গণনাট্য সঙ্ঘের সাথে আমার সম্পর্ক, আমার জন্মের ঠিক ৬ মাস আগে। না না মস্করা করছি না, তারিখ দিনক্ষণ আমার মনে নেই, থাকার কথাও না। তবে জায়গাটা ছিল তাহেরপুর, সাম্প্রতিক শাখার "তিতুমীর" নাটক অভিনীত হবে। আমার গর্ভধারিণী ৬ মাসের আমি-কে গর্ভে নিয়ে, মঞ্চে ওঠার ঠিক আগে, প্রথমবারের জন্য সাড়া দিয়েছিলাম আমি। খুশীতে পাগল হয়ে মা অভিনয়ে কোনও বাড়তি প্রেরণা পেয়েছিল কিনা জানি না,তবে আজও এই গল্পটা আমায় ভারি তৃপ্তি দেয় । আমায় বলে আমি তো ওদেরই একজন, যারা একসময়ে গ্রামবাংলা কাঁপিয়ে বেড়াতো, যারা আজও ঢেউয়ে ঢেউয়ে তুফান তোলে ...
জন্মের পর থেকে বাবা মায়ের সাথে... না বাবা মা বলব না গণনাট্য সঙ্ঘের সাথে সারা বাঙলা ঘুরে বেড়িয়েছি । হ্যাঁ ততদিনে আমার একটা অধিকার বোধ জন্মেছে । কারণ তখন আমার ভূমিকা এক ম্যারাকাস বাদকের, গানের দলের এক পাশে দাঁড়িয়ে ম্যারাকাস বাজাতাম, বিশেষ পাত্তাতো দূরের কথা একটা মাইকও জুটত না আমার। তাতে আমি থোরাই কেয়ার করি, নিজেই বাজাতাম নিজেই মুগ্ধ হতাম। আবারও একটা তৃপ্তি মনে বাসা বাঁধত , আমিও তো ওদেরই একজন।
একবার মনে আছে বাঁকুড়ার মাঝদায় মুক্তধারা শাখার "ক্রীতদাস"-এর শো , আমার সারা শরীর পোড়া নারেঙ্গায় আক্রান্ত, যন্ত্রণায় ককাচ্ছি, মা আমাকে সহকর্মীদের কোলে দিয়ে মঞ্চে উঠছেন আর নেমে এসে আবার কোলে নিয়ে ভোলাচ্ছেন। এই ভাবেও অভিনয় করা যায় !!! হয়তো শুধু গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরাই পারেন। ধুলোতে আমার সারা শরীর বিষিয়ে গেছিলো, ডাক্তারের কাছে জোর বকুনি খেয়েছিলো আমার বাবা মা, তাতে কি? ওদের মনের আগ্নেয়গিরির হদিশ পাওয়া ডাক্তারের কাজ না...
হ্যাঁ আবারও বলছি গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মীরাই পারে এমন সব অসাধ্য সাধন করতে, তার প্রতিদানগুলোও ছিলো ভারি অদ্ভুত। কোনও এক প্রত্যন্ত গাঁয়ে সবাই মিলে ডাব খাওয়া হলো, ডাবওয়ালা নিজে হাতে ডাব কেটে সবার মুখে তুলে দিয়ে পয়সা নেবার বেলা একদম মুখপালটি "তুমাদের থিকে পইসা লুবো নি, তুমরা কমরেড না?" কান্নায় গলা বুজে আসে না? সত্যিই তো আমরা কমরেড তোমাদের সাচ্চা কমরেড। এরকম ছোট ছোট কত ঘটনা, টুকরো স্মৃতি আবছা মণে আসে। কমরেড এসেছে শুনে শুধু সাদা ভাত আর আলুসিদ্ধ নিয়ে গ্রামের মানুষ হাজির , পরম তৃপ্তিতে খাওয়াবে আপনজনকে।
আর একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়, আমার বোনের জন্মের সময়, সদ্যোজাত বোনকে একবার চোখের দেখা দেখে আমাকে নিয়ে বাবা সটান চলে এলেন কলকাতার শিশির মঞ্চের অনুষ্ঠানে। গোটা অনুষ্ঠানটা বাবার ধুতির খুট ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। মনটা খারাপ ছিলো, নতুন অতিথিকে ভালো করে দেখাও হয়নি যে।
শুধুমাত্র পরিবারের কথা বলে যাচ্ছি কারণ এদেরকে কাছ থেকে দেখেছি। এরকম কত পরিবার আছে, কত মানুষ আছে যারা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে আম আদমির কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। এদেরকে আমরা বিদ্বজ্জন বলে মানি না, সম্মান করিনা। কারণ এরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের কাছে আসেন, আমাদের কথা বলেন, গানে, নাটকে, কবিতায়। নিজের চক্ষে সেদিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, গম্ভীরা, মহাভারতের যুদ্ধ, সূর্যশিকার, ক্রীতদাস, গণনাট্যের এক একেকটা প্রযোজনা যখন আছড়ে পড়ছিল, শাসকের বুকে শেলএর মত বিঁধছিল, সেদিন আমি সাক্ষী ছিলাম। সাক্ষী ছিলাম ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঘাড় সোজা করে লড়ে যাওয়া মানুষগুলোর লড়াইয়ের। তাই আজও হুজুগে শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের থেকে ওদেরকেই বেশি আপন মনে হয়। আমার কমরেড।
একটা ভারি মজার কথা মনে পড়লো, বীরভূম-এর কোন প্রত্যন্ত গ্রামে নির্বাচনী তরজা গানের আসর বসেছিল। যুযুধান দুই পক্ষ বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস । বামফ্রন্টের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন কমঃ শুভেন্দু মাইতি আর কংগ্রেস এর হয়ে জবাব দিচ্ছিলেন কমঃ মন্টু দে । প্রচুর লোক সমাগম ছিলো, বামফ্রন্ট এর চাঁচাছোলা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে মন্টুকাকু বলে উঠলেন। "আমার লাঠিটা কোথায় রে ব্যাটাকে মেরেই ফেলবো" সাথে সাথে দর্শকাসন থেকে একটা ইঁট উড়ে এলো মন্টু কাকুর বুকে। হতভম্ব সবাই, মন্টুকাকু কিছুটা সন্ত্রস্ত, দর্শকাসন থেকে চীৎকারের রোল "শালা কমরেডকে মারবে? মেরেই দেবো শালাকে" ... এক বৃদ্ধ রাগে কাঁপছিলেন, আশে পাশে অনেকেই উত্তেজিত। সব কমরেডরা এগিয়ে এলেন আড়াল করলেন মন্টু দেকে । বোঝাতে লাগলেন দর্শক দের উনি আমাদের লোক, শুধুমাত্র অভিনয় করছেন, কে শোনে কার কথা ? লোকে এই মারে কি সেই মারে। এবার ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন কমঃ মন্টু দে, তার দুচোখে অঝোর জলের ধারা , কাঁপা কাঁপা হাত তুলে বললেন "আমার জীবনের সেরা পুরস্কার নিয়ে যাব আজ এই গ্রাম থেকে, লাল সালাম"। রাগে ফুঁসতে থাকা মানুষ গুলোর চোখ নরম হয়ে গেল এক নিমেষে, পেশিবহুল হাতগুলো সমস্বরে জবাব দিলো "লাল সালাম"। কী অদ্ভুত জাদু-মাখা দুটি শব্দ। মন্টু দের শেষ যাত্রার শরিক ছিলাম। বড় অনাদরে চলে গেল লোকটা, একটা লাল শালুও জুটলো না। শেষ দিন অবধি বামপন্থার প্রতি বিশ্বাসে অটুট ছিলেন।
এবার কিছু অপ্রিয় সত্যের দিকে দেখা যাক। হঠাৎ করে সব হিসেব ওলট পালট হতে লাগল, সালটা ১৯৮৬, হোপ ৮৬ নামে একটি অনুষ্ঠান হয় যুবভারতী ময়দানে, সংস্কৃতির নামে বেলেল্লাপনার বোধহয় সেই শুরু। সাম্রাজ্যবাদ তার দুই প্রধান অস্ত্র পুঁজি আর সংস্কৃতিকে আগে পাঠায় আগ্রাসনে। পিছনে পিছনে নিজে আসে , দুই ফেউ এর আঘাতে ভেঙে পড়া জাতিকে দখল করতে সুবিধা বেশি হয়। নিছকই রণকৌশল। প্রসঙ্গে ফেরা যাক, এরপর থেকে দ্বিতীয় অস্তরটি তার কাজ শুরু করে দেয় এবং তা করলো একটি বামপন্থী দলের একাংশের তত্ত্বাবধানে। ঠিক এর পরপর সব জেলাগুলোতে, সি পি আই (এম) নেতৃত্বের একাংশের ইচ্ছায় এই সংস্কৃতি প্রসার লাভ করতে লাগল। এরা একটা গালভরা নাম ও দিলেন 'পপুলার কালচার' অর্থাৎ মানুষ কে দিশা দেখানো না, মানুষ যা চায় তার সাথে চলো। সেই পথ ধরে মানুষ যেদিন পরিবর্তন চেয়ে বসলেন, তখন অবশ্যই এরা আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু তখন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। সে কথা থাক, পপুলার কালচার প্রসারিত হলো। বিভিন্ন উৎসব হতে থাকল, তাতে দালাল সমাজ পুষ্ট হলো, সলিল চৌধুরীর নামাঙ্কিত মঞ্চে দালের মেহেন্দির প্রলয় নৃত্য হলো, বাপি লাহিড়ি, মিঠুনদা থেকে শুরু করে হালফিলের দেব-কোয়েল সবাই আছেন সেখানে, নেই শুধু আমাদের সেই কমরেডরা, আলোর রোশনাইতে ওরা একটু ফিকে দেখান যে। পপুলার কালচার পুড়িয়ে মারলো গণনাট্য সংঘকে , এটাই উদ্দেশ্য ছিলো।
আজ এত বছর পরে সেই পুরনো মানুষগুলোর সাথে দেখা হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজও কোনো অমোঘ বিশ্বাসে পতাকা টা আঁকড়ে ধরে আছেন, আমার বাবা মাও তাদের একজন। শেষদিন অবধি থাকবেন হয়তো। কিন্তু সবকিছু কি শেষ হয়ে গেছে ? তা তো হওয়ার নয়, মানুষের শ্রম নিঃসৃত সুর তো হারানোর নয়। সেই সুর সংগ্রহের কাজে আপনার হাতটা বাড়াবেন? পুঁজির সূর্য এখন মধ্যগগনে, আঁধার নামার আগে অনেকটা পথ পেরোতে হবে, জোরসে পা চালান কমরেড।