সিদ্ধার্থ যদি দুহাজার বছর আগে না জন্মে এই দুর্মর পলিটিকাল-কারেক্টনেসের যুগে জন্মাতেন, সুজাতার হাতে পায়সান্ন খেয়ে তাঁর আর বুদ্ধদেব হওয়া হতনা। বদলে হাজতে বসে পুলিশের পিটুনি আর মোটা চালের ভাত খেতেন। বৌদ্ধধর্ম লাটে উঠে যেত, নির্বাণ লাভ আরও কয়েক জন্ম পিছিয়ে যেত, কারণ মাথায় যা মামলা চাপত, তাতে মিনিমাম ১৪ বছর জেল। একে তো নাবালিকা সুজাতাকে ফুসলানোর অপরাধে শ্লীলতাহানির কেস। তারপর "বিয়ে করে বৌ-ছেলেকে ফেলে পালিয়েছিস?" বলে প্রতারণার চার্জ । রিগ্রেসিভ-প্রগ্রেসিভ চুলচেরা বিশ্লেষণে অভ্যস্ত সমবেত ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়ায় হাঁ করে কেসের ধারাবিবরণী গিলতেন, তারপর "বেশ হয়েছে, আর পালাবি?" বলে হাততালি মারতেন। সুজাতার পক্ষে অবশ্য কেউ-কেউ দাঁড়াতেন। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একটি মহিলাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বলে। কিন্তু যশোধরার পক্ষে থাকত সুস্পষ্ট জনমত। ব্যাটা সিদ্ধার্থ, বিয়ে করেছে, একটা দায়িত্ব নেই? খোরপোশ না দিয়ে সন্ন্যাসী? ইয়ার্কি নাকি?
সিদ্ধার্থ অবশ্য রাজমিস্ত্রী ছিলেননা, অন্যের বৌ নিয়েও পালাননি। এই এক বাঁচোয়া, কিন্তু কথাটা হচ্ছে, পরকীয়া করলেই কি মানুষের অধিকার উল্টে যায় নাকি? বা রাজমিস্ত্রী হলে? দুইজন গৃহবধূ, তাঁরা স্বইচ্ছায় দুইটি পুরুষের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিলেন। বলে-কয়ে যাননি। ফলে বাড়ির লোক পুলিশে খবর দেয়। পুলিশও অত্যধিক তৎপরতায় তাঁদের খুঁজে বার করে ফেলে দুই রাজমিস্ত্রীর সঙ্গে। সে খুবই ভালো কাজ, নিখোঁজ লোকের সন্ধান তো করতেই হবে। কিন্তু তারপর? খবরের কাগজের প্রতিবেদন বলছে, 'পলাতক'দের পাকড়াতে যেতেই এক পলাতকা পুলিশকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, "আমি ***কে ভালবাসি। আপনাদের কে মাথা ঘামাতে বলেছে?" সত্যি কথা বলতে কী, এরপর আর পুলিশের বা মিডিয়ার কিছু করণীয় থাকার কথা নয়। "আপনাদের ঘরোয়া ব্যাপার আপনারা বুঝে নিন" বলা ছাড়া। বাড়িতে না বলে পালানো নিশ্চয়ই অনুচিত কাজ। তাতে বাড়ির লোক নিশ্চয়ই রাগ করবে। রাগারাগি, ঝগড়াঝাঁটি, যা খুশি, একশবার করবে। পরকীয়া করলে, স্বামী ইচ্ছে হলে, ডিভোর্স দেবে। ইচ্ছে না হলে দেবেনা। তাতে দোষের কিচ্ছু নেই। কিন্তু কথা হল, এর কোনোটাই আইনী অপরাধ নয়। কাজেই পুলিশ বা জনতার মাথা গলানোরই অধিকার নেই। আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী যেমন রোজ মধ্যরাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলে আপনি একশবার রেগে তার পিন্ডি চটকে দিতে পারেন, কিন্তু পুলিশ এসে "অ্যাই মাঝরাতে বাড়ি ফিরিস কেন?" বলে হাজতে পুরে দিতে পারেনা, এও সেরকমই। কিন্তু সে বললে হবে? সমাজটাকে তো দেখতে হবে। তাই পুলিশ ক্ষান্ত তো দেয়ইনি। বরং বৌদের ধরে পাঠিয়ে দিয়েছে বাপের-বাড়ি। সন্তানকে পাঠিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। এবং রাজমিস্ত্রীদের পাঠিয়েছে হাজতে। একদম একবিংশ শতকের উপযুক্ত আচরণ যাকে বলে।
এর থেকে যা বোঝা যায়, তা অতি সহজ।
১। কোনো বিবাহিত মহিলা পরকীয়া করলে, সেটা পুলিশি মামলা। মহিলা প্রেম-পরকীয়া করতে পারবেন কিনা, কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে থাকবেন, এসব ঠিক করবে পুলিশ এবং মিডিয়া। মহিলার কোনো স্ব-ইচ্ছা থাকার প্রশ্নই নেই।
২। কোনো পুরুষ যদি বিবাহিত মহিলার সঙ্গে জড়ায়, তাহলে সেটা একদম নিঃসন্দেহে পুরুষের দোষ। প্রেম দ্বিপাক্ষিক, কিন্তু দায়, ও দায়িত্ব পুরুষের। দায়ভোগে নানারকম অভিযোগে হাজত ও জেলবাস অনিবার্য। বিশ্বাস না হলে, পেনাল কোডে অ্যাডাল্টারি নিয়ে কী লেখা আছে, পড়ে নিন।
৩। পুরুষ যদি ভদ্রলোক হন তো তাও কিছু ছাড় আছে। রিক্সাওয়ালা বা রাজমিস্ত্রী হলে, একদম রক্ষে নেই। তখন দায়িত্ববান ও প্রগতিশীল মিডিয়ার একমাত্র কাজ হল এই পেশাপরিচয়ে বিশেষ জোর দিয়ে সেনসেশনালাইজ করে ছিছিক্কারকে গোটা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। পুলিশ অন্যক্ষেত্রে যদি বা ঘুমোতো, এই ছিছিক্কারের পর তার আর বসে থাকার উপায় যেন না থাকে।
৪। এতে করে মহিলা বা পুরুষ, বা তাঁদের পরিবার কারও উপকার হবে, ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রেমিক থাকবে হাজতে, মহিলার সঙ্গে তাঁর স্বামীর বিচ্ছেদ হওয়াই স্বাভাবিক, 'রাজমিস্ত্রী'র সঙ্গে সম্পর্ক জানাজানি হবার পর 'ভদ্রসমাজ'এ মুখই দেখাবেন কীকরে তাঁরা। মহিলা পরগাছা হয়ে বাপের বাড়িতে জীবন কাটাবেন, আর প্রেমিক জেলে ঘানি টানবে। এতে করে মিডিয়ার হিট বাড়া ছাড়া আর কারো উপকার হবেনা। সেটা বড় কথাও নয়। বড় কথা হল সামাজিক অনুশাসন রক্ষা।
৫। মিডিয়াবাজরা এরপরে আবার নানা বাতেলা দেবেন। সেলিব্রিটিদের পরকীয়ার গসিপ সেলিব্রেট করবেন। এই 'স্টোরি' ভুলে যাওয়া যাবে। এই নিয়ে প্রশ্ন করলে বলবেন, "লোকে চাইছে তাই খবর করছি"। লোকে যে রাজমিস্ত্রী ও গৃহবধূর খবর, মিডিয়ায় না বেরোলে জানতই না, "ওগো একটু গৃহবধূ-রাজমিস্ত্রীর গপ্পো বলো" বলে কাউকে সাধেনি, স্ব-ইচ্ছায়, সেনসেশনালাইজ করার জন্য এগুলো বার করা হয়েছে, এ কথা তখন ভুলে যাওয়াই দস্তুর।
তো, একবিংশ শতকে প্রথা এরকমই। এই কেস ঠিক একটা কেস নয়। নতুন ধর্ষণ আইনের এক বছর পুর্তিতে দিল্লির জেলগুলির সমস্ত ধর্ষণ সংক্রান্ত কেস খুঁটিয়ে দেখেছিলেন হিন্দুর এক সাংবাদিক। দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন, প্রায় অর্ধেক কেসই এরকম। প্রায় কার্বন কপি। পুরুষের হাত ধরে পালিয়েছে একটি মেয়ে। বাড়ির অভিযোগে তাদের ধরে এনেছে পুলিশ। মেয়েটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর ধর্ষণের কেস দিয়ে ছেলেটিকে পাঠিয়েছে জেলে। মেয়েটি বাড়ি ফেরার পর তার 'অনার কিলিং' হয়েছে কিনা, সেটা প্রতিবেদনে ছিলনা। তো যাই হোক, যা দেখা গেছে, এবং যাচ্ছে, যে, 'কড়া আইন' খুব স্পষ্ট করেই অধিক এবং অধিকতর ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দুর্বলতম 'রাজমিস্ত্রী'দের উপর। লিঙ্গপরিচয়ে তাঁরা পুরুষ। মহিলাদের উপর খুব সুবিচার হচ্ছে তাও না। তবে তাঁরা জেলের ভাতটা খাচ্ছেননা। খাচ্ছে পুরুষ সঙ্গী। এবং, অবশ্যই, কড়া আইনের শাসনে মহিলাদের এমপাওয়ারমেন্টও গোল্লায়। এই নিয়ে কোনো আলোচনা অবশ্য চোখে পড়েনা। কারণ পলিটিকাল-কারেক্টনেস অধ্যুষিত এই প্রগতিশীল উপত্যকায়, ওসব সিলেবাসের বাইরে রাখাটাই রীতি। একবিংশ শতকের দস্তুর এরকমই।
*** নাম-ধাম গোপন রাখলাম। এর আর কোনো মানে নেই। কিন্তু ঔচিত্যের উল্লেখটুকু থাক।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।