আজি এ প্রভাতে সহসা কেন রে
পথহারা রবিকর
আলয় না পেয়ে পড়েছে আসিয়ে
আমার প্রাণের 'পর!
এই কবিতা সম্পর্কে তাবৎ বাঙালীকূল অবগত। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই কবিতাংশ ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-তে পাওয়া যায়। এর ইতিহাসও অনেকেই জানেন, তবুও প্রসঙ্গহেতু, তার সারাংশটি হল---
রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র একুশ। অধুনা ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের আশেপাশেই দশ নম্বর সদর স্ট্রীট। সেখানে তিনি থাকতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাদম্বরী দেবীর সাথে। ১২৮৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে ভাড়া নেওয়া ওই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত প্রায় সোয়া তিন মাস। এই সময়েই একদিন সকালে তার এক অতিলৌকিক দর্শন হয়, যাকে বলে vision। জীবনস্মৃতিতে তারই ভাষ্যে এই অভিজ্ঞতা পাই, “হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল।”
এই অবস্থা চারদিন ছিল। সেদিনই ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ লেখা হল। তার কয়েকদিনের মধ্যে ‘প্রভাত-উৎসব’। পরবর্তীকালে ওনার সমগ্র জীবন জুড়ে এই vision থেকে প্রাপ্ত সৌন্দর্যরূপ সত্যবোধের কথাই রূপে-রূপান্তরে কাব্যে-গানে-উপন্যাসে-গল্পে-প্রবন্ধে লিখে গেছেন। এমনকি ওনার ‘সাধনা’ প্রবন্ধগুচ্ছও ভারতীয় উপমহাদেশের ‘দর্শন’-এর নৈর্বক্তিক প্রকাশ নয়। উনি সেই দর্শনকেও তার আপন দর্শনের মাধুরী দিয়েই জগতের কাছে পেশ করেছিলেন।
এই ‘Vision’ বা ‘মহাবোধ’ অনেক মহামানবের জীবনেই এসেছে। এই বোধকে এক-একজন এক-একরূপে বর্ণনা করেছেন। মহাঅনন্তময় পরম চেতনাকে কেউ বলেন ‘ব্রহ্ম’, কেউ বা ‘নির্বাণ’, কেউ ‘সমাধি’, কেউ বা ‘দর্শন’। গৌতম বুদ্ধ একে ‘নির্বাণ’ বলেছেন, সক্রেটিস অত্যুজ্বল এক আলোকের সাথে তুলনা করেছিলেন, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাষায়, “...দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতিঃ-সমুদ্র!” ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, ‘লাইফ টার্নিং’ এক বোধের জন্ম হয়, এবং তৎপরবর্তীকালে সমাজের কাছে তাদের এক জ্যোতির্ময় আত্মপ্রকাশ। ভাবধারার এক বিন্দু যে শুভলগ্নে জন্মায় তাদের চেতনায়, সারা জীবন ধরে তারই প্রকাশ রূপে-রূপান্তরে ঘটতে থাকে। সেই আলোকে তার পার্শ্ববর্তী মানুষেরা আলোকিত হয়। এইভাবে সমাজের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক তরঙ্গ বইতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সেইদিনটা ছিল ১২৮৯ সালের চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যেকার কোন একটা দিন, যা পরবর্তীকালে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ নাম নিয়ে ঐ বছরেই ভারতী পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
সেই অনন্ত আলোকময় চেতনার ক্ষীণ দর্শন থেকেই বোধহয় এই মহামানবদের যাত্রা শুরু হয়। দর্শনের পর কেউ ফিরে আসে। কেউ-বা ফিরে আসে না। রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসেছিলেন এবং সেই ঘটনার পর থেকে সব কিছুর মধ্যেই সত্যরূপ সুন্দরকে দেখতে পেলেন। অতঃপর, আমরা দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে, জীবনচর্যার মধ্যে কুৎসিত কিছু নেই। এমনকি তা দেখতে চাইতেনও না। চরম অসুন্দরের মধ্যেও সুন্দরকে দেখতে চেষ্টা করতেন। দস্তয়েভস্কির মতো মানুষে-শয়তানে মুখোমুখি করার চেষ্টা পর্যন্ত করেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন, “নরকেও সুন্দর আছে, কিন্তু সুন্দরকে কেউ সেখানে বুঝতেই পারে না, নরকবাসীর সব চেয়ে বড়ো সাজা তাই।” দস্তয়েভস্কির অমন সত্যময় বীভৎসতাকে তিনি সত্যরূপ চেতনার সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠায় ঢেকেছেন।
রবীন্দ্রনাথ একদমই উচ্ছ্বাসপ্রেমী ছিলেন না। সংযত ভাবধারায় তার লেখার সৃষ্টি, আজীবন। কিন্তু এই উপলব্ধ সত্যের এমনই মহিমা যে, সমগ্র ‘প্রভাতসংগীত’ জুড়ে শুধু উচ্ছ্বাসের পর উচ্ছ্বাস। উক্ত কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় কবিতা সেই বোধের ভাষা-ভাষা প্রকাশের চেষ্টা এবং তারপরের প্রায় অন্যান্য সমস্ত কবিতাগুলোর মধ্যেই কম-বেশি সেই চেতনার ভাবোচ্ছ্বাসের বাঁধনখোলা বহিঃপ্রকাশ, সেই প্রকাশও আধো আধো শিশুমুখের ভাষার মতো।
বহু বছর পরে, ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ৫ই জ্যৈষ্ঠ ইন্দিরা দেবীকে লিখছেন, “’জগতে কেহ নাই, সবাই প্রাণে মোর’ --- ও একটা বয়সের বিশেষ অবস্থা।... প্রভাতসংগীতে আমার অন্তরতম প্রকৃতির প্রথম বহির্মুখী উচ্ছ্বাস, সেই জন্যে ওটাতে আর কিছুমাত্র বাচ-বিচার বাধাব্যবধান নেই। এখনো আমি সমস্ত পৃথিবীকে এক রকম ভালোবাসি --- কিন্তু সে এ রকম উদ্দামভাবে নয়---”
অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে এই উচ্ছ্বাসে বাঁধ দিয়েছেন। তার প্রকাশ দেখতে চেয়েছেন সর্বদিকে, বিশ্বজুড়ে, সবার মাঝে, কিন্তু সংযত হৃদয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন একজন প্রকৃত ‘কসমোপলিটান’। তার সমসাময়িক আর কেউ এমন হতে পেরেছেন কি?
সনাতন শাস্ত্রের সাথে রবীন্দ্রনাথের এই দর্শনের ব্যাপারটায় হয়তো মিলবে না। বিতর্কের অনেক ক্ষেত্র তৈরী হবে। কিন্তু, যদি আমরা দেখি, এই vision রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গীর কি পরিবর্তন করেছে, আর তা যদি জীবন্মুক্ত সাধকের সাথে মিলে যায়, তাহলে তো এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকে না।
জীবনের অন্তিম পর্যায়ে, ১৯৩৩ সালে, ‘মানুষের ধর্ম’ শিরোনামে প্রবন্ধগুচ্ছ লেখেন। আমরা জানি, উক্ত প্রবন্ধগুচ্ছ তার মানবজীবন সম্পর্কিত সর্বোচ্চ এক দর্শন। সারাজীবন ধরে সত্য ও সৌন্দর্যের সাধনা করে আসা এই মহামহিম মানুষটার পরম ও চরম মতবাদ। এই প্রবন্ধগুচ্ছের পরিশিষ্টে ‘মানবসত্য’ নামক এক প্রবন্ধে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ তথা প্রভাতসংগীতেরই ব্যাখ্যান করেন আরো গভীর ও ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিতে। আমি সেই আলোচনায় যাবো না। কেবল উক্ত প্রবন্ধের এক টুকরো অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরব পূর্ববর্তী বিতর্কের মধ্যস্থতার উদ্দেশ্যে ---
“যিনি সর্বজগদ্গত ভূমা তাঁকে উপলব্ধি করবার সাধনায় এমন উপদেশ পাওয়া যায় যে, "লোকালয় ত্যাগ করো, গুহাগহ্বরে যাও, নিজের সত্তাসীমাকে বিলুপ্ত ক'রে অসীমে অন্তর্হিত হও।" এই সাধনা সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই। অন্তত, আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না ক'রে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে-- তিনি নিখিল মানবের আত্মা। তাঁকে সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই। কেননা, আমার বুদ্ধি মানববুদ্ধি, আমার হৃদয় মানবহৃদয়, আমার কল্পনা মানবকল্পনা। তাকে যতই মার্জনা করি, শোধন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়াতে পারে না। আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি ভূমা, কিন্তু মানবিক ভূমা। তাঁর বাইরে অন্য কিছু থাকা না-থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত ক'রে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন।”
------------------------------------------
তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্র রচনাবলী, জীবনস্মৃতি, প্রভাতসংগীত, মানুষের ধর্ম, ছিন্নপত্রাবলী, রক্তকরবী, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ – স্বামী সারদানন্দ, রবীন্দ্রজীবনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘এই সময়’ দৈনিক সংবাদপত্র।
[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]