গোড়াতেই এটা বলে রাখি যে সেলফ্ আর আত্মা দুইই একধরণের নির্মাণ। দুটিকেই কোনোভাবে বস্তুবাদী পরীক্ষামূলক পদ্ধতি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু দুটিই তর্কসঙ্গত বা লজিকাল যার সাহায্যে এদের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আপনার সেলফ্ বা আত্মা কোথায়? সেটা দেখানো যাবেনা কিন্তু যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে। যেমন মস্তিষ্ক বা ব্রেন আর মন এক নয়। করোনা সংক্রমণে মৃত মানুষটির স্ত্রীর ব্রেনের এমআরআই করলে তার মনের কষ্ট জানা যাবেনা। সেটা বুঝতে গেলে আমাদের ধরে নিতে হয় যে মন বলে ভিতরে একটা কিছু আছে যা আমরা পাশ্চাত্য আর ভারতীয় দুই চিন্তাবিদদেরই আলোচনা থেকে জানতে পারি, যদিও এই দুই চিন্তাধারা ভিন্ন। এই ছোট নিবন্ধে অবশ্য আমরা নজর রাখব এই দুই ভিন্ন চিন্তাধারায় সৃষ্ট সেলফ্ আর আত্মার ভিন্নতা এবং তার বিবাদ থেকে উৎপন্ন সমস্যা যা আমাদের সংস্কৃতিতে মনস্তত্ত্বের প্রয়োগে বিঘ্ন ঘটায়। প্রথমে আমরা পাশ্চাত্যে সেলফ্ এর উদ্ভব কীভাবে হল দেখব আর পরে দেখব ভারতীয় দর্শনগুলিতে এর আলোচনা। শেষে একজন ব্যবহারিক মনস্তাত্ত্বিকের পরিপ্রেক্ষিতে এর সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করব।
সাইকোলজি চর্চায় সেলফ্ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাইকোলজির তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ভাবনা মনকে ঘিরে গড়ে উঠলেও তার ব্যবহারিক ভাবনা কিন্তু সেলফ্কে ঘিরেই আবর্তিত। অর্থাৎ আমরা কিভাবে চিন্তা করি (cognition), কিভাবে আমাদের আবেগ (affect) প্রতিফলিত হয়, কিভাবে আমাদের উদ্দেশ্যের (purpose) দিকে আমরা ধাবিত হই, এসবই আমাদের আত্মপরিচিতি বা আইডেন্টিটিকে নির্মাণ করে। আধুনিক সাইকোলজির এই সেলফ্ এর ধারণা আসছে ‘আমি’ (I) অর্থাৎ জ্ঞাতা এবং ‘আমার’ (Me) অর্থাৎ যাকে জানছি, সেই বস্তুটি হল জ্ঞেয় – এর পার্থক্যকরণের মধ্য দিয়ে। এই ভাবনার সূত্রপাত হয় ১৮৯১ সালে। পশ্চিমে এই ধারণা কিভাবে গড়ে উঠেছে প্রথমে সেদিকে একটু তাকানো যাক।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে যে সেলফের বিষয়টা আদতে আধুনিক। আজকের আধুনিক মানুষ যেভাবে তার সেলফ নিয়ে ভাবে মধ্যযুগের রাজা বা দাসেরা কিন্তু সেভাবে ভাবিত ছিলেননা। আধুনিক যুগের একদম গোড়ায়, মোটামুটি ১৫০০-১৮০০ শতকের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক সেলফের একটা পার্থক্যের ধারণা গড়ে উঠতে থাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধকে মূল্য দিতে আর মানবিক বিকাশ ও পরিবর্তনের ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে যে “know thyself” এর ধারণা গড়ে উঠেছিল সেটা ছিল একজনের প্রতিভা আর দক্ষতাকে সঠিকভাবে যাচাই করার জন্য যাতে সে তার কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং উপযুক্ত বিচার করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। একে আজকের আধুনিক মানুষের সেলফের ধারণার সাথে এক করে দেখা যায় না।[1] আর একজন গবেষক দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগে আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যের অভাবই প্রমাণ করে যে ব্যক্তির সেলফের উদ্ঘাটন নিয়ে তেমন উৎসাহ ছিলনা।[2] সেলফের এই অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি, যা কিনা আধুনিক সাইকোলজির একটি স্বতঃসিদ্ধ, ষোড়শ শতক থেকে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এই সময় থেকেই আত্মানুসন্ধান বা ইন্ট্রোস্পেকশনের ধারণা (যা প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে অনেক আগেই এসেছে) আসতে শুরু করে। উনিশ শতক থেকে ব্যক্তিত্ব বা পারসোনালিটির তত্ত্ব সেলফ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জীবনী ও আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যের আবির্ভাব ও তার বৃদ্ধিতে। ভিক্টোরিয়ান সময়ে এলো সেলফ অবদমনের পালা। উচ্চ নৈতিকতার দাবি আর ক্রমাগত সেলফকে সেই দাবি অনুযায়ী যাচাই করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তাকে লুকিয়ে রাখার এক প্রবণতা ব্যাপক হল। ফলে তৈরি হল একধরণের সেলফ-ডিসেপশন বা আত্ম-প্রবঞ্চনার খেলা। এই অবদমন নিয়ে ফ্রয়েড বিস্তর কাজ করে দেখালেন যে পূর্ণ আত্মজ্ঞান না পাওয়ার ফলে মনোবিকারের উৎপত্তি হয় আর সাইকোঅ্যানালিসিসের মধ্য দিয়ে সেখানে পৌঁছানো গেলে সেলফ এই মনোবিকারের থেকে মুক্ত হয়।
আধুনিক আলোকপ্রাপ্ত পাশ্চাত্য সমাজে বিশ শতকের গোড়া থেকেই সেলফ এর উদ্ঘাটন একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি হিসাবে ব্যাপ্ত হল। যে সার্বভৌম বা সভারেন মানুষের আবির্ভাব ঘটল তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও নাগরিকের ব্যক্তিদায় পালন করার মধ্য দিয়ে তার সেলফ আরও বেশি অ্যাটোমাইজড বা অণুপ্রমাণ হয়ে উঠল। পরিবার বা গোষ্ঠীর অনুগত সেলফের বদলে তা একদম ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেল।
ভারতীয় দর্শনে, ব্রহ্মণ সর্বব্যাপী এবং মানবদেহে তার উপস্থিতি আত্মারূপে। এই আত্মা অবিনশ্বর, অপরিবর্তনীয়, বন্ধনহীন। মানুষের ব্যক্তিত্ব, অহং, আচরণ ইত্যাদি সময়ের সাথে পালটায় ও বিকশিত হয় কিন্তু আত্মা স্থির এবং অন্তরতম নির্যাস। সত্যের মত আত্মার কোনও অন্দর ও বাহির নেই এবং শুধুমাত্র এবং সর্বৈব জ্ঞান দ্বারা গঠিত। তাই একমাত্র আত্মার অনুসন্ধানই আমাদের নিয়ে যেতে প্রকৃত সত্যজ্ঞানে এবং আনন্দে। ‘অন্তর্জগতের ঘটনাগুলো পাশ্চাত্য মনোবিদেরা যে রকম থিংকিং, ফীলিং, উইলিং ইত্যাদি প্রকারে ভাগ করে থাকেন, ন্যায়বৈশেষিক আচার্যগণও তাঁদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের বিভাগ ও স্বরূপ বিচার করেছিলেন। তবে পাশ্চাত্য দার্শনিকেরা ঐ ঘটনাগুলোকে ‘মনের কাজ’ বলে বর্ণনা করবেন, কিন্তু নৈয়ায়িক এখানে একটু কুণ্ঠা অনুভব করতে পারেন। কারণ তাঁর মতে এগুলো মনের সাহায্যে সম্পন্ন হলেও মন এখানে কর্তা নয় – চিনির বলদের মত সে শুধু কাজ করে চলে; আর কাজগুলো তাদের নিজ নিজ ফল সমেত ‘আমি’ পদবাচ্য আত্মার অধিকারে পড়ে’।[3] আত্মা হল "আমি" যা দেহে বাস করে এবং এর মাধ্যমে কাজ করে। আত্মা ব্যতীত, দেহটি ফাঁপা, আধারমাত্র। আত্মার পরিচিতির সাথে, দেহ জীবন, দর্শন এবং শ্রবণ, চিন্তাভাবনা এবং বক্তব্য, বুদ্ধি এবং আবেগ, ইচ্ছা এবং ইচ্ছা, ব্যক্তিত্ব এবং পরিচয় অর্জন করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সেলফ আর আত্মা একদম সমার্থক নয় যদিও গড়পড়তা অনুবাদের ক্ষেত্রে এটাই ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার সত্তা মানেও সেলফ নয় বরং অস্তিত্ত্বমূলক পরিচিতি বলা যেতে পারে।
বৌদ্ধধর্মের একটি মূল তত্ত্ব হল ক্ষণিকবাদ অর্থাৎ পৃথিবীর সবকিছুই সতত পরিবর্তনশীল, স্থায়ী সত্তা বলতে কিছুই নেই। বৌদ্ধধর্ম নিজেই এই ক্ষণিকবাদের প্রমাণ। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ক্রমাগত রূপান্তরের ইতিহাস, আদি বৌদ্ধধর্ম কি ছিল সে বিষয়ে প্রায় কিছুই জানা যায় না। বৌদ্ধধর্মে মনে করা হয় মানুষ ও অন্যান্য জীবের অন্তরে আত্মা বলে কিছু নেই। পাঁচটি সত্তা গঠনকারী উপাদান (রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান) আত্মাবিহীন বা অনাত্ম, অচিরস্থায়ী বা অনিত্য। কিন্তু বৌদ্ধরা চেতনসত্তার বিরোধী নন। তাঁরা কেবল স্থায়ী সত্তারই বিরোধী। তাঁদের আপত্তি স্থায়িত্বের বিরুদ্ধে, চৈতন্যের বিরুদ্ধে নয়। কারণ চৈতন্যবিশিষ্ট দেহকে আত্মা বলে স্বীকার করলে বৌদ্ধমতে জ্ঞান, প্রত্যভিজ্ঞা, স্মৃতি প্রভৃতির যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। আবার যেহেতু বৌদ্ধমতে নিত্য আত্মার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ বা অনুমানের দ্বারা প্রমাণ করা যায় না, তাই উপনিষদ প্রভৃতির আত্মতত্ত্ববাদকেও বৌদ্ধরা স্বীকার করেননি। বৌদ্ধমতে জীবের চেতন সত্তা ক্ষণস্থায়ী প্রবাহ বা ধারার ন্যায় পরিবর্তনশীল। প্রতিটি ক্ষণের অনুভূতি একটি কার্য-কারণমালা বা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে বলেই আমাদের মনে একটি স্থায়ী আত্মার ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। অনাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থে বুদ্ধ আত্মার অস্তিত্ব কখনোই অস্বীকার করেন নি। আত্মা বলতে তিনি মানসিক প্রক্রিয়ার অবিরাম ধারা বা প্রবাহকে বুঝিয়েছেন। মূলত শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার অস্তিত্বই এই মতবাদে অস্বীকার করা হয়েছে।
ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য তত্ত্বগুলি আলোচনার অবকাশ এই নিবন্ধে নেই। হিন্দু আর বৌদ্ধ দর্শনের পরষ্পর বিরোধী উদাহরণ টেনে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আধুনিক সাইকোলজির সেলফের ধারণার সাথে এগুলির পার্থক্য কোথায় এবং কতখানি।
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমাদের এখানে সেলফের প্রয়োগ হল ঔপনিবেশিকতার কৃপায় পাওয়া আধুনিক সাইকোলজির চর্চায়। আর পাঁচটি বিজ্ঞানের শাখার মত সাইকোলজিকেও আমরা গ্রহণ করলাম আধুনিক, (সেহেতু সর্বজনীন) এক জ্ঞান হিসাবে। যা যা পাশ্চাত্যে হয়েছে ঠিক সেইভাবেই এই বিদ্যার চর্চা শুরু হল। ধরে নেওয়া হল যে আমরা পিছিয়ে আছি কিন্তু একদিন ঠিক ধরে ফেলব ওদের এবং এই পার্থক্য মুছে যাবে। কিন্তু সেরকমটা হল না! আমার ধারণা দুটি প্রধান কারণ এর পিছনে কাজ করেছে। প্রথমটা খোদ আধুনিকতার তত্ত্বকে ঘিরেই। এই বিষয়টা চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি লেখায়। তিনি দেখিয়েছেন ‘আমাদের আধুনিকতার’ বৈশিষ্ট যা ঐ পাশ্চাত্যের মডেল অনুসারী নয়। তিনি বলেছেনঃ
পাশ্চাত্য আধুনিকতার আদিকল্পে কান্ট যেখানে অতীতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা বলেছেন, সে জায়গায় আমাদের কাছে বর্তমানের লক্ষণগুলোই হয়ে গেছে নেতিবাচক, নঞর্থক। এই আধুনিকতার গতিপ্রকৃতি, তার চালিকাশক্তি, পশ্চিমের আধুনিকতার ইতিহাসের তুলনায় একান্তভাবে ভিন্ন। এ হল আমাদের একদা-পরাধীনের আধুনিকতা। যে প্রক্রিয়ায় আমরা আধুনিক হয়েছি, সেই একই প্রক্রিয়ায় আমরা আধুনিকতার শিকার হয়েছি।......নিজেদের বিশিষ্ট আধুনিকতার রূপগুলি উদ্ভাবন করতে গেলে অন্যত্র প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতাকে সময় সময় বর্জন করার সাহস দেখাতে হয়। জাতীয়তাবাদের যুগে এ ধরণের বহু প্রচেষ্টা হয়েছিল। সে প্রচেষ্টার পেছনে সাহস ছিল, উদ্ভাবনী শক্তি ছিল, সাফল্য সবক্ষেত্রে সমান ছিল না। আজ গ্লোবালাইজেশনের যুগে হয়তো নতুন করে সাহস দেখাবার সময় এসেছে। তাই ‘আমাদের আধুনিকতা’র সেকাল আর একাল নিয়েও বোধহয় এবার আমাদের ভাবনা শুরু করা উচিত।[4]
দ্বিতীয় কারণটা হল যে সেলফ আমরা পাশ্চাত্য থেকে পেলাম সেটা কিন্তু সেখানকার আধুনিকতা অনুসারী এক মানুষের আদলে তৈরি। সেটা গোষ্ঠী-পরিবার বিরহিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অ্যাটমাইজড একটা সেলফ। সেখানে সার্বভৌম নাগরিক ব্যক্তি নিজেই নিজের কর্তা। তার সেলফের সঙ্কট একান্তই তার নিজের। আর ‘আমাদের আধুনিকতার’ যে সেলফ তা আমাদের দর্শন আর সংস্কৃতিবাহিত, গোষ্ঠী-পরিবারমথিত এক সেলফ যা এখনো ঐভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অ্যাটমাইজড হয়ে যায়নি। সেখানে আত্মার ধারণা মিশে আছে তার গোষ্ঠিকেন্দ্রিক জীবনে। তাই পাশ্চাত্য মডেল ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয় না। আমেরিকার বিখ্যাত সাইকোঅ্যানালিস্ট অ্যাল্যান রোনাল্ড ভারতে ও জাপানে দীর্ঘ সময় থেরাপি করে দেখেন যে এখানকার মানুষের সেলফ ভিন্ন, গোষ্ঠী ও পরিবারকেন্দ্রিক, যা তাঁর শেখা থেরাপিকে পুরোপুরি সফল হতে দেয় না।[5] তাই দরকার সাহস আর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আমাদের আধুনিকতা অনুসারী এক সেলফ এর নির্মাণ যা সৃষ্টি করবে আমাদের সংস্কৃতির উপযুক্ত থেরাপি।
[1] Alasdair Maclntyre (1981). After virtue: a study in moral theory. University of Notre Dame Press.
[2] Karl Joachim Weintraub (1978). The Value of the Individual: Self and Circumstance in Autobiography. Chicago: University of Chicago Press.
[3] বিমলকৃষ্ণ মতিলাল (২০১৬) আমি ও আমার মন। ভূমিকা ও স ম্পাদনা অরিন্দম চক্রবর্তী, অনুষ্টুপ, পৃঃ ৬০
[4] পার্থ চট্টোপাধ্যায় (২০০০) “আমাদের আধুনিকতা”, ইতিহাসের উত্তরাধিকার। আনন্দ পাব্লিশার্স, পৃঃ ১৮৪
[5] Alan Roland (1998) In search of self in India and Japan: toward a cross-cultural psychology. New Jersey: Princeton University Press.
আচ্ছা, এইটের আরো বিবর্ধন চাওয়া গেল। যে পারে!
খুব মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । আরও অনেক প্রশ্ন উস্কে দিল।
একটু প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরায় আলোচনা করা যাক।
পূর্বপক্ষঃ(প্রবন্ধটি আমি যা বুঝেছি)
১ মন এবং মস্তিষ্ক এক নয় । ব্রেন কাটাছেঁড়া করে মনোজগতকে ধরা যায় না ।
উত্তরপক্ষঃ (আমার ব্যক্তিগত মত)
ব্রেন একটি অর্গান। মন হল ব্রেন এবং স্নায়ুতন্ত্রের ফাংশন (আপেক্ষিক ভাবে)। ব্রেনের স্টাডি করে মানুষের মন খানিকটা খানিকটা বোঝা যাচ্ছে। লাই ডিটেক্টর টেস্ট তার একটা উদাহরণ। নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় উত্তরদাতার ব্রেনের ম্যাপিং এর তরঙ্গ তার মানসিক উত্তেজনার আভাস দেয় । এ বিষয়ে যোগ্যব্যক্তিরা ভাল ইনফর্মেশন দিতে পারবেন।
২ পূর্বপক্ষঃ(প্রবন্ধটি আমি যা বুঝেছি)
পাশ্চাত্য চিন্তার 'সেলফ' এর ধারণা আধুনিক, বড়জোর দুই শতাব্দী। ওদের ব্যক্তির সত্তা এবং পরিচয় নিয়ে চিন্তাভাবনা রেনেসাঁর আগে ছিল না। 'আপনাকে এই জানা'র প্রক্রিয়া ভারতীয় দর্শন শুরু করেছে বহু আগে, 'আত্মার' ধারণা থেকে যা পাশ্চাত্যের সেলফের থেকে আলাদা। 'মন' এবং 'সেলফ' এক নয়।
উত্তরপক্ষঃ (আমার ব্যক্তিগত মত)
ভারতীয় দর্শনে 'মন' এবং 'আত্মা' কি আলাদা? লেখক স্পষ্ট করেননি। পাশ্চাত্যে যুক্তিবাদের শুরু চারশ বছর আগে। মধ্যযুগীন স্কোলাস্টিসিজম এর বিরুদ্ধে রনে দেকার্ত বললেন-- ঈশ্বরকেও যুক্তিসিদ্ধ হতে হবে। ওঁর চিন্তায় 'মন' এবং আত্মা একই। এই মননের শক্তিই মানুষকে জীবজন্তুর থেকে আলাদা করে। মানুষ যতক্ষণ চিন্তা করছে ততক্ষণই মানুষ হিসেবে বেঁচে আছে ।
ওঁর বিখ্যাত যুক্তিঃ আমি যে আছি , বা আমার অস্তিত্ব আছে তার প্রমাণ কি?
-- 'কজিতো এরগো সুম'! আমি যে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করছি, সন্দেহ করছি-- তার মানেই আমি আছি, আমার অস্তিত্ব আছে। নইলে প্রশ্ন বা সন্দেহের কর্তা কে?
৩ পূর্বপক্ষঃ(প্রবন্ধটি আমি যা বুঝেছি)
ভারতীয় দর্শনে সর্বব্যাপী আত্মা বা ব্রহ্মণের ধারণা শ্রেষ্ঠ, কারণ এই সত্য স্বরূপ অবাঙ্মনসোগোচর আত্মা , যিনি অজর অক্ষর অমর, যিনি অণূর চেয়ে সূক্ষ্ম এবং বৃহতের চেয়ে বৃহৎ -- এঁকে বোঝা বা জানাই মানুষকে সত্যিকারের আনন্দ দিতে পারে। এই জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মকে যুক্তি দিয়ে বোঝা যায়।
উত্তরপক্ষঃ (আমার ব্যক্তিগত মত)
ভারতীয় দর্শন বলতে আত্মা নিয়ে কোন হোমোজিনিয়াস ধারণা নেই। বৌদ্ধ দর্শনের আত্মা এবং বেদান্তের আত্মার ফারাক লেখক নিজেই দেখিয়েছেন। এছাড়া বেদপ্রামাণ্য মেনে চলা ছয়টি আস্তিক দর্শনের মধ্যেও আত্মা নিয়ে বিস্তর মতভেদ। যেমনঃ
৩.১ সাংখ্য দর্শনের আত্মা (পুরুষ নামে অভিহিত) নিশ্চলম নির্বিকল্পম। অচেতন। প্রকৃতি শুধু সক্রিয়। একই আত্মা সর্বব্যাপী সক্রিয় সর্বজ্ঞ নয়।
৩.২ যোগদর্শনের ঈশ্বর পুরুষবিশেষ মাত্র, একমেবাদ্বিতীয়ম নন।
৩'৩ ন্যায়বৈশেষিকের আত্মা মন আলাদা। ন্যায়ের ঈশ্বর অণু, আকাশ (স্পেস) ইত্যাদির সৃষ্টিকর্তা নন। শুধু নিমিত্তকারণ। কুমোর যেমন কাদামাটি চাক সৃষ্টি করেনা, অথচ ওগুলোর সাহায্যে বাসন বানায়।
৩.৪ পূর্বমীমাংসা দর্শনে অমন ব্রহ্ম , আত্মা , দেবতা কিছুই নেই। দেবতা মন্তরের শব্দমাত্র। কোন সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, সঙ্ঘারকর্তা নেই, আছে শুধু বৈদিক মন্তের শক্তি।
৩.৫ লেখকের বর্ণনাতীত সর্বব্যাপী জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মের অবধারণা স্পষ্ট এবং স্ট্রাকচারড ওয়েতে শুধু উত্তরমীমাংসা বা বেদান্তদর্শনে আছে।
এরকম বিষয়ে সুন্দরভাবে গুছিয়ে আলোচনার অবতারণা করায় লেখক ধন্যবাদার্হ।
রঞ্জন, আপনার প্রশ্ন ও মতামতের জন্য ধন্যবাদ। প্রথমত, দর্শন আমার বিষয় নয়। মনোশ্চিকিৎসা করতে গিয়ে যেসব তাত্ত্বিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি তার উত্তর খুঁজতে গিয়েই এসব চর্চা করেছি।
লাই ডিটেক্টর সরাসরি মনের অবস্থা ধরতে পারে না। closed question এর উত্তরে হ্যাঁ/না, সত্য/অসত্য, ঠিক/ভুল এভাবে উত্তর নেওয়া হয়। প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় ব্রেনে যে পরিবর্তন আসে তার শরীরবৃত্তীয় প্রভাব মেপে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য এতে ভুলও হয়। MRI যে তথ্য দেয় তাতে মনের অবস্থা জানা যায় না, আচরণের কিছুটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মাত্র।
ভারতীয় দর্শনে মন এবং আত্মা এক নয়। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের যে বইটির উল্লেখ করেছি তার একটি দীর্ঘ ভূমিকায় অরিন্দম চক্রবর্তী এর একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এছাড়াও দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য শাস্ত্রী ১৯৭৩ সালে প্রাচীন-ভারতীয় মনোবিদ্যা নামে যে বইটা লিখেছেন সেখানেও মন আর আত্মার পৃথকীকরণ আছে।
কোনও জ্ঞানচর্চাই সমসত্ত বা হোমোজিনিয়াস হতে পারে না। বছরের পর বছর ধরে যে চর্চা চলে তার বিতর্ক আর টীকাভাষ্যই তাকে বিভিন্নতায় ও বৈচিত্র্যময়তায় আকর্ষণীয় করে তোলে। এই জ্ঞানচর্চা অবশ্যই ক্ষমতার প্রশ্নের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই জ্ঞানের বস্তু বা object of knowledge এর সত্যের দাবিও ঐ ক্ষমতার প্রশ্নে রাজনৈতিক। যদিও এ নিবন্ধে আমি এবিষয়ে আলোচনা করতে চাইনি।
এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল এটা ধরিয়ে দেওয়া যে পাশ্চাত্য মডেলের সেলফকে সতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে এখানে যে মনশ্চিকিৎসা করা হয় সেটা কার্যকর নয় এবং সাফল্যও সামান্য। কারণ 'আমাদের আধুনিকতা'য় এই সেলফ আমদানি করা তত্ত্বের সেলফের থেকে ভিন্ন। Alan Ronald ছাড়াও আরও কিছু গবেষক এটা ধরেছেন, স্থানাভাবে সবার কথা উল্লেখ করিনি। আমাদের সংস্কৃতি এখনও গোষ্ঠী বা কৌমনির্ভর। আমাদের আধুনিকতায় আমরা এখনও এর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন নই। মনোরোগীর সমস্যার দায় পুরোপুরি তার একান্ত নিজস্ব নয়। তার সেলফের সাথেই জড়িয়ে থাকে তার পরিবারের আত্মপরিচয়, তার কৌমনির্ভর সংস্কৃতি। তাই আমাদের এখানে মনোরোগের ব্যাপকতা পাশ্চাত্যের 'বিকশিত' দেশগুলির তুলনায় কম। তার communitarian mind আমাদের এখানে, অন্তত মনোরোগ নিয়ন্ত্রণে একটা বড় আশীর্বাদ। কিন্ত্ত দুঃখের বিষয় আমাদের ঐ পাশ্চাত্য মডেলে আধুনিক হতে চাওয়া মনশ্চিকিৎসার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও এটা বুঝে উঠতে পারেনি। এমনকি ভারতীয় দর্শনগুলির মনোবিদ্যাবিষয়ক কোনও জ্ঞানও সেখানে আলোচিত হয় না।
পরিশেষে বলি দেকার্তের মন/শরীরের পার্থক্যীকরণ ভারতীয় কেন এশিয়ার সংস্কৃতিতেও কাজ করে না। এই উপলব্ধি হালে আধুনিক নিউরোসায়েন্সেে আসতেে শুরু করেছে।
প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আবারও আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
অনেকটাই একমত।
প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের, ধরুণ এশীয় কৌম সমাজ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। পেশায়, জীবনযাপনে বাড়িঘর এর, বাজার হাটের ডিজাইনে, পারিবারিক ধাঁচে ক্রমশঃ ওই পাশ্চাত্যশৈলীকেই আঙ্কড়ে ধরছি। ফলে ব্যক্তিমানুষের অবসাদ, বিচ্ছিন্নতা, আত্মবিনাশের ঝোঁক বেড়ে চলেছে।
কিন্তু এর সমাধান?
আমার জানা নেই।
তবে সময়ের চাকা পেছনে ঘুরিয়ে আগের কৌম জীবনে ফিরতে পারি কি?
আপনার অভিজ্ঞতা থেকে নামধাম বদলে কিছু লিখুন না! পড়তে এবং জানতে আগ্রহী। আমার বিশ্বাস এখানে অনেকেই পড়তে চাইবেন।
কিন্তু রঞ্জন, এই যে তুই বলছিস, "এশীয় কৌম সমাজ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই" এটা কিসের ভিত্তিতে ? আমাদের ঘর-বাড়ি, বাজার হাট পাল্টেছে - কোথায় ? শহর এবং শহরতলীতে। তার বাইরে যে বিশাল পরিসর, গ্রাম ও জঙ্গলে থাকা মানুষজন, তাদের জীবন কতোটা পাল্টেছে ? যেখানে শিল্প আছে সেখানে পাল্টাতে বাধ্য, তাছাড়া ? আমি ভারতের কথা বলতে পারি। তাও কি পারি ? যতটুকু গ্রাম দেখেছি , সেও তো শহরের লাগোয়া। যে লক্ষ লক্ষ গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, সেখানকার জীবন নিয়ে কতটুকু জানি ? দূর প্রাচ্য বা মধ্য প্রাচ্যের গ্রাম জীবন নিয়ে তো কোন ধারনাই নেই।
পিছিয়ে যাওয়া যাবে কিনা জানিনা। তবে "এগিয়ে" যেতে পারলে, সেই যুক্তিতে "পিছিয়ে" যাওয়া যায়, অসম্ভব কিছু না। তুই জানিস পুঁজি ও বাজারের বাইরে বের হওয়া যায় কিনা, সেটা আমার কিছু আবোলতাবোল খোঁজের একটা। তাতে কখনো এটাও মনে হয়েছে, যে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজ একসময় এই উপমহাদেশে ছিলো, যেখানে রাষ্ট্র শুধুমাত্র খাজনা আদায় করতো ও সেই সংক্রান্ত বিবাদ মেটানোর কাজ করতো, বাকি সব কিছুর দায়িত্ব ছিলো সমাজের, তেমন কোন মডেল হতেই পারে। যেখানে উৎপাদন ও বন্টনে সমাজের একটা বড় ভূমিকা ছিলো। তেমন একটা সমাজে "আমি"র গুরুত্ব কমে যেতেই পারে।
আমি হয়তো অনধিকার চর্চা করলাম। না মনস্তত্ব না অর্থনীতি কোনটাতেই আমি অধিকারী নই। তবু মনে হলো......