এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • শঙ্খমালা

    শুভেন্দু বর্ধন
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৮২১ বার পঠিত
  • সুনামি ও বিপন্নতা আজ সমার্থক। সুনামি এক স্বেচ্ছাচারী কল্লোল, এক আন্তর্জাতিক সমুদ্র সন্ত্রাস। তামিলনাড়ু ও আন্দামান দ্বীপবাসীরা বোধহয় এখনও বুঝে উঠতে পারেনি কত ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী এই ক্ষয়ক্ষতি। স্বজন হারানো বাদ দিলেও, কৃষিজমি ও ভুগর্ভস্থ জল লোনা হয়ে যাওয়াতে বেশ কয়েক বছর ধরে আন্দামানে পানীয় জলের এবং চাষের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূল ভূমধ্য-আশ্রিত বলে হয়তো প্রাকৃতিক কারণেই আমরা সুনামি পীড়িত হইনি। তবে এই ঢেউ আছড়ে পড়েছে এক আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে। তখন পত্রপত্রিকায় ও টিভিতে প্রায়ই শোনা যেত পশ্চিমবঙ্গের বহু শাঁখারীপাড়া বন্ধ হওয়ার মুখে। শঙ্খ আসছে না তামিলনাড়ু ও শ্রীলঙ্কা থেকে। আশংকা, সুনামির তাণ্ডবে, হয় এই শামুকগুলো মারা গেছে অথবা যে জেলে বা ডুবুরীরা এদের সমুদ্রতল থেকে তুলে আনতো তারা আর বেঁচে নেই।

    সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ সান্নিধ্য পেয়েছে, বন্ধুতা পেয়েছে অনেক জীবজন্তুর কাছ থেকে। কিন্তু, অন্দর মহলে, বিশেষত পূর্বভারতে, ঠাঁই পেয়েছে এক সামুদ্রিক জীব, শঙ্খ। আমাদের পরিবারে, ঠাকুরঘরে বিগ্রহের পাশাপাশি থাকে জলশঙ্খ, বাজাবার শাঁখ যা কিনা নানা আচার অনুষ্ঠানের অত্যাবশ্যক সামগ্রী। পরিবারের বিবাহিত মহিলাদের হাত ঘিরে থাকে এক জোড়া শ্বেত বলয়, শাঁখা। শঙ্খ থেকেই এই শাঁখা তৈরী হয় শাঁখারীপাড়ায়। এছাড়া আছে, শাঁখের আংটি, মহিলাদের প্রসাধনী শঙ্খচূর্ণ। আমাদের পরিবারে তাই এত শঙ্খের ভীড়। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, শাঁখারীপাড়ার কর্মব্যস্ততা। কত পরিবারের অন্নসংস্থান এর সাথে জড়িত। সমুদ্র থেকে শঙ্খ সংগ্রহ করে একদল মৎসজীবি, তাদের চালান ও পরিবহনের সাথ যুক্ত কিছু ব্যবসায়ী। আর, শাঁখারীপাড়া তো এক বৃহৎ কুটীর শিল্পের জমজমাট কর্মস্থল, শঙ্খের কারখানা। দক্ষ শিল্পীর হাতে সামুদ্রিক কাঁচামাল পরিশোধিত ও পরিমার্জিত হয়ে বিভিন্ন দশকর্মের দোকান এবং শঙ্খভান্ডার হয়ে আমাদের বাড়ীতে পৌঁছয়। আজ সুনামি ছিঁড়ে ফেলেছে এক প্রাচীন ও বহুধা বিস্তৃত এই কর্মজাল। বিপন্ন অর্থনীতি, বিপন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক আচার, অনুষ্ঠান। শাঁখার অভাবে বিয়ের মরশুম বিঘ্নিত হলে, শাঁখের মাঙ্গলিক ধ্বনি না শোনা গেলে আমাদের পরিবারে নিয়ে আসবে এক শ্বেত সন্ত্রাস।

    সব খারাপ জিনিসেরই হয়তো কিছু ভালো দিক আছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়তো ফিরিয়েও দেয় কিছু। মহাবলীপুরমের বেলাভূমি থেকে বালি সরিয়ে সুনামি অনাবৃত করেছে এক প্রাচীন, লুপ্ত নগরী। সাংস্কৃতিক আচ্ছন্নতাকে সরিয়ে আমরা এখন ফিরে শুরু করতে পারি, কে এই শঙ্খ, মৎসগন্ধা জলপরী? যার সাজে সজ্জিতাকে জীবনানন্দর মনে হয়েছিলো শঙ্খমালা নারী। "" ধানের রসের গল্প পৃথিবীর -- পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ/ পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই -- আর তার প্রেমিকের ম্লান/ নি:সঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মত প্রাণ,/ জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না।'' ...সিন্ধুসারস, মহাপৃথিবী কাব্য গ্রন্থ)। কত প্রাচীন আমাদের এই সামাজিক শঙ্খ শিকার? আজ যদি শঙ্খ সত্যিই না পাওয়া যায়, সুনামিকেই দায়ী করবো আমরা? নাকি নীলাভ জলের এই অমল ধবলতার তিরোধানে আমাদেরও দায়বদ্ধতা আছে, যাকে বলে, হিউম্যান ইম্‌প্যাকট।

    জলশঙ্খ, বাজাবার শাঁখ এবং হাতের শাঁখা একটি বিরল প্রজাতির শঙ্খের শক্ত খোলক বা তার অংশ থেকে তৈরি। প্রজাতিটির বৈ'¡নিক নাম, টারবিনেলা পাইরাম (Turbinella pyrum) । যে কোন শঙ্খই শামুক শ্রেণীর (গ্যাসট্রোপোডা) অন্তর্ভুক্ত। ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে তৈরি টারবিনেলা পাইরাম-এর খোলক এক জ্যামিতিক বিস্ময় (ছবি১)। কর্ক-স্ক্রুর মত প্যাঁচানো কুণ্ডলী ক্রমশ দক্ষিণাবর্তে বড়ো হয়ে সুতোর তকলির মতো দেখতে লাগে। ফলে খোলকটির দুদিক সরু এবং মাঝখানের পরিধি বিস্তৃত হয় যার ভেতরে শামুকটির নরম অংশ থাকে। নীচের বা মুখের দিকে এক লম্বা নালী আছে যার সাহায্যে প্রাণীটি বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখে। পাইরাম-এর এই শক্ত খোলকটি যেন এক চলমান পাথুরে দূর্গ যা ওকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। দূর্গের অভ্যন্তরে আছে এক জৈব-কারিগরির অনন্য প্রযুক্তি। একটি শক্ত অক্ষদণ্ডের চারপাশে খোলকটি আবর্তিত হয় যেন মার্বেল পাথরের এক ঘোরানো-সিঁড়ি। শঙ্খ শিল্পীরা শাঁখ তৈরি করার সময় ওপরের সরু অংশটি কেটে বাদ দিয়ে দেয়, ফলে একটি ছিদ্র তৈরি হয়। বাজাবার সময়, ছিদ্র দিয়ে দীর্ঘ ফু দিলে, বাতাস ঐ ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। ধ্বনি, প্রতিধ্বনির অনুরণনে যেন এক সমুদ্র গর্জন তৈরী হয়। এই নিনাদ, প্রাচীন যূথবদ্ধ মানুষের কাছে মনে হয়েছিল এক অপার, সাংগীতিক মূর্ছনা। ঐন্দ্রজালিক চেতনায় এক রহস্যঘন আবহ তৈরি হত যা মনে হয়েছিলো মাঙ্গলিক। শঙ্খধ্বনি তাই আজো আমাদের প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানে, স্মৃতিতে এবং মিথে। শাঁখা বানানোর সময় শিল্পীরা খোলকের অনেকটাই কেটে বাদ দিয়ে দেয়। ভেতরের অক্ষ দণ্ড, ঘোরানো সিঁড়ির ধাপ কেটে বের করে নিলে একটা ফাঁপা খোলক তৈরি হয়। তারপর মাঝখানের বিস্তৃত অংশ আড়াআড়ি কেটে শাঁখা বানানো হয় (ছবি২)। অনেক শামুকই আকৃতিগতভাবে পাইরাম-এর কাছাকাছি, কিন্তু তাদের খোলকের ওপরের অংশ এত মসৃণ, পুরু আর সাদা নয়। দুর্ভাগ্য পাইরাম-এর; তার সৌন্দর্য, অঙ্গ সৌষ্ঠব নিজের শত্রু।

    [১]

    [২]
    একটি টারবিনেলা পাইরাম থেকে কম বেশী চারটি শাঁখা তৈরি হয়। একজন বিবাহিতা রমনীর হাতে থাকে একজোড়া। দু'জন নারীর হাতে দোলে একটি পূর্ণবয়স্ক পাইরামের শুভ্র কংকাল। মৃণাল সেনের ছবির ভাষায়, পিসফূল ভায়োলেন্স! শুধু বাঙ্গালী নয়, পূর্বভারতের অধিকাংশ বিবাহিত হিন্দু নারীর অঙ্গশোভা এই শাঁখা। বর্তমানে কয়েক কোটি পূর্বার হাতে পাইরাম-এর মৃতদেহ ঝুলছে। একজন সধবা নারী জীবনে অন্তত পাঁচ থেকে ছ'বার ভেঙ্গে গেলে বা পুরানো হলে, শাঁখা বদলান। সন্তান গড়ে পিটে মানুষ করতেও তো শাঁখা ভাঙ্গে! তাহ'লে শুধু এই বর্তমান সময়ে কতো অসংখ্য পাইরাম আমাদের সাংস্কৃতিক ভোগের শিকার? এছাড়া প্রতি পরিবারে অছে জলশঙ্খ ও শাঁখ হিসেবে অসংখ্য ছোট, বড় পাইরাম। আমাদের সমাজে শাঁখের ব্যবহার, শাঁখার প্রচলন কতো পুরনো? পাঁচালী, অজস্র লোকায়ত ব্রত ছড়া ও শাস্ত্রে আমরা এদের ব্যবহারের কথা জানতে পারি (ছবি৩)। কিন্তু সাম্প্রতিক পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অন্যান্য প্রত্নসামগ্রীর সাথে মিলেছে শঙ্খের তৈরি নানা জিনিসপত্র ও শাঁখা (কেনয়ার, ১৯৮৪; গৌড়, ২০০৫)। তখনও শাঁখা তৈরী হত টারবিনেলা থেকে (ছবি ৪)। শঙ্খের অজস্র ব্যবহার ও তার ব্যাপকতা থেকে বি'¡নীরা অনুমান করেন সিন্ধু সভ্যতায় গড়ে উঠেছিলো বিশাল বিশাল শঙ্খের কারখানা (ছবি ৫)। শঙ্খের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছিলো দূরদূরান্তের সমসাময়িক সভ্যতায় (ছবি ৬)। মহেঞ্জোদারোর শিল্পাঞ্চলের সাথে গ্রামীণ বাংলার শাঁখারীপাড়ার আশ্চর্য মিল পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতার আনুমানিক বয়স পাঁচ হাজার। ইতিহাসের আদি অবস্থা থেকেই মানুষের শঙ্খ শিকার। জেমস হর্নেলের (১৯১৬) মতে, পূর্বভারতে ঢাকায় (অধুনা বাংলাদেশ) প্রথম শঙ্খের কারখানা স্থাপিত হয় ১৪শ খৃষ্টাব্দে। দাক্ষিনাত্যে মালিক কাফুরের আক্রমণের পর শঙ্খশিল্প পুরোটাই ঢাকায় চলে আসে। দীনেশ চন্দ্র সেন (১৯৩৫) অবশ্য পুরনো বাংলা সাহিত্য ঘেঁটে অনুমান করেন বল্লাল সেনের (১২শ খৃষ্টাব্দ) আমলেই ঢাকায় শঙ্খ বাণিজ্য শুরু হয়।
    [৩] [৪] [৫] [৬]
    শাঁখার প্রচলন কেন এত প্রাচীন? শাঁখা কি শুধুই অলংকার, শোভাবর্ধনকারী? লক্ষ্যণীয়, শাঁখা বিবাহিতা নারীর এয়োত চিহ্ন এবং অনার্য সংস্কৃতির অঙ্গ। লাল সিঁদুরের না হয় ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাস -- উর্বরতা-তত্ত্বের সাথে সম্পর্ক আছে। রজস্বলা নারীর রক্তের প্রতীক সিঁদুর। তার জন্মদায়িনীর ভূমিকা ছিল যূথবদ্ধ জীবনে অতীব প্রয়োজন। জমির উৎকর্ষতা তাই। নারী, ভূমি একাকার হয়ে যায় উর্বরতা তত্ত্বে। কৃষিপ্রধান ভারতে আজও মেয়েরা ক্ষেতে বীজবপন করে, বিহু তাই মিলনের, অধিক ফলনের এক নিবিড় কোরিয়োগ্রাফিক রিচুয়াল। কিন্তু লাল রংয়ের বিপ্রতীপ কোণে দাঁড়িয়ে যে শ্বেত শঙ্খ, সে কেন এয়োতির বাহুলগ্ন হবে? শুভ্রতা এক ধু ধু শূন্যতা, সেতো শেষ দৃশ্যে বিমলার বৈধব্যের মরুভূমি। আগেই বলেছি, টারবিনেলা পাইরাম-এর মুখের দিকে এক সরু, দীর্ঘ নালী আছে। সেই নালী বোধ হয় কৃষিজীবি মানুষের কাছে স্ত্রী জননেন্দ্রিয়র সমার্থক মনে হয়েছিলো। কড়ি এক ধরনের শামুক, যার বৈ'¡নিক নাম সাইপ্রিয়া (Cypraea) । কড়ির ব্যবহার মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া গেছে। কড়ির মুখগহ্বের সাথে যোনি পথের লক্ষ্যণীয় সাদৃশ্য আছে। কড়ির একটি প্রজাতির পোশাকি নাম, Cypraea virginianaz কড়ি খেলা তাই, আমাদের বিয়ের এক অঙ্গাঙ্গী আচার। সেই উর্বরতা-তত্ত্ব। মহেঞ্জোদারোর শাঁখায়, 'V' -আকৃতির এক সিন্ধু হরফ খোদাই করা থাকতো যার পাঠোদ্ধার আজো সম্ভব হয়নি। কিন্তু অনুমান করা হয় শাঁখা তখন থেকেই এক বিশেষ সামাজিক প্রথার অঙ্গ।

    যে সামাজিক প্রথা ছিল ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের উত্তরাধিকার তাকে বি'¡নমনস্ক সমাজে টিকিয়ে রাখা কুসংস্কার। অগুনতি টারবিনেলা হত্যা চলেছে এই সামাজিক অ'¡নতার জন্য। লাগামহীন হত্যালীলায় তা সে খাদ্যের কারণে হোক বা সামাজিক আচারের শিকার হোক, অসংখ্য প্রাণী হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। " "In many instances the cultural practices become lethal when they are combined with certain medical religious and technological features of the dominant consumeristic culture'' (Soule, 1986 in Ramakrishna and Dey, 2003)z '' ১৯১৭ সালে হর্নেল লক্ষ্য করেছিলেন মাদ্রাজের পারওয়া সম্প্রদায়ের জেলেরা শুধু খাদ্যের জন্য সংগ্রহ করেছিলো ২৫০,০০০ টারবিনেলা শামুক। আর, ঐ বছরেই তামিল সরকার "hundreds of thousands' শঙ্খ বিক্রি করে রেভিনিউ পেয়েছিলো অর্ধলক্ষ টাকা। আজকে শুধু মানার প্রণালীতেই বছরে ৪৫,০০০ হাজার টন সমুদ্রতল-বাসী (demersals) প্রাণীদের (যাদের অধিকাংশই টারবিনেলা পাইরাম) ধরা হয়। মজার কথা, মান্নার প্রণালীকে অনেকদিন আগেই National Park (৩৬০০ প্রজাতি সমৃদ্ধ এই এলাকা পৃথিবীর অন্যতম Biodiversity hotspot ) বলে ঘোষণা করা হয়েছে (ভেঙ্কটরমন প্রমুখ, ২০০২) যেখানে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ! যারা এখনো টিঁকে আছে তাদের বিবর্তনের নানা রকমের পরিবর্তন দেখা দেয়। কয়েক বছর আগে, আনন্দবাজার পত্রিকায় এক অসাধারণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো, "হায় বড় ইলিশ তোমার দিন গিয়াছে'। এই সাইজ ছোট হয়ে যাওয়াটা বিবর্তনের ইঙ্গিত। আমরা এখন দেখবো, প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে শিকারের ফলে টারবিনেলা পাইরাম-এর কী অবস্থা।

    আগেই বলেছি, টারবিনেলা পাইরাম এক লৌকিক জলপরী। সে কুড়ি মিটার পর্যন্ত গভীর জলে বালির মধ্যে থাকতে ভালোবাসে। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য, সে প্রবালদ্বীপের বাসিন্দা। শুধু প্রবালদ্বীপের নয়, পাইরাম সম্পূর্ণ ভারতীয়, তার বসবাস শুধুই ভারতীয় এলাকার প্রবালদ্বীপের মধ্যে। সমুদ্রের বেশীরভাগ শামুকের জীবন-চক্র চলে, ডিম থেকে শূক (larva) এবং শূক থেকে শিশু শামুক। শূক অবস্থায় তারা জলে ভেসে বেড়ায় এবং বহুদূর পর্যন্ত যেতে পারে। টারবিনেলার এই মধ্যদশা (larval stage) নেই, ডিম থেকে সরাসরি ছানা ফুটে বেরয়। এই জন্যই তাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি কম, তারা ভারতের কিছু খাঁড়ি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। প্রবাল দ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম জটিল ইকোসিস্টেম। সামুদ্রিক প্রাণীর বিভিন্নতা ও প্রাচুর্য এখানে সবচেয়ে বেশী। বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর সহাবস্থান, নির্ভরশীলতা ও খাদ্য-খাদক সম্পর্ক প্রবালদ্বীপকে এক স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে। এ এক স্বয়ং সম্পূর্ণ পৃথিবী, যেখানে জীবন-চক্র নিজস্ব নিয়মে চলে। প্রতিটি প্রাণীর বিশেষ ও নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। টারবিনেলা পাইরাম সমুদ্র তলের ওপরকার বাসিন্দা; মূলত মাংসাশী। জৈবিক ভারসাম্য রাখতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবহমান কাল ধরে শিকারের ফলে টারবিনেলা পাইরাম-এর ভৌগোলিক সীমা সংকুচিত হয়েছে। মহেঞ্জোদারোর সময় কচ্ছ উপসাগর ও করাচীর উপকূলে এদের প্রচুর পাওয়া যেত। এখন এই প্রজাতিটি মূলত শ্রীলঙ্কা-তামিলনাড়ুর অন্তর্বর্তী মান্নার প্রণালীর অধিবাসী। জীববি'¡নের ভাষায় এরা এনডেমিক (আঞ্চলিক), সীমাবদ্ধ এলাকায় এক বিশেষ পরিবেশে এদের বসবাস। যেমন, উত্তরপূর্ব ভারতে একশৃঙ্গ গণ্ডার বা সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার। অবলুপ্তির ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, যেসব জীবজন্তু বা গাছপালা আঞ্চলিক তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বেশী বিপন্ন হয় এবং তাড়াতাড়ি লুপ্ত হয়। অবলুপ্তির আরেক কারণ, কোন প্রজাতির বিলীয়মান সংখ্যা। টারবিনেলা পাইরাম-এর বিলুপ্তির সব কটা কারণই আমরা ঘটিয়েছি। তার ভৌগোলিক সীমা ক্রমশই সংকুচিত হয়েছে। সংখ্যাও কমে আসছে। জেলে বা ডুবুরীরা জাল বা সমুদ্রতলে ডুব দিয়ে জীবন্ত পাইরাম তুলে আনে। ছোট-বড় কেউ বাদ যায় না, কেননা সবই আমাদের ধর্মীয় আচারে কাজে লাগে। তাই যে প্রজাতিটির মৃত্যুদণ্ডের রায় আমরা দিয়েছিলাম, সুনামি বোধ হয় তাকে কার্যকরী করলো। সুনামির বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা এখন সবাই ওয়াকিবহাল। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমুদ্রের অগভীর এলাকা। আর প্রবালদ্বীপ শুধুমাত্র অগভীর জলেই তৈরী হয়। খবরে প্রকাশ, আন্দামান ও তামিলনাড়ুর বেশীরভাগ প্রবালদ্বীপ ধ্বংস হয়েছে বা বালি চাপা পড়েছে (উইলকিনসন প্রমুখ, ২০০৬)। অনেকেই খেয়াল করিনি, সুনামির পরে বঙ্গোপসাগরের নীল জল দুদিন ধরে ঘোলাটে আকার ধারন করেছিল। তার মানে সমুদ্রের তলাকার সমস্ত বালি আলোড়িত হয়েছিল প্রবল আন্দোলনে। সেখানকার অধিবাসীরা আজ নয় মৃত বা উদ্বাস্তু।

    কোন প্রাণীর বিলুপ্তি ঘোষণা করতে বৈ'¡নিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়। যদি দেখা যায় টারবিনেলা পাইরাম আর বেঁচে নেই, বর্তমান প্রবন্ধটিকে একটি খুনের কাহিনি হিসেবে পড়তে হবে। আর, যদি সংখ্যায় নগন্য হলেও এরা বেঁচে থাকে, একে সংরক্ষণ করতে হবে। বিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। যে প্রাণীটি মানুষ দ্বারা সবচেয়ে আক্রান্ত (বাঘ, গণ্ডার নয়, অলিভ কচ্ছপ নয়) তাকে আমরা এখনো Wild Life Act (1972, 1991) অনুযায়ী 'Schedule' (বিলুপ্তপ্রায়) ঘোষণা করতে পারিনি (রামাকৃষ্ণ ও দে, ২০০৩)। আমরা পশুর চামড়া দিয়ে তৈরী পোশাক ও অন্যান্য জিনিষ বেআইনি ঘোষণা করেছি। কুটীর শিল্প বাঁচাতে আসুক শঙ্খের প্লাস্টিক বিকল্প। ঠাকুর ঘরের বিগ্রহও তো সোনার বা পিতল মূর্তি মাত্র! "ফেলে দাও রেশমি চুড়ি'-র মতো আহ্বান জানানোর অধিকার আমার নেই। তবে বাঙ্গালী জায়াদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার একটি লাইন শোনাবো, "হলুদ শাড়ি আর পরো না / এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি' (ধান, বন্দী জেগে আছো কাব্যগ্রন্থ)।

    গ্রন্থপঞ্জী :

    1. Dash, J. 2003, Srestha Kabita, Varbi Publishers, 10th Reprint, Kolkata.
    2. Gangopadhyay, S. 2001 Kabita Samagra, Part-1, Ananda Publishers, Kolkata.
    3 Gaur, A. S., S. Patankar and V Patankar, 2005. Ancient shell industry at Bet Dwarka Island; Current Science, Vol. 89(6) pp. 941-946
    4. Hornell, J., 1915. The Indian Conch and its relation to Hindu Life and Religion, London
    5. Hornell, J., 1917. The edible molluscs of the Madras Presidency. Madras Fisheries Bulletin, 11:1-51.
    6. Kenoyer, J.M., 1984. Shell Working Industries of the Indus Civilization: A Summary. Paléorient. Vol. 10(1), pp 49-63.
    7. Kenoyer, J.M., 1992. Ornament Styles of the Indus Valley Tradition: Evidence from recent excavations at Harappa, Pakistan. Paléorient. Vol. 17(2), pp 79-98.
    8. Ramakrishna and Dey, 2003. Mannual on Identification of Schedule Molluscs from India, Zoological Survey of India.
    9. Sen, D.C., 1935. Brihat Banga, Vol. 2, Calcutta.
    10. Venkatrama et al. 2002. Faunal Diversity of Gulf of Mannar Biosphere Reserve. Conservation Area Series 15, Zoological Survey of India.
    11. Wilkinson, C., D. Souter, and J. Goldberg. (eds.) 2006. Status of Coral Reefs in Tsunami Affected Country: 2005. Australian Institute of Marine Science, Townsville, Queensland. 160p.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৮২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন