এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • বিড়ালবৃত্তান্ত

    অর্পণ চৌধুরী
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৭৫৬ বার পঠিত


  • বেড়াল বেড়াল কেমন বেড়াল?

    বিড়াল দুই প্রকার। গৃহপালিত ও বন্য। যে সকল বিড়াল ঘরে থাকে তারা গৃহপালিত। আর যারা বনে থাকে তাদের বলে বনবিড়াল। গৃহপালিত ও বন্য উভয় বিড়ালই গুম্ফশোভিত। কবি বলে গেছেন শিকারী বিড়াল মাত্রই গোঁফ দিয়ে চেনা যায়। এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় সকল বিড়ালই স্বভাবগতভাবে শিকারী। গৃহপালিত বিড়ালেরা আরামপ্রিয়, দুধটি-মাছটি-মুড়োটি খেয়ে তেল চুকচুকে, গণতন্ত্রপ্রিয় ও ধুতিপাঞ্জাবিতে সজ্জিত। চৌর্যবৃত্তিতে এদের বিশেষ পারদর্শিতা দেখা যায়। বন্য বিড়াল স্বভাবে জঙ্গী, বিপ্লবের আদর্শে দীক্ষিত ও গেরিলা যুদ্ধে পটু। আত্মগোপন করে থাকে বলে অধিকাংশ সময় এদের মুখ গামছাবৃত থাকে। গৃহপালিত বিড়াল ও বন্যবিড়ালের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে পৃথিবীতে অনেক কবিতা ও গান রচিত হয়েছে। খাঁচার বেড়াল বনাম বনের বেড়াল গানটি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

    বি.দ্র.-উদবিড়াল কিন্তু বিড়াল নয়। উহা জলপুলিশের আন্ডারে।


    খিল খিল্লির মুল্লুকেতে থাকতো নাকি দুই বেড়াল

    বিড়ালেরা গভীর রাজনৈতিক সচেতন। রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে তাদের সমাজ বহুধাবিভক্ত। এই কারণে তারা কলহপ্রবণ। খবরের কাগজ ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের স্টুডিওতে সেলিব্রিটি বিড়ালদের কলহ অতীব মুখরোচক। সেলিব্রিটি বিড়াল মাত্রেই আম বিড়ালের চেয়ে বেশি বুদ্ধির অধিকারী। এইজন্য এই প্রজাতির বিড়ালদের সেরেবিড়াল বলা হয়ে থাকে। বিড়ালসমাজ মূলত সাদা (স্থানভেদে শাদা) ও কালো এই দুই রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত। সাদা বিড়ালেরা স্বাধীনতাপ্রিয় ও উদারপন্থী। এদের লিবেড়াল বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে কালো বিড়ালেরা আধিপত্যকামী ও অন্য বিড়ালদের প্রতি অসহিষ্ণু। ইতিহাসে এরা ব্ল্যাকশার্ট নামে কুখ্যাত। "ফ্যাঁস' শব্দের মাধ্যমে এরা নিজেদের ফ্যাঁসিবাদী পরিচয় জানান দেয়।

    এছাড়া সংখ্যায় কম হলেও লাল রঙের বিড়ালও ইতিউতি দেখা যায়। সামগ্রিকভাবে এদেরকে তৃতীয় ফ্রন্ট বলে (যদিও এদের মধ্যে মতাদর্শগতভাবে বহু শাখা উপশাখা দেখা যায়)। লাল বর্ণের বিড়ালেরা উঁচুমার্গের তাঙ্কিÄক, ম্যানিফেস্টো লেখে আর অন্যান্য বর্ণের বিড়ালদের প্রতি সন্দেহের চোখে তাকায়। কথিত আছে একদা এদের এক চেয়ারম্যান মোলায়েম "মিঁয়াও'-র বদলে জঙ্গি "ম্যাঁও' ডাককে জনপ্রিয় করেন। সেই থেকে লাল বিড়ালদের একটি অংশ ম্যাঁওবাদী নামে পরিচিত। এরা অন্যান্য ফিকে লাল বর্ণের বিড়ালদের সংশোধনবাদী বলে খিল্লি করে থাকে।

    (পাল্টে যাওয়া সময়ে এক বৃহদংশ লাল বিড়াল তাদের বর্ণদৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে ফেলেছে। রং যাই হোক না কেন যে বিড়াল ইঁদুর ধরে সেই ভালো বিড়াল, এই যুগান্তকারী প্রবাদবাক্য ইতিমধ্যে বিড়ালদের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে।)

    ও কেউ নয়, ভয় পাসনি বিমলা,
    ও তো বিড়াল
    চুরি করে মাঝরাত্রে দুধ খেয়ে পালালো!

    ইহা বিড়াল বিষয়ক একটি দুষ্টুমিষ্টি কবিতার শেষ তিনলাইন। কবিতাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটি হুলোবেড়াল, যে কিনা মাঝরাত্রে প্রায়ই দুধ চুরি করে খেয়ে পালায়। হুলোদের শুধু চোর হিসেবে দুর্নাম আছে তাই নয়, সুযোগ পেলেই তারা মেনিদের পিছনে লাইন লাগায়। একটি মেনিকে নিয়ে দুই বা একাধিক হুলোকে প্রায়ই লড়তে দেখা যায় আর বিজয়ী হুলোটি মেনিটিকে জীবনসঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করার সুযোগ পায়। এই জৈব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকে ন্যাচারাল সিলেকশন বলা হয়ে থাকে। বিয়ের পরে সকল হুলো মেনিদের কথা মন দিয়ে শোনে, তখন তাদের নাম হয় মেনিমুখো।

    এদিকে এক প্রখ্যাত চিত্রপরিচালকও বিড়ালদের নিয়ে ঘরে বাইরে নামে একটি সামাজিক ছবি বানিয়েছেন। ছবিটিতে নিখিলেশ নামে এক ভেজা বেড়াল (ঘরোয়া) ও তার বিপ্রতীপে সন্দীপ নামে এক বিড়াল তপস্বীর (বহির্মুখী) দেখা মেলে। আলোচ্য ছবিটি ও উদ্ধৃত কবিতা দুটিতেই বিমলা নামে এক চরিত্রের কথা আছে। যদিও জানা যায় না উভয়েই একই চরিত্র কিনা। কবিতা থেকে এও জানা যায় না বিমলা কার জন্য মাঝরাত্রে চুপিচুপি দুধ (হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষীর) সাজিয়ে রাখে। লক্ষ করে দেখবেন, দুধ সাজিয়ে রাখে বিমলা আর সেই দুধ যায় হুলোর পেটে। কোন সে হুলো, সন্দীপ না নিখিলেশ, নাকি অন্য কেউ (নেপো), তা সে জানেই না। কোনো হুলো কখনো তার জন্য দুধের গ্লাস সাজিয়ে রাখে কিনা তাও জানা যায় না। বিড়ালসমাজ যে ঘোর পুরুষতান্ত্রিক এসব থেকেই বেশ বোঝা যায়।


    সারা দিন একটা বেড়ালের সাথে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়:

    বিড়াল সমাজবদ্ধ প্রাণী নয়। বিড়াল একা নিজের বৃত্তে থাকতে ভালোবাসে। প্রতিটি বিড়ালেরই আছে একটি মুক্তাঞ্চল। এইভাবে প্রতিটি বিড়াল একাধারে সুশান্ত ঘোষ ও কিষেণজি। বিড়ালদের এই দ্বৈত সত্তাকে কবি ও সাহিত্যিকরা বিড়াল ও রুমাল প্যারাডক্স বলে অভিহিত করে থাকেন। সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক শ্রুডিঙ্গার সাহেব তাঁর পোষা বিড়ালটিকে গিগা কাউন্টারওলা একটা ফ্লাস্কে বন্দি করে দিয়ে বিড়ালের দ্বৈত সত্তা প্রমাণের চেষ্টা করেন। পরীক্ষাটির অসম্ভাব্য ফলাফলের কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে। যদিও একদল প্রথম থেকেই বিড়ালের গলায় ঘন্টা পরিয়ে তাকে ফ্লাস্কে ঢোকানোর কথা বলে আসছিলেন, অতি দুরূহ বলে সংখ্যাগুরু অংশ সেই প্রস্তাবে জল ঢেলে দেন। মোটামুটি এর পর থেকেই বিড়াল অ্যানিমাল প্ল্যানেটে হিরো হিসেবে গণ্য হতে থাকে। আর ফস্কে যাওয়া চান্স বোঝাতে বেড়াল মারার বিখ্যাত প্রবাদটি এই সময়েই জন্ম নেয়।


    উপসংহার

    মেলা বাজে ভাট হল। শেষ করার আগে এইবার চাট্টি কাজের কথা বলা যাক। গোদা বাংলায় বিড়াল এক আশ্চর্য প্রাণী। বিড়ালের আত্মা সূর্যসন্ধানী ও সদানন্দ। তা স্থাণু হয়ে থাকে সকাল ন'টার রোদে, হাসপাতালের হলুদ দেওয়ালের পাশে, সামান্য "কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতা'-য় লীন হয়ে। ক্ষীরের পুতুল - হেমন্তের মায়াবী সন্ধ্যা - মহাযুদ্ধ ও মহামন্দা - মন্বন্তর - দেশভাগ সবই দেখে সে নির্লিপ্ত চোখে। নয়-নয়টি জীবন পেরিয়ে আসে সে। সাদা মাটির সিল্যুয়েটে জেগে থাকে তার আশ্চর্য সেই থাবা।

    "Please would you tell me," said Alice..."why your cat grins like that?"
    "It's a Cheshire cat," said the Duchess, "and that is why."

    ছবি- সুমেরু মুখোপাধ্যায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৭৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন