প্রাণ বলতে আমরা যা বুঝি, তা আমরা মানুষের ইন্দ্রিয়জাত বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিগ্রাহ্যতা দিয়েই বুঝি। স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক মহাকাশ-বিজ্ঞানী ও বায়োলজিস্ট দাবী করেন যে ‘আর্থলাইক’ নয় এরকম পরিবেশেও প্রাণের বিকাশ হতে পারে। সেই প্রাণ কী ইন্টেলেকচুয়ালি সুপিরিয়র হতে পারে? সম্ভবত হ্যাঁ। এর বিরুদ্ধে যে যুক্তি তা হল এই যে, মানুষের যা ডিজাইন তা এতই গ্র্যান্ড, অন্য কোনো ভীষণ বিসদৃশ ফর্মে, খুব ইন্টেলিজেন্ট প্রাণের উদ্ভব হতে পারে না। একটা উদাহরণ দিই। জিনাস ‘হোমো’-র যে অংশটি, অর্থাৎ যখন আমাদের এক দিদিমা প্রথম শুধু দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তখনই প্রথম মস্তিষ্কের তুমুল বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিল। সেই প্রথম তার নিজস্ব দুটি হাত হল, ‘ফ্রি অ্যান্ড এম্পটি’ এবং ক্রমে সে বিস্তর চিন্তাভাবনা শুরু করতে বাধ্য হল যে এই খালি হাত দিয়ে সে কী কী কাজ করতে পারে। কিন্তু যতদিন সে চতুষ্পদ প্রাণী ছিল, এ নিয়ে তার খুব সামান্যই মাথাব্যথা ছিল। অর্থাৎ মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও উন্নততর বুদ্ধিমত্তার জন্য কমপক্ষে দুটি হাত জরুরী ছিল। (এবার বোঝা যাচ্ছে তো হিন্দু দেব-দেবীর কেন অতগুলি করে হাত?) তবে একথাও অস্বীকার করা যায় না মানুষের শরীরের যে ৬০% জল, তার কারণ তো পৃথিবীতে জলের প্রাচুর্য। ধরা যাক এমন এক গ্রহ যেখানে ইথাইল অ্যালকোহলের প্রাচুর্য আছে, তো সেখানে যদি প্রাণের উদ্ভব হয়, বলাই-বাহুল্য সেই প্রাণ-শরীরের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হবে ইথাইল অ্যালকোহল। এও অনুমান করা অসম্ভব নয় যে সেখানে জল খেলে ‘নেশা’ (অ্যালকোহল ডাইলিউটেড হবে) হয়ে যাবে এবং উন্নত প্রাণের উদ্ভব হলে সেই গ্রহে দেশি-বিদেশি জলের বার-কাউন্টার খোলা হবে। জোকস অ্যাপার্ট, পৃথিবীর সাপেক্ষে অনেক বিরুদ্ধ পরিবেশেও কিন্তু মাইক্রো-অর্গানিজম পাওয়া গেছে এবং এমনও হয়ত সম্ভব যে একদম নন-আর্থলাইক পরিবেশে ‘অসম্ভব’ সুপিরিয়র কোনো প্রাণ ঘাপটি মেরে বসে আছে। এখানে ‘অসম্ভব’ শুধু মানুষের রেফারেন্স ফ্রেমে অসম্ভব। সাহিত্যিক গার্সিয়া মার্কেজ একটা ইন্টার্ভিউতে বলেওছিলেন, The arrogance of those who assert that ours is the only inhabited planet is touching. I think that rather we are something like a lost village in the least interesting province of the Universe, and that the luminous discs that are passing in the night of the centuries are looking at us like we look at chickens.
এই সব নিয়ে অন্য কোনোদিন আলোচনা করা যাবে। আমি আসলে লিখতে চাইছিলাম যা, তা হল, প্রাণ অসম্ভবকে সম্ভব করে। তার গতি অর্থহীনতার বিপরীতে। যতই বিরুদ্ধ-পরিবেশ হোক না কেন, প্রাণ, প্রাণ-ধর্মের কারণেই টিকে থাকতে চায়, মানিয়ে নিতে চায়, লড়াই করে, অভিযোজিত হয়। কিন্তু এর লিমিট ঠিক কতটা? কেউ জানে না।
একটা উদাহরণ দিই। মহাকাশে প্রথম মাকড়সা ছিল অ্যারাবেলা এবং অনিতা, দুটি সাধারণ মাকড়সা (Cross Spiders) যাদেরকে ১৯৭৩ সালে নাসার স্কাইল্যাব স্পেস স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিছু প্রাথমিক অসুবিধার পরে (১ নং ছবি) অবশেষে অ্যারাবেলা একটা ডিসেন্ট মাকড়লালা-জাল (২ নং ছবি) বুনেছিল, যদিও এটা ছিল পৃথিবীর সাধারণ মাকড়সা-জালের চেয়ে কম শক্ত। ২০১১ সালেও গ্লাডিস এবং এসমারেলদা নামের দুটি মাকড়সাকে (Golden Orb Spiders) আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এবারেও দেখা যায় প্রাথমিক কিছু বিভ্রান্তির পর মাকড়সা-দুটি জাল বুনতে সক্ষম হল, অর্থাৎ তাদের আচরণ মাইক্রোগ্রাভিটি-তে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এই যে ভরশূন্য অবস্থায় বারবার মাকড়সারা জাল বুনতে সক্ষম হচ্ছে, এই হচ্ছে প্রাণের জয়জয়কার। একটা যন্ত্র যে পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে কাজ করবার কথা, অর্থাৎ যে পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা ভেবে যন্ত্রটি ডিজাইন করা হয়েছে এবং সেই ডিজাইনকে পরিনির্মাণ করা হয়েছে, তার অন্যথা হলেই যন্ত্রটি মুখ থুবড়ে পড়বে, চেষ্টা তো অনেক দূর কী বাৎ। প্রাণ, এমনকি মাকড়সা-প্রাণও কল্পনাতীত জটিল। সে চেষ্টা করে, সম্ভব-অসম্ভব। যে প্রাণী পৃথিবীর অভিকর্ষের বিরুদ্ধে জাল বুনে শিকার ধরতে অভ্যস্ত, সেই একই প্রাণী কী কৌশলে ভরশূন্য অবস্থায় বা মাইক্রোগ্রাভিটি-তে মানিয়ে নিতে শেখে এবং ঊর্ণাজাল বুনতেও সক্ষম হয়, এই ট্রায়াম্ফ অব লাইফ, এখনকার বিজ্ঞানের কাছেও ব্যাখ্যাতীত, সুন্দর। তবে এটুকু বোঝা যায়, লাইফ রকস!