মিসেস সেনগুপ্ত একবার প্রেমে পড়েছিলেন। আর্লি যৌবনে। বিয়ে হওয়ার আগে আগে। পরবর্তীকালে তিনি বুঝতে পারেন, বরফি আদতেই খুব ভালো মানুষ। আস্ত গোটা হীরা বললে ভুল হয় না।
শুক্লা বাবু, এককালে পেটমোটা পুলিশ অফিসার ছিলেন, তখন বরফির পিছনে চরকির মতন ঘুরেছেন। কালে কালে তিনিও বুঝতে পারেন আদতেই বরফির কোন তুলনা হয় না।
দুজনেই তাদের উপলব্ধির কথা বললেন। আমরা যারা সিনেমা হলে গেছিলাম তারা শুনলাম। আসুন আপনাদের ও শোনাই। বরফির গল্প। একটু ছেলেমানুষি, কিছুটা ভালোমানুষি আর বাকিটা প্রেম, অল্প অল্প। এ গল্প বরফি(রণবীর কাপুর) শোনাতে পারবেনা। কারন সে জন্ম থেকেই মূক ও বধির, তার উপর এখন হাসপাতালে। বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ভোররাতে নিজেই নিজের ছবি তুলে দুড়ুম করে মেঝেতে পড়ে গেছে। ছবি পাঠানো হয়েছে কলকাতায়। মিসেস সেনগুপ্তের(ইলিনা ডিক্রুজ)কাছে।
মিসেস সেনগুপ্ত বুড়ো বরফির ছবিখানি দেখলেন পরম মমতায়। তিনি খবর পেয়েছেন। বরফিকে শেষবারের মত দেখার জন্য তিনি দার্জিলিংয়ের ট্রেনে চাপলেন। ট্রেনে একটা বাচ্চা ছেলে সুন্দর একটা কাগজের এরোপ্লেন বানিয়েছে, রেখেছে জানালার ধারে। হাওয়ার এরোপ্লেনের পাখা কাঁপছে ফরফর ফরফর। মিসেস সেনগুপ্ত স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লেন। পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
সেই আটাত্তর সালের কথা, যখন অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা, চুরি ও ডাকাতির অভিযোগে মোটু পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর শুক্লাবাবু দুই হাবিলদারকে নিয়ে বরফিকে ধরতে এলো, বরফি কুলকুচি করতে করতে পালানোর চেষ্টা করলো, সেই বারের কথা। সেদিনও পুলিশ শেষমেস বরফি ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মিসেস সেনগুপ্ত এমনি করে ট্রেনে চেপে রওয়ানা হয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের পথে, বরফিকে বাঁচাতে, সমাজের কেয়া্র না করে, সেনগুপ্ত বাবুর(জি টিভি সারেগামাপা, যীশু) কড়া কথা অগ্রাহ্য করে। মিসেস সেনগুপ্তর আজও মনে আছে, যীশু তাকে বাঁকা সুরে প্রশ্ন করেছিলো, 'কেয়া লাগতা হ্যায় ইয়ে বরফি তুমহারা?" মিসেস সেনগুপ্ত মনে মনে হাসলেন," কেয়া লাগতা হ্যায়?" ওমনি মিসেস সেনগুপ্তের মনে পড়ে গেলো আরো পুরোনো দিনের কথা।
বাহাত্তর সালের কথা। মিসেস সেনগুপ্ত তখন আর্লি যৌবনে। নাম শ্রুতি ঘোষ। মিস্টার সেনগুপ্তের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দার্জিলিংয়ে এসেছে বাবা মায়ের সাথে। বাবা চাকরি সুত্রে ট্রন্সফার হয়ে এসেছে। এই বাহাত্তর সালেই বরফির সাথে শ্রুতি ঘোষ, অধুনা মিসেস সেনগুপ্তের দেখা। দার্জিলিংয়ের রাস্তার। বরফি তখন দামাল দস্যি যুবক, সাইকেলে বিহার করে, গাড়ির কাচে চুল আঁচড়ায়, বাচ্চা ছেলের চকলেট কেড়ে খেয়ে নেয়, বগল বাজিয়ে নাচে, ঘন্টাঘরের ডগায় চড়ে কাঁটা ঘোরায়। কী কিউট না? এমন ছেলের প্রেমে না পড়ে কি থাকা যায়? অ্যাঁ?
শ্রুতি দার্জিলিংয়ে আসা ইস্তক বরফি তার পিছনে পড়ে ছিলো। টয় ট্রেনে যেতে যেতে, খাওয়ার প্লেটে কল্পনার গোলাপ রেখে, চিঠি লিখে বরফি তার প্রেম নিবেদন করলো। তারপর দুজনে বন্ধু হয়ে গেলো এবং ঘোড়ায় চেপে ঘুরতে বেরোলো। এরপরে তারা সাইকেলে এবং টয়ট্রেনেও চেপেছিলো। তারপর একদিন শুভলগ্ন দেখে চুমু খেয়ে তারা পাকাপাকি ভাবে প্রেমে পড়ে গেলো।
ওদিকে শ্রুতির বিয়ের লগ্নও এগিয়ে এসেছে, যীশু মাঠে নেমে পড়েছে। তাও দুড়মুড় করে প্রেম চলছিলো। কে বলতে পারে শ্রুতি আর বরফির বিয়েও হয়তো হয়ে যেতো যদি না শ্রুতি মা কাঠি করে দিতো। কারণ বরফি তো শুধু ড্রাইভারের ছেলে তায় নয়, সাথে বোবাও, কালাও। শ্রুতি মা শ্রুতিকে বোঝালো, দ্যাখ, বিয়ে করতে হয় ভালোবেসে নয়, হিসেব কষে। শ্রুতির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেও শেষ পর্যন্ত ফিরে গেলো বরফি। বরফির মন জুড়ে সেদিন ছিলো শুধু শ্রুতি। শ্রুতির ছোখ জুড়ে ছিলো বাঁধ ভাঙা কান্না। আর সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিলো।
বরফির মা নাই। বাপ চ্যাটার্জীবাবুদের ড্রাইভারি করে দিন চালায়। চ্যাটার্জীবাবুর এক মেয়ে ঝিলমিল (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) অটিস্টিক। চলতি বাংলায় পাগল, কিন্তু ঠিক পাগল না। এই রোগে রোগীর সামাজিক ব্যবহারে অসঙ্গতি দেখা যায়। ডিটেলে জানতে হলে গুগল করে নিন। তো এই চ্যাটার্জীবাবু আসলে ঘরজামাই হয়ে আছেন। চ্যাটার্জীবাবু ও তার স্ত্রী কেউই ঝিলমিল কে ঠিক পছন্দ করেন না। ঝিলমিল তাই বেশীরভাগ সময় একটা হোমে কাটায় যার দেখভাল করেন দাদ্দু (হারাধন বন্দোপাধ্যায়)। ইনি আবার ঝিলমিলকে খুব ভালোবাসেন। ঝিলমিল হোম থেকে বাড়ি চলে গেলে দুচোখ বেয়ে বন্যা নামে। ঝিলমিলকে ঝিলমিলের নিজের দাদুও খুব ভালোবাসে।
ঝিলমিলকে আরো একজন পছন্দ করতো। সেও ঝিলমিল কে পছন্দ করতো। সে সবাইকেই পছন্দ করতো।বোঝাই যাচ্ছে, সেই সে হল আমাদের বরফি। তারা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসতো। কী মিষ্টি।
শ্রুতি ফিরে গেছে কলকাতায়। ক’দিন পরে ঝিলমিলের দাদু মারা গেলেন। মারা যাবার আগে সব সম্পত্তি ঝিলমিলের নামে একটা ট্রাস্টিতে দিয়ে গেলেন। ঝিলমিল পাকাপাকি ভাবে হোম থেকে ঘরে চলে এলো। চ্যাটার্জীভাবু দুরদুর করে সব চাকর ড্রাইভার তাড়িয়ে দিলো। বরফির বাবাকেও। দুঃখে বরফির বাবার কিডনি খারাপ হয়ে গেলো। শোকে বরফির মাথা খারাপ হয়ে গেলো। বাবা আছে হাসপাতালে। ডাক্তার ৭০০০ টাকা জোগাড় করতে বলেছে। বরফি কোথায় পাবে টাকা? অপহরণ করতে বেরোলো বরফি। ঝিলমিলকে তুলে নিয়ে আসবে চ্যাটার্জীবাবুদের বাড়ি থেকে। মুক্তিপণ ৭০০০ টাকা এভাবেই আদায় করবে। এরকম ই ভেবে অপহরণ করতে বেরোলো বরফি।
কী হবে তারপর? কোন দিকে ঘুরে যাবে ঘটনা? আপনারা দেখে নিন। রমরমিয়ে চলছে সিনেমাটা। বেজায় হিট। অনেক গল্পই বাকি আছে এখনো। দাঁড় বেয়ে রেল লাইন ধরে পালাবে বরফি। গরুর গাড়ি চড়ে কলকাতায় চলে আসবে। সাথে ঝিলমিল। এট্টুস পরকীয়াও পাবেন। আর আছে ঝিলমিল অন্তর্ধান রহস্য। টানটান উত্তেজনা আর গাদাগুচ্ছের ইমোশান। শেষবেলায় জুতো নাচিয়ে সেই রহস্যও সমাধান করবে ডিটেকটিভ বরফি। আমি শুধু কনক্লুশন টানি।
মিসেস সেনগুপ্ত আর্লি যৌবনে একবার প্রেমে পড়েছিলেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন বরফি আসলে খুব ভালো ছেলে। আরো বুঝতে পেরেছিলেন, ভালোবাসলে হিসেব কষলে কী হয়। কী হয়? একটা আধা কমেডি আধা আর্ট ফিলিমের ট্রাজিক সাইড রোল পাওয়া যায়।