[রচনায় উল্লেখিত সমূহ চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোন সাদৃশ্য সমাপতন মাত্র ও অনিচ্ছাকৃত।]
রুণাবৌদি বালিগঞ্জের মেয়ে. সহুরে জীবন যাপনের মধ্যে বড় হয়েছেন. হিন্দুস্তানপার্কের এই বাড়িটা দাদুর করা. ছোটবেলায় দাদুর কাছে গল্প শুনেছেন তখন নাকি হিন্দুস্তান পার্কে শেয়ালের ডাক শোনা যেত. আশেপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে একএকটা বাড়ি হচ্ছে. রাসবিহারী এভিন্যুর মাঝখান দিয়ে ট্রাম লাইন পাতা হচ্ছে. রাস্তার মাঝ বরাবর একটু উঁচু করে ঘেসো জমি, তার ওপর দিয়ে ট্রাম লাইন. এ জিনিস কলকাতায় তখন বিরল. রুণাবৌদি তাঁর জ্ঞান থেকেই দাদুকে শয্যাশায়ী দেখে এসেছেন. প্যারালিসিস হয়ে বিছানাতেই থাকতেন সব সময়, একটা চারদিকে জানলাওলা বিশাল ঘরে দাদু থাকতেন। ঘরের সামনে বারান্দার ওপর দরজা। বাকি তিন দিকেই বাগান, দাদু নিজের থাকার জন্যে ঘরটা এই ভাবেই প্ল্যান করে নিয়েছিলেন. রুণাবৌদিরা; বোনেরা মাঝে মাঝে দাদুর বিছানার পাশে এসে বসতেন. স্পষ্ট ভাবে দাদু কথা বলতে পারতেন না, কেমন এলিয়ে এলিয়ে বলতেন. তাই খুব বেশি কথা দাদুর সঙ্গে কখনও হয়েছে মনে করতে পারেন না. দাদু মারা যান তখন রুণার বয়স সাত. খুব ছোটবেলার কথাও ওনার মনে আছে কিছু কিছু.
বাবার কথা ছোটবেলায় কেউ কিছু বলতে চাইত না. কালেভদ্রে বাড়িতে আত্মীয়রা কেউ কেউ আসত. মা বলে দিতেন: ইনি তোমার অমুক পিসি বা জ্যেঠু. কিন্তু পরের বার যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হত, সে মুখ একদম অচেনা লাগত বৌদির.
২.
যোগেশ্বরের হাত দুটো ছিল টোল ট্যাক্সের গেট, কাঁধ ছিল টাটা সেন্টারের ছাদ, মাথা ছিল কালবৈশাখির প্রোলগ কালো ফালি মেঘ. যোগেশ্বর মদ গাঁজা তামাক এমন কি চা ইস্তক খেতেন না। এ হেন যোগেশ্বরের একটি বদরোগ; দুনিয়ার সব ফুলকে তিনি অধিগত ভাবতেন. যোগেশ্বর যোগবলে একটা ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলেন. ফুলেদের নিচে দাঁড়ালেই আপনি খসে যেত তারা, অথচ যোগেশ্বর আঁজলা ভরে ওদের ঘ্রাণ নিতেন না. কখনও কোনো ফুলকে তিনি ঘরের ফ্লাওয়ারভাসে রাখেন নি. কখনও গুঁজে দেননি কোন ফুল মেঘলা কবরীতে. পল্লব পুকুর আড়ায় যোগেশ্বরের আখড়া ছিল. যদিও পল্লব পুকুরে ভালো-বাসার প্রত্যাশীদের টাকা ছাড়া আর কিছুই ডোবে না, তাও সে পুকুর এবং বধ্য। বধ্য প্রোমোটারের সুদর্শন বাইকের চাকায়।
যোগেশ্বর মর্ষকামী; যোগেশ্বর অস্মিত; তাই ফুলেদের সুবাস তির্যক হয়ে উসুলের প্রতিক্ষায় থাকত। অগত্যা যোগেশ্বর একদিন বেদম মার খেলেন। যাচ্ছিলেন বনপথে, জারুলের ব্যাথাতুর বেগুনি ফুলশাখা ভেঙে পড়ে গেল যোগেশ্বরের ঘাড়ে. আরক্তিম আড়ষ্টতা ভাঙতে গিয়ে কৃষ্ণচূড়া ভেঙে ফেলল ডাল, ডালের আগার ফেন্সিং তীক্ষ্ণতা দীর্ণ করল যোগেশ্বরের মাথার মেঘমাল্লার। যোগেশ্বর পড়ে গেলেন মাটিতে. অমনি রাধাচূড়াদের হলুদ তারুণ্য খিলখিল করে ছড়িয়ে পড়ল শায়িত শরীরে। চোরা কাঠের ব্যাপারীরা পড়ে পাওয়া অর্জুন কাঠ ভেবে তুলে নিয়ে গেল চেরাই কলে, কলের মালিকের সন্দেহ হোল গোড়ায় আগুন লাগানোর চিহ্ন নেই; এমন একটা শক্ত সমর্থ; শুধুশুধু পড়ে মরতে যাবে কেন? কাটা ছেঁড়া যখন চলছে, করাত কলের পাশেই প্রস্ফুটিত ঘেঁটু ফুল তার বকের মত গলা বাড়িয়ে বলল:
ও অর্জুন নয়; যোগেশ্বর. স্নান পূর্নিমার রাতে বন-পুদিনার রসে ও হয়েছিল ফুলেদের রাসপুতিন।
ব্যাস ব্যবচ্ছেদ রদ্দ হয়ে গেল. যোগেশ্বর ফিরে এলেন তপোবনে, পল্লব পুকুর আড়ায়। নির্জন সেগুনের পাতা দলছুট হাতির কানের মত দুলে দুলে চামর দুলিয়ে তাঁকে স্বাগত করল। সেই থেকে যোগেশ্বর পেলেন নির্ভার ঘেঁটুর আদল আর বর্ণময়ী সুবাসিত ফুলেরা হ’ল ভরা বিছুটির বন, ঘেঁটু তাদের অন্তস্থ। কটুগন্ধ ঘেঁটু-গুল্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছুটি বনের ভেতর। আজ তাও শেষ। প্রোমোটারের কোদালের কোপে ইতস্তত ভূলুন্ঠিত বিছুটির ঝোপ, দলিত মথিত ঘেঁটুফুলদল, এখন গন্ধ নেই; কটুতাও তো সজীবতা দ্যোতক.
বিমলের যোগেশ্বর রূপ, অথ উন্মুঞ্চতি।
৩.
রুণা দেখতে মোটামুটি যাকে বলে চটক আছে. এ ছাড়া অন্য কিছু কতটা কি ছিল সে নিয়ে উনি নিজে ও অন্যেরা বরাবরই সন্দিহান ছিলেন। পরপর দুবার তৎকালীন হায়ারসেকন্ডারিতে একাধিক বিষয়ে ব্যাক পেয়ে পড়াশুনার ব্যাকবোনটা স্থায়ী ভাবে ভেঙ্গে গেল। রুণাবৌদি বায়সকুলকে চ্যালেঞ্জ না জানিয়ে একটি গানই গাইতে পারতেন; সেটা হোল: কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’. প্রাক বিবাহ কালে রুণা ছিলেন মোটামুটি সঙ্গীহীন। স্কুলের বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া আসা তেমন বেশি ছিলনা। হিন্দুস্তান পার্কের এই অঞ্চলটায় প্রতবেশীদের বাড়ি যাওয়া আসাও তেমন প্রচলিত ছিল না। রুণার দিদি তাঁর থেকে পনের বছরের বড়, বিয়ে হয়ে গিয়েছিল যখন রুণার বয়স পাঁচ। বাবাকে হারিয়েছিলেন, তিন বছর বয়সে, দাদু তার পরও বছর দুয়েক জীবিত ছিলেন। বাবার পিএফ-এর টাকা ও দাদুর জমান টাকার সুদে তাঁদের সংসার চলত। কান্দি মহকুমার হিজল গ্রামের জমিদারীর স্মৃতি হিসেবে ছিল ; লম্বা লম্বা দেরাজ আর প্রমাণ সাইজের বেলজিয়ান কাঁচের আয়না সম্বলিত বার্মা টিকের পুরনো ড্রেসিং টেবিল, রোজ উডের গ্রামাফোন স্ট্যান্ড, আবলুশ কাঠের বেজোড় পায়া সমেত একটা ঢাউস পিয়ানো, যার স্টিলের রিড গুলোয়ে জং ধরেছিল,কালের সাক্ষী হয়ে । পেতলের এগ্রাফিটা কোন এক মেকানিক খুলে নিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরৎ দেয়েনি। হ্যামারের ফেল্ট জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল হিন্দুস্তান পার্কে আসার আগেই, দেশি ফেল্ট লাগিয়ে বাবা নাকি কয়েক বার বাজানর চেষ্টা করেছিলেন, হুপিং কাশির মত ঘংঘং আওয়াজ করে পিয়ানো জবাব দিয়েছিল সে আজ এন্টিক। দেওয়ালে টাঙানো পূর্বপুরুষ উসনাধিপতি ও জলধিজাপতির দুটি তৈলচিত্র। অল্প কিছু বইও ছিল; যেমন আলেক্সান্ডার ডুমার চামড়া বাঁধান জাবদা ‘কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো’, চার্লস ল্যাম্ব সম্পাদিত ‘ট্রাজেডি অফ শেক্সপীয়র। বাংলা বই হিসেবে রুণার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বভারতীর প্রকাশিত কুড়ি খন্ড রবীন্দ্ররচনাবলী।
নি:সঙ্গ হলেও, তাঁর এক দূর সম্পর্কের মাসতুত দাদার কথাটা ফ্যালনা না. যখনই দেখা হত, রুণাবৌদিদের বাড়িতে বা তাদের বাড়িতে, দাদাটি ঘনিষ্ট হতে চাইতেন. অবশ্য চার দশক আগে কলকাতার মধ্যবিত্ত গণ্ডিতে খুব বেশি ঘনিষ্টতা সম্ভব ছিল না, এই একটু আঙুলে আঙুল ছোঁয়া, হাতে হাত, খুব বেশি হলে অন্যমনস্কতার আছিলায় শরীরের কোন অংশে বা বুকে হাত ঠেকে যাওয়া, তার বেশি নয়.
৪.
বিমলদা হায়ার সেকন্ডারীটা পাস করেছিলেন. সেই সুবাদে নাগস-মেডিকালে মেডিকাল- রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরিটাও পেয়ে গিয়েছিলেন. বিমলদার জন্ম হাওড়ায় হলেও , হাওড়ার বাড়িটা বিমলদার বাবা অনেক পরিণত বয়েসে করেছিলেন। শোনা যায় ওনারা বিরাট জমিদার বংশ, একসময় ভারতের অনেক বড় সহরেই ওনাদের বাড়ি ছিল। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেল. বিমলদাদের ভাগে পড়ল কানপুরের বাড়িটা. হাওড়ায় আসার আগে ওনারা কানপুরেই থাকতেন. পাড়ার লোকেরা আড়ালে ওনাদের কানপুরিয়া বলত।
রুণাবৌদি-বিমলদার ঝগড়াটা উচ্চৈঃস্বর ও পাড়ার লোকেদের গা-সওয়া. কিছু সংলাপ তো অবিস্মরনীয়তা পেয়ে ছিল। বিমলদার বাবা নাকি প্রতি সপ্তায় বাড়িতে বাইজি আসর বসাতেন, ইত্যাকার অনেক তথ্য ঝগড়ার মাধ্যমে প্রকাশ পেত.
দৃশ্যত জীবিকার দাবীতে বিমলকে মাসের মধ্যে কুড়ি-বাইশ দিন বাইরে থাকতে হত। বিয়ের পর থেকেই রুণা এই রকম দেখে আসছেন। ছেলেটা তখন পেটে। বিমল যথারীতি বাইরে। ননদ এক প্রাইভেট নার্সিংহোমে পাস-না-করা নার্সের চাকরি করতেন। সকাল আটটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে। বাড়িতে অথর্ব শ্বশুর ছাড়া আর কেউ থাকত না সঙ্গ দিতে। ঠিকে কাজের লোক দুজন। তারা সময়ে এসে সময়ে চলে যেত। এই সময় রুণার খুব ভয় করতঃ বিমল যদি তাঁকে ছেড়ে চিরকালের মতন চলে যান! একবার তো সপ্তাখানেক খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলেন। বিমল ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর ডাক্তার কনসাল্ট করা হল। অ্যাকিউট ডিপ্রেসন। সপ্তায় একটা করে গোটা আষ্টেক ইন্ট্রাভেনাস ভিটামিন ইঞ্জেকশন নিতে হবে। প্রথম দু-একটা ইঞ্জেকশন বিমল তাকে নিজেই দিয়েছিলেন, কি ভাবে ভেইন খুঁজে নিতে হয় শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরের কয়েকটা রুণা নিজেই নিতেন, বিমলকে তো সব সময় বাড়িতে আশা করা যায় না!
ইদানিং বিমল যে ক'দিন বাড়িতে থাকতেন, মানে যে কয়েক ঘন্টা, তার মধ্যে কোন সময়ে ওনাদের ঝগড়ায় ছেদ পড়ত, সে দিন বা রাত্রি যাই হোক, হলফ করে বলা মুশকিল। সাংসারিক ব্যস্ততা,অন্যমনস্কতা,নিদ্রাযাপন বিষয়গুলি তো পড়শিদেরও থাকে।
৫।
ইতিমধ্যে বিমলদার বাবা গত হয়েছেন। বিমলদাদের বাড়ি ভাই-বোনের মধ্যে ভাগ হয়েছে। একবার তো বিমলদা এক নাগাড়ে দু-মাস মত বাড়ি ছাড়া। কোথাও কোনো খবর নেই। রুণা বৌদি বছর চারেকের ছেলে নিয়ে তাঁর অংশে একা। এদিকে বৌদি আজকাল সকাল বিকেল গান প্র্যাকটিস করেন। ছকু বলে এক বছর পঁচিশের যুবক আসে তবলায় সঙ্গত দিতে। রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত মহড়ার আওয়াজ শোনা যায়।
একদিন হোলো কি ঘটুদের বাড়ির ছাদে যে পায়রা বসার মাচা-টা; এক গল্প দেখে ফেলল। কে না জানে পায়রার পায়ে বাঁধা হয়ে আসে বিপুল তথ্য। মাচার গঠনও টিভি এন্টেনার মতন। সুতরাং দৃশ্যমানতা গ্রহনে অসুবিধেটা কোথায়? আর মাচা তো মূলত ফ্রেম, মহাবিশ্বের সব রহস্যই তো ধরা পড়ে কোন না কোন ফ্রেমে!
রুণা বৌদির ঘরের জানলাটার একটা পাল্লা খোলা ছিল। বৌদি খাটে আধ-শোয়া, ছকু নিচে মাদুরে নিলডাউন পোজিশনে। দুজনে দুজনের আলিঙ্গনপাশে; চুম্বন রত।
৬।
ক’দিন পরে থানা থেকে পুলিশ এল বিমলদার খবর নিয়ে। এরেস্ট হয়েছেন। শ্যাওরাফুলির এক মহিলা অভিযোগ করেছেনঃ
বিমল তাঁর স্বামী। বিমল তাকে হিন্দু মতে বিয়ে করেছেন। শ্যাওরাফুলিতে ঘর ভাড়া করে তাঁরা সংসার পেতেছেন। ইতিমধ্যেই স্বামী নিয়মিত ভাবে তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালান, সংসার খরচের টাকা পয়সা ঠিকঠাক দেন না। প্রায়ই বেপাত্তা হয়ে যান।
পুলিশও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেঃ
মেয়েটি আরামবাগ সহরে এক ক্লিনিকে আয়ার কাজ করে। বিমলকে কাজের সুত্রে সেই ক্লিনিকে যেতে হত। বিয়ের সাক্ষীও কয়েক জন আছে। শ্যাওরাফুলির ঘর থেকে একটি তানপুরা আর তেল ও জল রঙে আঁকা মেয়েটির নানা রকম পোজের কতগুলি ছবি পাওয়া গেছে। ছবিগুলির নিচে বিমলের সই।
থানা থেকে এক ইন্সপেক্টর তদন্তের জন্য এসেছিলেন।পুলিশকে নির্দ্বিধায় রুণা জানালেন:
-আপনারা কি বুঝতে পারছেন না, বেশি টাকার লোভেই অভাবী সংসারের এই মেয়েটা একটা গল্প ফেঁদেছে, বিমল আমার স্বামী, চাকরির স্বার্থে ওকে মফস্বলের গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে হয়. ওর রিজিওনের কাছাকাছি বড় সহর এই শ্যাওরাফুলিই. প্রায়ই ওর কাজ শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যায়, তাই আমরা ঘরটা ভাড়া নিয়ে রেখেছি, আর ওমনি লোকেদের গুজব রটানো শুরু হয়ে গেছে। আপনাদেরও বলিহারি যাই বাবা, বাড়ি বয়ে জিজ্ঞেস করতে এসেছেন! মানুষের আক্কেল জ্ঞান কোথায় গেল কে জানে!
সে সব দিনে শ্যাওরাফুলির পাড়ায় পাড়ায় মানুষ পরস্পরকে চিনত. কারুর বাড়িতে অতিথি এসে ক'দিন থাকলেও প্রতিবেশীরা জেনে যেত. অথচ পাড়ায় নতুন ভাড়া এলো; লোকে জানলোনা এটা অসম্ভব. কাজেই, স্থানীয় সাক্ষী পেতেও পুলিসের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তবে বাড়িটা একটু অন্য রকম জায়গায়. শ্যাওরাফুলি স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে রেললাইন বরাবর বৈদ্যবাটির দিকে গেলে, একটা পতিতা পল্লী পড়ে, বাড়িটা সেই পল্লীর কাছেপিঠে. সেই কারণে সাক্ষীরা কেউ বিয়ের সপক্ষে নিশ্চিত কিছু বলতে পারল না.
এদিকে মেয়েটি অভিযোগ গুরুতর, বিনা তদন্তে কেস ক্লোস হওয়ার নয়। এ ক্ষেত্রে আর যাই হোক নারী শরীরে মিলনের সাক্ষ্য-চিহ্ন নিশ্চিত. আশ্চর্যজনক ভাবে, শারীরিক পরীক্ষায়, অন্য চিহ্ন দূরস্থান মেয়েটির কৌমার্য সূচক চিহ্নটিও অটুট আছে দেখা গেল. ইতিমধ্যে স্বপক্ষের সাক্ষী হিসাবে মেয়েটি যাদের এনেছিল, তাদের মধ্যে থেকে কিছু মেয়ে দাবি করে বসলো তারা প্রত্যেকে বিমলকে পতি রূপে কামনা করে প্রস্তাব দিয়েছে, এখন মনোনয়নের অপেক্ষায়।
অগত্যা পুলিস বিমলকে ব্যক্তিগত মুচলেকার বিনিময় হাজতবাস থেকে মুক্তি দিল. এর পরেও মেয়েটি কোর্টে কমপ্লেন কেস করবে হুমকি দিল. এইভাবেই টাল-মাটালের মধ্যে চলছিল সেই দিনগুলি. বিমলদাও সাসপেন্ড না হয়ে চাকরিতে জয়েন করেছেন. একবার বিমলদার দিন পাঁচেকের অনুপস্থিতিতে রুণা বৌদি মেয়েটিকে ডেকে পাঠালেন বালিগঞ্জে তাঁর পিত্রালয়ে. বালিগঞ্জের পিত্রালয় ততদিনে বিক্রির কথা চলছে এক গুজরাটি ব্যবসাদারের সঙ্গে. এডভান্স ডিডও হয়ে গেছে. ডিডের শর্ত রুণার মা যত দিন জীবিত থাকবেন তাঁর দেখাশোনার দায়িত্ব ওই ক্রেতা ভদ্রলোকের। দামও ধার্য হয়েছে সেই ভিত্তিতে। অবশ্যই সাকুল্যে যা পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে মফস্বলেও কোন জমি কেনা যায় না।
৭।
মেয়েটির গ্রাম সম্পর্কের এক দাদা বালিগঞ্জের বাড়িতে এলো, সঙ্গে মেয়েটিকে নিয়ে। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর মেয়েটি বলল:
-ওকে ভালো লেগেছিল বলেই মডেল হতে রাজি হয়েছিলাম বৌদি, টাকা পয়সার জন্যে নয়। তোমারই বা আপত্তি কিসের? তুমি তো থাকবে তোমার জায়গায়, আমি আমার জায়গায়। অমত করছ কেন?
জানা গেল বিমল মেয়েটিকে বলেছিলেন তিনি বিবাহিত. মেয়েটি চায় যে কোন মূল্যে বিমলকে পেতে, সে দিন মেয়েটিকে রুণা তার কি প্রাপ্য দিয়েছিলেন জানা যায়নি। তবে মেয়েটি আর কোনদিনও বিমল ও রুণার বৃত্তে আসেনি। শোনা যায় নাকি, রুণা তাঁর বিয়ের বেনারসী মেয়েটিকে দিয়েছিলেন।
বিমলদার হাইট প্রায় ছফুট. একদা ডিস্ট্রিক্ট লেভেল ভলিবল প্লেয়ার ছিলেন. পারিবারিক সুত্রে পাওয়া কন্ঠ ভারতীয় ধ্রুপদের মূলসুরে বাঁধা. মুখে আভিজাত্যের উদ্ভাস. চোখে শিল্পী সুলভ ভাবালুতা. সুন্দর ছবি আঁকেন. তাঁর মনের স্থানাংক মধ্যবিত্ত প্রাত্যহিকতার মেট্রিক্স ইমারতে নেই, আছে অমৃতকুম্ভের ফেনিল উত্সারে. কখনও তুর্কি ঘোড়ার দ্রুতিতে, তো কখনও ঝর্নাতলার উড়ানখোলা প্রজাপতির ডানায়. গদ্যময়তায় প্রতি স্বাভাবিক অনীহা তাঁকে চাকরিতেও শিথিল করেছিল। অনুপস্থিতির মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলল। হাজার হলেও নাগস-মেডিকাল প্রাইভেট কম্পানি, ছোট কম্পানি। ওয়ার্নিংএর পর ওয়ার্নিং এসে একদিন চাকরিটা চলে গেল। পিএফের সঞ্চয় দিয়ে কিছু দিন চলছিল. রুণা বৌদিও বাড়িতে বাংলা মিডিয়াম নিচু ক্লাসের ছাত্র দূর দূরান্ত থেকে ধরে প্রাইভেট টিউশনের চেষ্টা করলেন, গানের টিউশনের চেষ্টা করলেন. কিন্তু কোনটাই আখেরে দাঁড়ালো না. কারণ সব অর্থকরীতাতেই ব্যক্তি মানুষের পরিচয়, একটা মলাট জরুরি, যেটা তাঁর ক্ষেত্রে বড় জীর্ণ ও মলিন.
৮।
রুণা বৌদির গান শেখা অনেকদিন অস্তমিত. ছকু এখনও বাড়িতে আসে.তবে আজকাল এলে কিছু সঙ্গী স্যাঙ্গাত নিয়ে আসে. এবং বেশির ভাগই বিমলের অনুপস্থিতির সময়, যে পরিস্থিতিটা আদৌ দূর্লভ নয়। ওরা বন্ধুরা খুবই সহানুভুতি প্রবণ. একটা বন্ধু; নাম বাচ্চা, খুব রসিক, একটু আদিরসাত্মক. কোন একটা ব্যাঙ্কে ক্যাজুয়াল স্টাফ. কোন মন্ত্রীর সুপারিশে চাকরিটা পেয়েছে. খুব শীঘ্রই পার্মানেন্ট হয়ে যাবে. ও মাঝে মাঝেই রুণা বৌদিকে দু পাঁচশ টাকা ধার দেয়ে, তবে কখনও শোধ করতে বলেনা. রুণা বৌদি টাকা শোধের কথা তুললেই বলে, আগে বিমলদার কিছু একটা হোক তারপর দেখা যাবে.
বিমল প্রায় মাস ছয়েক ফেরার। অস্বাভাবিকতার স্বভাবসিদ্ধতায় রুণা কোন খোঁজ নেন নি। তবে এবারের বিশেষতা অন্য।
ইদানিং বিমল পাশ্চাত্য ধ্রুপদীতে আকৃষ্ট হন। একটা পিয়ানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে; সিন্থেসাইজারের ধাতব সঙ্গত এখানে যথেষ্ট নয়। রুণার বিয়েতে পাওয়া গয়নার প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। একটা বিছেহার কিন্তু কখনও হাত ছাড়া করেন নি। তার কারণ সঠিক কি রুণার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। হতে পারে, তাঁর ঠাকুমা, যিনি তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম মূহুর্তেই তিরোধান করেন, তাঁর স্মৃতি। নাকি দাদুর স্মৃতি, যিনি তাকে হাতে করে ঠাকুমার স্মৃতিটুকু তুলে দিয়েছিলেন। ঠাকুমার কথা যেটুকু, দাদুর কাছেই শুনেছিলেন রুণা, সীমিত পারিবারিক আখ্যান-মালার বিরল চর্চার মধ্যে বহুচর্চিত। বীঠোফেনের মুনলাইট সোনাটার সাথে ভীমপলশ্রীর মেলবন্ধনের কাজটা বিমলের সাম্প্রতিক। কম্পোজিশনটা কার্লটন কিটোর আখড়ায় তৈরি হওয়ার সময় ক’দিন রুণা বিমলের সঙ্গে গিয়ে শুনেছিলেন। এর জন্য সাবেকি পিয়ানোতেও কাজ চলবে না। কাস্টম-বিল্ট পিয়ানোর প্রয়োজন, যাতে রীডের সংখ্যা থাকবে অনেক বেশি। তখন থেকেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, পিয়ানো কেনার টাকা ওই বিছেহারটা বিক্রি করে সংস্থান হবে। সে প্রায় এক বছর আগের কথা। বিমল সে কথায় কর্ণপাত করেননি বা পিয়ানোও কেনা হয়নি।
তা এবার বিমলের সাথে সাথে সেই হারটাও নিরুদ্দিষ্ট।
৯।
সে দিন এসে থেকেই বাড়াবাড়ি রকমের অসভ্যতা করছিল বাচ্চা। চায়ের দোকানের ছেলেটা কেটলি ও খালি গ্লাসগুলি নিয়ে চলে গেল। রুণার ছেলেটা এখন বছর চারেক। পাশের ঘরে টিভিতে ছোটদের আসর দেখছে। বাচ্চা বলে বসলঃ
‘বৌদি তোমাকে আমি পুরো নিরাভরণ করে দেখতে চাই, যেমন বিমলদা দেখে ওর মডেলদের। দেখতে চাই তোমার মধ্যে কোন জিনিষটা নেই, যেটা বিমলদা পায় ওর মডেল মেয়েদের মধ্যে।’
রুণা জানে বিমল বিবসনার কাছে কিছুই চায়না। শুধু ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে চায় যা কিছু তাদের ধার করা নয়, সম্পূর্ণ নিজস্ব। পোশাকের উপস্থিতিটা সেখানে আরোপিত অনচ্ছতা, অসচেতন চয়নে প্রায়শই এক দুর্বোধ্য প্রতিবন্ধক, রূপমূলের যুগলবন্দি নয়, বেতালে বাজা, যেন অসাবধানে কেউ উপুর করে ঢেলে দিয়েছে প্যালেটের কালো রঙ। বিমলের করা মডেলদের ছবি তাই পুরোপুরি পোর্ট্রেট না হয়ে অনেকটা নারীত্বের সুর্রিয়ালিসম।
বাচ্চার চোখে এখন খিদে। এ খিদে জীব জগতের সব পুরুষের, মানুষের একার নয়। এ দৃষ্টির সঙ্গে স্ত্রীজীবের পরিচয় সহজাত। আচম্বিতে রুণার পিঠে এক হাতের বেড় দিয়ে সজোরে নিজের বুকের সাথে সেঁটে ধরল বাচ্চা। রুণা নিচে বাচ্চা ওপরে, দুজনেই এক সাথে পড়ে গেল পাশের খাটের ওপর। বাচ্চার অন্য হাতটা রুণার আচ্ছাদিত বক্ষ মথিত করতে করতে ব্লাউসের ফাঁকের ভেতর ঢুকে গেল। ব্রেসিয়ারের হুকটা ছিঁড়ে গেল। ডিপ ফ্রিজের ভেতর থেকে একটা ফসিল হঠাৎ জীবন্ত বেরিয়ে দাপাদাপি করতে থাকল রুণার স্নায়ুময়, অথচ প্রাগৈতিহাসিকটা মূহুর্ত আগেও প্রত্যাশিত ছিলনা। রুণা চোখ বন্ধ করলেন। এক অচেনা সৈকতে পড়ে আছে দুটি শরীর, দামাল জলোচ্ছাসে ধুয়েমুছে গেছে আভরণ। বালিমাটির টিলা উপত্তকায় পীচফল ঠুকরে খেতে থাকল বাদুর। ঘাসের ভেতর শ্রোণীমূলে একেবেঁকে ঘুরতে থাকল পাড়াগাঁয়ের অঞ্জনি সরীসৃপ।
ঘোর কেটে গেল। দরজার পাশ থেকে ছেলের গলা ভেসে এল, অস্ফুটেঃ ‘মা’।
১০।
পুরীতে স্বর্গদ্বারের কাছের সৈকতে ভিড়টা বড় বেড়েছে। হাঁটতে গেলে গায়ে গায়ে লেগে যায়, তো নিরালায় বসা! বিমল পান্থনিবাসের পিছন দিকের তটে বসেছিলেন। পায়াগুলো বালিতে পুঁতে ইজেলটা দাঁড় করান। ক্যানভাসে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছেঃ
অদূর সমুদ্রে একটা মেছো নৌকা নুলিয়ারা টেনে নিয়ে আসছে কিনারার দিকে। তীরে প্রতীক্ষায় জনকয়েক নানা বয়সের নুলিয়া রমণী। একটি কিশোরী ভিড় থেকে দূরে, খোঁপায় ঝাউ পাতা গোঁজা। আদুর গায়ে, খেঁটো শাড়িটার আঁচল জড়ান। নির্লিপ্ত চেয়ে আছে সাগরের পানে কিন্তু দেখছে না কিছুই। ওকে কি কথা দিয়ে গেছে বিশেষ এক ঢেউঃ ‘আবার আসিব ফিরে...’? ও কি জানেনা ‘কেউ কথা রাখে না...’
বিমল এঁকে চলেছেন, নিবিষ্ট মনে। আচমকা খেয়াল হোল; কে যেন পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে তাঁর আঁকা। মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন এক শেতাঙ্গ তরুনী। নাম বললঃ মিচেল। ফ্রান্সের নেটিভ। আলাপ জমে উঠল। নিজে ছবি না আঁকলেও প্যারিসের বিশ্ববিদিত লুভ্র্ আর্ট গ্যালারির জনৈক কিউরেটর। ছাত্রী জীবনের বিষয় ছিল ইতিহাস, স্নাতকোত্তরে বিশেষীকরণ প্রত্নতত্বাবধানে। কিছু টাকাকড়ি জমিয়ে পূর্ব ভারতে বেড়াতে এসেছেন। পুরীতে উঠেছেন তোশিলি স্যান্ডে। বিমলের আঁকার সাথে সাথে আলাপ চলতে থাকল। মিচেল ইংরেজিটা ভালই বলেন, ইয়াঙ্কি, স্কট বা অস্ট্রেলিয়ানদের মত ঠেট নয়, ওয়েল্শ্দের মত নাকি-উচ্চারন নয়, অনেকটা খাস ইংল্যান্ডের ইংলিশের মতন।
মিচেল দেখছিলেন বিমলের আঁকা, তেল রঙের অনুভূমিক বলিষ্ঠ স্ট্রোকে দ্রুত ফুটে উঠছে ছবির বিষয়। বিশুদ্ধ ইলাস্ট্রেশন। অপ্রয়োজনীয় কিউবিজম অনুপস্থিত, অনুপস্থিত সুর্রিয়ালিজমও। এ থিমে এইটাই দরকার। যেখানে প্রকৃতি নিজেই এত উদাত্ত, চেতনা প্রকৃতির সাথে অনুনাদী হওয়াই শৈল্পিক সততা। মিচেল চমতকৃত হলেন।
ভারতীয় রেলের অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য মিচেল কোলকাতা থেকে পুরী ট্রেনে এসেছেন। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক ট্যুরিস্ট গ্রুপে ছিলেন, ওনারা কনস্যুলেট মারফত পরিচিত। পুরীর সিবীচ অন্যদের কাছে তত আকর্ষক না হওয়ায় মিচেল একা হয়ে গেলেন। প্ল্যাটফর্মে ওনারা মিলে বব ডীলানের ‘গট আ ট্রাভেল অন’ গানটা গাইছিলেন। দূরে বসে একটি ছেলে স্কেচ করছিল। মিচেল একবার গিয়ে দেখে এলেন। কিউবিসম। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মটাই কিউবিসম। বিদেশী ট্যুরিস্টদের গীটার বাজিয়ে গান, অপেক্ষারত যাত্রীদের চাদর বিছিয়ে বসা, হকার-ভেন্ডার, প্ল্যাটফর্মের ওপর থুথু ফেলতে থাকা মানুষ, লাইনের ওপরে পেচ্ছাপ করতে থাকা মানুষ, দুর্গন্ধ, ঝগড়া, লোকজনের মতলব-ধান্দা, সব মিলিয়ে অসংখ্য উপাদান। তাদের লব্ধ নান্দনিকতা কিউবিস্ট ফর্ম ছাড়া অন্য কিছুতে প্রকাশ করা যায় না। ভাবা যায় না। কিন্তু তাঁর দেশের মত ধনী দেশগুলো? যেখানে কেবল বাঁচার জন্যে অগুনতি মাথার মিছিল নেই? সেখানেও রেলস্টেশন-হাসপাতালের স্থাপত্য, চিত্র-ভাস্কর্য সর্বত্র কিউবিস্ট প্রকাশ...দেখে দেখে তিনি ক্লান্ত। কতটা গভীরে পৌঁছতে পারে কিউবিসম? কত দূর নিয়ে যেতে পারে কিউবিস্ট প্ল্যাটফর্মে ভেড়া দূরগামী ট্রেন? অথচ বিমূর্ত বা অধিবাস্তবতার সে প্রতিবন্ধকতা নেই। অসুবিধে নেই, ইনস্টলেশন-আর্ট-ফর্ম ব্যাপক ছড়িয়ে পড়লেও। সেটা হল যেন উপযুক্ত শব্দ বেছে কবিতা লেখার মতন, সব শব্দই প্রকৃতিতে মজুদ। তা সত্বেও আধুনিক পাশ্চাত্যে নান্দনিকতা ঝুঁকে আছে কিউবিসম-এর দিকে, আর বহুমাত্রিক সঙ্কোচনের যুগে পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়াচ্ছে সেই চেতনার বংশাণু। মিচেলের মনে হয় এর কারণ বাহুল্যের প্রতি মানুষের দুর্বলতা। ভূমার প্রতি মানুষের আকর্ষন বেড়ে যাচ্ছে প্রাচুর্যের সাথে সাথে।
আলাপে-গল্পে ছেয়ে গেল মকবুল-বাওয়া-গণেশ পাইন-এর কাজ থেকে শুরু করে সালভাদর দালি-পাবলো পিকাসোর কাজের বিষয়। দ্রুততায় কাটতে থাকল সময় ও নোনা হাওয়া। উড়তে থাকল বালি, মিচেলের স্কার্টের ফ্রিঞ্জ, বিমলের ঝুলওলা পাঞ্জাবি, চুড়িদার ক্রমাগত পতপত করে দিতে থাকল মুক্তির রিবেল শ্লোগান। তাঁদের পেইন্টিং নিয়ে আলোচনা দেশ-কাল চতুর্মাত্রায় সব দিকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকল, মানে বিমলের ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোও বাদ গেল না। ভীমবেটিকা থেকে শভি-পন্ট ডি আর্ক; মধুবনী থেকে গ্রানাডার ম্যুরাল; আলাপ চলতেই থাকল।
সূর্য অস্তমিত, পশ্চিমে দিকরেখার ওপর যেখানে আকাশ সাগরে মিশেছে, হাল্কা ম্যাজেন্টা ডাস্ট আরক্তিমতা। বিমলের গলায় খেলে গেল এক কলি পূরবীর মুখরা। মিচেল গেয়ে উঠলেন আর্কিক ফ্র্যাঙ্কো-জার্মান ডায়ালেক্টে এক স্ট্যাঞ্জা ভাইকিং ফোক। একর্ডিয়ন ও ভায়োলিন থাকলে সোনাটাও হতে পারত এটা।
মিচেল নিজের কার্ড দিলেন। বিমলের তো ওসব কিছুই নেই। ওনার নাম আর ঠিকানাটা লিখে নিলেন মিচেল নিজের স্ক্র্যাপ বুকে। সেই সময়ে চাকরি চলে যাওয়া এক প্রাইভেট কম্পানির মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভের টেলিফোন থাকা বাতুলতা, আর সেল ফোনের জন্য পৃথিবীকে অপেক্ষা করতে হবে আরও দুটি দশক। মিচেল ডিনারের আমন্ত্রণ জানালেন তোশিলি স্যান্ডে। দুজনে পায়ে পায়ে হাঁটতে থাকলেন অদূরের রিসর্ট-এর দিকে। রিসেপসনে বিমলকে ইনট্রোডিউস করলেন মিচেল নিজেই, ওনার ট্যুর গাইড হিসেবে। নিজের স্ক্র্যাপ বুক দেখে নির্ভুলে নাম ঠিকানা লিখে দিলেন, রিসর্টের গেস্ট বুকে। সে সময় মৌলবাদী সন্ত্রাসে তটস্থ হয়ে পদেপদে নিরাপত্তার কড়াকড়ি ধারণাতীত ছিল।
রুম সার্ভিসকে বলে ডিনার অর্ডার করা হল মিচেলের স্যুটে। স্বল্প আয়োজন। বিমল যেহেতু অ্যালকোহল নেন না, ওঁর জন্য ইম্পোর্টেড ট্যাঞ্জারিন জুস। মিচেল নিলেন এক মাগ ল্যাগার বিয়র। সঙ্গে থাকল হেজ্ল নাট। অ্যাস্পারাগাস স্যুপ, ব্রেডরোল এসে গেল। বিমল তখন ইমনে মুখরা ধরেছেন। স্যুপ শেষ করে মিচেল স্প্যানিশ গিটারটা বার করলেন। দক্ষিণ ফ্রান্সের নরম রোদে ভরে গেল দূর প্রাচ্যের এক রিসর্ট-স্যুটের অবেলা। মিচেল ধরেছেন কর্সিকান ফোক সঙ। প্রুশিয়ন স্যালাড, মেয়োনিজ কাভারড বেক্ড ভেটকি আর টিনড সার্ডিন সার্ভ করা হয়ে গেল। ডিনারের লাস্ট কোর্সে মিচেল একটা কনিয়াকের পেগ নিলেন। বিমল কিছু নিলেন না। শেষ করা ক’টা ক্যানভাস বিমল লজের ঘরে রেখে এসেছেন, তাই মিচেলকে দেখাতে পারলেন না। মিচেল বিমলকে দিয়ে একটা পোর্ট্রেট স্কেচ করিয়ে নিলেন স্ক্র্যাপ বুকে। কিন্তু স্কেচটা মিচেলের মন পেল না। এ যে শুধু তাঁর মুখের আউট লাইন। এতে তাঁর ফোক সঙ কই, কোথায় তাঁর ফোক সঙের তালে তালে শরীরের হিন্দোল?
মিচেলের করতল বিমলের মণিবন্ধ ছুঁলঃ
বিমল প্লিজ, তোমার সঙ্গে আর একটা ফ্রেম করা ক্যানভাস দেখছি। ওটা নিশ্চই এখনও ফাঁকা। তেল রঙে আমার একটা ফুল সাইজ ন্যুড এঁকে দাও।
এটেন্ডেন্ট ক্রকরিস নিয়ে চলে গেছে। বিমল ঘড়ি দেখলেন। রাত নটা। ছবিটা মোটামুটি এগারোটার মধ্যে নির্মাণ হয়ে যাবে। বাকি স্ক্র্যাপিং, রিটাচ, ফাইন-টাচ কাল সারা দিন লজের ঘরে বসে করলেই হবে। মানে সন্ধ্যে নাগাদ ছবিটা মিচেলকে দিয়ে দিতে পারবেন। মিচেল কাল চিল্কা সাতপাড়া সিমাউথ ডলফিন পয়েন্ট দেখতে যাবেন, সন্ধ্যেএ ফিরে আসবেন। রাত্রিটা হোটেলে কাটিয়ে সকালে পুরী ছেড়ে ভুবনেশ্বর যাবেন গৌহাটির ফ্লাইট ধরতে।
মিচেল তাঁর পোর্টেব্ল প্লেয়ারে চালিয়ে দিলেন রিচার্ড আর কারিন কার্পেন্টার্স। জানলার ট্রান্সপারেন্ট শার্সি; ভারী পর্দাগুলো সরিয়ে ঢেকে দিলেন। রিসেপসনে ফোন করে বলে দিলেনঃ ফলোয়িং থ্রি আয়ার্স নো কল প্লিজ।
ড্রেসিং রুমে না ঢুকেই একটা একটা করে উন্মোচিত করে চললেন; বাথরুম স্লিপার, টপ, স্কার্ট, ব্রা এবং সব শেষে প্যান্টি। বিমল কিছুক্ষন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিচেলের দিকে। চিত্রশিল্প অভিজ্ঞ সকলেই জানান, ন্যুড নির্মাণের প্রেক্ষিতে এই তাকিয়ে থাকা কতখানি জরুরি, কিন্তু মিচেল কি বিমলের তাকানোর ভাষায় আরো কিছু অর্থ খুঁজে পেলেন? ঘটনার ক্রমান্বতাই সে কথা বলতে পারে। লেখার টেবলের ওপর রাখা রীডিং ল্যাম্পটার কমনীয় গ্রীবায় মোচড় দিয়ে মিচেলের ওপর ফোকাস করে দিলেন বিমল। ঘরে স্ক্যাটার্ড ডে লাইট ছাড়া অন্য কোন আলো রাখলেন না বিমল।
কাজ শেষ করে বিমল বসলেন ডিভানে, ক্যানভাসটা খুলতে মিনিট পনের লাগবে। ইন্সট্যান্ট-কিওর অয়েল কালার আসতে এখনও কিছু বছর লাগবে। মিচেল ওই অবস্থাতেই একবার অর্ধ সমাপ্ত ছবিটার কাছে গিয়ে দেখে এলেন। তারপরই এসে বিমলের কোলে বসে ওষ্ঠদ্বয় সজোরে কামড়ে ধরলেন। গভীর শোষণে নিঃস্ব করে দিতে চাইলেন, সৃষ্টিনদীর উৎসাধারের সবটুকু এলিক্সার অথবা পোশন। ঘটনার দ্রুতি বিমলের কাছে আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত বা অপরিচিত নয়, তিনি বলিষ্ঠ হাতে নিজেকে বন্ধন মুক্ত করলেন। মিচেল ঠাস করে ওঁর গালে চড় মেরে বললঃ
‘ভাউ নার্শিসি ফেআ’ (Vous Narcisse fiers)’
বিমল ছিলেন তরলের উদ্বায়ীতা, তাঁর সব দিকে ছিল গতি। কিন্তু তেমনই আকস্মিক ছিল ঘনীভবন। রান্না ঘরের চালের ফুটো দিয়ে পড়া সুর্য রশ্মি বেয়ে যেমন দেখা যেত বাস্পীভূত ফ্যান- কণার রামধনুরঙের উর্দ্ধমুখ গতি, তেমনই দেখা যেত তাদের ফিরে আসতে।
কিছুদিন সান্ধ্য ক্লাসে, শখে ফ্রেঞ্চ শিখেছিলেন। ইজেল ক্যানভাস গোটাতে গোটাতে বললেনঃ
‘অ রিভআ(au revoir)’
মিচেল ড্রেসিংগাউন চাপিয়ে স্যুটের দরজা খুলে পাশে সরে দাঁড়ালেন। কাঁধে ঝোলা, হাতে ইজেল নিয়ে বিমল প্যাসেজে দু’পা রাখতে রাখতেই প্রত্যুত্তরে বলে উঠলেনঃ
‘অ রিভআ(au revoir)’
এক পাল্লার দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল; পেতলের ডোর-নবটা দু’সমকোণ ঘুরে গেল।
১১।
দু’মিনিট। বাচ্চা উঠে প্যান্ট শার্ট পরে বেড়িয়ে গেল। ওর সাইকেলের লক খোলার আওয়াজ রুণা বিছানা থেকেই শুনতে পেলেন। উঠে সায়া ব্রেসিয়ার শাড়ি ব্লাউস পরে নিলেন। দৌড়ে পাশের ঘরে গেলেন; টিভি চলছে; ছোটদের আসর শেষ হয়ে আর একটা কি প্রোগ্রাম চলছে। পাশে পিসিদের জিজ্ঞেস করতে ওনারাও কিছু বলতে পারলেন না। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। বছর চারেকের ছেলে, কত দূর আর যাবে। এ পাড়া ও পাড়া সে পাড়া কোন জায়গা থেকেই অ্যাক্সিডেন্টের খবর নেই। দুটো বাস রাস্তার কোথাও কোন খবর নেই। অঞ্চলে রুণার সামাজিক মলাট তাঁকে একঘরে করে দিয়েছে। দু-একজন ছাড়া ‘কেমন আছ’ জিজ্ঞেস করার মত লোক নেই; যার বাড়ি গিয়ে ছেলের খোঁজ করা যায়। তবে ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট হলে লোকে খবর দেবে না, এমনটা অসম্ভব। থানায় যাওয়ার মুখও রুণার বন্ধ অনেক দিন, যে নারীর স্বামীর চরিত্র সন্দেহাতীত নয়....বেশীর ভাগ সময় কোথায় কাটায় ঠিক নেই...সেদিনের মফস্বল থানার চোখে সে অপরাধী। হয়ত ছেলেধরা নিয়ে গেছে, দলে নিয়ে ভিক্ষে করাবে, কিম্বা একটু বড় করে পকেটমারি-ছিনতাই। তা করাক তবু তো আর কিছু দিন খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে। রুণা ভালই জানেন; বিমল ইম্পোটেন্ট নয়। ছেলেটা বিমলেরই। যে বাবা জন্ম দেওয়ার পর থেকে কোনদিন সন্তানের খাওয়া পরার কথা চিন্তা করেনি, তার সন্তানের আর কীই বা হতে পারে।
রুণা বাড়ি ফিরে এলেন। টেবলের ওপর বিমলের চামড়ার ফোলিও ব্যাগটা রাখা। মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা ওই রকম ব্যাগে ফিজিশিয়ন স্যাম্পল নিয়ে ঘোরে। ডিসমিস করার সময় কম্পানি ওটা ফেরৎ নেয়েনি, হয়তো খেয়াল করেনি। রুণা ব্যাগটা হাতরে কিছু ব্লিস্টার প্যাক, কিছু শিশি, ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল ও কয়েকটা সিরিঞ্জ পেলেন। ওষুধগুলোর এক্সপায়ারি ডেট দেখতে থাকলেন, রুণার খুব অসুখ, এক্ষুনি ওষুধ দরকার। ইঞ্জেকশন দরকার। একটা কাগজের বাক্সে পেলেন গোটা দশেক অ্যাম্পুল, অ্যাম্পুলের স্টিকারে দেখলেন, আরো কয়েক মাস ভ্যালিডিটি আছে। স্টিকারে নাম লেখা আছে বার্বিচুরেটস। রুণা বিছানায় বসে কতগুলো আড়াইশো এমজি-এর অ্যাম্পুল ভেঙ্গে গ্লাসে ঢেলে এক ঢোকে গিলে ফেললেন। তারপর পটাপট অভিজ্ঞ হাতে চড়িয়ে নিলেন গোটা চারেক ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন। হঠাৎ সব আলো নিভে গেল।
১২।
বাড়িতে ঢোকার মুখে এক ফালি খালি জায়গা। কটা রিকশ হামেশা দাঁড় করান থাকে। রিকশওয়ালারা মুখ চেনা হয়ে গেছে। ওদেরই একজন প্রথম খবরটা বিমলকে দিলঃ
-দাদা খপর পাননি? আজ পনের দিন হল বৌদি মারা গেছে। লাশ কাটাও তো হয়েছিল। বিষ খেয়ে মরেছে। ঘরে নাকি বিষ রাখত বৌদি? পুলিশ আপনাকেও খুঁজছে। এলাকার সবাইকে বলে গেছে আপনাকে দেখতে পেলেই থানায় খপর দিতে।
বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই পার্টিশনের ওপাশ থেকে বোন বেরিয়ে এলোঃ
দাদা দুর্ঘটনার কথাটা শুনলি তো! যা থানায় গিয়ে দেখা করে আয়। পুলিশ মোটামুটি মেনেছে, কেসটা আত্মহত্যা। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ওভার ডোস বার্বিচুরেটস-এর প্রয়োগ জানা গেছে। পুলিশ জানতে চায় ওষুধগুলো কি ভাবে বাড়িতে এল। আমি আর তোর ভগ্নিপতি তোর নাগস-মেডিকালে চাকরির কথা, পুলিসকে বলেছি। তবে ওরা তোর জবানবন্দি চায়।
প্রথম কথাটা বিমলের মুখ থেকে বেরলঃ
ছেলেটা কোথায়?
রিকশওলাদের মধ্যে থেকে কারুর হাসির আওয়াজ শোনা গেল, বোধহয় বিমলের কথা শুনেই।
বোন বললেন ওর কথা আর তোকে ভাবতে হবে না। ওর এক রকম ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে সেই একবার ভাড়া এসেছিলেন না কুন্ডুবাবু? হোমিওপ্যাথি প্র্যাক্টিস করেন। মোড়ের মাথায় চেম্বার, উনি ছেলেটাকে নিয়ে নিয়েছেন, মানুষ করবেন বলে।
মানুষ! মানুষ শব্দটা বিমলের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। সকাল থেকেই বুকের ভেতর চিনচিন একটা ব্যথা। মাথাটাও ঘুরে উঠল। বিমল পড়ে গেলেন। হাঁসফাঁস করে বললেনঃ ‘গ্যাস...গ্যাস’। ছটফট করছেন। ওই অবস্থাতেই রিকশওলারা কোন রকমে পাঁজাকোলা করে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। বাড়িতে একটাই বিছানা, একটা ডবল বেডের খাট, বিয়ের সময়ের, শুইয়ে দিল। দম বন্ধ হয়ে আসছে, বলছেন বিমল। কুলকুল করে ঘামছেন, অথচ পাখা চালিয়েও লাভ নেই। চাকরি নেই, প্রায় বছরদুয়েক, ইলেক্ট্রিক বিল মেটান বাকি, সাপ্লাই অনুনয়-বিনয়ের ফলে প্রায় মাসছয়েক সয়ে ছিল, তারপর লাইন কেটে দিয়েছে। রুণা পাড়ার ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির দোকানের ছেলেটাকে বলে যতবার হুকিং করেন, সাপ্লাই থেকে লোক এসে কেটে দিয়ে যায়, চেনা চোর, ধরতে অসুবিধে নেই। ইদানিং মিস্ত্রি ছেলেটারও পাওনা অনেক বাকি পড়ে যাওয়ায় আসেনা। তা ছাড়া ওদের দোকানে সাপ্লাই থেকে লোক এসে, খোদ মালিককে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়ে গেছে।
সবাই বুঝছে ডাক্তার ডাকা দরকার। যে বাড়িতে ভিজিটের ফীস না পাওয়াটা মোটামুটি নিশ্চিত, তা জেনেও আসতে রাজি, এমন ডাক্তার কে আছেন...ভাবতে ভাবতে বিমলের ভগ্নিপতির মাথা থেকে বেরুল, কুন্ডুবাবুর নাম। এখন সকাল আটটা, ভগ্নিপতির অফিস-কাছারি কোনকালেই নেই, বাড়ি থেকেও বেরোন না খুব একটা। বিমলের বোন কোন এক নার্সিং হোমে চাকরি করেন, সংসার খরচের সংস্থান সেই আয় থেকেই হয়। বাড়িতে সাইকেল নেই, রিকশওলারা ক্বচিৎ বিনাপয়সার সওয়ারি নিলেও, এ বাড়ির কারুকে নেবে না, কোন অবস্থাতেই। ভগ্নিপতি বেরিয়ে গেলেন কুন্ডুবাবুর উদ্দেশে। ডিসপেনসারিটা কাছে হলেও দশটার আগে খুলবেনা। ওনার বাড়ি হেঁটে পৌঁছতে মিনিট পনের। বাড়িতে একটা পুরোন কাঠের বেঞ্চ ছিল। কিছুটা খোলা হাওয়ার আশায়, বিমলকে অগত্যা বেঞ্চটায় শুইয়ে বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটায় এনে রাখা হল। এই জায়গটায় বিমলের বাবা তাঁর সময়ে বাগান করতেন। মাঝে কিছুকাল আগাছা ভর্তি হয়ে পড়েছিল। আজাকাল রিকশগুলোর আড্ডার সুবাদে অনেকটা সাফসুতরো। পুরোন একটা ঝাঁকড়া কাশির ল্যাংড়া আমের গাছ আছে। আগে বিপুল ফল দিত, এখন সমতুল ছাওয়া দেয়ে, এর ছাওয়াতেই রিকশগুলো থাকে। বেঞ্চও সেই ছাওয়াতেই রাখা।
বোনের বুঝতে বাকি নেই, স্পষ্ট হার্ট এটাকের লক্ষণ। রুগীর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। দুজন রিকশ চালক বিমলের হাত পা চেপে ধরে আছে, না হলে মাটিতে পড়ে ছটফট করতেন। দেখতে দেখতে কয়েক ঝলক রক্ত মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে জমিতে পড়ল।
পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ অবশ্যই দেখেছেন। তাঁদেরই কেউ এম্বুলেন্স ডেকে থাকবেন। সে সময় মফস্বলে অলিতেগলিতে নার্সিং হোম গজিয়ে ওঠেনি। বিমলদাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল আট কিলোমিটার দূরের জেলা হাসপাতালে। হাসপাতালের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিলঃ ব্রট ডেড।
১৩।
সংসারে ভৌতিক ঝড়ের বাইরে যে সব ঝড় আছে, তাদেরই কোন একটায় ঘটুদের ছাদের পায়রার মাচা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তার লিঙ্ক উড়ে গিয়ে আটকেছিল প্রত্যন্ত এক বনে, টিকে ছিল কোন গাছের ডালে আটকে। তিরিশ বছর ধরে মাঝে মাঝে হালকা হাওয়ায় ফিরে ফিরে আসত, তার শুরুয়াতির এই মফস্বলে। বিমলদাদের বাড়িটা কেউ এক জন কিনে নিয়েছিলেন। বিমলদার বোনও তাঁর অংশ সেই ক্রেতা ভদ্রলোককে বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন। ফাঁকা জায়গাটা ঘেরা হয়ে পড়েছিল বহু বছর। অথচ বাড়িটা তালা বন্ধ থাকত। অজস্র বিছুটিগুল্মের অন্তস্থলে দেখা যেত একটি মাত্র ঘেঁটু ফুল বকের মত গলা বারিয়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। পুরোন পায়রার পা আজ খবর বেঁধে নিয়ে এসছে, ওই ক্রেতা প্রোমোটার, কি এক আইনি জটিলতায় ফ্ল্যাট বাড়ির কাজ শুরু করতে পারেননি, ইদানিং সে সব মিটে গেছে। শুরু হয়ে গেছে পুরোন স্থানাংকে নব নির্মাণ।