এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  কাব্য

  • আত্মপোনিষদ্ (৩) - ছান্দোগ্য

    Chitralekha Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    কাব্য | ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ৪২৯ বার পঠিত
  • ছান্দোগ্য উপনিষদ্ (সামবেদ)
     
    (১)
    হা ব্রহ্ম হা পূজনীয় হা অসীম সাধারণ্যে
    আমার অঙ্গ, বাক্, প্রত্যঙ্গ, নিঃশ্বাস নৈমিষ্যারণ্যে   
    চক্ষু, কান, চলৎ শক্তি, প্রতিভা পলাতোক
    সমস্ত ইন্দ্রিয় উপাদান বিকশিত হোক!
    সবকিছুই ব্রহ্ম উপনিষৎ ঘোষিত
    তাঁকে কোবুল করি — নস্যাৎ নিয়মিত ।  
    মনে নিন্দা না রেখে অপরিমিত —
    তিনিও আমায় স্বীকার বিচার করুন    
    যবে চিনিবো উভয়ে উভয় — সংযোগ দারুণ ।   
    গুণাবলী যোগ্যতা উপনিষৎ আইন কানুন  
    হউক আমার মধ্যে ডুবো শরীর সমাহৃত।

    শান্তি আর শান্তি আর শান্তি নামুক
    ত্রিলোক বিপদ ক্লেশ থামুক  ॥
     
    (২)
    কুরুদেশের  শস্য শিলাবৃষ্টিতে বিনষ্ট হবার পরে 
    চারদিকে দুর্ভিক্ষ মন্বন্তর জাঁকড়ে ধরে
    মহর্ষি চক্রের ছেলে ঋষি উষস্তি
    ক্ষুধা, যন্ত্রনা, অস্বস্তি —
    ঘুরে ফেরে গ্রাম, সঙ্গে নাবালিকা স্ত্রী ভিত
    কিঞ্চিৎ অনিচ্ছায় মাহুতদের গ্রামে আশ্রিত।
     
    ভুখা পেটে ঘুরে ফেরে, উষস্তি বলে: “অন্ন ভিক্ষা চাই” 
    মাহুত বলে: “থালার পচা-মাংস ভিন্ন কিছুই বাকী নাই”।
    উষস্তি বলে: “চলিবে তাহাই”। 
    মাহুত বলে: “তবে আগে গ্রহণ করো জলভরা পাত্র”
    উষস্তি বলে: “না, পানীয় বিরাজে প্রাকৃতিক সর্বত্র
    ভিক্ষা না করিয়াই আঁচল ভরিয়া পাই —
    ইহা পান করিলে হবে এঁটো ঘাটা তাহাই ।
    পানসে মাংসে বাঁচিবে এ জঠর অপুষ্ট দেহ  
    জলোবৎ উচ্ছিষ্ট দোষ নাই তার, নিঃসন্দেহ”।

    পরদিন সকালে শয্যা ত্যাগ পূর্বক উঠিয়া
    আবারো অন্ন তন্নতন্ন কোথাও না পাইয়া
    আবারো বাসি-গন্ধ পচা-মাংস গলায়  
    উষস্তি গেলো এক রাজার বাড়ির যজ্ঞসভায় ।
    যজ্ঞে হাজির ব্রাহ্মণদের সে ব’লে বসে হঠাৎ 
    “না বুঝে মন্ত্র করিলে পাঠ
    হইবে মাথা হেঁট, জ্ঞান দম্ভ লোপাট 
    হইবে সশব্দে — যন্ত্রবৎ — মুন্ডো পাৎ”।
     
    বিপদ দেখিয়া যজমান রাজা বলেন: “উষস্তি সাধু
    এ যজ্ঞে চাই পান্ডিত্য আপোনার জ্ঞান যাদু
    বাকীরা সহায়তা করুন প্রারব্ধ আপোনায় 
    আপনি ছাড়া ঋত্বিক-কর্ম ভুল, অন্যায় 
    তদুপোরি, ধনরাশি পারিশ্রমিক এদের তুল্য সমান   
    ক্ষত্রিয় যজমান দিতেছে প্রতিশ্রুতি, রাজার জবান”।

    অনন্তর প্রস্তোতা, উদগাতা, প্ৰতিহর্তা
    জিজ্ঞাসিলেন সবিনয়  
    — “ঠিক কি কি ভাবে মুন্ডো পাৎ হয়”? 
    উষস্তি বলে: "অন্নো মিতি হো বাচো সর্বাণি —
    অন্নের জন্য বাঁচে সঅব প্রাণী
    জাফরি কোলাহল নিমন্ত্রণী
    সমস্ত জীব, সজীব নির্জীব, হিরণ্যগর্ভ ডিম 
    অন্ন দেবতায় অধিকার … সব সবাকার … হান্ড পিরিম
    অন্ন হইচই কুড়াই আহরণ — ক্ষিদের মতো নিম” ।

    — “সমস্ত জীব, সজীব নির্জীব দিক সংসার   
    বিশ্ব ব্রহ্মান্ডো
    এ দেবতায় অধিকার সবার
    সব সবাকার হান্ড  
    অন্ন হইচই আহরণ আখ্যান
    মহাকাব্য কান্ড
    বিপুল প্রকান্ড” ॥ 

    (৩)
    একদা দলভ্য ও মিত্রার পুত্র বক ও গ্লাব 
    উভনামে পরিচিত এক ঋষি কিংখাব   
    বেদ পড়িতে গ্রাম ছাড়িলেন দৈবাৎ
    এদিকে শ্বেতো কুকুরের দল হাঁটু ভেঙে কাৎ।   
    তাড়না খিদের জ্বালালো এতো
    ঋষিকে ধরিতে বলে সাম গান যতো
    ভরাতে হবে পেট, অন্ন উপায়, দুঃখ পশ্চাৎ।

    বক ও গ্লাব উভনাম ধারী ঋষি
    ধরিলেন সাম গান, উচ্চ কণ্ঠ দিশি। 
    গুনগুন গানে গানে
    ল্যাজে ল্যাজ বেঁধে, পরিক্রমা করে কুক্কুর গণে
    গোল গোল ঘোরে উল্লাস।
    জনে জনে
    ‘হিংকার’ উচ্চারণে 
    দাবী একরাশ। 
    — “হে ওম্,
    শক্তি দাও
    খেতে চাই …
    শক্তি দাও
    পান করি খাই …
    হে অন্নপতি সূর্য্য
    খাদ্য দাও
    বেঁচে যাক পারম্পর্য …
    দেহ কার্য” ।
     
    প্রার্থনা অধিকার মনুষ্যতর অধিক ভক্তি-প্রেয়সী
    এভাবে প্রতিষ্ঠিত করিলেন বক ও গ্লাব ঋষি    
    পশুর তরে বৈদিক সাম আরাধনা 
    দিতে জানোয়ার ন্যায্য অন্ন দানা ॥

    (৪)
    জনশ্রুতের ছেলের নাতি জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ
    করিতেন বহু দান ধ্যান, অন্ন রন্ধন।
    সরাইখানা নির্মিণিয়ে মুক্ত-হস্ত খামার ।
    পথের ধারে পথচারী, সহজলভ্য আহার। 

    হঠাৎ-ই সায়াহ্ন রাত্রিকালে   
    একঝাঁক পাতিহাঁস উড়ে এলো দলে দলে।
    তারা একেক্কেরে সোমঝিয়ে বলে:
    — “ও হে ভল্লাক্ষ, হংস অবুঝ  
    পৌত্রায়ণের শস্য খন্দ গম্বুজ
    তুমি করিও না আত্মসাৎ
    তাহার প্রভা করিবে তোমার মরদেহ নস্যাৎ”। 

    ভল্লাক্ষ বলিল: “ও হে হংস আহাম্মক
    জানশ্রুতি কে? তার কিসের এতো দর, মারাত্মক?
    প্রভা টোভা আছে জানি সাধুবর রৈক্ব নামক”।

    ফুলের মত ফিসফিস কুজন 
    শুনে গেল পৌত্রায়ণ 
    আর জানিতে হইলো মন ।  
    হাতের কাছেই ছিল এক ক্ষত্রিয় ও শূদ্রের সন্তান
    ক্ষত্তা সে, সারথি, অর্থাৎ এক নীচ সাধারণ প্রাণ
    তারে ডেকে রাজা জিগায় বিলক্ষণ:
    — "তুমি কি আমায় রৈক্ব মানিবে?"
    — "আমি আবার তারে চিনিলাম কবে?"
    — “শুনেছি সবার পুণ্যে তাহার পুণ্য
    তাই পুণ্য ভাঁড়ার যায় না শূণ্য
    যাও রাজধানী — খোঁজ নিতে হবে”।

    ঘুরিল সারথি নগর নগর ভূঁয়ে
    নজরে আসে, গরুর-গাড়ির নীচে থুয়ে
    একখান লোক চুলকাইতাসে তার খুজলি পায়ে শুয়ে।   
    সারথি বলে: “হ্যা গা মহাশয়
    রৈক্ব নাম কি আপোনার-ই হয়?"
    — “হাঁ গা হাঁ, আমি-ই সে। নাই পিছটান 
    এই গরুর গাড়ির একেলা কোচোয়ান”।
    শুনে, সারথি তড়তড়িয়ে  
    রাজার কাছে হাজির তাঁরে নিয়ে ।

    রাজা জানশ্রুতি দিলেন তারে মখ্-মলিন পথ
    কণ্ঠহার, গাই ছ'শো, অশ্ব তরী সুদ্ধ রথ
    জানিতে চাহিলেন খালি:
    "পূজা করেন কোন ঠাকুরালী?"
    — বস্তু সুখে তাচ্ছিল্য তার ভারী
    রৈক্ব বলে: "শূদ্র সারথি, এসব নিয়ে যা তোর বাড়ি!"

    জানশ্রুতি ছাড়িবার পাত্র নন মোটে। 
    বলেন: "ও গুলো দিলাম আবার, আরো দিলাম গ্রাম বাস্তু ভিটে
    সঙ্গে, নিজ কন্যাও জোটে। 
    বলেন তা'লে এই বারে ___
    পূজা করেন কোন দেব্তারে?"
    — বস্তু সুখে তাচ্ছিল্য তার ভারী
    রৈক্ব বলে: "শূদ্র সারথি, কেন আনিলে সাৎ তাড়াতাড়ি?"
    তবে গ্রামগুলি পেয়ে মহাবৃষো দেশে
    আহ্লাদ হলো তার শেষে।
    রৈক্ব বলিল: “হে পৌত্রায়ণ, উৎসুক রাজন
    ভজন পূজন নিজের আবেগ উপার্জন 
    কত যে ছড়িয়ে গল্প গাঁথা, সুশ্রী মনোহরণ।
    মাথা-র থেকেও বেশী শোনো দিয়া মন” —

    এই যে বায়ু বাইরে বয়   
    আগুন নিভিয়া তাতেই লীন হয় 
    শুকনো জল-ও বিলীন হয় যাতে
    চন্দ্র, সূর্য চলাচল করে তাতেই।
    ইহাই সংযোগ, সংলগ্নতা, সম্বর্গ দর্শন
    দেখো লক্ষণ অসাধারণ
    জীব ও তার দেবতা, যার নাম 'বায়ু'
    সেই যে বায়ু বাইরে বয়
    ছড়িয়ে ভেতরময়
    যখন সে আয়ু  
    নিদ্রাকালে সব ইন্দ্রিয় সেখানে থিতু 
    নাম তার 'প্রাণ' — সে-ই সম্বর্গ, সংযোগ সেতু।
    এ উপায়ে জীব ও তার প্রাণ দেবতা — অভিন্ন নয়
    বাইরে ছড়িয়ে, ভেতরে জড়িয়ে বায়ুর মত বয়
    শুধু-ই ভাব — নেই কোনো আড়ি   
    তাদের মিলালো যে প্রাণ — উপাসনা করো তার-ই ॥

    (৫)
    একদা শুনক-তনয় কাপেয় শৌনক কপিগোত্রীয়
    এবং কক্ষসেন-পুত্র অভিপ্রতারী কাক্ষসেনিয়
    যখন খাওয়া দাওয়া করছিল দুজনায়    
    এক ব্রহ্মচারী করজোড়ে অন্নভিক্ষা চায় 
    তারা ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা দিল না উভয়।
    ভাবে তারা ব্রাহ্মণ দাম্ভিক বলিহারী  
    প্রশ্ন করিব এমন, বিপাকে পড়িবে ভারী!
    সওয়াল শুনিয়া ব্রাহ্মণ বলে: "হায় রে অকাল হায়!
    বেদজ্ঞ, যে দেবে জ্ঞান, ভোগে অন্ন-হীনতায়!"
    অতঃপর শৌনক হাঁকে: "ভৃত্যগণ
    নিয়ে আসো খাবার, করাও ব্রাহ্মণ-ভোজন। 
    অপরাধ নেবেন না, বিজ্ঞ গুরু বর
    আমাদের ব্রহ্ম ওই এক, এক-ই ঈশ্বর" ॥

    (৬)
    ‘মা জননী', একদা জবালাকে বলে সত্যকাম
    পালন করিব ব্রহ্মচর্য, গুরুগৃহে বাস অবিরাম  
    তাই জানা প্রয়োজন আজি পূর্বসূরী নাম  
    আমার বংশ, পরিচয় খাস, পিতৃ ধাম।
     
    জবালা বলে: "সোনার মানিক ছেলে
    যৌবনে ছিলাম বহুচারী, বাউন্ডুলে
    নাম, ধাম, সমস্ত গেছি ভুলে
    তুমি ঠিক কার থেকে এলে।
    তবে বলিও গুরুকে নমস্কারে
    জবালার পুত্র জাবাল তুমি, সত্যকাম চিরতরে”।

    সত্যকাম হাজির গুরু আশ্রম
    নিভৃত সবুজ উঠোন
    গৌতম, হরিদ্রুমৎ তনয়
    শুধায় —   
    “কে তুমি বালক নূতোন?
    কি-ই বা তোমার পিতৃ বংশ লক্ষণ”?

    সত্যকাম বলে: “গুরু নেবেন না অপরাধ
    আপোনার শিষ্য হতে মনে জাগে সাধ
    মা বলিল জবালা পুত্র জাবাল বোলো
    যৌবনে বহুচারী মাতা বাবার নাম ভুলো
    তবে বলিল, করজোড়ে মুক্ত করিও মন 
    গুরুর কাছে রাখিতে নাই কিছুই গোপন”।
    সব শুনিয়া গৌতম বলেন পুলকিত
    “সর্বব্যাপী ব্রহ্ম-চেতন সত্য অনুগত  
    এইভাবে বলতে পারে কে-ই বা? ব্রাহ্মণ ব্যতীত?
    নিয়ে এস যজ্ঞ কাষ্ঠ ধূপ
    দীক্ষা দিতেচি এখনি ব্রহ্মচারী স্বরূপ”।
    এরপর চারি শত দুর্বল গাভী চড়াতে
    নবীন ব্রাহ্মণ শিষ্য গেল আরো নিবিড় জঙ্গল ক্ষেতে।

    বনের ভেতর চড়তে রইলো গরু
    নূতন শিষ্য ঘেরাও ঘাসে ভাবছে দুরু দুরু  
    আনন্দ পাবে বেজায় রকম সপ্ত-ঋষি গুরু   
    করবো এদের এক-হাজারু। 
    দিনের পর দিন যায় একা একা অরণ্য পশুমিলন
    সত্যকাম গোণে একটা একটা সহস্র কুঁজ বন ।
    গাভী অনুপাৎ বাড়লো যদাৎ ধীরে ক্রমান্বয়ে
    নির্ঘাৎ জাবাল অসুখ মনে অংক যোগ বিগায়ে । 
    বহু দিন কেটে গেল, পৃথক হলো রাত  
    বৃষ মধ্যে ঢুকে গিয়ে বায়ুদেব করিলো বাৎ
    বলিল “এক সহস্র হয়েছি আমরা গাই”
    চলো এইবার তৎপরে গুরু ঘরে যাই ।

    জঙ্গল পথে ছড়ানো হরেক বিপদ
    থেমে থেমে চলে সবাকার ক্ষুর পদ
    প্রায়শ প্রকৃতি দুরূহ বেয়াড়া বিশদ
    বৃষভ, অগ্নি, রাজহাঁস রোদে ফিকে
    ব্রহ্ম বিদ্যা খুইয়ে পাওয়া পাঁচ সিকে 
    জল-ডুব্ পাখি, ডুবুরি মদ্-গু  থেকে।

    গৌতম ডেকে বলে: “জাবাল সত্যকাম
    কার কার থেকে শিক্ষা নিলে, তালিম উদ্যাম”?
    — “গুরু, ছিল মনুষ্যেতর সব চাঁন্দ, তারা, হাঁস
    মানুষ কেবল আপনি বলুন ব্রহ্ম ইতিহাস”।
    মহা ঋষি গৌতম বড়োই পুলকিত
    এমন শাগরেদ আগে দেখিনি তো!
    জানিতেন তিনি যা যা বোঝালেন হুবহু পুরু
    সত্যকাম জ্ঞান পেল, গুরু গৌতম সহস্র গরু ॥

    (৭)
    এরও অনেক অনেক পরে
    সত্যকাম যখন নিজে ওস্তাদ, পাঠশালা ঘরে
    কমলের ছেলে উপকোসল তার পোঁ ধরে।
    জোয়ান উপকোসল কামলায়ন
    করিতে ব্রহ্মচর্যা পালন 
    জাবালের পদোপাশে 
    একগুঁয়ে গোঁ ধরে বসে।
    বারো বৎসর উষ্ণ আগুন সেবা করিল সে
    "সত্যকাম, ওকে বাড়ি পাঠাও" — বলিল বউ এসে
    তবুও জাবাল করিল না তার বাড়ি-ফেরা অনুষ্ঠান
    কে জানে কোথায়, পাড়ি দিয়ে হায়, যাত্রায় চলে যান।  
     
    মানসিক যন্ত্রণা বশে
    উপকোসল উপবাসে
    গুরুমা বলে: "আহার করো না কেন ব্রহ্মচারী?"
    — "হৃদয়ে কামনা দাপায়, মনে ময়লা জমেছে ভারী!"
    একথা শুনে আগুন ফুলকি পাতার নীচে ফিসফাস
    — “চলো, আমরা-ই শিখাই একে ক, খ, প্রাণ, উল্লাস”।
    কমল পুত্র বুঝিয়া শুনিয়া শুধায়:   
    “প্রাণ টাতো বুঝিলাম, বুঝিনি ক, খ কারে কয়”!

    অগ্নিবিদ্যা রপ্ত হলো না মক্সো 
    গুরু ফিরিয়া ডাকাডাকি করে: “বৎস
    কার কার থেকে শিক্ষা নিলে, পরামর্শ”?
    ভয়ে কামলায়ন বলে: “ইঙ্গিত দিলো খালি ঐ
    আগুনগুলো বলছিল মানুষ মরে খই 
    গুরু মশাই আপনি বলুন — ব্রহ্ম বিদ্যা লই”।

    অধুনা জ্ঞানী সত্যকাম বড়োই পুলকিত
    ব্রহ্ম বিদ্যা গতি — আগে বলিনি তো!
    পদ্ম পাতায় জল, করে টলোমল, হড়কানি 
    ব্রহ্ম বিষয়, পাপ ঝরে যায় ধুপধাপ তেমোনি।
    মানুষের দু' দু' টি পা, শরীর না চায় — তা-ও এগায়   
    তা হলে কি বলা যায় — এ দু'পা  শরীরের নয়?
    ব্রহ্ম বিদ্যা প্রায়শ্চিত্ত মৌন
    রথ রঙ-বেরঙ গৌণ
    যুদ্ধে ঘোড়া রক্ষা করে সৈন্য সওয়ার
    যজ্ঞ করো হাজারে হাজার 
    করো যজমান ত্রুটি অবহেলা মুক্ত
    অভ্যাসে, চর্চায় মেলে ব্রহ্ম জ্ঞান যথাযুক্ত॥

    (৮)
    পূর্বে কখনো, প্রাণোসমূহ স্বীয় স্বীয় শ্রেষ্ঠতা নির্ণয় জন্য অবাধ
    "আমি-ই শ্রেয়", "আমি-ই শ্রেয়” — এইরূপ দ্বন্দ্ব বিবাদ।
    পিতা প্রজাপতি বলিল: "কিসের লড়াই, প্রতিবাদ? 
    তোমাদের মধ্যে দেহ ত্যাগ করিলে যেই জ'ন 
    লাগে শরীর সিষটি-ছাড়া, বাজে, অশুচি আবেদন
    শ্রেষ্ঠ সেই জানিও তোমাদিগে, হে প্রাণো দল গণ"।

    তখনি কথা করিল দেহ ত্যাগ, প্রবাসে
    এক বৎসর পর ফিরিয়া আসে। 
    কথা বলে: "কি করে কাটালে তোমরা ভাষাহীন জীবন দৈন্য"?
    — "কেন? বাঁচা ছেড়ে দেয় নাকি কথার অভাবে বোবা, মূক, মৌন"?
    বাক্ ফিরিল দেহে, চলে গেল চক্ষু প্রবাসে
    এক বৎসর পর ফিরিয়া আসে।
    চক্ষু বলে: "কি করে কাটালে তোমরা জীবন আঁধার রংহীন"?
    — "কেন? বাঁচা ছেড়ে দেয় নাকি কানা, অন্ধ, দৃষ্টিহীন"?
    চক্ষু ফিরিল দেহে, চলে গেল কর্ণ প্রবাসে
    এক বৎসর পর ফিরিয়া আসে।
    কর্ণ বলে: "কি করে কাটালে তোমরা শব্দহীন জীবন নিঃশব্দ"?
    — "কেন? বাঁচা ছেড়ে দেয় নাকি অকর্ণ, বধির, কালা হদ্দ"?
    কর্ণ ফিরিল দেহে, চলে গেল হৃদয় প্রবাসে
    এক বৎসর পর ফিরিয়া আসে।
    হৃদয় বলে: "কি করে কাটালে তোমরা নিঃসার জীবন মনহীন"?
    — "কেন? বাঁচে না নাকি অন্তরহীন শিশু অমলিন"?
    হৃদয় ফিরিল দেহে, চলে যেতে উদ্যত শ্বাসবায়ু 
    প্রাণোসমূহ বলে: "করো কি, করো কি, ফুরাবে সবার আয়ু"!
    ছটফটে ঘোড়া যেমন উপড়ে ফেলে খুঁটি, কীল, বাঁশের বাঁধন
    শ্বাসবায়ু চলে গেলে, শরীর উপড়ে, নিথর শীতল পাথর মরণ।
    প্রাণগুলা বলে: “বলেছিলেন ঠিক পিতা প্রজাপতি
    আমাদিগে শ্রেষ্ঠ শ্বাসবায়ু, উহা ছাড়া নাই কোনো গতি”।
    — বাক্, চক্ষু, কর্ণ কিম্বা হৃদয়
    প্রাণহীন ইন্দ্রিয় বলা কি যায়?
    প্রাণোঃ দেবতা বায়ুশ্বাস, হিরণ্যগর্ভ, জনম ভরিয়া 
    সমস্তে মুখ্য তিনি-ই — ইন্দ্রিয় সন্দর্ভ, স্বপন-সুরা ॥

    উক্ত এই প্রাণ-উপাসনা — জ্ঞান বিনিময়, গল্প বলার ফাঁকে 
    সত্যকাম বলে আবার ব্যাঘ্রপদের বাছা গোশ্রুতি-কে:
    — “বশিষ্ঠ গোত্রীয় গোশ্রুতি, জেনো
    জ্ঞানো বিদ্যায় এ হেনো
    নিরস গাছের কান্ড বোঁটায়
    ফুল, ডাল, পাতা ফোটায় ।
    জপ করো, পুনরাবৃত্তি থেকে থেকে     
    আওড়াও অন্তরে প্রভুর নাম হেঁকে
    — প্রাণ-কে বলে অল্পসহায় 'অম্'
    — আমি-ই সেই 'অম্', দুর্দম"। 
    [কারণ, আমারি ভিতর নিখিল সকল মহৎ
    জ্যেষ্ঠ আমি, শ্রেষ্ঠ আমি — প্রভা অধিপৎ।   
    প্রাণ-ই করায় প্রাপ্ত
    দক্ষ আধিপত্য
    প্রাণের-ই ন্যায় হইতে চাই সমগ্র জগৎ] ॥
     
    (৯)
    গৌতম বংশীয় অরুণের ছেলে উদ্দালক
    বিশ্বামিত্র বংশধর যাজ্ঞবল্ক্য-র গুরু শিক্ষক।
    [শুনা যায়, এই যাজ্ঞবল্ক্য-ই ছিলেন বক্তা কথক 
    শুক্ল যজুৰ্বেদ্ ও উপনিষদ্ বৃহদারণ্যক।]
    তো একদা, ছেলে শ্বেতকেতু-কে
    মহাঋষি উদ্দালক শুধায় ডেকে:
    “পুত্র, দেরী কোরো না আর, কালক্ষয়  
    বারো বৎসর বয়সী হোলে তো নিশ্চয়
    এবার গুরু খুঁজিয়া নাও, করো গুরুগৃহ গমন 
    সাধন করো ব্রহ্মচারী, ব্রহ্মচর্য পেশা পালন”। 
    আরো, বছর বারো, ব্রহ্ম মজলিশ 
    শ্বেতকেতু তখন সবে তরুণ চব্বিশ
    ফেরে, ব্রহ্মচর্য সেরে, পিতার বাড়ি।
    উদ্দালক ডাকে তারে সাত-তাড়াতাড়ি  
    — “বাছা, কি এমন জ্ঞান পেলে?
    অহংকারী রাশভারী বিদ্বান হলে ! 
    জানো কি সেই তথ্য যার মারফৎ 
    না-শোনা বিষয় যায়-শোনা যুগোপৎ   
    অসম্ভব অচিন্ত্য ধারণা 
    হয় পরিচিত — সচেতন জানা 
    অনিশ্চিৎ বস্তু হয় সম্বৎ সম সুনিশ্চিৎ”
    শ্বেতকেতু বলে: “বাবা, সে আবার কি তত্ত্ব অপরিচিৎ”?

    উদ্দালক বলে: "বাছা, ভুলো মনে তোলা
    দেয়ালের ভিতে একদলা কাদার ঢ্যালা
    প্রমাণ করে, মাটির মেজাজ কল্পতরু
    যত্নে রক্ষিত স্বর্ণ পিন্ড ধনীর আবরু —  
    বলে — সোনার ওজন, মূল্য, খাঁটি, পুরু।
    একখানি ইস্পাতে নিহিত অচেনা ইস্পাত সারা     
    কারণ, বস্তুর রূপভেদ খালি নাম —
    আলাদা, আলাদা, ধার করা …
    একই সত্য … মৌলিকত্ব … লৌহ সমান ভরা"।

    — “হে সোম্য, সৃষ্টির অতীতে ছিল একখানি সৎ
    ভাবিল সে ভরিবে ভরাট ভূখন্ড জগৎ।  
    তাই থেকে তেজ এলো গরম
    তেজ থেকে জল — তরল, নরম । 
    জল ও তেজ — পড়শী কুটুম জ্ঞাতি সঙগৎ     
    লাগিলে তাপ, বেরোয় ঘাম, এখনো এযাবৎ।
    জল ভাবিল জীবন কই? ঝপাং করে আসি —
    বর্ষা হলে ফসল ফলে — প্রাণোবন্ত হাসি”।

    — “হে সোম্য, দধির আত্মীয় হলদে ঘৃত।    
    মন অন্নময় সঙ্গ-পিরিত প্রীত।    
    তেজোময় বাক্  অতি উদ্বেলিত।
    জল প্রাণ ও পানীয় — বাঁধনে জড়িত।  
    বৎস্য, পনেরো দিন বিরত হও ভোজন, অন্নসুখ   
    যথেচ্ছ করো জল পান, শুধু-ই পাত্রে চুমুক” ।

    ষোড়শ দিনে থিতু শ্বেতকেতু
    ধেয়ানে আহার মুখ্য হেতু। 
    "আওড়াও আগে" আদেশ করিল পিতা 
    — "ঋক্, সাম, যজুঃ সংহিতা     
    আওড়াও ত্রিবেদ অনুপুঙ্খ   
    পুঙ্খানুপুঙ্খ"।
    — "পিতা, উপবাসে ভুলে গেছি সব পঠন পাঠন                                           
    পাতার আড়ালে সবজে কুঁড়ির মতন"।
    — "পানীয়ে বেঁচেছে প্রাণ, ভোজনে বাঁচিবে মন                                         
    আসিবে ইয়াদ, ইয়াদের বিস্মরণ"।

    — “হে সোম্য, সৃষ্টির অতীতে যে ছিল একখানি সৎ                                              
    তাহাতেই সৃষ্ট, পালিত, গলিত, বিলীন ভূখন্ড জগৎ।
    নিয়ে এসো বটফল, এবার ভাঙো তাকে                                                    
    দেখতে পাচ্ছ অণুর মত বীজ গুলাকে?"
    — "পাচ্ছি বাবা। ভাঙিয়া দেখি বীজ গুলা ফাঁকা"  
    — “ঐ ফাঁকা-র থেকেই গজালো বট, বৃক্ষ একা একা।  
    ডুবছে জলে জোয়ার ভাঁটা, ডুবছে সফেদ নুন
    লবণ যায় না পৃথক করা উধাও হবার দরুন 
    নোনতা-স্বাদ দ্রবণ প্রিয় জলের আসল গুণ ।
    তিনি-ই সৎ, তিনি-ই সত্য, তিনি-ই সূক্ষ্ম কারণ                                          
    তুমি-ই সেই, সেই-ই তুমি, ব্রহ্ম উপকরণ।  
    হও সত্য অনুসন্ধ, হও মধুরস পতঙ্গ
    হও আপাদো নিখাদ সৎ অনুষঙ্গ 
    তুমি এমন, তেমন তুমি-ই
    মুক্ত মাঝি বৈঠা তরঙ্গ। 
    ‘তৎ’ মানে বিরাট, তিনি সম্ভাবামি                                                    
    ‘ত্বাম্’ অর্থ ব্যক্তিগত মানুষ তুমি
    আর এই দুইকে জোড়ে ক্রিয়াবাচক ‘অসি’
    অর্থাৎ হয়, ভবতু, ‘তিনি-ই তুমি’ অবিনাশী
    ‘তৎ ত্বাম্ অসি’ সেই আদি সৎ সৃষ্টি বিহঙ্গ
    পূর্ণ পরিচয় প্রত্যক্ষ একতা ব্রহ্ম-কারণ অন্তরঙ্গ”।   

    ইতোমধ্যে শ্বেতকেতু বুঝিল পাঠ্য
    রহস্য মুখোশ মুক্ত-প্রহর অকাট্য
    তেজোময় বাক্ নির্দ্বিধায়
    জলোময় প্রাণ লহর উঠায়  
    ক্ষুধার্ত মন অন্নময় মুঠো
    জীবন মোহর ভাঙা খড়কুটো॥                                                                 
     
    (১০)
    আমন্ত্রণ চিঠি একদা পাইলো উদ্দালক                                                      
    জৈবলি প্রবাহণ পঞ্চালরাজ পত্র-প্রেরক।
    কিন্তু, রক্ষার্থে পিতার অন্য নিমন্ত্রণ হাজিরা  
    পিতৃ প্রেরিত দূত, প্রতিনিধি ভাড়া করা
    আরুণেয় শ্বেতকেতু জনসভা পঞ্চাল যায়
    বিজ্ঞ প্রবাহণ তাতে খানিক না-খুশই হয়।

    অকপট প্রশ্ন আরুণেয় প্রতি তার
    —“ব্রাহ্মণ, তুমি-ই কি নিয়েছ পিতার
    যজ্ঞ কর্ম ভার ?
    শিখেছ তো পিতার কাছে যা যা শিখার? 
    শ্বেতকেতু কহিল — “হ, তিনি সব বলেছেন” ।
    রাজা প্রবাহণ কহে:
    — "আচ্ছা, বলো তো বন্ধু উদ্দালক তনয় 
    মরিয়া মানুষ এ-লোক উর্ধ্বে কোথায় যায়?
    তারা আবার কি করে এ-লোক ফিরে আসে?
    পিতৃযান ও দেবযান দুটি রাস্তা, ঠিক কোথায় দুপাশে?
    চন্দ্রলোক পরোজগৎ কেন সর্বাৎ অতুষ্ট?
    শ্রদ্ধা, সোম, বৃষ্টি, অন্ন, রেত: ঘনিষ্ঠ 
    এই পাঁচ নৈবেদ্য আহুতি পশ্চাৎ 
    কর্মের অজানা ফল-বশত নির্ঘাৎ
    চপল তরল উৎসর্গ দ্রব্য-বিষয় নিম্ন গামী
    কেন হয়, পুনরায়, পুরুষ পদবি কামী?” 
    শ্বেতকেতু কহে: “নাহ্, তিনি বলেননি এসব খুঁটিনাটি” ।
    রাজা কহিলেন তবে তো তোমার শিক্ষা আধেক খাঁটি !
    মনো বেদনায় ফেরে বাড়ি শ্বেতকেতু, নির্দয় অপমান
    বলে: "পিতা, আপনি সত্যিই জানেন না রাজন্যবন্ধু সমান"?
    — "রাজন্যবন্ধু? সে তো ক্ষত্রিয় রাজা
    খুলে বলো এখনি, পঞ্চালরাজ সভায় বলেছে যা যা"।

    এবার উপস্থিৎ উদ্দালক, সমীপে প্রবাহণ                                                     
    — "ছেলেকে যা যা বলেছ, বলো আমায় এখন"।  
    — "থাক না ওসব, আদেশ করুন গাই বাছুর বিত্ত"  
    — "বিত্তে অর্থে নয়, তোমার জ্ঞানে ভরাও চিত্ত"।
    রাজা বলে — "ক্ষত্রিয় আমি, কেমনে বানাই ব্রাহ্মণ শিষ্য"?
    — "কিন্তু, এড়াবে কেমনে ব্রাহ্মণ প্রার্থনা প্রশ্ন বিমৃষ্য"?
    — "হে গৌতম, তবে হোক তাই।
    গুরুকুল হোক প্রাসাদ, দীর্ঘকাল ঠাঁই। 
    এতকাল যোদ্ধাজাতি মধ্যে ছিল এই বিদ্যা বিশ্বাস  
    ক্ষত্রীয়-জ্ঞানে আপনি-ই প্রথম ব্রাহ্মণ তমোনাশ"।

    — “বৃষ্টির জল পড়িবে কোথা?                                                                  
    কেউ কি জানে প্রামাণ্যতা?
    মানব জন্ম এলোমেলো খামখেয়াল
    ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য যোনি বা
    চণ্ডাল যোনিতে নাজেহাল।
    শাস্ত্রবিমুখ সাধারণ ব্যক্তি  
    মরন-বাচন ফান্দ আসক্তি  
    জায়স্ব ম্রিয়স্ব ইতি আবর্তীনি অসকৃৎ
    জন্মায়-মরে-জন্মায় পুনঃ ভ্রাম্য পথিকৃৎ”।

    — “ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করা পুণ্য   
    উল্লাস লড়াই সিপাহী সৈনিক প্রয়োজন্য।   
    যুদ্ধ বালাই ঘাত প্রতিঘাত ছাপ
    হার-জিৎ নহে নগন্য নিরুত্তাপ
    শত্রু নিধন দুঃখদায়ক পুণ্য সিঁড়ি ধাপ”। 

    — “যখন পুণ্যে জনম পূর্ণ তীব্রতরে  
    পুনর্জন্ম সাঙ্গ জাতিস্মরে    
    ফিরিতে হয় না আবার যতেক জাদুকর সংসারে। 
    এই বিশ্বাস ভরসায় নিশ্চয় 
    ক্ষত্রিয় যুদ্ধে যায়
    অস্ত্র বর্ম জীবন ঘূর্ণি এড়াবে অবহেলায়।  
    অদ্য এ-বিদ্যার সারথি আপনি-ও 
    মনোরম মুক্তি নাকি জন্ম চক্র প্রিয়
    বাছাই করুন বল্গা খুলা জীবন আলোকলতায় ॥

    (১১)
    কোনো এক গড়িমসি সাতসকাল বন্ধু উপভোগ্য                                        
    উপমন্যুর বাছা প্রাচীনশাল, পুলুষের ছেলে সত্যযজ্ঞ
    ভল্লবির নাতি ইন্দ্রদ্যুম্ন, শর্করাক্ষের ছেলে জন  
    এবং অশ্বতরাশ্বের পুত্র বুড়িল বসিল আড্ডা নিমন্ত্রণ।  
    "আমাদের আত্মা কি? ব্রহ্ম কি?" জল্পনা বিস্তর   
    "এই কি সেই এক-আত্ম-স্বরূপ সকল মানব বৈশ্বানর?"
    অরুণ পুত্র উদ্দালক নিশ্চই জানেন অনুসন্ধান উত্তর। 
    উদ্দালক বলে, চলো যাই কেকয় পুত্র অশ্বপতির কাছে
    শুনিয়াছি রাজা ইদানিং বৈশ্বানর বিষয়ে মেতে আছে । 
    অশ্বপতি বলে: "ক্ষত্রিয় আমি, কেমনে বানাই ব্রাহ্মণ শিষ্য"?
    — "কিন্তু, এড়াবে কেমনে ব্রাহ্মণ প্রার্থনা প্রশ্ন বিমৃষ্য"?
    — "হে গৌতম, তবে হোক তাই।  
    গুরুকুল হোক প্রাসাদ, রাত্রিকালীন ঠাঁই। 
    প্রাতঃ কালে করিব এই বিদ্যা অভ্যাস অনুশীলন   
    ক্ষত্রীয়-জ্ঞানে গুরুসেবা, বৈশ্বানর দেহ প্রকাশ উন্মোচন"।

    — “বৈশ্বানরের মাথায় স্বর্গ নভঃ সুতেজা দ্যুতি                                           
    আদিত্য বিশ্বরূপ তার চোখ দু’খান দুটি
    স্বেচ্ছাগামী বায়ু প্রাণে অবাধ হাওয়ায়
    বহুল আকাশ মধ্য দেহ হস্ত পাহারায়
    জল জনিত সম্পদ তার মূত্রাশয়ে তলপেটে 
    প্রতিষ্ঠা ভিৎ চলন চালন, পৃথিবী পায় হেঁটে।
    এরা নয় আলাদা, পৃথক, সমুদ্র লহর ঢেউ 
    দুদিক বন্ধ এক-ই দেহের আষ্টেপিষ্ঠে হরেক কেউ”।

    — “ ‘প্রাণায় স্বাহা’ মন্ত্রে তৃপ্ত করো প্রাণ”
    তৃপ্ত করো নজর, সূর্য আদিত্য চোখ জুড়ান
    আদিত্য তুষ্ট হলে স্বর্গ সুষ্ঠু থাকে
    স্বর্গতলে থাকে যারা, পড়ে না বিপাকে। 
    সমগ্রে ভজনা করো তাকে
    নাম ধরে বৈশ্বানর উপাসনা ডাকে। 
    খুশি হলে তিনি
    ভোক্তা মানুষ সুখী দিবস রজনী  
    লাভ করে প্রজা
    অন্ন পশু তরোতাজা
    দেহকান্তি ব্রহ্মতেজ দাপুটে রাজা। 
    আংশিক জ্ঞান শুকনো জলাশয় 
    ভজন পূজন মজা দীঘি
    পৃথক পৃথক দেব-ধ্বনি প্রার্থনায়
    ভস্মে ঢেলো না ঘি” ॥                                                                               

    (১২)
    পুরাকালে শিক্ষা দানের সে ছিল এক রীতি
    গুরুর কাছে খুলে বলো কারণ উপস্থিতি।
    ব্রহ্মাপুত্র নারদ বলে মহা মুনি সনৎকুমার
    “পড়লুম এতো, তাও যেন শোক যাচ্ছে না আমার”।  
    — “আচ্ছা বাছা বলবো খন
    ভূমা সুখোসার তালিম বচন    
    দেখি আগে জানো কতো প্রকৃতি শাস্ত্র মন্ত্র খেউর
    দেখি আগে ঠিক, কতো খানি দূর তোমার দৌড়?”  

    নারদ মুনি বলে দ্রুত ধাবমান 
    "পড়েছি চার চারিটি বেদ মহান
    বেদের মতো পঞ্চম স্থানীয় ইতিহাস পুরাণ।  
    পড়িয়াছি আরো — ব্যাকরণ, শ্রাদ্ধ তত্ত্ব, গণিৎ
    কমে ক্যামনে দৈব উৎপাত, ভৌতিক বিদ্যা গীৎ
    নক্ষত্র, তর্ক, জ্যোতিষ, ভূৎ, নীতিবিদ্যা সিদ্ধান্ত    
    সর্প আর ধনু, প্রকৃতি, ভূতত্ত্ব দুরূহ প্রাণবন্তো ।  
    আধার নিধি মহাকাল ইত্যাদি 
    বেদাঙ্গ-কলা শিল্প-কল্প আদি।  
    তথাপি শোক বিলাপ গেল না নির্বিবাদ     
    আপনি আমায় শিখিয়ে দিন দুঃখ অধিক পরমাদ” ।

    সনৎকুমার বলে: “এ অনিবার্য আশ্চর্য   
    তুমি এদ্দিন যা যা জেনে এসেছো 
    তা খালি নাম, কেবলি শব্দ, নামমাত্র, তুচ্ছ ।
    শোনো, নাম হইতে বড়ো ভাষণ, ভাষা, বাক্ 
    বাক্ হইতে মন গোপন হাঁক ডাক। 
    মন হইতে সংকল্প বৃহৎ — উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, তা   
    সংকল্প থেকে মহান চিত্ত, উচ্চ মানসিকতা।  
    চিত্ত চাইতে প্রধান ধ্যান, মনোনিবেশ ক্ষমতা।  
    ধ্যান হইতে বিজ্ঞান, বিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা মহৎ ঘোর   
    এদের চেয়েও চমকদার শক্তিশালীর জোর।  
    ক্ষমতা অধিক ভরোসা অন্ন, শ্রেষ্ঠ দুনিয়াদারি 
    অন্ন হইতে জল, মেঘ, বৃষ্টি, পবন, বারি।  
    জল থেকে জীবনী তেজ আলো
    গরম-পোড়া রৌদ্র মেঘে বিদ্যুৎ চমকালো   
    তেজ হতে নক্ষত্র ধুম আকাশবায়ু ভালো। 
    আকাশ অধিক ধরন-ধারন স্মরণ-স্মৃতি পরিষ্কার
    স্মৃতি চেনালো মানুষ পশুর তফাৎ বিস্তার। 
    স্মৃতির অধিক আপাদ-প্রত্যাশা, মহৎ অধিকার  
    আশায় করায় কাজ, যাগ যজ্ঞ উপাচার।   
    আশার অতীত প্রাণ,
    সব রকমে মহান,
    মূর্তি অভিমান,
    শরীর বাহক যান”।

    — “মনে হতে পারে বড়ো বড়ো কথা  
    সত্য অতিবাদী অযথা ।
    জীবন খানিই সব।
    যদি একজন মানুষ এটি করে অনুভব 
    এবং অনুভবে অটল অতল মন 
    তবে তার তর্ক আলোচনা অপ্রয়োজন।
    এটা তার অস্বীকার না করাই উচিত —
    যে সত্য সে জানে তা আলোচনা অতীত।
    মানুষ কি খাঁটি সত্য বলতে পারে?
    না জেনে 'জানি, জানি' ভাব অন্তরে?
    মানুষ যা জানে তাই বলে। সত্য তবে সব।
    নারদ, সত্য — জানো আগে — অতিবাদ কোলাহল রব” ।

    — “পরন্তু, সত্য অসাধ্য সবিশেষ জ্ঞান ছাড়া    
    চিন্তায়, মননে, ভাবনায় — বিজ্ঞান বাঁধনহারা। 
    না ভাবিলে, বিজ্ঞান লাভ হয় না।
    নারদ, তাই ভাবো, ভাবার নাই তুলনা” । 

    — “তথাপি, ভাবনা টাবনা পরিপাকে  
    শ্রদ্ধা বিশ্বাস যদি থাকে ।    
    অবিশ্বাসী, নেই তার সেই মনন সহায়।
    নারদ, তাই শ্রদ্ধা থাকুক বজায়”।

    — “পুনরায়, শ্রদ্ধা আসে
    ভক্তি টক্তি বিশ্বাসে
    নিষ্ঠাবানের আশেপাশে
    ভক্তি ছাড়া, উপায় নাই।
    নারদ, তাই ভক্তিতে হোক ঠাঁই”।

    — “পুনশ্চ, মানুষ যখন একনিষ্ঠ গভীর
    তখন সে মত্ত ভক্ত নিবিড় । 
    সুস্থিরতা ছাড়া
    এলোমেলো জগৎ দিশা হারা       
    নারদ, তাই করো মন সংহত
    একাগ্র হও প্রথমত”।

    — “অথচ, মানুষ যখন সুখী  
    তখনি সে একাগ্র, কর্তব্য অভিমুখী।  
    প্রসন্নতাহীন সাধন কর্ম ধর্ম অসাড় নিষ্প্রাণ
    আত্মপ্রসাদ কাজ করার প্রয়োজনীয় শর্ত প্রধান ।
    নারদ, তাই আবশ্যক জানিও সেই আনন্দটিকে জানা
    তাহায় সুখ, তাহা ‘ভূমা’, তাহা প্রচুর, প্রতুল, নানা ।
    যঃ বৈ ভূমা তৎ সুখম্।
    ন অল্পে সুখম্ অস্তি। ভূমা এব সুখম্।  
    সামান্যে সুখ নাই কাহারো
    অল্প আয়েস পোষায় না কারো।
    হেথা অল্প ও ভূমা পরস্পর বিপরীত আরো”।

    — “যাহাতে কেউ দেখে না অপর কারো  
    শুনে না অপর, জানে না অপর অন্যতর
    তখন সে সীমাহীন ভূমা অবাধ
    ভূমা অমৃত — অল্পে নশ্বর জনপদ আবাদ
    প্রতিষ্ঠিত ভূমা স্বমহিমায়
    স্ব-রূপে অন্তরঙ্গ  
    এর জুড়ি মেলা দায়
    আলোছায়
    সাতপোহর নিরালম্ব”।

    — “আলম্ব বিহীন ভূমা নির্ভর করে না কিছুর ওপর
    তিনি নীচে, পিছে, সামনে, ডানে, বামে, সবার উপর;
    তিনিই সব, সমস্ত পর অপর ।
    যদি 'তিনি' না বলে 
    'আমি' রাখি বদলে
    তবে হয়, আমি নীচে, পিছে, সামনে, ডানে, বামে, সবার উপর;
    আমিই সব, সমস্ত পর-অপর ।
    যদি 'তিনি' না বলে 
    'আত্মা' রাখি বদলে
    তবে হয়, আত্মা নীচে, পিছে, সামনে, ডানে, বামে, উপর;
    আত্মা-ই সব, সমস্ত পর-অপর” ।

    — “এইরূপ দর্শনে
    এইরূপ বিজ্ঞান মননে
    যে বিদ্বান সে
    নিজেই নিজেকে ভালবাসে
    আত্মক্রীড়া দেহতট
    নিজের সাথে খেলা করে আত্মরতির নিকট 
    নিজের সাথে একাত্ম হয় আত্মমিথুন নোঙর
    নিজেকে ভোগ করে নিজে আনন্দ অষ্ট প্রহর
    নিজেকে শাসন করে সে নিত্য অবেলা
    তার খুশিতে স্বরাট জীবন, বকাবকি কানমোলা”।

    — “সেই জ্ঞানী তাত্ত্বিক সদা তৎপর   
    হতে পারেন এক রকম প্রকার প্রখর 
    অথবা বহুধা হন যোগ্যতা গুণ সহিৎ
    তিন পাঁচ সাত নয় এগারো বা একশো গুণিত 
    কিংবা প্রতিলিপি একশো দশ, এক হাজার বিশ
    যিনি এক, তিনি-ই আজ ইতস্তত ছড়ানো জিনিস”। 

    — “বিশুদ্ধ খাদ্যে মেলে খাঁটি বুদ্ধি কান্ডজ্ঞান     
    বুদ্ধি হইতে প্রসারিত নিখাদ স্মৃতি অনুধ্যান   
    স্মরণে রাখি মনে আত্মার অবিরাম নির্গুণ উপস্থিতি
    হৃদয়ের জোরালো জট
    কেটেছেঁটে অকপট
    আজাদ ধুলার ভার, আলগা বাঁধন রূপসী পিরিতি।
    সত্য বাস্তব ও তার আরোহী উর্দ্ধগামী ধাপ
    শোক বিলাপ উপচে উচ্চে সকল নির্বিবাদ”।       

    দুঃখ পরখ জ্ঞানের বিচার
    শিখাইল সনৎকুমার 
    বেদন অধিক রোদন অসার 
    আনন্দ পরমাদ নিরবধি বীতশোক
    রোজ রোজ ভারি মজা হোক॥

    (১৩)
    সৃষ্টির নিয়ম ঐক্যসূত্রে সমস্ত সদৃশ, হুবহু সমান                                       
    অন্দরে ঘটিছে যা, বাহিরে তাহার চাক্ষুষ প্রমাণ ।
    মানবদেহ ব্রহ্মনগর স্থানীয় শাশ্বত শহর
    সেই শহরের মধ্যিখানে বক্ষ নৌবহর ।   
    সামান্য হৃদয় পদ্ম প্রাসাদ ও তাহার ভিতর জব্দ 
    অন্তর আত্মা আকাশ ঘিরে ঘুম ভাঙানোর শব্দ ।    
    সেই ‘দহরাকাশ’ ব্রহ্মপুরে একইসুরে আত্মভাবে
    ঐশ্বরিক অশরীরী বিরাট বিশ্ব খুঁজে পাবে।
    ইনিই আত্মা, অমৃত, অভয়, সেতু সমুদয়                                                      
    ব্রহ্ম, সত্য, বা আর যে যে নামে ডাকা হয় —
    ব্রহ্মসেতু আত্মার করো তদন্ত খোঁজ                                                             
    ইষ্ট, যজ্ঞ রোজ রোজ 
    আর লাগাতার 
    ব্রহ্মচর্য এক নাগাড় ।                                                                                        
    ব্রহ্মসেতু তৈরী হোক, দীর্ঘতম বাঁধ
    হৃদয় শরীর সপ্তলোকে বিছানো আহ্লাদ
    বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ফিরিছি অবাধ॥                                                      

    (১৪)
    একদা বলেছিল ঠিক পিতা প্রজাপতি
    আত্মা অনুভবের সবিশেষ নীতি। 
    এই আত্মার সম্যক পরিচয় পাইলে
    লাভ হয় যা-যা সব কাম্য বস্তু চাইলে।

    অতঃপর ...
    দেবরাজ ইন্দ্র এবং 
    অসুর রাজা বিরোচন
    হইল তৎপর ...  
    ব্রহ্মচর্যে বসোবাস বত্রিশ বৎসর। 

    তারপর …
    পিতা প্রজাপতি জিজ্ঞাসিল: “কি উদ্দেশ্য বশত  
    দেবতা অসুর মিলিত আজি লতিয়ে গাছের মত?”
    — “জানিতে চাই সেই আত্মা কই
    যাতে পিঁপড়া ও প্রজাপতি হয় সই”।
    — “চোখ দিয়ে নিহারো যে দেহ-পুরুষ বৈভব 
    জলে আমি, আয়নায় আমি একই অবয়ব।
    তিনি-ই আত্মা, অমৃত, ভরোসা, অভয়
    ব্রহ্ম বিশ্বাস সমুদয়”।

    অতঃপর ...
    দেবরাজ ইন্দ্র এবং 
    অসুর রাজা বিরোচন
    হইল তৎপর ...

    তাকায় তারা পাত্র ভরা
    ভাঙায় গড়া মানুষ তারা
    চেহারা থতমত 
    ঘড়ার জলে আয়না মূর্তি অবনত ...  
    দেখে লোম খাঁড়া 
    দেখে নোখ একতাড়া  
    দেখে দেহ ছবি দোলন তরঙ্গ চেহারা।

    এরপর …
    পিতা প্রজাপতি আদেশ করিল: “সেজেগুজে আইসো এখন”
    দেবতা অসুর মিলিত আজি রাজবেশে যে যার মতন।
    পুনর্বার …
    তাকায় তারা জল ভরা পাত্রে সমবেত  
    দেখে লোম, দেখে নোখ, দেহছবি তরঙ্গিত।
    পিতা প্রজাপতি বলে: “এই
    তরঙ্গিত আত্মা সেই
    অমৃত, ভরোসা, অভয়
    ব্রহ্ম বিশ্বাস সমুদয়”।
    দেবতা অসুর পুনরায় শান্ত হৃদয়।

    “শোনো গো ভ্রাতা অসুরগণ” বলে বিরোচন রাজা
    “প্রজাপতি শিখাইলেন উপনিষৎ তরোতাজা
    যে দেহের ছায়া পড়ে চক্ষে
    তাহাই আত্মা পূজনীয় বক্ষে
    এমনকি দেহ যখন মৃত
    করিও অলংকার সজ্জিত
    করিও ইহলোক পরলোক জয়
    ‘আসুরী উপনিষৎ’ এই কৌশল বাতলায়”।

    এদিকে দেবরাজ মনে নিত্য সন্দেহ 
    এ তো প্রত্যহ মামুলি নশ্বর দেহ
    আকাশ ছায়ায় লুটায় ভস্মভার
    কি করে হইবে তার আত্মা চমৎকার?
    ইন্দ্র ফিরিল গুরু বাড়ি পুনর্বার।   

    অতঃপর ...
    দেবরাজ ইন্দ্র 
    হইল তৎপর ...  
    ব্রহ্মচর্যে বসোবাস আরো বত্রিশ বৎসর।

    তারপর …
    বলে পিতা প্রজাপতি
    “স্বপ্নে আত্মার অবলোকন প্রীতি  
    বালিশ বিছানা শায়িত পরিধি
    তাও, তোমা স্বপ্নে যে মৃত্যুহীন তুমি ধী
    তিনি-ই আত্মা, অমৃত, ভরোসা, অভয়
    ব্রহ্ম বিশ্বাস সমুদয়”।
    দেবরাজ পুনরায় শান্ত হৃদয়।

    এদিকে দেবলোক পৌঁছবার পূর্বেই
    দেবরাজ মনে উঠোতি বাড়োতি একই সন্দেহ সেই: 
    “হ্যাঁ, ঠিক, নিজের স্বপ্নে আমরা অমর সকলেই
    তথাপি, এ তো প্রকৃত হৃদয় নিঙড়ানো
    সান্ত্বনা পুরস্কার কোনো
    এ আশ্বাস নীল চূড়া ভস্ম ভার
    কি করে হইবে তার
    আত্মা চমৎকার?”
    ইন্দ্র ফিরিল গুরু বাড়ি পুনর্বার।
    অতঃপর ...
    দেবরাজ ইন্দ্র 
    হইল তৎপর ...  
    ব্রহ্মচর্যে বসোবাস আরো বত্রিশ বৎসর।

    তারপর …
    বলে পিতা প্রজাপতি
    “স্বপ্ন বিহীন নিদ্রায় মানব প্রকৃতি
    নিজের সাথে শান্তিতে তৃপ্ত খুশি বরং
    বালিশ বিছানা শায়িত নিরঙ্কুশ স্বয়ং  
    তিনি-ই আত্মা, অমৃত, ভরোসা, অভয়
    ব্রহ্ম বিশ্বাস সমুদয়”।
    দেবরাজ পুনরায় শান্ত হৃদয়।

    এদিকে দেবলোক পৌঁছবার পূর্বেই  
    দেবরাজ মনে আবার সেই
    আকুল করিল সন্দেহ
    “সুষুপ্তি তে কেবল নিদ্রা, নাই স্বপ্ন স্নেহ 
    নৈ অয়ং, নৈ স্বয়ং, নিখোঁজ যেনো কেহ
    কিছুই জানে না নিছক দেহ।    
    এ আশ্বাস সকালে মিইয়ানো ভস্ম ভার 
    কি করে হইবে তার
    আত্মা চমৎকার?”
    ইন্দ্র ফিরিল গুরু বাড়ি পুনর্বার।

    অতঃপর ...
    দেবরাজ ইন্দ্র 
    হইল তৎপর ...  
    ব্রহ্মচর্যে বসোবাস আরো পঞ্চ বৎসর।

    তারপর …
    বলে পিতা প্রজাপতি
    “এই শরীর মরণশীল অতি
    কিন্তু ইহারি ভিতর করে বসতি 
    অশরীর আত্মা। 
    অশরীর আরো কি কি আছে, ভেবে দেখো তা —
    বায়ু, সূক্ষ্ম মেঘ, মেঘ গর্জন, তড়িৎ 
    দেহহীন ইহারাও হিৎ বিহিৎ  
    ও অকারণে স্থায়ী
    নিজের মতো প্রায়-ই
    স্ব-রূপে প্রকটিত
    ওই আকাশ হইতে হরদম উত্থিত
    ওই আকাশেই সৌরতেজ সম স্থিত”। 

    “তেমনি আত্মা দেহ আয়ু
    উত্তম পুরুষ দ্রুতবেগ স্নায়ু
    রণক্ষেত্র দূৎ
    সংসার মাতানো হাস্য দংশন অদ্ভূৎ —
    মরো জর্জর পিতা মাতা হইতে সম্ভূত
    এ-দেহ আকাশ-মনে প্রাণ সম স্থিত
    এ-দেহে আত্মা জুড়ে থাকে ওতপ্রতো
    অশ্ব ও তার রথের মতো জড়িত”।

    “এই আত্মার করিলে উপাসনা, পাইলে সম্যক পরিচয় 
    কাম্য বস্তু চাইবে যা যা, সব লাভ হয়”।
    অতঃপর ...
    দেবরাজ ইন্দ্র
    হইল প্রজাপতির শিষ্য শ্রেষ্ঠবর  
    ব্রহ্মচর্যে বসোবাস মোট একশত এক বৎসর॥     

    (১৫)
    জ্ঞান বিনিময় নিম্নগামী ধাপ
    হিরণ্যগর্ভ হতে প্রজাপতি কশ্যপ 
    প্রজাপতি হয়ে মনু মারফৎ
    মানুষে মানুষে পাইলো আত্মজ্ঞান তৎ হ এতৎ —  
    গুরুগৃহে পড়ো বেদ পাঠ 
    গার্হস্থ্যে পালো সংসার
    ধর্ম পরায়ণ পুত্র পরিপাট
    ইহারো পরে ভুলিও হিংসা দ্বেষ
    করো জপ করো তপ যা দিতেছি নির্দেশ
    ফিরিবে না আর এ জগৎ তৎ কালোময় 
    অফুরান ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হও আলোময় ।       

    শ্যাম অমাবস গভীর নিবিড়                                       
    তায় থেকে পাই জগতো মদির
    শবল বিচিত্র বিভিন্ন রঙীন চমৎকার
    নিম্নতম গাঢ় অন্ধকার
    বৈচিত্র্যে প্রাপ্ত হোউক একরূপতা আমার।

    ঘোড়া যেমন তার পশম নাড়ায়                                  
    মাছি পোকা হালকা ময়লা তাড়ায়
    তেমনি আমি
    বিধৌত করিব আজন্মের যত পাপ। 
    চন্দ্র যেমন কাটিয়ে ফেরে রাহুর অভিশাপ
    ফিরে পায় তেজ, বর্ধিত হয় পক্ষ ভাগে
    তেমনি আমি
    আনধার পেরুবো শরীর ত্যাগে।  
    ইহার পরে প্রাপ্ত হোউক অপলক দু'নয়ান
    শাশ্বত ব্রহ্মলোক আলোময় অফুরান॥

    যার আকাশ নামে শ্রুতিতে পরিচিতি
    জগতের নাম ও রূপের অভিব্যক্তি পিরিতি    
    ঐ নামরূপে বিদ্যমান যিনি
    ব্রহ্ম তিনি
    ঐ ব্রহ্ম সুধা নির্যাস তরঙ্গিণী
    ঐশ্বরিক অনুপম
    তৎ ব্রহ্ম, তৎ অমৃতম।

    যেতে পারি যেন ব্রহ্ম প্রাসাদ ব্রহ্ম সভায়
    ব্রাহ্মণ সম্ভ্রম পাইতে আশা হয়
    ক্ষত্রিয়ের খ্যাতি জনতায় নামডাকে   
    বৈশ্যের বৈভব বাড়বাড়ন্ত হতে থাকে  
    সকল যশ জড়িয়ে দাঁড়ায় 
    যশস্বী আমি ব্রহ্মদাস
    আমার যেন আর না হয়
    কষ্টকর গর্ভবাস।
    ~~~ 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • কাব্য | ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ৪২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন