কান্দাহারে আমেরিকান পতাকা ওড়ে ১৮ই ডিসেম্বর। ২০০১ সালে। ৯-১১র মাসখানেকের মধ্যে। যে সে পতাকা নয়, যে পতাকাটি তোলা হয়, তা গ্রাউন্ড জিরো ঘুরে পৌঁছেছিল আফগানিস্তানে। এর পরে হয় কাবুল বিজয়। জনমানসে তখনই আফগানিস্তান বিজয় শেষ। যুদ্ধ শেষ। তালিবানদের হটিয়ে দেওয়া গেছে, বস্তুত কোমরও ভেঙে দেওয়া গেছে, দুনিয়া জুড়ে লোকে এরকমটাই ভেবেছিল। লেফটেনান্ট জেনারাল ডগলাস লিউট, পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করেছেন, যে, কাবুলে সে ছিল আশার সময়। দলে-দলে লোক, যারা তালিবানি আমলে কাবুল ছেড়ে পালিয়েছিল, তারা কাবুলে ফিরছে। সেলুনে দাড়ি কাটার ভিড়। মেয়েদের বোরখাবিধি উঠে গেছে। আফগান মহিলা ফজিয়া কুফি, পরবর্তীতে যিনি সাংসদ হবেন, এই সময়ই কাবুল ফেরেন। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, কাবুলে এসেছিলেন তিনি বোরখা সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু এসে দেখেন, যে, বহু মেয়েই বোরখার পাট তুলে দিয়েছে।
এখানে দুটি জিনিস লক্ষ্যণীয়। প্রথম, আফগানিস্তানের এই 'স্বাধীনতা' এসেছিল মার্কিন বাহিনীর হাত ধরে। এই সময়েই 'স্বাধীনতা' এবং 'আমেরিকা' প্রায় এক হয়ে যায়। স্বাধীনতাপন্থীরা, স্বভাবতই আমেরিকান বাহিনীর আক্রমণের পক্ষে ছিলেন। ফলে তখনই একটি বাইনারি তৈরি হতে শুরু হয়েছে, আমেরিকাপন্থী এবং বিরোধীদের। শহুরে 'প্রগতিশীল'রা মূলত আমেরিকার পক্ষের। এই বাইনারিটি তখনও জায়মান। দ্বিতীয়ত, এই চিত্রটি কেবল শহরের। রাজধানী কাবুলের। তার বাইরে কী হচ্ছে সে খবর আমেরিকান বাহিনী তখনও রাখেনা। কাবুলের বাইরের বিস্তীর্ণ আফগানিস্তান, তখন, যুদ্ধবিধ্বস্ত, দরিদ্রতম একটি দেশ।
তো, এই অবস্থাতেই আমেরিকান বাহিনীর মাথায় আসে, অতঃকিম। তালিবানদের হটিয়ে দেওয়া গেছে। তারা আর কোনোভাবেই আমেরিকার উপর কোনো হামলা করতে বা হামলার সমর্থন জোগাতে সক্ষম না। যুদ্ধ সে অর্থে জয় হয়ে গেছে, এবার কী? ব্রায়ান ক্রকার, যিনি পরবর্তীতে আফগানিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হবেন, স্মৃতিচারণ করেছেন, যে, পরিষ্কার দুটি ভাবনা ছিল সে সময়। একদল ভাবত, যে, এবার নির্মাণের সময়। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বিস্তীর্ণ আফগানিস্তান যে কোনোকালে আবার আমেরিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেবেনা, তার একমাত্র গ্যারান্টি হল উন্নয়ন। উন্নয়নের আমেরিকান পদ্ধতি যে সেই মার্শাল প্ল্যানের পর থেকে আজ অর্যন্ত কোথাও ফলপ্রসূ হয়নি, সে কথা অবশ্য তিনি বলেননি যাই হোক, দ্বিতীয় ভাবনাটি ছিল, যথেষ্ট হয়েছে, বিজয় সম্পন্ন, এবার বাড়ি ফেরা যাক। সেটি ছিল রামসফিল্ড জমানা। ক্রকার পরিষ্কার বলেছেন, যে, রামসফিল্ডের নীতি খুব পরিষ্কার ছিল। আক্রমণ কর, ভেঙেচুরে দাও, বাড়ি চলে এস। কয়েকবছর পরে যদি আক্রমণ করতে হয়, তো আবার করা যাবে।
তো, এই নীতির একদম হাতেকলমে পরীক্ষা হয় ওই দশকে। নাওমি ক্লেন যার পরে ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজমের তত্ত্ব তৈরি করবেন ( আগ্রহী পাঠকেরা 'দা শক ডকট্রিন' পড়ে দেখতে পারেন)। আফগানিস্তান যখন অর্ধেক ধ্বংসস্তূপ, তখনই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় পরবর্তী যুদ্ধের। ইরাক। সেখানে কয়েকবছর পরে আবার যাওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর দলবলের। তার জন্য যা যা মিথ্যে কথা বলা হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। বুশ, পাওয়েল, রামসফিল্ড, চেনি, সবাই একযোগে বলেছিলেন ইরাক সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিচ্ছে, গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে, তার অব্যর্থ প্রমাণ আছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, উদ্ধৃত ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সের রিপোর্ট ছিল ভুয়ো, ব্রিটিশ সরকার তার জন্য ক্ষমাও চায়। গুয়ান্তানামো বে তে জনৈক আফগানের সাক্ষ্য জোগাড় করা হয়। সেখানে যা করা হয়েছিল, বহু লোকেই প্রকাশ্যে বলেছেন, তা অত্যাচার করে সাক্ষ্য আদায়। গুয়ান্তানামো বে একটি অন্য প্রসঙ্গ, এখানে তাতে ঢোকা হবেনা, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এফবিআই এবং সিআইএ ইরাকের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছিল। ইরাকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআইএ হ্যান্ডলারের কী হাল করা হয়েছিল, সে নিয়ে তিনি নিজেই একটি বই লিখেছেন। তার নাম 'ফেয়ার গেম'।
ভ্যালেরি প্লাম এর সেই স্মৃতিকথাটি এবং গোটা দুনিয়ার লিবারাল মিডিয়ার ন্যক্করজনক ভূমিকা নিয়ে অন্যত্র লেখা যাবে। আপাতত আফগানিস্তান প্রসঙ্গে এটুকুই গুরুত্বপূর্ণ, যে, এরপর ঢাকঢোল পিটিয়ে ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার সরাসরি প্রভাব এই, যে, এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০০২ থেকেই আমেরিকা আরেকটি ফ্রন্টে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। অর্থ, সামরিক সরঞ্জাম, সৈন্য, সমস্ত রকম সম্পদই আফগানিস্তান থেকে ইরাকে চালান করা শুরু হয়। আফগানিস্তান ঝুলতে থাকে ন-যযৌ-ন-তস্থৌ হয়ে। না হয় পুরো দস্তুর পুনর্নির্মান, না হয় পুরোদস্তুর বিজয়। রামসফেল্ডের নীতি, আগেই বলা হয়েছে, খুবই সহজ ছিল। ভেঙে-চুরে দেওয়া গেছে। আপাতত যুদ্ধ শেষ। পরে দরকার হলে আবার দেখা যাবে।
২০০৩ সালের মে মাসে রামসফিল্ড কাবুলে যান। ঘোষণা করেন, যে আফগানিস্তানের যুদ্ধ প্রায় শেষ। একই দিনে আমেরিকার পশ্চিমে একটি জনসভায় বুশ ঘোষণা করেন, ইরাক করায়ত্ব ( মিশন অ্যাকমপ্লিশড)। ইরাকের সন্ত্রাসযোগের মতো, এও ছিল বুশ জমানার আরেকটি সফল সেলস পিচ। গোটা দুনিয়ার মিডিয়া, হামলে পড়ে যা প্রচার করে। এসব যে মর্মান্তিকরকম মিথ্যে ছিল, আজ সে কথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু যে কথাটি কখনই বলা হয়না, তা হল, বুশের ইরাক আক্রমণ আসলে লাদেনের ভাষ্যের বিজয়। আমেরিকা যে যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যের উপর দখলদারি বজায় রাখতে চায়, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কীইবা হতে পারে ইসলামি দুনিয়ায়? ফলত লাদেনের সংস্পর্শরহিতভাবেই জন্ম হতে থাকে নতুন শক্তির। আফগানিস্তানেও কোনঠাসা তালিবানরা মতাদর্শগত আয়ুধ পায়। এমনিতেই রামসফিল্ডের সৌজন্যে আমেরিকা তখন দুইটি ফ্রন্টে লড়ছে। আর মূল লড়াই তখন ইরাকে। সেই সুযোগে তালিবান পুনরুত্থান শুরু হয় প্রত্যন্ত আফগানিস্তানে। ফলে আমেরিকান ফৌজ থেকেই যায় দুই দেশে। গোটা দুনিয়ায় তখন কেউ জানতনা, এই অদ্ভুত লড়াইয়ের শেষ কোথায়। কোন সমীকরণে এই সমস্যার সমাধান হবে। এই দিশাহীন স্থিতাবস্থা চলতে থাকে গোটা বুশ জমানায়। গোটা দুনিয়া যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার জন্য দুই দফার রাষ্ট্রপতিত্ব শেষ করতে বুশের অবশ্য সমস্যা হয়নি।
ওবামা ক্ষমতায় আসেন ২০০৮ সালে। সেই বছরই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আফগানিস্তানে আরও ৮০-৯০ হাজার সৈন্য চেয়ে সুপারিশ করা হয়। কারণ, জেনারাল ডেভিড পেট্রারিয়াস স্মৃতিচারণ করেছেন, যে, ওই সময় তালিবানদের ক্রমশ উত্থান হচ্ছে। একটির পর একটি জেলা তাদের দখলে আসছে। এর কারণ তিনটি। এক, আমেরিকার শক্তি কমে যাওয়া। দুই, মতাদর্শগত পুনরুত্থান। দুটির কথাই আগে বলা হয়েছে। কিন্তু তালিবান যোদ্ধাদের সংখ্যা তো শুধু মতাদর্শে বাড়েনা। তার কিছু বাস্তব কারণ লাগে। তৃতীয় কারণটি সেই বাস্তব কারণ। আমেরিকান সৈন্যের লড়াইয়ের ধরণ।
সার্জেন্ট জেমস লাপোর্টা, যিনি এইসময় হাতাহাতি লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, এই সময়ের একাধিক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি তাঁর প্রথম মানুষ মারার গল্প। ২০০৯ এর জুলাই মাসে তাঁরা একটি গ্রামে টহল দিচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে একে-৪৭ হাতে বেরিয়ে আসে এক কিশোর। লাপোর্টা তাকে গুলি করে মারেন। ছেলেটির বয়স সম্ভবত ১৫র বেশি না। লাপোর্টা বলছেন, কে এ? সত্যিই তালিবান? কী কারণে একটি ১৫ বছরের ছেলে অস্ত্র ধরে? আমার দেশে বিদেশী সৈন্যরা দখলদারি করলে আমি কী করতাম? গুলি করতাম?
বিদেশী সৈন্যরা কোনো দেশকে 'স্বাধীন' করার চেষ্টা করলে এইভাবেই সবকিছু গুলিয়ে যায়। ভালো-খারাপ লোক আলাদা করে চেনা যায়না। স্থানীয়দের সবাইকে মনে হয় শত্রু। যেকোনো সময়ে যেকোনো দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে আততায়ী। যাকে দেখে ডাঙ্গুলি খেলা কিংবা ঘুড়ি-ওড়ানো কিশোর মনে হচ্ছে, তার হাতেই থাকতে পারে একে ৪৭। শুধু মানুষ না, প্রতিটি পদক্ষেপেই থাকে ভয়। মাটির নিচে থাকতে পারে আইডি। যেকোনো মুহূর্তে আস্ত শরীরকে উড়িয়ে দিতে পারে লহমায়। তথ্যচিত্রনির্মাতা বেন অ্যান্ডারসন এই সময়ের মার্কিন প্রতিরোধের একটি চিত্র দিয়েছেন। আইডির ভয়ে আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে টহল দেবার জন্য তারা ব্যবহার করত তিরিশ ফুট লম্বা এবং অজস্র হ্যান্ড গ্রেনেড বাঁধা একটি লম্বা দড়ি। যেখান দিয়ে যাওয়া হবে সেখানে প্রথমে ছুঁড়ে দেওয়া হত এই দড়ি। বিস্ফোরণে তিরিশ ফুট এলাকার সবকিছু উড়ে যেত। বাড়ি বা রাস্তা, বা ক্ষেত। ক্ষতিপূরণের কথা, জানা যায়না, বলাবাহুল্য। অ্যান্ডারসন বলেছেন, স্থানীয় আফগানরা বলতেন তালিবানরা কখনও এরকম করবে না। ফলে তখন থেকেই, প্রশ্নটি ভালো তালিবানের নয়, খারাপতর আমেরিকানদের। প্রশ্নটি বাইনারির। তালিবানরা দাড়ি রাখতে বাধ্য করে, শরিয়া পালন করায়, মেয়েদের বোরখা বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু আফগানমাত্রেই শত্রু ভাবেনা। ক্ষেত, বাড়ি, রাস্তা স্রেফ টহল দেবার জন্যই উড়িয়ে দেয়না। জনমানসে এই চিত্র তৈরি হলে যুদ্ধ হারার আর বাকি কী থাকে?
২০১১ থেকে ওবামার ঘোষণামতো সৈন্য অপসারণ শুরু হয় আফগানিস্তান থেকে। ওই বছরই লাদেনকে হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। কিন্তু তাতে তালিবান অগ্রগতিতে ভাঁটা পড়েনি। এই আরেকটি সাক্ষ্য, যার থেকে বোঝা যায়, যে, যুদ্ধটি আর ঠিক ধর্মীয় নির্দেশে চলছেনা। এই অগ্রগতির সামনে মার্কিন বাহিনী বস্তুত দিশাহীনের মতো আচরণ করতে শুরু করে। এর কয়েক বছর পরে ২০১৫ সালে মার্কিন ইনস্পেকটর জেনারাল 'কী শিখলাম' এই মর্মে নানা সামরিক-অসামরিক লোকজনের সাক্ষ্য নেন। তৎকালীন লেফটেনান্ট জেনারাল মাইকেল ফ্লিন সাক্ষ্যে খুব স্পষ্ট করে বলেন, তালিবানরা একের পর এক এলাকা দখল করছে। আমরা সবাই ২০০১ থেকে যদি দারুন কাজ করে থাকি, তো এমনটা হল কীকরে? বস্তুত এ ঠিক ২০১৫র ব্যাপারও না। ওই একই জায়গায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ২০০৬-৭ সালের ন্যাটো কম্যান্ডার ব্রিটিশ জেনারাল ডেভিড রিচার্ডস প্রায় একই কথা বলেন। যে, পশ্চিমী বাহিনীর কোনো কর্মসূচির ( স্ট্র্যাটেজি) বালাই ছিলনা। প্রচুর কৌশল ছিল, কিন্তু কোনো রণনীতি ছিলনা। তার পরের জেনারাল ড্যান ম্যাকনিল তাঁর সাক্ষ্যেও একই কথা বলেন। ন্যাটোর কোনো কর্মসূচি ছিলনা। তিনি যুদ্ধে যাবার আগে প্রশ্ন করেছিলেন, এই যুদ্ধ জেতার সংজ্ঞা টা কী? ওয়াশিংটনে তার কোনো উত্তর ছিলনা।
এসব সাক্ষ্য অবশ্য ২০১৫তে জানা যায়নি। ওয়াশিংটন পোস্ট বছর তিনেক মামলা লড়ে জিনিসগুলি উদ্ধার করে। কিন্তু মার্কিন নেতাদের এসব অজানা ছিলনা। বুশ থেকে ওবামা পর্যন্ত সবাই আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আগাগোড়াই মিথ্যা কথা বলে গেছেন। বস্তুত শুধু সামরিক ক্ষেত্রে না, সেই ২০০৬ থেকেই গোটা আফগানিস্তানই ছিল একটি নড়বড়ে দিশাহীন অবস্থায়। স্রেফ আমেরিকানদের বক্তব্য শুনলে বা পড়লেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায়। সামরিক পরামর্শদাতা ক্রিস্টোফার ওলেন্ডা দীর্ঘদিন ছিলেন আফগানিস্তানে। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের সরকার ২০০৬ সালের মধ্যেই চৌর্যতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। এ ছিল ব্রেন ক্যানসার, যার ফলে রোগির মৃত্যু অনিবার্য। মার্কিন ইনস্পেকটর জেনারাল জন স্পোকো আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার কেমন করে খরচ হচ্ছে, তার হিসেব নিতে। তাঁর নিজেরই কথায়, গোটা মার্শাল প্ল্যানের চেয়েও বেশি টাকা ঢালা হয়েছিল আফগানিস্তানে। তার বেশি অংশটাই নিরাপত্তা ক্ষেত্রে। ইউনিফর্ম, অস্ত্র, প্লেন, সামরিক নির্মান, এইসব কাজে। কাজ কতটা হয়েছে বলা মুশকিল, তবে চুরি হয়েছে বিস্তর, বলেছেন স্পোকো। একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। ৪০০ মিলিয়ান ডলার খরচ করে আফগান মিলিটারির জন্য কেনা হয়েছিল জি২২২ বিমান। এমনই বিমান, যারা কখনও উড়তে পারেনি। স্পোকো বা অন্যরা স্পষ্ট করে বলেননি, কিন্তু এর থেকে টের পাওয়া যায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও এসব থেকে টাকা পিটেছে বিস্তর। পূর্বোল্লিখিত নাওমি ক্লেন স্পষ্ট করেই দেখিয়েছেন, ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজমের একটি লক্ষণ এইটিই। একটি দেশ ধ্বংস হবে, যুদ্ধ হবে, পাওয়া যাবে একচেটিয়া অনন্ত বরাত। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সবসময়েই যুদ্ধের পক্ষে থেকেছে। এবং পশ্চিমী মিডিয়াও তাদের পথ অনুসরণ করে চুপচাপ থেকেছে। নইলে চুরি, বরাত, এসবের খবরের জন্য সামরিক প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করতে হয়না। শুধু এইটুকুই নয়, জেনারাল জন অ্যালেন আফগান সামরিক এবং পুলিশ বাহিনীর যা বর্ণনা দিয়েছেন, পড়ে আঁতকে উঠতে হয়। এই বাহিনী গাঁজা থেকে হেরোইন, সবেতেই ছিল সিদ্ধহস্ত। অস্ত্র থেকে পেট্রোল, সব কিছুই বেচে দিত। এবং শুধু এইটুকুই না, আফগান পুলিশ দপ্তরে গেলেই দেখা মিলত কিছু 'চায় বয়' এর। যাদের বয়স হত ১০-১২। দেখতে মিষ্টি। দিনের বেলা এরা চা দিত, রাতে নাচত এবং যৌন চাহিদা মেটাতো। এদের পুলিশ বাহিনী সাধারণভাবে অপহরণ করে আনত। দুনিয়ার লিবারাল মিডিয়া, যারা এখন আফগানিস্তানের নারীর দুরবস্থা নিয়ে খুবই চিন্তিত, তারা বছরের পর বছর এই প্রাতিষ্ঠানিক যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।
২০১১ সাল নাগাদ দিশাহীন আমেরিকান বাহিনীও যথেচ্ছাচার শুরু করেছিল। এই সময় একাধিক খবর আসে, কোনোটিতে দেখা যাচ্ছে, মৃত আফগানদের শরীরে মার্কিন সৈন্যরা প্রস্রাব করছে। আরেকটি খবর আরও মারাত্মক। আমেরিকান বাহিনীর একটি প্লেটুন, স্রেফ নিজেদের হাতে বন্দুক থাকায় আফগান লোকজনকে গুলি করে মারত। নিরীহ লোকেদের বহু লাশ পড়েছিল। খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইউনিটটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার জায়গায় অন্য ইউনিট আসে। তাদের উপর এবার আত্মঘাতী হামলা হয়। পাঁচজন মারা যান। সেই বাহিনীর সদস্য ছিলেন অ্যাডাম লাইনহ্যান। তিনি জানাচ্ছেন, যে, ওই ঘটনার পর থেকেই মার্কিনবাহিনী বাধ্য হয় সাধারণ আফগানদেরও বন্দুকের ডগায় রাখতে। বিদেশী এই বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিলনা কে তালিবান, কে নয় বিচার করা। যেকোনো লোক যেকোনো সময়ই পেটে বোমা বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে বাহিনীর উপর। হয়তো কোনো আপনজনের মৃত্যুর শোধ তুলতে। ফলে সবসময়েই তাদের বন্দুকের নলের সামনে রাখা হত। একটি বিদেশী বাহিনী এসে স্থানীয় লোকেদের মারছে, বন্দুকের ডগায় রাখছে, তার ফলাফল কী হতে পারে, সে আর বিশদে বলার প্রয়োজন নেই। তালিবানদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য এর চেয়ে সহায়ক কাজ আর সম্ভব ছিলনা।
এরই মধ্যে কমতে থাকে মার্কিন বাহিনীর সংখ্যা। ওবামার প্রতিশ্রুতিমতো। তালিবানদের সঙ্গে টক্কর দিতে ওবামা প্রশাসন নতুন নীতি নেয়। নির্বিচার ড্রোন হানা। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় খুব সম্ভবত হাজারে হাজারে ড্রোন হানা হয়েছিল। বেশিরভাগই শত্রুকে না দেখে। আন্দাজ করে। স্রেফ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা হচ্ছে, এরকম বলা হলেও আদতে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে আঘাত করা হত যত্রতত্র। সন্দেহভাজন ছাড়াও মারা যেত হয়তো আরও কয়েকশো লোক। তারা সবাই 'আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি'। এই পাইকিরি হত্যা শুরু হবার পর সর্বপ্রথম ব্যাপারটি জনসমক্ষে আসে এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা কিছু নথিপত্র থেকে। দেখা যায়, শুধু আফগানিস্তানে নয়, পাকিস্তান, ইয়েমেন সহ একাধিক বাইরের দেশেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। সার্বভৌমত্ব তো লঙ্ঘন করা হয়েইছে, এমনকি খুন করা হয়েছে মার্কিন নাগরিকদেরও। আশ্চর্য নয়, যে, স্নোডেন এর পরে আর আমেরিকায় ফিরতে পারেননি। প্রসঙ্গত স্নোডেনের জীবনীচিত্রে দেখা যায়, ড্রোন আক্রমনে খুন হচ্ছেন এক আফগান বাবা। তারপর তাঁর শবযাত্রায় জড়ো হচ্ছে বহু লোক। সেই জমায়েতও সন্দেহজনক হওয়ায়, তার উপর আবার ড্রোন আক্রমণ, এবং এবার মারা যাচ্ছে বাবাকে সমাধি দিতে আসা ছেলে।
স্নোডেনের জীবনীচিত্রের এই ছোটো ছোটো অংশগুলি কতটা বাস্তবানুগ জানা নেই। কিন্তু পাকিস্তানি মহিলা সাংসদ হিনা রাব্বানি খার-এর কাছ থেকে যা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা খুব আলাদা নয়। পাকিস্তানের মাটিতেও ড্রোন আঘাত হয়েছে বিস্তর, তাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আবদ্ধ রাখা খুবই মুশকিল, ফলে 'আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি' প্রচুর। এবার, এই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ব্যাপারটি ঠিক কী? হিনা বলেছেন, লক্ষ্যবস্তু মানে আসলে যেকোনো পুরুষমানুষ, একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে।
ফলত, এই ২০১১ থেকে আফগানিস্তানের দুর্গম গ্রামগঞ্জ ভরে যেতে শুরু করে খোঁড়া, কানা, বিকলাঙ্গ মানুষে। এছাড়াও মাটির নিচে জমতে থাকে লাশ। আর কচি কচি বাচ্চারা ফুঁসতে থাকে প্রতিশোধের আকাঙ্খায়। তালিবান এদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল। মার্কিন বাহিনীর প্রতিটি বন্দুকের গুলি, প্রতিটি খুন, প্রতিটি সম্পত্তি নষ্ট, প্রতিটি ড্রোন আক্রমণ, এভাবেই জন্ম দিতে থাকে আরও অনেক অনেক তালিবানের। তারা তখন লড়ছিল প্রতিশোধের লড়াই। আর মার্কিনীরা কোনোক্রমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখছিল। তার জন্য দরকার হচ্ছিল আর ড্রোন আক্রমনের। এবং তাতে জন্ম নিচ্ছিল আরও তালিবান। এই তথাকথিত স্থিতাবস্থা এবং নিজের 'প্রগতিশীল' ইমেজ অক্ষত বজায় রেখেই রাষ্ট্রপতিত্ব শেষ করেন ওবামা। যুদ্ধের ফলাফল কী হতে চলেছে, তা অবশ্য তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতায় আসেন বহুনিন্দিত ট্রাম্প। এক কথায় তিনি বলেন, আফগানিস্তান আক্রমনটা নিজেই একটা বিপর্যয়। ওখানে যাওয়াই উচিত হয়নি। এবং তিনি আফগানিস্তানকে আল্লা ও তালিবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে সৈন্যসামন্ত ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু করে দেন। বাকিটুকু আর কারও অজানা নয়। বস্তুত বাকিটুকু গতিজাড্যের খেলা। অমনটাই হবার ছিল।
ফলে, আফগানিস্তান এক জটিল অবস্থায়। ড্রোন আক্রমনের গণহত্যা লিবারাল মিডিয়া দেখেনি, বা দেখেও দেখেনি, ফলে তাদের পক্ষে এই বৃহৎ চিত্রটি তোলা অসম্ভব। তাদের কাছে গণহত্যা জায়েজ, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র ভাঙা বর্বরতা। যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে জাস্ট মেরে ফেলাটা নেহাৎই আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি, কিন্তু বোরখা চাপানো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এখানে বোরখার পক্ষে একেবারেই কোনো নরম মনোভাব দেখানো হচ্ছেনা, কিন্তু এই বাইনারিতে পড়লে এমনকি তালিবান নারীও সম্ভবত বাপ-স্বামী-ছেলের লাশ হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে বোরখা ভালো, এমনটাই বেছে নেবেন। দুটোই খারাপ, কিন্তু কোনটা খারাপতর, সেটাই এখানে চয়েস। সব মিলিয়েই একবিংশ শতকের পরিস্থিতি এরকমই ভজকট। মার্কিনী আগ্রাসনকে যারা লড়াই দিয়েছে তারা লালফৌজ না, কট্টর মৌলবাদী তালিবান, কিছুদিন আগেই যারা বুদ্ধমূর্তি অবধি ভেঙে দিয়েছিল। আর 'প্রগতিশীল' যাঁরা, তাঁরা সমস্ত প্রগতিবোধ নিয়েও আমেরিকান আক্রমণের পক্ষে। অল্প কিছু 'প্রগতিশীল' উল্টোদিকেও নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু তাঁরা নগণ্য। পরিস্থিতি আরও ভজকটতর হবে, যদি এখানে যোগ করা যায়, যে, তালিবানদের বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তকদের আশীর্বাদ নিয়ে যাঁরা পানশিরে লড়ছেন, তাঁরাও আরেক মৌলবাদীদের দঙ্গল। এই অদ্ভুত সমীকরণ আমাদের যোগবিয়োগের অঙ্কে মেলেনা। কিন্তু একবিংশ শতক এমনই। পুরোনো মুজাহিদিন হেকমতিয়ার বলেছেন, সোভিয়েত আর মার্কিনী দখলদারিতে তফাত কোথায়? প্রতিরোধেই বা তফাত কী? তখন আমাদের বলা হত স্বাধীনতা সংগ্রামী, আর এখন বলা হয় সন্ত্রাসবাদী।
একবিংশ শতকে এ দুয়ের মধ্যে তফাতটা কোথায়? পুরোনো সমীকরণে উত্তর মিলবেনা। এই শতকের ভিডিও গেমের মতো হাইটেক কিন্তু নির্মম, প্রায় আনরিয়েল বাস্তবতার মধ্যে এর উত্তর খুঁজে বার করতে হবে।
উনবিংশ শতকে, এমনকি বিংশ শতকের বড়ো অংশেও এ দুইয়ের মধ্যে খুব বড় তফাত ছিলনা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।