
তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পরে সম্ভবতঃ তাদের জনভিত্তির উৎসগুলি অনুসন্ধান করার দরকার কিছুটা বেড়ে যায়। আমরা বরং উল্টোভাবে দেখি, তৃণমূলের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগগুলি কী ছিল- দুর্নীতি, মুসলিম তোষণ এবং কর্মসংস্থানের অভাব। আমরা এই আপাতত তিননম্বর পয়েন্টটা দেখি। একথা সত্য সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে বিশাল কর্মহীনতা দেখা গেছে। এপ্রিল ২০২০তে ১৭% বেকারত্ব ছিল বাংলায়, কিন্তু সে তো লকডাউনের পর্যায়, যখন ভারতের কর্মহীনতা ২৩ শতাংশে ছিল, সারা পৃথিবীতেও সম্ভবতঃ ছিল। বিরোধীরা বুঝেছিলেন যে মানুষ এই পরিস্থিতির দায় সরকারের উপরই চাপাবে, কিন্তু এক বড় অংশের মানুষের কাছে কর্মহীনতার সমস্যা সবচেয়ে বড়ো ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় নি, তা ভোটের ফলে দেখলাম। তাহলে, লকডাউনের আগের বেকারত্বের অবস্থা কী ছিল সেটা একবার দেখে নিই। cmieর ওয়েবসাইটে পশ্চিমবঙ্গের বেকারি হার ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি যা দেখলাম, তা জাতীয় গড়ের থেকে খুব খারাপ নয়। বরং, ডিমনিটাইজেশনের পরের কিছু সময় বাদ দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জাতীয় গড়ের থেকে কম এবং তাতে খুব বেশি ওঠা নামা নেই। মোট কর্মক্ষম জনতার মধ্যে কত শতাংশ কাজে অংশগ্রহণ করছেন, সেই হিসেব দেখলে তা জাতীয় গড়ের থেকে বেশ কিছুটা ওপরে, তামিলনাড়ূ বা কর্ণাটকের সঙ্গে তুলনীয়। ২০১১-১২ র তুলনায় ২০১৭-১৮য় কর্মসংস্থান বাড়ার হার বাংলায় বেশি বলে একটা সার্ভে পাচ্ছি, এবং বিশেষ করে মহিলাদের নিযুক্তি বেড়েছে। উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার ৭.৬%, যা জাতীয় গড়ের থেকে খুব সামান্য কম। তাহলে, লকডাউনের সমস্যাকে আলাদা করে নিলে, কর্মসংস্থানের সমস্যা সার্বিকভাবে বাংলায় বাকি দেশের থেকে আলাদা নয়, এটুকু দেখা যায়। এরকম হতে পারে, স্বচ্ছল শ্রেণির চাকরির মানের সমস্যা আছে। এইবার, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে সচরাচর যা অভিযোগ, এখানে নতুন বড় ও ভারি শিল্প বহুবছর হয় নি। শিল্প এলে কর্মসংস্থান হত। বস্তুত, তৃণমূল সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে সিংগুরের শিল্প উদ্যোগ ব্যর্থ করার ঘটনাক্রমেই। আমরা সত্যিই জানি তারপর সেরকম ভাবে বড় শিল্প এই রাজ্যে আসে নি বরং চা-বাগান থেকে পাটকল অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে কর্মসংস্থান জুটছে কী করে? সেইটাই এই লেখায় দেখার চেষ্টা করব। এবং এ-ও দেখব, কর্মহীনতাই কি আসলে এই রাজ্যের বাস্তব, যা ঢাকা রাখা হয়েছে বিভিন্ন ভাতা ও প্রকল্পের মধ্যে?
ভারি শিল্পে প্রচুর চাকরি হয়, এই দাবি নিয়ে বহুদিনই ওয়াকিবহাল মহলকে সন্দেহ প্রকাশ করতে দেখা যায়। বরং তাঁরা বলেন যে ভারি শিল্পের অনুসারী শিল্পই আসলে কর্মসংস্থান দেয়। তাহলে, কর্মসংস্থানের জন্য ছোট উদ্যোগগুলির অবস্থা পর্যালোচনা করা দরকার। আমরা ভারতসরকারের ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র শিল্প মন্ত্রকের বিগত একদশকের রিপোর্টগুলি দেখার চেষ্টা করলাম। ২০১৯-২০র রিপোর্টে ২০১৫-১৬র পরিসংখ্যান দেওয়া আছে। সেই তথ্য বলছে বাংলায় ১.৪ কোটি লোক ৮৮ লক্ষ এম এস এম ই ইউনিটে নিযুক্ত। ইউনিটের সংখ্যা উত্তরপ্রদেশের (একনম্বরে, ৮৯ লাখ) থেকে সামান্য কম। অথছ ২০০৬-৭ এ উত্তরপ্রদেশে ৪৪ লক্ষ ইউনিট ছিল, বাংলায় ছিল ৩৪ লক্ষ, তৃতীয় স্থানে ছিল তামিলনাড়ু (৩৩ লক্ষ)। তামিলনাড়ূর সাম্প্রতিক ইউনিট সংখ্যা বাংলার প্রায় আদ্ধেক। আমরা অতিসাম্প্রতিক তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারি সাইটে পাইনি। রাজ্যসরকার দাবি করেছে এম এস এম ইর বিকাশ অব্যাহত থেকেছে, তার হার বেড়েছে। তবে এও বিভিন্ন সংবাদপত্রে দেখেছি যে বাংলার ছোট শিল্প লকডাউনে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্য রাজ্যের থেকে বেশি। একটা জিনিস খুবই আকর্ষণীয় যে বাংলায় মহিলা কর্মীর সংখ্যা সর্বাধিক। উত্তরপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে যেখানে ২৭ লক্ষ মহিলাকর্মী, বাংলায় সেই সংখ্যা ৪৩ লক্ষের বেশি। মহিলা মালিকের সংখ্যাও সর্বাধিক বাংলায়, ২৯ লক্ষ, যা দ্বিতীয়স্থানে থাকা তামিলনাড়ুর দ্বিগুণ। সারাভারতের মহিলা ক্ষুদ্রশিল্প মালিকের ১/৪ অংশ বাংলার। এই রিপোর্টগুলি থেকেই এই সরকারের এই ধরণের শিল্প নিয়ে একটা পরিকল্পনা চোখে পড়ে। ২০১১-১২ থেকে ক্ষুদ্রশিল্পে সরকারি সাহায্য পশ্চিমবঙ্গে অনেকটা বেড়েছে। ২০১০-১১তে পশ্চিমবঙ্গ মহারাষ্ট্র উত্তরপ্রদেশে সাড়ে তিন হাজারের মতন ইউনিট সরকারি সাহাযা পেয়েছিল, যেখানে পরের বছর বাংলায় সংখ্যাটা দেড়গুণের বেশি বেড়ে যায় এবং এই সাহায্য পরের বছরগুলিতে বেড়েছে। এখানে আমরা দু-তিনটে জিনিস লক্ষ্য করতে পারি- ক) ক্ষুদ্র অতিক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান প্রচুর হয়েছে এই রাজ্যে, মানে বাকি রাজ্যগুলির তুলনায়; খ) এই কর্মীগোষ্ঠীতে মহিলাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য; এবং গ) এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ- মালিক শ্রমিক অনুপাত দেড় এরও কম অর্থাৎ এগুলি খুবই ছোট ইউনিট, অনেকক্ষেত্রে একজন মালিক নিজেই সর্বসময়ের কর্মী, একভাবে স্বনিযুক্তিও। এই তিন নম্বর পয়েন্টটা ভাতার আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে আরেকধরণের কর্মসংস্থানের কথা আমরা শুনি, যা ব্যাপকহারে হয়েছে এবং মহিলাদের অংশগ্রহণ খুব বেশি। তা হল স্বনির্ভর গ্রুপগুলি। মাসিক আয় ১৫০০০ এর বেশি নয় এরকম পরিবারগুলির থেকে স্বনির্ভর গ্রুপ গড়ে তোলার জন্য একাধিক প্রোগ্রাম সরকার নিয়েছেন বিগত দফাগুলিতে। স্বনির্ভর গ্রুপ সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে শুরু করেছিল। তৃণমূলের দুটি দফায় তাদের জন্য ট্রেনিং, এককালীন অনুদান এবং সহজ লোনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও কর্মীদের জন্য ইনিশিওরেন্স ও অন্যান্য সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে। ন্যাশনাল ব্যাংক ফর এগ্রিকালচারাল এবং রুরাল ডেভেলেপমেন্টের সমীক্ষা (২০১৮) অনুযায়ী স্বনির্ভর গ্রুপের উদ্যোগ সারা ভারতের মধ্যে বাংলায় সবচেয়ে সফল। এখানে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ স্বনির্ভর গ্রুপ আছে, যাদের মাধ্যমে প্রায় দুলক্ষ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হিসেব মতন তারা কুড়ি হাজারেরও বেশি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে গত দশবছরে সাহায্য করেছেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কোনও পরিবার থেকে একজন সদস্যই সামিল হতে পারবেন এবং এর মধ্যে প্রায় একচেটিয়াভাবে মেয়েদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। পরিশেষে বলার, অনেক ক্ষুদ্রশিল্প স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।
উপরের আলোচনাগুলো থেকে দেখা যায়, গরিব মানুষের কর্মসংস্থান এবং আয়ের একধরণের নিশ্চয়তা তৃণমূল সরকার দিতে পেরেছে। এবং, বাকি ভারতের তুলনায় সেই উদ্যোগ এখানে খুব পিছিয়ে নেই বরং মহিলাদের অংশগ্রহণ আলাদা করে চোখে পড়ার মতন। এই উদ্যোগগুলি গড়ে তোলার পিছনে সরকারি নানা সাহায্য, ট্রেনিং, ঋণ এবং সরাসরি অনুদানের ভূমিকা আছে। এবার লক্ষ্য করার, এই সবগুলিই স্বনিযুক্তি মূলক বা খুব ছোট সংস্থার মাধ্যমে। এগুলি নিয়মিত চাকরি নয় যে মাসের শেষে বাঁধা মাইনে ধরা থাকবে। তেমনই বড়ো উদ্যোগের মতন কর্মীদের স্বাস্থ্য বাসস্থানের সুবিধে বা পেনশনের ব্যবস্থা এর মাধ্যমে হবে। আবার বাজারের ওঠাপড়া বা লকডাউন ডিমনিটাইজেশনের ফল ঝড়ের মতন এদের উপর আছড়ে পড়বে। বড় সংস্থার মতন বা সরকারি চাকরির মতন একটা ন্যূনতম রোজগারের নিশ্চয়তা এতে নেই। সেইজন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপারটা। ধরুন একজন ক্ষুদ্রতম উদ্যোগীর বাড়িতে একজনের শরীর খারাপ হল, বৃষ্টিতে বাড়ির চাল পড়ে গেল বা যে শিল্পের সঙ্গে তিনি জড়িত, তার কাঁচামাল আসা বন্ধ হয়ে গেল কয়েকমাস। তখন তিনি কীভাবে টিঁকে থাকবেন? এইটুকু ক্ষমতায়নের জন্য স্বাস্থ্যসাথী, গৃহশ্রী বা খাদ্যসাথী মতন প্রকল্প জরুরি হয়ে পড়ে। বড় নিযুক্তির বদলে সরকার নিজেই সেই সুরক্ষা দিচ্ছেন এইখানে। এই ভাতাগুলি না থাকলে এই স্বনিযুক্তির অর্থনীতি চলবে না। আমরা যদি সরকারি প্রকল্পগুলি দেখি, তার অনেকগুলিই আসলে পেশদারি ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এবং সেইজন্যে বিশেষ বিশেষ টার্গেট গ্রুপকে (মহিলা- কন্যাশ্রী রূপশ্রী সবলা, নির্যাতিত মহিলা, যৌনকর্মী- স্বাবলম্বন, গরিব মহিলা- আনন্দধারা, যুবক যুবতী- গতিধারা, যুবশ্রী, অনগ্রসর কিশোর কিশোরী- শিক্ষাশ্রী, এমন কী স্বনিযুক্ত মহিলাদের জন্য শিশুআলয়) লক্ষ্য করে। বর্তমান সরকার দুটি প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে- মহিলাদের ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করা এবং দুয়ারে রেশন (যা হয়ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে হবে)। আমরা খেয়াল করি, এই ভাতাগুলি আসলে সেই সুরক্ষা দেয় যার উপর দাঁড়িয়ে পারিবারিক স্বচ্ছলতার প্ল্যাটফর্ম ব্যতীতই একজন নিজের পেশাদারি জীবন শুরু করতে পারেন।
এই আলোচনায় আমরা ১০০ দিনের কাজের কথা উল্লেখ করলাম না। তাতেও পশ্চিমবঙ্গের পার্ফর্ম্যান্স দেশের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। কিন্তু সেই কাজও যেহেতু ১০০দিনেরই মাত্র, তাও পুরো ১০০ দিন কেউই প্রায় পায় না, বাকি সময়ের জন্য সামাজিক সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়। অনিশ্চিত ছোট অন্যান্য উদ্যোগের মতন এখানেও অনিশ্চিত অংশটুকু সমাজ না দেখলে মানুষ সেটা সামলে উঠে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন কী করে? সরকার সমাজের হয়ে সেই ভূমিকাটা একটা মাত্রা নিচ্ছেন বলেই মনে হয়। অর্থাৎ, আমরা দেখলাম এই রাজ্যে সাধারণ মানুষের রোজগার নেই এরকম না। কিন্তু সেই রোজগার নিশ্চিত করতে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন, যার মধ্যে বিভিন্ন ভাতা অনুদানও এসেছে। সরকারি যেকোনও অনুদানমূলক ব্যবস্থায় দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকে। আমরা বিগত সরকারের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ শুনেছি। সেইগুলি নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনার অন্য পরিসর আছে।
বিশ্বেন্দু নন্দ | 45.112.***.*** | ০৫ মে ২০২১ ১৭:১২105522আমরা কারিগর সংগঠনের পক্ষে বার বার বলে এসেছি এমএসএমই এবং কারিগরি ব্যবস্থার চরিত্রের মধ্যে বিপুল পার্থক্য আছে,সেটা কোনওভাবেই বর্তমান সরকারি স্তরে ক্ষুদ্র অতিক্ষুদ্র এই ধারণায় ধরা যায় না। এমএসএমই মূলত বড় পুঁজি নির্ভর উদ্যমের অনুসারী প্রকল্প যা স্বনির্ভর হিসেবে গণ্য হলেও স্বনির্ভর নয় মূলত বড় পুঁজির বিনিয়োগ প্রযুক্তি চাহিদা ইচ্ছে বাজার নির্ভর। ফলে কর্পোরেট পুঁজির প্রযুক্তি বাজার ইত্যাদি পাল্টালে এই উদ্যমগুলির নাভিশ্বাস ওঠে। কলকাতার আশেপাশের হাওড়া অঞ্চলে গত সহস্রাব্দের অনুসারী শিল্পর ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমার এই বক্তব্যকে পুষ্ট করে। অন্যদিকে কারিগরদের প্রযুক্তি নিজের বাজার নিজের কাঁচামাল নিজের ফলে তাকে কারোর ওপর ভরসা করে উৎপাদন করতে হয় না সে নিজের কাজেই স্বরাট।
এখন সমস্যা হল সরকারি বাবুরা এ নিয়ে কোনও দিন ভাবেন নি তারা এই দুটি সেক্টরের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পান না। তাই এমএসএমই বিপুল বরাদ পায় আর কারিগরদের জন্যে কিছু বাঁহাতি মেলা ইত্যাদি বরাদ্দ দিয়ে দায়িত্ব খালাস করে দেন।
আরেকটা সমস্যা মহিলা স্বরোজগার দলগুলোর বিপুল পুঁজি প্রায় নিকম্মা হয়ে বিওসে রয়েছে। জেলায় জেলায় বিপুল বিনিয়োগে তৈরি সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল কৃষক মাণ্ডির মতই সেগুলি কোনও কাজের নয় কারন অধিকাংশ স্বরোজগারী সংগঠন এই বিপুল সম্পদ নিয়ে কী করবে জানে না। এ নিয়ে সরকারকে বলতেও ভয় করে কারন তাহলে তারা ম্যাকিনসে টাইপের পরামর্শদাতা সংগঠনকে ভাবার দায়ত্ব দিয়ে এই বিপুল অর্থকে হয়ত শেয়ার বাজারে নিয়ে ফেলবেন বা কর্পোরেটদের ভোগ্য করে তুলবেন।
পুঁজি বসে থাকলে এদের রোজগার হয় কীভাবে?
বিশ্বেন্দুবাবুর ভ্যালিড পয়েন্ট ও সোমনাথের প্রশ্নের উত্তর শোনায় আগ্রহী।
তাসত্ত্বেও বলব এই নিবন্ধটি বেশ কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত তুলে ধরেছে। বিশেষ করে সাপোর্টের পয়েন্টটা। ১৯৮০-৯০ এর সময় ছত্তিশগড়ের গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে আই আর ডি পি ইত্যাদি স্বরোজগার প্রকল্পের সময় খেয়াল করেছি স্বল্প পুঁজির কারিগরি বা দোকানদারির স্টার্ট আপগুলো ওই সাহায্যের অভাবে কেমন করে অল্প ঝড়েই নেতিয়ে পড়ে। পরিবারের একজনের অসুখ হলে বা কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় এলে। যেহেতু এদের কোন সঞ্চয় বা ব্যাক আপ নেই, তাই ওরা প্রথমেই ব্যবসায়ের পুঁজি ভেঙে ফেলে এবং এর ভিশিয়াস সাইক্ল এসে ফেঁসে সর্বস্বান্ত হয়।
আর্গুমেন্টটি একটি গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে বলতে চেষ্টা করছি।
ধরুন, এই স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ এবং তার ফলে আউটপুট বৃদ্ধিকে যদি এই ভাবে দেখাই y=mx , যেখানে x= পুঁজি বিনিয়োগ(ধরুন ঋণ), y= উৎপাদন বা ট্রানজাকশন, এবং m= গুণক, যা আসলে ব্যবসায়ে ভ্যালু বৃদ্ধির সূচক, এখানে m>1.
তাহলে আমরা ঋণ দিয়ে আশা করি যে যতটুকু দিয়েছি বছর ঘুরতে ঘুরতে তাতে ভ্যালু অ্যাড হয়ে ওর আয় এবং সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে । ও ক্রমশঃ গরীবি রেখা পার করার দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু ওর আর্থিক কাজকম্মের আসল গাণিতিক ছবিটি হল
y= mx+ c; , যেখানে c= বেঁচে থাকার জন্যে ন্যূনতম খরচ , এতে খাদ্য, চিকিতসা ও কিছু আনুষঙ্গিক ব্যয় ধরা হয়েছে।
এখানে আমরা লোন দেয়ার সময় c কে হিসেবের মধ্যে না ধরে কেবল উৎপাদন ব্যয়ের জন্যে আবশ্যক পুঁজির হিসেব লাগাতাম। ফলে শিগগিরই c= y-mx, হয়ে যেত। অর্থাৎ কনসাম্পশন নীডের সাশ্রয় হত পুঁজি বা আয়ের একটা অংশ পুনঃ বিনিয়োগের বদলে উপভোগে। আর্থিক প্রয়াস যেত মায়ের ভোগে। সোমনাথ এই দরকারটা খেয়াল করেছেন ।
রঞ্জন-দা, বিশ্বেন্দুদার কাছ থেকে আরও বিশদে কারিগরদের নিয়ে জানতে পারলে ভালো হবে। বিশেষতঃ সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁরাও তো এম এস এম ই তে পড়েন, তাহলে প্রকল্পগুলির মধ্যে তাঁদের অ্যাকমডেট করা হয় না কেন, সেটাও। আমার ধারণা ছিল এম এস এম ই নিয়ে সার্বিক উদ্যোগে কারিগররাও পুষ্ট হচ্ছেন।
সেলফ হেল্পগ্রুপ নিয়ে আমার ধারণা কম, কিছু ডকুমেন্ট পড়েছি কেবলমাত্র। বিশ্বেন্দুদা লিখলে ভালো হয়।
স্বাতী রায় | ০৫ মে ২০২১ ২২:০৭105542আমাদের কর্ম সংস্থানের ধারণার মধ্যে কি খানিকটা সামাজিক সমস্যাও লুকিয়ে আছে? গত কয়েক বছরে মুলত কাজ বেড়েছে সেলফ-হেল্প আর স্বনিযুক্তি প্রকল্পে। সেখানে আয় অনিশ্চিত, সুরক্ষা নেই ,কাজ ও অনেক সময় সিজনাল। প্রেস্টিজও কম বোধহয়। যদিও বেকারত্বের হার ভারতের গড়ের তুলনায় কমই এখনও,তবু কিছু ডেটা এলার্মিং। বেকারত্ব ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে প্রায় ৩০% ,গ্রাজ্যুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রি ধারীদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ। লক ডাউন পুর্ব ডেটা। শিক্ষিতরা বিশেষত শহুরে শিক্ষিত ছেলেরা চান নিয়মিত আয় , বিভিন্ন সুরক্ষা । অনেকেই ভাবেন সেলফ-হেল্প আর স্বনিযুক্তির কাজ প্রাইমারি ব্রেড আর্নারের জন্য নয়। ওসব খুচরো কাজ মেয়েদের জন্য। ছেলেদের চাই নিরাপদ চাকরি চান, আয়ের নিরাপত্তা, সুরক্ষার নিরাপত্তা।
এই চাহিদাটা মেটান যাচ্ছে না। সরকারি চাকরির সংখ্যা কমেছে ,পার্মানেন্ট নিয়োগ কমছে। আই টিতে নাকি চাকরী বেড়েছে ,তবে সে তো বেশিটাই বেসরকারিতে - সেখানে ইঞ্জিনীয়র পান দশ হাজার টাকা ( অবশ্য শুনেছি ,সত্যি কিনা জানি না টো টো চালক নাকি মাসে পান আট হাজার টাকা । ) এদিকে টেট ইত্যাদি বন্ধ।
বছর বছর টেট জাতীয় পরীক্ষা নিয়ে চাকরী দেওয়ার জন্য কোষাগারের শক্তি আছে কি? জানা নেই। এদিকে ভারি শিল্প একেই আসার চান্স নেই আর এলেও কতজনকে চাকরি দেবে কতটা পরিবেশের ক্ষতি করবে সেগুলো ডিবেটেবল। শিক্ষা কি তাহলে আমাদের বুমেরাং হয়ে গেল? কর্মসংস্থানেরসমস্যার সঙ্গে কি শিক্ষাকে জড়িয়ে নিয়েই ভাবা উচিত?
স্বাতী রায় | ০৫ মে ২০২১ ২২:৩২105543বাই দ্য ওয়ে, আমার আগের মন্তব্যটা সোমনাথের লেখার বিষয়ের সঙ্গে খুব একটা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত না,তবু পরোক্ষ সংযোগ খানিকটা আছে বলে মনে হয়। অনুদানের প্রয়োজন আরও বাড়বে যদি অসংগঠিত কর্মক্ষেত্র আরও বাড়ে আর সংগঠিত কাজের জায়গা আরও ছোট হয়। কাজেই অনুদানকে গালি না দিয়ে বরং তার এফেক্টিভ ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামান যাক।
স্বাতীদি, আমি একমত।
১) শিক্ষাকে বাজারে টেলর মেড ম্যানপাওয়ার সরবরাহের একটা উপায় করে তোলা হচ্ছে। এইটা খুব বিপজ্জনক। একজন পার্টিকুলার ফিল্ডে এক্সপার্টাইজ করে সেই ফিল্ডের চাকরিই শুধু করবে, প্রযুক্তি পালটে গেলে সে ফালতু হয়ে পড়বে। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে শিক্ষা আর পেশা আলাদা হওয়ার দরকার আছে। শিক্ষা একটা ভিত দেবে, যার উপরে বিভিন্ন রকম পেশা, স্বনিযুক্তি বেছে নিতে পারবে।
২) আজকের দিনে অনেকে স্টার্ট আপ খুলে এই চেষ্টা করেন, তাঁরা হাতে গোণা। কারণ পারিবারিক সুরক্ষা হাতে গোণা লোকের থাকে। তাই সামাজিক সুরক্ষা অনেককে সেইভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে।
সামাজিক সুরক্ষাকে ভিক্ষাণ্ন দেখার সভাব সো কলড বামপন্থীদেরও আছে। সেটাকে ক্ষমতায়ন হিসেবে দেখলে ভালো। এবং মমতা এই টার্মে সম্পূর্ণ অন্য রাস্তায় যেতে পারেন বা ইমপ্লিমেন্টেশনে ঢিলে দিতে পারেন। সেইখানে ওয়াচডগ থাকার দরকার।
সোমনাথ
রণবীর সমাদ্দারের ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি) বঙ্গ, বিহার, দিল্লি, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, তামিলনাড়ুর এই ধরণের সোশ্যাল সাপোর্টিভ সবকিছুর একটা স্টাডি করে রিপোর্ট পাবলিক করেছে। তাতে এগুলোর ইকনমি, সোশ্যাল সিকিউরিটি, প্রান্তিক মানুষের জন্য কতটুকু কাজে আসে এবং ভোটের বাক্সে প্রভাব সব বিষয়ে মোটের ওপর পজিটিভ মনে হয়েছে। আদৌ ভিক্ষান্ন নয়।
arin | 161.65.***.*** | ০৬ মে ২০২১ ০১:৪৫105558রঞ্জন বাবু সোমনাথ স্বাতী , এই সমস্যা কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে বাড়বে বই কমবে না | আমরা কয়েকজন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুজ্ঞের পটভূমিকায় এই নিয়ে কিছুটা লিখেছি আপনাদের আলোচনায় কাজে লাগতে পারে হয়তো
https://ir.canterbury.ac.nz/rest/bitstreams/10cd1d42-0483-4250-a05d-30e54986d52e/retrieve
অরিন,
বড় কাজ করেছেন। ডাউন লোড করে কয়েক জনের সাথে শেয়ার করলাম।
ধন্যবাদ অরিন, পড়ছি
সন্দীপ | 42.***.*** | ০৭ মে ২০২১ ১১:১৫105639মূল্যবান লেখাটি এবং প্রতিটি মূল্যবান মন্তব্য খুব মন দিয়ে পড়লাম। আরেকবার পড়ব। বন্ধুদের কাছে শেয়ার করার অনুমতি চাইছি।
এবার কয়েকটি কথা -
১. সোমনাথবাবু লেখাটি অনুচ্ছেদ ভেঙে ভেঙে, কিছু জায়গায় পয়েন্ট করে করে লিখলে আরেকটু সহজবোধ্য করা যেত বলে আমার মনে হয়েছে।
২. বিশ্বেন্দুবাবুর MSME এবং কারিগরি পুঁজির পার্থক্যজনিত আলোচনা আরেকটু বিশদে হোক।
৩. রঞ্জনবাবুর অসাধারণ আলোচনার প্রেক্ষিতে জানতে চাই রণবীর সমাদ্দারের গবেষণাটি কি ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে?
৩. স্বাতীদির মন্তব্য ধরে নিয়ে বলি, ধরা যাক আইটি ভাইটি মফস্বল থেকে যাওয়া আসায় পাঁচ ঘন্টা পেরিয়ে সেক্টর ফাইভ গিয়ে দশ পেলেন আবার নিজের এলাকায় টোটো চালিয়ে দশ পেলেন, তিনি কি করবেন, সেটা তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মাইন্ড সেটআপ।
৪. অরিণবাবুর দেওয়া লিংকটি এবার পড়ব।
সন্দীপ, লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আরও যত্ন নিয়ে লেখা উচিৎ ছিল। বিশেষতঃ, অর্থনীতির মতন বিষয় আসছে যখন।
বিশ্বেন্দু নন্দ | 45.112.***.*** | ০৭ মে ২০২১ ২২:৫৬105688কারিগরি ব্যবস্থা আর পুঁজির অনুসারী শিল্পের পার্থক্য করতে গিয়ে চার বছর আগের একটা লেখা ডেওয়টা গেল
---
বিশ্বেন্দু নন্দ | 45.112.***.*** | ০৭ মে ২০২১ ২৩:০৪105690আরেকটা বড় লেখা থাকল। একদা আমরা গিল্ড তৈরি করেছিলাম। মাসে একটা করে খবরদার(নিউজলেটার) বার করলাম। এটা তৃতীয়টার বিষয়বস্তু।
--
নিননিছা | 2409:4060:2e94:112a:b8ef:77d6:589b:***:*** | ০৮ মে ২০২১ ০১:১৬105692আইটি কর্মীর বেতন দশ হাজার নয়, অনেক টাই বেশি।
https://www.payscale.com/research/IN/Job=Software_Engineer/Salary
্বিশ্বেন্দুদা, বাকি পয়েন্টে পরে আসছি, কিন্তু এম এস এম ইর ডেফিনেশনে তো ন্যূনতম বিনিয়োগ নেই, ঊর্ধতম মান দেওয়া আছে। ১ কোটির নিচের বিনিয়োগ হলেই এম এস এম ই। আমি মহিষাদলে ব্রাস ক্লাস্টারের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছি। তাঁরা তো কারিগর-ই।
https://msme.gov.in/sites/default/files/MSME_gazette_of_india.pdf
বিশ্বেন্দু নন্দ | 45.112.***.*** | ০৮ মে ২০২১ ০৮:১১105695পুঁজি নির্ভর এমএসএমই আর পুঁজি নিরপেক্ষ কারিগর ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য হোক। যে নীতিগুলো নিয়ে এমএসএমইএর পরিকল্পনা হয়,তার সঙ্গে কারিগর ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য আছে। সরকার বা কনসালট্যান্টরা জোর করে মিলিয়ে দিতে পারেন হয়ত কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয় না বরং কারিগর ব্যবস্থাকে বাধ্য করা হয় বড় পুঁজিরমত ঢেলে সাজানো ব্যবস্থায় মানিয়ে নিতে।
শমীক সাহা ( কারিগর শমীক) | 182.66.***.*** | ০৮ মে ২০২১ ১৩:১৯105703বিশ্বেন্দু দা আমার সহযোদ্ধা। তিনি অনেক বিষয়কেই খোলসা করেছেন। কিন্তু মুশকিল হল কারিগর অর্থনীতিকে বুঝতে হলে এই কারিগরি উৎপাদনের ভিতরে থাকতে হয়, বাইরে থাকলে বোঝা যায় না। সত্যিই বোঝা যায় না।
এবার যারা কারিগরি ব্যবস্থাপনাকে বুঝতে চাইছেন, আন্তরিক ভাবেই চাইছেন, তাদের সবাইকে তো বলতে পারি না যে - আগে কারিগর হোন তারপর বুঝবেন। সেটা খুবই বাড়াবাড়ি রকমের আবদার হয়ে যাবে।
আমি বরং একটা অন্য রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করি। কিছু প্রশ্ন রাখছি, নিজেরা উত্তর খুঁজুন, তাহলে অনেকটা বুঝতে পারবেন -
১। করোনার বিরুদ্ধে কত মাস্ক আর পিপিই সেলাই হয়েছে? কোটির কম কি?
২। কারা এগুলো বানালো? তাদের এগুলো বানানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল কি?
৩। সরকারকে কোনও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হয়েছে কি?
৪। এই চাহিদা আচমকা এসে উপস্থিত হয়নি কি?
৫। এই উৎপাদনের পুঁজি কোনও ব্যাঙ্ক যোগায়নি, তাহলে কারা যোগালো?
৬। এই উৎপাদন প্রকৌশলের কোনও মালিকানা বা পেটেন্ট আছে কি?
৭। বাজারে অক্সিজেন কম পড়েছে, অটোমেটিক মেশিনে তৈরি N95 কম পড়েছে, কিন্তু সেলাই করা মাস্ক কি এক দিনের জন্যও কম পড়েছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই লুকিয়ে আছে কারিগরি উৎপাদনের অপরাজেয় হয়ে টিকে থাকার সহস্র বছরের ঐতিহ্য। এই কারণেই আমরা বলি - কারিগরি উৎপাদন = সামাজিক উৎপাদন।