১.
ছোটবেলায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেটি ছিল টালির ছাউনির দু'কামরার ঘর। বারান্দা প্লাস্টারের। তার ওপর সিমেন্টের সর নেই। এবড়ো খেবড়ো হেতনেয় বসে চলত হুটোপুটি। খানিক পা ঘষলেই চামড়ায় সরু সরু দাগ পড়ত...সমান্তরাল; যেন স্কেল দিয়ে মাপজোখ করে কেউ বুঝি খোলস থেকে কয়েক পরত রং তুলে নিয়েছে। তিন হাত উঁচু সেই বারান্দার পাশেই ছিল ঘেঁটু ফুলের জঙ্গল। মায়ের আটপৌরে শাড়ির মতন কিঞ্চিৎ গুটানো সাদা পাপড়ি আর মধ্যিখানে আলো করে বসে আছে বেগুনী ; আঁচলে রান্নার হলদে দাগের মতন সমাচ্ছন্ন বেপথু সে রং। বারান্দা বরাবর লম্বা যাত্রা শেষে লাল পিঁপড়েরা প্রায়শই নেমে যেত সে জঙ্গলে।
ঝাড়ুর একটা কাঠি টেনে নিয়ে কখনও কখনও বসতাম বারান্দায়, পিঁপড়ের সারির পাশে। একের পর এক লাল খুদি টুকরো, সবাই সামনের জনের কোমর ধরে প্রেয়ার শেষে ক্লাসরুমে ঢোকা বাধ্য ছাত্রছাত্রী। আমি ক্লাস টিচার। কাঠি হাতে গর্তের মুখে তাদের পৌঁছে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় দায়ভার অলিখিতভাবে বুঝি আমার।
কাঠির গুঁতোয় যদিও, খানিক ইচ্ছাকৃতভাবেই, দলছুট করে দিতাম তাদের, বহুদিন। ফলে হঠাৎ যে এই হুড়োহুড়ি, বাইরের আঘাতে সূক্ষ্ম সারি বিতত হয়ে যাবার হকচাকানো প্রভাব; এসব খেই হারাবার দৃশ্য ছিল দেখবার মতন।
আচমকা লকডাউন, আমাদের এই পিঁপড়ে জীবনে অযাচিত কাঠিটি। জিন্দেগি দিব্যি চলমান অথচ বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ ছন্দপতন। কোমর ধরে 'ইয়ে মালগাড়ি....লে ঝমঝম পা পিছলে আলুর দম' এর হল্লাও বারণ। কলরব শুধু গর্তে ফেরার জন্য মাথা কুটে মরে। একবার মুখ ঢুকিয়ে ফেললেই করোনা হুস...!
অথচ আমি তো পিঁপড়ে সেনানী নই, নচেৎ বাসায় খোলসটি ছাড়বার আগে এত মারামারি হাতাহাতি করে ভাঁড়ারের খাবার বাকিদের মুখ থেকে কেড়ে নিতে পারতাম কি এমন অক্লেশ অনায়াসে! আর সেই যে দূরের অগুনতি লাল সারি...প্রত্যেকের ঠিকানা নির্দিষ্ট; শুধুমাত্র রাতারাতি কাঠি ছোয়াঁনো হল বলে সে জন মরীচিকাবৎ দোদুল্যমান। প্রগাঢ় বেদনা নিয়ে তারা অপেক্ষায় 'পরিযায়ী শ্রমিক' সন্ততির...নির্বেদ ভণিতা এরপর কি অনায়াসে দাক্ষিণ্যের চিবুক ছুঁয়ে মৃত্যুতে নেমে যায়।
২.
আমাদের ঘরটার ঠিক সামনেই ছিল দোচালা আরেকটা বাড়ি। খুব ছোটবেলায় মনে আছে, চন্দন নামের এক ছেলে আর তার মা বাবা বাস করত সেখানে। পরে তারা শহরে চলে গেলে ঘরখানা ফাঁকা পড়ে থাকে।
আমাদের টালির ঘর আর সামনের দোচালা টিনের ঘরের মাঝে দূরত্ব মোটামুটি হাত পঞ্চাশেক। দুই বাড়ির সামনেই মাঝারি সাইজের একটি করে উঠোন। আমাদের ঠিক বাঁ পাশে ঘেঁটু আর আকন্দের জঙ্গল পেরিয়ে হঠাৎ বিদ্যুন্চমকের ন্যায় উঁকি মারে ঘাস ছাঁটা হাঁটা পথ। এক বিঘৎ পরেই সে রাস্তা ফুরিয়ে যায় খিল আঁটা আলকাতরা মাখানো কালো দরজায় ধাক্কা খেয়ে। পেছনে মালিকের শান বাঁধানো বড় পুকুর।
সরু রাস্তার পাশে কলতলা আর দুই ঘরের জন্য বরাদ্দ দু'টি বাথরুম। গোটা জায়গাটা সাংঘাতিক উঁচু, সব্জে হলুদের শ্যাওলার পুরু স্তরে ঢাকা বাদামি রঙের প্রাচীন ইঁটের দেওয়ালে ঘেরা, মালিকপাড়া থেকে বিচ্ছিন্ন। সদর দরজা বলতে ঘাটে যাবার মতোই সেটিও একইরকম কাঠের ভারী পাল্লার। তবে এর কাঠ ওজনে বেশ দড়। লোহার মোটা হুড়কো, পেল্লায় খিল থাকা সত্ত্বেও যাতে, মা পরে তালা ঝুলিয়েছিল চোর-ডাকাতের ভয়ে।
আমার সমূহ আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল দোচালা ফাঁকা ঘরখানা, বিশেষ করে বারান্দা থেকে ঢুকতেই যে প্রকান্ড ঘরটি হাঁ করে গিলে খায় অযাচিত-অনাহুত অতিথি আগমন। সচরাসচর বন্ধ এ ঘরের শেকল বাইরে থেকে টানা থাকে বছরভর। কখনও পরিষ্কারের জন্য মালিক এখানে লোক পাঠালে সে রংচটা সবুজ দরজা খোলা হয়। হাঁ মুখো ঘরখানা এরকমই কোনদিন বাইরে থেকে আবিষ্কার করে যুগপৎ বিস্মিত ও শিহরিত হই।
একদিন ঘর পরিষ্কারের পর, বোধ করি, শেকল টানতে ভুলে গেছিল মালিকের জন। আদুড় প্রবেশ দ্বারের একপাশে ধুলো-ঝুল আর শুকনো পাতা আঁজলা করা। প্রকান্ড উঁচু দেয়াল জায়গায় জায়গায় ভেঙে ভেঙে পড়েছে, কয়েকটা পাথরকুচি আর লতানে গাছ গজিয়েছে সদ্য। মাথা হেলিয়ে লম্বালম্বি দেখলেও ঘরের ছাদ ঠাহর করা যায় না। কড়িকাঠের অগুণতি কড়ি-বরগার জালে জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন নীল। একটিমাত্র জানলার ফাঁকফোঁকর থেকে স্থির রোদ লম্বা লম্বা ছায়া ফেলেছে লোহার শিকের।এই ঘরের পাশে আর কোনও ঘর নেই, আমাদের মতন।
আচমকা তীক্ষ্ণ এক আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে। পেছনে সদর দরজা, একফালি রোদ্দুর ধরে রেখে গুটিয়ে গেছে কখন।
আমার ভয় করে এবার। তাবৎ আবিষ্কার আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ঘুচে গিয়ে বাড়ির কথা মনে পড়ে, মায়ের কথা। মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, হুতাশ...বুকে ছাঁৎ,স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি চেনা গলা, হাওয়ায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুরছে আমার নাম; মা ডাকছে।
প্রথমে গৃহবন্দী, ওয়ার্ক ফ্রম হোম এসব শুনে প্রভূত পুলকিত হয়েছিলাম, বলাই বাহুল্য। পরিজনের সবার সাথে অষ্টপ্রহর থাকব, তাদের সাথে ডিনার টেবিলের বাইরে এতটা সময় কাটানোর সুযোগ যে এ জীবনের মোক্ষলাভ। মেয়েবেলার ওই ঘর আবিষ্কারের মতন হাতে চাঁদ পাওয়া ব্যাপার।
এরপর সময় গড়াল কিন্তু বন্দীজীবন রইল ধ্রুবক; বাইরে বেরোনো নেই, ছোট বাচ্চাদের খেলার জায়গা নেই, নীল আকাশে ফুরফুরে সাদা মেঘেদের দেখতে পাওয়া নেই। বদলে আছে বন্ধু-পরিজন দেখলে দূরত্বে সরে যাওয়া, আশঙ্কা, ভয় আর মুখোশ। বাড়ি ফেরার, আগের 'স্বাভাবিক' জীবনে ফেরবার জন্য আনচান হয় মন..দূরত্ব তবু আঙুল রেখেছে কীবোর্ডের স্পেসে।
আমার বড্ড ইচ্ছে করে ওই ছেঁড়া নামের মত মা ডাকুক এখুনি, ফিরিয়ে নেবার ডাক; বান্ধবীগাছ মায়ের প্রশ্রয়ে নাজুক নাদান স্বাভাবিক জীবন...মুখোশহীন।
৩.
সারাদিন বাড়িতে বসে করোটা কী!!
কমবেশি শোনা একটা বাক্য। বাবার 'অনুযোগ' মা'কে। 'অনুযোগ': অন্তত মা যেমন বলত। আমি জানি বকা, ঠিক মাস্টারমশাইদের মতন; প্রত্যাশা না মেটানোর আর পেশীক্ষমতা আস্ফালনের মিশেল, যাকে যত্ন করে 'তোমাকে চিনি/ভালবাসি বলেই তো প্রত্যাশা রাখি'র মোড়কে গুছিয়ে রাখা হয়।
অথচ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাংসারিক অলিখিত 'টু ডু লিস্টে' কীভাবে একের পর এক টিক হয়ে যায় সেসবে ঘামানো মাথা, সোনার পাথরবাটি।
স্নেহচরণেষু মা,
জ্বরে মথন হয়েছে তোমার তনু, কালো করে মন খারাপ এসে দু'চোখের নিচে কতক জিরিয়ে নিচ্ছে। শ্বাস অনিয়মিত, কপাল পুড়ছে, কলিজার ধুকপুকে একরাশ ক্লান্তি; যেন যুঝতে যুঝতে তলানিতে এসে পৌঁছেছে কায়ামন...তবু কত আর হাসিমুখে ক্ষমাঘেন্না করে দেবে প্রিয়জনের ভুলের ইথার। তোমারও তো মন খারাপ হয়, গা এলিয়ে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে অবসরে...। আদুড় গায়ে মুখ এলাবে জানলা খোলা মতিচ্ছন্ন হাওয়ায়, পাতটি পেড়ে খাওয়াবে প্রিয়সখা, প্রগাঢ় অভিমানে ঝর্ণা হবে বেপথু...অথচ দেখ মিলনান্তির অনুঘটকিনী আমি কেমন সরে গেছি নিশ্চুপ, দায় ফেলে...।
ইতি,
তোমাকে আজীবন 'টেকেন ফর গ্রান্টেড' ভেবে আসা, মুখে কুলুপ ও চোখে ফেট্টি আঁটা, সুবিধাবাদী এক সন্তান
ধরিত্রী জানে এই নাজনিন যাত্রাগাহন। ভালবেসে জড়িয়ে থেকেছ এযাবৎ, মেহজাবিন প্রশ্রয়লতায়। মুখ তুলে দেখিনি, চোখে রাখিনি চোখ,আঙুল ছুঁইয়ে গেলে ভুলে গেছি পারদের নাম; তোমার আবার শরীর খারাপ হয়! পথ থেকে তাই সরিয়ে নিয়েছি ছায়া, আকাশ বড্ড রুক্ষ্ম- ব্রততীনীল হীন। চোখ মুছেছ তুমি, প্রিয় বসুন্ধরা আশ্রয়, শেষে হাত ধরেছ বারেবার। এখনও বলবে, শাস্তি প্রাপ্য নয়! বন্ধক রেখছি জীবন, তোমারই মুখাপেক্ষী। ভাইরাস-কালো আবহে খান খান করো সন্ততি দেমাক তবু পৌনঃপুনিক অনুরোধ ফিরিয় না, প্রিয় মাতৃস্নেহ। কথা দিলাম এই একাকী একহারাক্ষণ যত্নে রেখে দেব আশীর্বাদসিন্দুকে।
৪.
ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে প্রচন্ড ঘাম হয়। ঘাম জমে কোরকে, তেষ্টা পায়। জল খাই ঢকঢক। দুঃস্বপ্ন তখনও জড়িয়ে থাকে মনে, শিকারের পর পেট ফুলিয়ে শুয়ে থাকা ময়ালের মতন।
থিতিয়ে আসে ভয় এরপর। রক্তহীন শরীর সতেজ হয় ধীরে ধীরে, স্বপ্নের খোলস ফুটে প্রিয় সকালের রোদ বেরিয়ে এলে। চারদিক এত চেনা; এইসময়ে ঘুমের ওই স্বপ্নের কথা ভাবতেও বড্ড কষ্ট হয়।
অথচ সময় এখন ঠিক বিপ্রতীপ। ঘুমের সময়টা আরাম- প্রশান্তির, বাকি সময় আশঙ্কা-দুশ্চিন্তা-মৃত্যুভয়।
'জন্মিলে মরিতে হবে' ঠিকই তবে এই যে আপৎকালীন সংকট,যুদ্ধ কিংবা দাঙ্গা ন্যায়,দরজা খুললেই ওৎ পেতে বসে থাকা শত্রু হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে আশঙ্কায় লুকিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকে বেঁচে থাকতে হবে পরবর্তী সময়; গর্তের ভেতর লুকোনো এ খরগোশজীবন বড় হুতাশসম। ইচ্ছে করে অন্ধকার থাকুক, শৈত্য চলুক, পায়ের শব্দ শুনেও মুখ তুলি বেড়ার ওপারে...এক টুকরো মলয় এসে ধুয়ে দিক মুখ, হাটখোলা পরিন্দা সন্ধিক্ষণে.....মায়ের মুখ মনে পড়ছে শুধু.. বৃষ্টিতে ভেজা বেড়ালছানার মত ঘরের এককোণে পড়ে থাকা মায়ের মুখ...গাঢ় হয়ে জমাট বেঁধেছে সে।