন্তন-ভাবনার সপাট, নির্ভার ও সাবলীল নির্গমন, সেই আশীষ লাহিড়ী।

    রূপকঃ হ্যাঁ, আপনি কবিতা অনুবাদ প্রসঙ্গে বলছিলেন।

    আশীষঃ (রোলে আরাও একটা কামড় পড়ে!) প্রথমত, কবিতা ব্যাপারটাই, মানে সেই রবীন্দ্রনাথের কথায়, ফুলের গন্ধের মত। ব্যাপারটা কী ইউ ক্যানট ডিফাইন। মানে এই অস্পষ্টতাটাই কবিতার বৈশিষ্ট্য। আমি যেমন কবিতা একেবারে লিখতে পারি না। একসময় রবীন্দ্রনাথের কিছু গান বা কবিতা অনুবাদের চেষ্টা করেছি। আমার ভাই সৌমিত্রও করতো, আমারা একে অপরের সঙ্গে মেলাতাম; কিন্তু আমি দেখেছি যে আমার হাতে সেটা প্যারাফ্রেজিং হয়ে যাচ্ছে। মানে সেটা পড়ে মূল কবিতার অর্থটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু দ্যাট ইজ নট দি পোয়েম। কাজেই কবিতার ক্ষেত্রে ওই যে এক্সট্রা মাত্রাটা, সেটা শুধু তার লজিক নয়, শুধু তার শব্দ নয়, অথবা সবকিছু মিলিয়ে, ধরো তার ধ্বনি, মানে এই সবকিছু মিলিয়ে যে বাড়তি ব্যাপার, আমার মনে হয় অনুবাদে সেটা সম্ভবই না। তাহলে কি বলবে কবিতা অনুবাদের কোনো মানে নেই? এক অর্থে হয়তো নেই! রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার প্রমাণ। কোনো কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ইংরেজি গীতাঞ্জলি বেশ ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই! কিন্তু যারা গীতাঞ্জলিকে বাংলা-গীতাঞ্জলি হিসেবে পড়েছে তারা সেই রসটা খুঁজে পাবে না। অর্থাৎ যে লোক বাংলা জানে না তার কাছে কিন্তু ওটার মূল্য আছে এবং সেখানেই আমি বলবো কবিতা অনুবাদের সার্থকতা; যেটা বুদ্ধদেব বসুও পয়েন্ট আউট করেছিলেন।

    রূপকঃ বুঝতে পারছি।

    আশীষঃ কাজেই অনুবাদ করতে গেলে তোমাকে কিছু স্বাধীনতা নিতেই হবে, কিন্তু তা ভাবের দিক থেকে নয়। এমনকি গদ্য রচনাতেও! আমি নিজে তো গাদা গাদা অনুবাদ করি, সেক্ষেত্রে লাইন ধরে অনুবাদ না করে প্যারাগ্রাফ ধরে অনুবাদ করায় আমি সব থেকে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি।

    রূপকঃ আরেকটু খুলে বলবেন? বুঝতে সুবিধা হয়।

    আশীষঃ অর্থাৎ, ইংরেজি ও বাংলা, এই দুই ভাষার চলনের তো একটা অদ্ভুত তফাৎ আছে?

    রূপকঃ তাতো আছেই!

    আশীষঃ এইযে ইংরেজিতে নানান রকম ক্লজ দিয়ে লম্বা লম্বা সেন্টেন্স, তুমি বাংলায় অনুবাদের সময় স্বচ্ছন্দভাবে সেই ধারাবাহিকতাটা বজায় রাখতে পারবে না। বাংলায় করতে গেলেই একটা আড়ষ্টতা এসে পড়ে। কাজেই বাক্যগুলোকে তোমায় ভাঙতে হবে। এখন বাক্যগুলোকে ভাঙলে আবার যুক্তির যে পরম্পরাটা, যেভাবে একটা বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে, সেটা ইংরেজিতে বা অন্য ভাষায় ঠিক যেভাবে আছে বাংলায় রক্ষা করা যায় না। সুতরাং তুমি যদি একটা গোটা পরিচ্ছেদে কী বলা হয়েছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের বলার ধরনটা, মানে উনি কি খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে বলছেন নাকি হাইলি এ্যাকাডেমিক ভঙ্গিতে বলছেন, আড্ডার ভঙ্গিতে নাকি কথোপকথনের ভঙ্গিতে, সেই স্টাইলটা ধরে নিতে পারো এবং সেই এন্টায়ার প্যারাগ্রাফের বক্তব্যটা তুমি যদি গুছিয়ে মাথায় নিতে পারো, সেক্ষেত্রে বাক্যের অর্ডারটা না মানলেও দেখবে খারাপ দাঁড়াচ্ছে না। মানে অনেক সময় অনুবাদের ফাইনাল ফর্মে দেখা যাবে যে প্রথম বাক্যটা হয়তো একেবারে শেষে আছে, আর তাতেই জিনিসটা 'বাংলা' দাঁড়িয়েছে!

    রূপকঃ বেশ পরিষ্কার হল, একদম! কিন্তু সেক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা দাঁড়ালো সেটাকে আপনি অনুবাদ বলবেন না অনুসরণ বলবেন?

    আশীষঃ না না এক্ষেত্রে আমি তাকে অনুবাদই বলবো। ওই নির্দিষ্ট ভাবনাটাকে ধরে যদি আমি নতুন একটা কিছু সৃষ্টি করি তখন তাকে অনুসরণ বলা যেতে পারে। মানে ধরো ভাবনাটা রইলো, এবং তাকে ধরে আমি নতুন কিছু করলাম তখন তাকে আমি অনুসৃষ্টি বলবো। কিন্তু ট্রান্সলেশান বলতে ওইটেই।

    তাছাড়া আরেকটা কথা খুব শুনি, মূলানুবাদ ও ভাবানুবাদ! মানে লিটরাল ট্রান্সলেশান আর অন্যদিকে ধরো আইডিয়াটাকে ট্রান্সলেট করা। আমি, সত্যি কথা বলতে এর কোনো মানে বুঝি না! লিটরাল ট্রান্সলেশান হয়? খুব সিম্পল একটা উদাহরণ ধরো যে, “হি হ্যাঁজ কিকড দা বাকেট লাস্ট মানডে”- এবার যখন তুমি বলছ যে “বিগত সোমবার তার মৃত্যু হয়েছে”, এটা কি অনুবাদ হল? (হাসি) সেক্ষেত্রে “হি ডায়েড” বা “হি পাসড আওয়ে” হলে হত। কিন্তু 'কিকড দা বাকেটের ক্ষেত্রে”, “সে শিঙা ফুঁকেছে” বা ”সে পটল তুলেছে” ধরনের কিছু বললে ঠিক হবে, এবং সেটা ভাবানুবাদই হবে! আবার অন্যদিকে এটা লিটরাল অনুবাদও কারণ 'কিকিং দা বাকেটের' বাংলা কিন্তু মরে যাওয়া নয়, 'পটল তোলা' বা 'শিঙে ফোঁকা'।
    এই কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়লো। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী ছিলেন লীলা রায়…

    রূপকঃ হ্যাঁ

    আশীষঃ একটু একটু আমেরিকান এ্যাকসেন্টে বাংলা বলতেন, খুব সুন্দর লাগতো শুনতে। তো বহু আগে, মানে ধরো প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর আগে টিভিতে উনি ওনারই একটা অনুবাদের কাজ নিয়ে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় একটা কনসেপ্ট আনলেন, পরে অবশ্য দেখেছি আরো অনেকেই এই ধরনের কথা বলেছেন, যে লুক ফর “কালচারাল ইকুইভ্যালেন্ট” নট দি ওয়ার্ড ইকুইভ্যালেন্ট! এই কিকিং দা বাকেটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একইরকম।

    রূপকঃ স্ল্যাং-এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা বোধহয় তাই?

    আশীষঃ একদম! এটাও তো অলমোস্ট স্ল্যাং-ই! নট কোয়াইট, বাট অলমোস্ট! কাজেই তুমি যে ধরনের গদ্যই অনুবাদ করো, তোমার টারগেট থাকবে তুমি কত বেশি কালচারাল ইকুইভ্যালেন্স এ্যাপ্লাই করতে পারছ।

    রূপকঃ কিন্তু এই পদ্ধতি কি সবক্ষেত্রে খাটে?

    আশীষঃ না খাটে না তো! আমার মনে আছে লীলা রায় ওই একই ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, যেটা আমি খুব ফলো করি, যে, "ধরা যাক আপনি একটা প্যারাগ্রাফ অনুবাদ করছেন যাঁর মধ্যে এমন কতগুলো লিটারারি এ্যালিউশানস আছে যেগুলো ইংরেজিতে অদ্ভুতভাবে খাপ খেয়ে যায়, কিন্তু সেগুলোর আপনি সরাসরি বাংলা করতে গেলে মিলবে না…"

    রূপকঃ এই মুহূর্তে মাথায় কোনো উদাহরণ আসছে?

    আশীষঃ কথা বলতে বলতে হয়তো এসে যাবে, দেখি! তো, সেখানে উনি প্রিন্সিপল অফ সাপ্লিমেন্টেশানের' কনসেপ্ট আনছেন। যেমন ধরা যাক, একটা খুব সহজ উদাহরণ, যদিও এত সিম্পল সাধারণত হয় না, 'আই থিনক দেয়ারফোর আই এ্যাম'। সাদা বাংলায় যেটা দাঁড়ায় তা হল 'আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি'; তাতে কিন্তু কোনো ভুল নেই। কিন্তু এই অনুবাদে দেকার্তের কথাটার জোরটা কি ধরা গেল? লীলা রায় আরো কিছু কবিতার লাইন টেনেও বুঝিয়েছিলেন যে ওইরকম এগজ্যাক্ট এসেন্সটা সবসময় ধরা যায় না। সব জিনিস হয় না, ইউ হ্যাঁভ টু এ্যাক্সেপ্ট! তোমার মাথায় রইলো যে ওই তিন নম্বর বাক্যে যেটা ছিল সেটা কিন্তু তুমি পারনি।

    এবারে ঠিক উলটোটা। পাঁচ নম্বর বাক্যের একটা খুব গদ্যময় এক্সপ্রেশান দেখে তোমার মনে হল যে সেটার একটা চমৎকার সাহিত্যিক এ্যালিউশান বাংলায় পেয়ে যাচ্ছ। ব্যাস তুমি ঝট করে ওটা বসিয়ে দিলে! ফলত কি দাঁড়ালো? গোটা প্যারাগ্রাফের ভাবটা তো প্রকাশ পেলই আর তার সঙ্গে ওর মধ্যে যে সাহিত্যিক গুণ বা উইটটা ছিল, যেটা তুমি তিন নম্বর বাক্যে মিস করে গিয়েছিলে, পাঁচ নম্বর বাক্যে সেই মেজাজটাকে তুমি ধরোতে পারলে। এটাকেই লীলা রায় প্রিন্সিপল অফ ইকুইভ্যালেন্স' বলছেন!

    রূপকঃ প্রিন্সিপল অফ কালচারাল ইকুইভ্যালেন্স?

    আশীষঃ হ্যাঁ।
    দাঁড়াও, এই এতক্ষণে একটা উদাহরণ মনে পড়লো। আমরা যখন 'প্রস্তুতিপর্ব' কাগজ বের করতাম, ইমার্জেন্সির সময়, গৌরীদা (গৌরীপ্রসাদ ঘোষ) নকশাল আন্দোলনের ফেইলিওর নিয়ে বেশ বড় একটা লেখা লিখেছিলেন। A4 সাইজের তিরিশ পাতা, ইংরেজিতে! সেটা আমি বাংলা করি। তো তার মধ্যে উনি বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা প্রসঙ্গ আনছেন, এনে বলছেন যে এরা না-ঘরকা-না-ঘাটকা, আর কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেই চরিত্র খুব বেশি করে প্রকাশিত হয়েছে! এই ধরনের আরো কিছু কথাবার্তা বলে উনি একটা এক্সপ্রেশান ব্যবহার করেছিলেন যে, “দা বেঙ্গলি মিডল ক্লাস ইজ লাইক দা মিথিকাল ইউনিকর্ণ”। (হাসি)

    তো সেই লেখাটা অনুবাদ করতে গিয়ে আমি ইউনিকর্নের জায়গায় সুকুমার রায়ের 'হাঁসজারু' ব্যবহার করেছিলাম। সেটা গৌরীদার এত ভালো লেগেছিল কি বলবো! উনি জানতে চাইলেন এটা তোর মাথায় এলো কিভাবে? আমি বললাম আপনি তো বলতে চাইছেন এটাও হয় ওটাও হয়,মানে ঘোড়াও হয়…

    রূপকঃ গরুও হয়?

    আশীষঃ (হাসি) সেই, শিংটা আছে, ঠিকই! তো আমি তো তখন এর প্রিন্সিপলটা জানতাম না, করেছিলাম এইভাবে। পরে লীলা রায়ের কথায় বুঝেছি, দিস ইজ কালচারাল ইকুইভ্যালেন্স!
    আসলে অনুবাদ বলতে আমি যেটা মানি তা হল, মূল লেখকের মেজাজটা ঠিক মত ধরা গেল কিনা!

    রূপকঃ বেশ, বুঝলাম। গদ্য অনুবাদের উপায় আর মেজাজটা ধরা গেল। এবার একটা রিলেটেড কিন্তু অন্য আঙ্গিকের প্রশ্ন করি। আপনি একটু আগে একই সময় নিয়ে লেখা ইতিহাস কেন্দ্রিক দুটো বইয়ের কথা বলছিলেন…

    আশীষঃ হ্যাঁ একটা রামচন্দ্র গুহর “ইণ্ডিয়া আফটার গান্ধী”, আর অন্যটা বিপন চন্দ্রের “ইণ্ডিয়া আফটার ইন্ডিপেন্ডেন্স”- ওই দুটোই আমি অনুবাদ করেছিলাম। কিন্তু দুটোর মেজাজ এক্কেবারে আলাদা। বিপনবাবু বিরাট পণ্ডিত মানুষ, তাই ওনার লেখা স্বভাবতই এ্যাকাডেমিক। অন্যদিকে রামচন্দ্র সেই গুরুগম্ভীর কথাগুলোকেই সহজ করে গল্পের ঢঙে সবার জন্য বলছেন। আমার মনে আছে এ-দুটোর ক্ষেত্রে আমি সম্পূর্ণ দুটো ভাষাভঙ্গি এ্যডপ্ট করতে পেরেছিলাম।

    রূপকঃ হ্যাঁ এগজ্যাক্টলি। আমি এই দুটো বইয়ের কথাই বলছি। এক্ষেত্রে এই দুটোকে বা এই দুটোর মধ্যে একটাকেও কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং বা সৃজন সাহিত্যের ব্র‍্যাকেটে ফেলবেন?

    আশীষঃ না, দেখো এই দুটোর কোনোটাই ক্রিয়েটিভ রাইটিং নয়। এ-দুটো হিস্টরি রাইটিং, আর তুমি তো ইতিহাস 'ক্রিয়েট' করতে পারবে না?

    রূপকঃ কিন্তু দুটো বইই তো দুটো আলাদা এ্যপ্রাচ থেকে গল্প বলছে, আর গল্প বলা সৃজন-সাহিত্য তো বটেই!

    আশীষঃ (খানিকক্ষণ ভাবলেন)… হ্যাঁ সে অর্থে তুমি বলতে পারো বটে। কারণ এইযে ক্রিয়েটিভিটি, রামচন্দ্র গুহর বইটার কিছু কিছু জায়গায় তুমি তার নিদর্শন পাবে।

    রূপকঃ দু একটা উদাহরণ মনে পড়ছে?

    আশীষঃ হ্যাঁ, যেমন ধরো স্বাধীনতার পর যে সময়টায় এদিক থেকে পাকিস্তানের দিকে বহু মানুষ চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন…উনি কিন্তু এপারের থেকেও ওপারের গল্পটা আরো বিস্তারে ধরেছিলেন…

    মানে ধরো ধুলো উড়ছে এবং তার মধ্যে দিয়ে মানুষ এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে আর ওপার থেকে এপারে আসছে। এরপর ধুলো যখন থিতিয়ে এলো তখন কতশত ধর্ষিতা রমণী, শিশু, মলমূত্র, মৃতদেহের গন্ধের মাঝে পুলিশের বুটের শব্দ ছাপিয়ে প্রবল একটা আর্তনাদ উঠলো যে, “কেন?”… ওনার বিবরণ পড়ে সত্যি সত্যিই আই ওয়েপ্ট! এর চেয়ে আসল লেখাটা আরাও অনেক বেশি পোয়েটিক, আমি তো শুধুমাত্র এসেন্সটা তোমায় বোঝাতে চেষ্টা করলাম।

    রূপকঃ বুঝতে পেরেছি…

    আশীষঃ দেখ এটা তো উনি ইতিহাসই লিখছেন, ইট বর্ডার্স অন ক্রিয়েটিভ লিটারেচার, বাট ইট স্টিল ইজ নট ক্রিয়েটিভ রাইটিং আফটার অল। কারণ আনলাইক উপন্যাস উনি যত কাব্যই করুন, ঠিক কতজন মানুষ এপার থেকে ওপারে গিয়েছিল বা মারা গিয়েছিল সেই হিসাবের মধ্যে থেকেই ওনাকে কাজটা করতে হবে! কাজেই এই 'এগজ্যাক্টিচুড' যেখানে এসে যাচ্ছে সেখানে সৃজনশীলতার থেকেও তথ্যের প্রাধান্য বেশি বলেই আমার অন্তত মনে হয়।

    রূপকঃ বেশ, তাহলে এখনও পর্যন্ত যা বেরিয়ে এলো তা হল ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে আমরা সৃজনশীলতার আঙিনায় অল্পবিস্তর ঘোরাঘুরি করে এলেও, ইট রিমেইনজ এ্যাজ দি লিটেরেচার অফ নলেজ! তাইতো?

    আশীষঃ হ্যাঁ।

    রূপকঃ বেশ, এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির কথায় আসি এবার। বিজ্ঞানও তো লিটেরেচার অফ নলেজ। কাজেই আপনার কথায় “বর্ডারিং অন ক্রিয়েটিভিটি” হলেও তা ঠিক ক্রিয়েটিভ লিটারেচার নয়। সেক্ষেত্রে অধ্যাপক সি পি স্নো-র “দা টু কালচারস”-এর সমস্যাটা বিকামজ এভিডেন্ট! তাহলে আর বাংলা ভাষায় বা জনসাধারণের জন্য বিজ্ঞান লেখালেখি নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগ করবো কেন?

    আশীষঃ দেখো বিজ্ঞান-সাহিত্য অনুবাদ নিয়ে দুটো কথা বলার আছে।
    প্রথমত একটা সায়েন্টিফিক জার্নাল থেকে কোনো প্রবন্ধ অনুবাদ করলে ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। কারণ সেখানে তথ্য আর যুক্তি ছাড়া কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।

    রূপকঃ ঠিক।

    আশীষঃ কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ক বইতে, মানে তুমি স্নোয়ের বইটাই ধরোতে পারো, যেখানে রাজনীতি আসছে, সমাজ আসছে, ইতিহাস আসছে সেখানে কিন্তু ওই প্রিন্সিপল অফ ইকুইভ্যালেন্স' প্রয়োগ করার অনেক সুযোগ থাকছে। আরেকটা উদাহরণ দি, সেটা আমার জীবনের প্রথম অনুবাদের কাজ।
    ছোটো বেলায় আমার খুব প্রিয় একটা বই ছিল জ্যাক লন্ডনের “ওয়াইট ফ্যাং”। আমাদের সময় ক্লাসিক্স ইলাস্ট্রেটেড বলে কিছু বই পাওয়া যেত…

    রূপকঃ লেডি বার্ডের কিছু আমার কাছেও ছিল। থ্রি লিটল পিগজ, এলভজ এ্যাণ্ড দা শু মেকার, দা বিগ প্যান কেক,… স্কুলে প্রাইজ পেতাম…

    আশীষঃ (হাসি) হ্যাঁ কমিকজ নয়, খুব সুন্দর! বাবা আমায় কিনে দিয়েছিল। সেখান থেকে পড়ার অনেক পরে যখন অরিজিনালটা পড়লাম তখন আমার মাথায় ঘুরতে শুরু করলো যে, "এটা আমি বাংলা করবো!" তা, যখন কথাশিল্পে (কলেজ স্ট্রীটে) আমরা আড্ডা মারি, মন্টুদা তখন তার মালিক, খুব সজ্জন লোক, আমায় বললেন আশীষ অনুবাদ করবি? আমি বললাম যদি করতে হয় এইটা করবো! তো সেই কাজটা করতে গিয়ে তুমি যে ক্রিয়েটিভ প্রসেসটার কথা বলছ সেটা করার জায়গা পেয়েছিলাম। বইটা পড়ে থাকলে জানবে যে, ওয়াইট ফ্যাং যে কিনা আসলে একটা নেকড়ের বাচ্চা, তাকে পোষ মানানোর গল্পটা রোমহর্ষক। এক্কেবারে শেষে যখন সে পোষ মানছে, মানে মনিবের (স্কট) কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে সেই জায়গাটা বোঝাতে গিয়ে জ্যাক লন্ডন বাইবেল থেকে কোট করছেন যে “দাই উইল বি ডান!” এখন এর বাংলা আমি কি করবো? (হাসি)

    আমি তো স্কটিশ স্কুলে পড়েছি। স্কুলে থাকতে আমাদের প্রতিদিন সকালে হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতঃ ইত্যাদি আওড়াতে হত, কিন্তু ওই দিয়ে কিছু হওয়ার নয়! তখন মাথায় এলো আর আমি রবীন্দ্রনাথকে কোট করলাম, 'তোমারি ইচ্ছা করহে পূর্ণ আমারও জীবনও মাঝে!' মন্টুদা দেখে বললেন, “অপূর্ব হয়েছে, কিন্তু তুই একটা জিনিস কি ভেবে দেখেছিস যে ছিদ্র সন্ধানীরা কি বলবে? বলবে কুকুরের মুখে রবীন্দ্রনাথের গান!” আমি বললাম, “তা যদি হয়, তাহলে ওনারা খালি ছিদ্রই খুঁজে বেড়ান, কাব্য সাহিত্য কিছু বোঝেন না। আসল গল্পে ওর মুখে তো বাইবেল বসিয়েছে!” (হাসি)

    এই গোটা অনুবাদের কাজটা খানিকটা ক্রিয়েটিভ লিটারেচার হয়েছিল। সেই আলাস্কা অঞ্চলের ভয়ংকর রুক্ষতা, তার বাংলাটাও কোথাও কোথাও গদ্য কবিতা হয়ে উঠেছিল। ওনার 'কল অফ দি ওয়াইল্ড'টা আরো ভালো, ওটাই বোধহয় ওঁর বেস্ট কাজ! আমি তো সংস্কৃত জানি না, তো রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কারো লেখায় কালিদাসের ব্যাপারে পড়েছিলাম যে উনি বরফের ভয়ঙ্কর রুক্ষতাকে শিবের অট্টহাসির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যেন নিঃশব্দ অট্টহাসি! জ্যাক লন্ডন তো আর কালিদাস পড়েননি, তবে আলাস্কার বিবরণে উনিও ঠিক ওইরকমই উপমা টেনেছেন! যেন রুক্ষ অট্টহাসি! কাজেই এখানটার বাংলা করতে গেলে একটা ক্রিয়েটিভিটির এলিমেন্ট আসবেই! রবীন্দ্রনাথ যেটাকে কবিতার গন্ধ বলেছেন, ক্রিয়েটিভ অনুবাদ বলতে আমি এইটাই বুঝি। যদি পারো তো ওই গন্ধটাকে নিজের মত করে রিপ্রোডিউস করো।
    সে কারণেই আমি কবিতা অনুবাদের দিকে যাই না! (হাসি)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • আলোচনা | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৬৩৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হ্যাঁজ,হ্যাঁভ | 117.194.***.*** | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:১৬516481
  • এগুলো একটু ঠিক করে দিন। 
  • Ranjan Roy | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:১০516487
  •  অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়ছি। আশীষ লাহিড়ীর প্রবন্ধের আমি ফ্যান। 
  • প্রতিভা | 115.96.***.*** | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:২৪516497
  • অসাধারণ একটি সাক্ষাৎকার। শুধু আড্ডার মেজাজ ধরে রাখবার জন্যই নয়, গদ্যানুবাদের একটি দিশা দেবার জন্যও।
    টাইপোগুলো ঠিক করে দিলে ভালো হয়। লীলা রায় দেখলাম লীলক রায় হয়েছেন।
  • sch | 115.187.***.*** | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:১৫516614
  • পর্ব ২ - ??
    সম্প্রতি ইয়োকো ওগাওয়ার "অঙ্কের জগৎ ও অধ্যাপকের প্রেম" পড়তে গিয়ে অনেক বার মনে হয়েছে এই কথা - কালচারাল ইকুইভ্যালেন্স। কিন্তু যখন একটা দেশের কথা বলছে মূল লেখায় তখন কি সেটা ঠিক?
  • শুভময় দত্ত। | 2409:4060:392:7b1e::1b51:***:*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৯:০৫516998
  • খুব ভালো লাগলো। আশীষবাবুর প্রতিটি কথা ভালোভাবে বুঝলে অনেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন