এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, আন্তর্জাতিক সাহিত্যের গভীর বোধ ছাড়া দেশীয় সাহিত্য তার উন্নতির শিখরে উঠতে পারে না। কিন্তু, আমাদের সমসময়ে এ এক করুণ ঘটনা—আমরা ক্রমেই আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি, এমনকি জাতীয় ক্ষেত্রে ভারতেই এই মুহূর্তে কী লেখালেখি হচ্ছে, কোন্ অঙ্গরাজ্যে কতখানি তাৎপর্যমণ্ডিত সাহিত্যচর্চা ঘটছে, আমরা অনেকেই জানি না, আমাদের অনেক খ্যাতিমান বাঙালি লেখকই এ বিষয়ে অজ্ঞ এবং উদাসীন। এমনই এক পরিসরে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটল। এমন হয়তো নয় যে, তিনি অকালে প্রয়াত হয়েছেন, যেহেতু তাঁর আয়ু ৮০ অতিক্রম করেছিল, কিন্তু এই প্রয়াণ আমার রক্তে ঈষৎ হিম ধরিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই মৃত্যুর এক প্রতীকী দিক্নির্দেশ রয়েছে। যেদিকে এই মৃত্যু আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, সেই দিকে বাঙালির মেধা ও মননের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। এখন আমরা চাঁদের দিকে তাকাব, না কি চাঁদে নিবদ্ধ অশ্লীল তর্জনীর দিকে, সেটা নির্ভর করবে আমরা মানবেন্দ্রবাবুর জীবনকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখছি, তার উপরে, তাহলেই তাঁর মৃত্যুকে অতিক্রম করে মানবেন্দ্রবাবুর সারস্বত সাধনা আমাদের উদ্বুদ্ধ ও প্রেরিত করতে সক্ষম হবে।
অনেকের কাছেই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র পরিচয়—তিনি অনুবাদক। কিন্তু যাঁদের কাছে কেবল তাঁর অনুবাদক পরিচয়টাই বড়ো হয়ে দেখা দেয়, তাঁরা সম্ভবত সেই পরিচয়ের পিছনে একজন মানুষের অপরিসীম জ্ঞানতৃষ্ণা ও সারা পৃথিবীর ভাষাশিল্পকে আঁকড়ে ধরার, আস্বাদন করার এবং সকলের সঙ্গে নিজের স্বাদ ও রুচি ভাগ করে নেওয়ার আধুনিক মানসিকতাকে শনাক্ত করতে বিফল হন। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অনুবাদক নন, যে-কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের মতোই তিনি একজন সাহিত্যিক, একজন অন্বেষক, একজন রূপতাপস এবং সর্বোপরি, সামাজিকভাবে একজন দায়বদ্ধ মানুষ। নিজের বেঁচে থাকা, নিজের অধ্যয়ন এবং সারা পৃথিবীর সাপেক্ষে নিজের এই দুটি দিককে চরিতার্থ করতে পারার মতো বিরল ঘটনা মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পরে আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজে বিরলতর হয়ে উঠবে, এমনই আমার আশঙ্কা। একটা উদাহরণের মৃত্যু হল আমাদের চোখের সামনে, যদিও তাঁর কাজ রয়ে গেল।
লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে যে অনায়াস দক্ষতায় তিনি বাঙালির পড়ার টেবিলে এনে দিয়েছেন, তার একটা কারণ, বা তার একটা বড়ো যুক্তি হল, এই মানুষটি কোনো বিশেষ ভাষা বা দেশের গণ্ডিতে যেমন আবদ্ধ ছিলেন না, তেমনই কোনো বিশেষ ভাষা বা দেশকে নিজের করে নিতেও তাঁর কোনো সমস্যা ছিল না। একটি বিদেশের ভাষা, লোকাচার, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে তিনি এমনই এক আশ্চর্য অবয়বে উপস্থিত করতে পেরেছেন যে, সেই অবয়বে বাঙালির মুখই যেন ফুটে উঠেছে, আর লাল হয়ে উঠেছে বাঙালিরই নতুন কাঁচা জিভ। সম্পাদক হিসেবে দাঙ্গা, দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সর্বভারতীয় যে গল্প সংকলন তিনি বাংলায় অনূদিত করলেন, তার নাম রাখা হল—‘বিভেদ’, এই নাম যে কতখানি বাঙ্ময় তা আজকের ভারতবর্ষে বলার অপেক্ষা রাখে না।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যে আমাদের সমসময়েই একজন বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তার একটা বড়ো সহায়ক হয়তো ছিল বিদ্যায়তনিক জীবনে কখনও ছাত্র কখনও শিক্ষক হিসেবে তাঁর মায়ানমারের রেঙ্গুন, কানাডার টরন্টো, পোল্যান্ডের তাসভি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অভিজ্ঞতা এবং তা নিয়ে যাদবপুরে এসে কর্মরত হওয়া। কিন্তু কেবল তাই নয়। একজন মানুষ বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে পারেন নিজের তৃষ্ণায়। নিজের অভিজ্ঞতা বা ভ্রমণ সেক্ষেত্রে সহায়ক হয়তো হতে পারে, নির্ণায়ক হতে পারে না। তিনি একজন কবি ছিলেন। সেই কবিত্ব মানবেন্দ্রবাবুর লেখা কবিতায় যতটা পরিস্ফুট হয়েছে, তার চেয়ে কিছু কম হয়নি তাঁর করা অনুবাদে, তাঁর প্রবন্ধে। কবিকে কেবল তাঁর কবিতার মধ্যেই পাওয়া যায়, এ এক অসাড় ধারণা, আমার মনে হয়। ‘বাস্তবের কুহক কুহকের বাস্তব’ বইটিতে লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজমকে চিনতে আমাদের যে এতখানি সুবিধা হয়, তার কারণ আমরা ঘোড়ার খবর যেন স্বয়ং ঘোড়ার মুখ থেকেই পাই, সহিসের মুখ থেকে নয়।
কোনো পাঠক যদি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত জুল ভের্নের অনুবাদ গল্পগুলি পড়েন, তিনি বুঝবেন এই অনুবাদ আসলে কতখানি রূপতৃষ্ণা নিয়ে ওই বিখ্যাত লেখকটির রচনার প্রত্যেক শব্দকে নিজের জন্যই যেন সাজাচ্ছে, যেন জুল ভের্নের মধ্যে আছে এক আশ্চর্য জগতের চাবিকাঠি এবং মানবেন্দ্র প্রত্যেক দুটি শব্দের মধ্যবর্তী ফাঁকে সেই চাবিকাঠিকেই খুঁজছেন, আর সঙ্গে নিয়েছেন নিজের পাঠককে, যে পাঠকের মধ্যে ঠিক তাঁর মতোই এক বিস্ময়পাগল চিরকিশোর লুকিয়ে আছে। জুল ভের্নের অনেক অনুবাদ বাংলায় হয়েছে, কিন্তু মানবেন্দ্র কেবল জুল ভের্নের লেখার নয়, স্বয়ং জুল ভের্নকেই যেন অনুবাদ করেছেন ও আমাদের সামনে পেশ করেছেন। এই একই কথা বলা যায় যখন তিনি নিকানোর পাররা বা চেশোয়াভ মিউশের কবিতার অনুবাদ করছেন। এই দুজন কবির কবিতা যে অনুবাদ করা যায়, এটাই আমার বিশ্বাস হত না, যদি না তাঁর কাজ দেখতাম।
এই একই ঘটনা আমি টের পেয়েছি, দেখতে পেয়েছি বলব না, সরলা এরেন্দিরা ও বিশ্ববিখ্যাত কর্নেলের ক্ষেত্রে। যাঁদের কাছে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লাতিন আমেরিকার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, তাঁরা হয়তো খেয়ালই করেন না যে তাঁর ভাষান্তরে এরেন্দিরা, তার ঠাকুমা, কর্নেল, বা সেই যে মেয়র যে তার দাঁত তোলানোর জন্য ব্যাকুল, তারা কখন যেন ‘আমরা’ হয়ে গেছে, ‘আমি’ হয়ে গেছে। এ কেবল ভাষান্তর নয়, এ একরকম ব্ল্যাক ম্যাজিক, যেন আত্মার স্থানান্তরণ। এই জাদুবিদ্যাকে বুঝতে হলে আমাদের সেমানটিক্সের দিক থেকে আসতেই হবে। মার্কেসের যে কর্নেল, মানবেন্দ্রের যে কর্নেল এবং পাঠক হিসেবে আমার বা আপনার যে কর্নেল, এরা একসঙ্গে একটাই ধারণার মধ্যে মিলে যেতে পেরেছে, যেখানে বেশিরভাগ অনুবাদের ক্ষেত্রে এই বিরল মেলবন্ধন অসম্ভব হয়ে যায়, কারণ বেশিরভাগ অনুবাদকের মধ্যে একজন কবির উপস্থিতি থাকে না। গল্পের শেষে কর্নেল যখন বলেন ‘গু’, তখন সেই গু এক সর্বজনীন মানবিক ধারণায় উদ্ভাসিত হয়, যা খেয়ে একজন মানুষ তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করবে, যে পৃথিবীতে সে বাঁচছে সেই পৃথিবীরই উপরে। সেই শব্দটা তখন বাংলাভাষায় লেখা হচ্ছে, নাকি ইংরেজিতে, নাকি মার্কেস তথা কর্নেলের মাতৃভাষায়, সেটা হয়তো অবান্তর।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে কোভিড ভাইরাস কেড়ে নিয়ে গেল, এই সংবাদও তো জাদুবাস্তবের দুনিয়া থেকেই ভেসে এল, আমার মনে হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যে জাদু অনেক কমে গেল, বাস্তব আরও দাঁত-নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়তেই পারে এবার।