এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বই

  • বাঙালীর বই, বাংলায় মুদ্রণ

    দ্বৈপায়ন লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ | ১০১৬ বার পঠিত
  • স্বপন চক্রবর্তী (সম্পাদক): মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই: কলকাতা, অবভাস: প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০০৭: মূল্য ২২৫.০০,

    ISBN 978-81-904755-4-9

    বাংলা সাহিত্য নিয়ে আজ অব্দি যত গবেষণা হয়েছে, যত প্রবন্ধ এবং বই প্রকাশিত হয়েছে, তার একভাগ কাজও হয়নি বাংলা সাহিত্যের মূল সুরটি অর্থাৎ বাংলা বই নিয়ে। বাংলায় লেখা পুঁথির কথা তো ছেড়েই দিলাম, আজ থেকে মাত্র দুশো পঁচিশ বছর আগে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী বাংলা ভাষাবিদ হালেদ সাহেব

    (N.B.Haled)
    ব্রিটিশ কর্মচারীদের বাংলা শেখাবার উদ্দেশ্যে একখানি ইংরাজী বাংলা ব্যাকরণ বই রচনা করেছিলেন। সেই প্রথম ছাপা বইএর মুখ দেখেছিল বাংলা অক্ষরগুলি। অথচ এই ইতিহাস খুঁজে দেখার তেমন কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় নি বাঙালী গবেষক মহলে। প্রায় দু'দশক আগে, হালেদের বই প্রকাশের দুশো বছর উপলক্ষে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ছাপা বইএর ওপর একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন, শ্রীপান্থ প্রমুখেরা চেষ্টা করেছেন বাংলা বইয়ের এই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে কিছুটা তুলে ধরার। কিন্তু ক্রমপরিবর্তনশীল বাংলা বই, তার মুদ্রণ সংস্কৃতি অথবা প্রকাশনা ও পাঠের প্রযুক্তি ইত্যাদি নিয়ে বাদ প্রতিবাদ বড়ই কম হয়েছে, দরকারের চেয়ে। তাই স্বপন চক্রবর্তী মহাশয়ের সম্পাদনায় "মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই' নামক প্রবন্ধ সংকলনটি যখন হাতে এলো, তখন সেটার পাতা উল্টে দেখার লোভ সামলানো গেল না।

    ভূমিকাতেই সম্পাদক উল্লেখ করেছেন যে সংকলনটি তত্ত্বের বইও নয়, গবেষণা গ্রন্থও নয়। বরং বাঙালী পাঠককুলের সামনে বাংলা বইএর ধারাটা তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। হাতে লেখা পুঁথি থেকে আজকের কম্পিউটার টাইপিং আর তার ফাঁকে ফাঁকে হারিয়ে যাওয়া বহু ছোট ছোট ইতিহাস নিয়ে সংকলিত বইখানি। মোট ষোলখানি প্রবন্ধ রয়েছে সংকলনটিতে। বিভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধগুলি, বিষয় নির্বাচনও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। শেষেরটি সম্পাদকের নিজের লেখা। প্রবন্ধগুলির অধিকাংশই অবভাস পত্রিকায় পুর্বে প্রকাশিত।

    সংকলনটির শুরু হচ্ছে অভিজিৎ গুপ্তের প্রবন্ধ, "ভারতবর্ষের গ্রন্থেতিহাস: কিছু মৌল সমস্যা' দিয়ে। বইয়ের ভূমিকাতে সম্পাদক যা বলতে চেয়েছিলেন, সেই সুরটিকে ধরেই এগিয়ে গেছেন লেখক। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠকদেরকে গ্রন্থেতিহাসের এর মূল সূত্রগুলি বুঝিয়েছেন। মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা হয় গ্রন্থেতিহাসকে - মুদ্রণ প্রযুক্তির ইতিহাস, পুস্তক ব্যবসার ইতিহাস, পাঠক ও পাঠের ইতিহাস এবং গ্রন্থাগারের ইতিহাস। প্রথম দুটি ধারা নিয়ে কিছু কাজ হলেও, পরের দুটি ধারা নিয়ে গবেষণার সংখ্যা বড়ই সীমিত। এছাড়াও আছে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব, যা কোনো একটি মূল ধারার পাশাপাশি অনেকগুলি সমান্তরাল ধারাও তৈরী করে ফেলেছে। ফলে গবেষকদের কাজও হয়ে উঠেছে জটিলতর। এসবের পাশাপাশি হারিয়ে গেছে পুরনো সূত্রগুলি। বাংলা বইয়ের প্রকাশকগণও কোনোদিন তাদের প্রকাশিত বইএর আর্কাইভ বানাবারও চেষ্টা করেননি। ভারতের গ্রন্থেতিহাস তাই আজও অসম্পূর্ণ এবং সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত।

    এই ভারতীয় গ্রন্থেতিহাসেরই অন্যতম ধারা হলো বাংলা বইয়ের ইতিহাস। তাই বাংলা বইয়ের ইতিহাস বুঝতে হলে প্রাচীন ধারাটিকে আগে বোঝা দরকার। সেই ধারাটিকে তুলে ধরা চেষ্টা করেছেন প্রবন্ধকার তুষারকান্তি মহাপাত্র। "হাতে লেখা বই' প্রবন্ধে, লেখক বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিকে। প্রবন্ধটিতে যেমন আছে বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথির ইতিহাস, তেমনই আছে প্রাচীন পুঁথি বানাবার পদ্ধতির কথাও। ভুর্জপত্র থেকে শুরু করে তালপাতা, এমনকি তুলট কাগজ দিয়েও কি ভাবে বানানো হতো পুঁথি, কি ভাবে তৈরী হতো লেখার কালি, কী ভাবে আঁকা হতো রঙিন ছবি তার বিবরণ আছে প্রবন্ধে। লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে জৈন ধর্মলম্বীদের চিত্রিত পুঁথিগুলোর কথা, এসেছে তালপাতায় লেখা তুরফান পুঁথি, হরিউজি পুঁথি ইত্যাদির কথা।

    এই ইতিহাসের ধারা বেয়েই এসেছে বাংলা বইএর কথা, আর বাংলা বইএর ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন একাধিক লেখক, যদিও বিষয়গত ভাবে প্রতিটি লেখাই স্বতন্ত্র। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় লেখক আশীষ খাস্তগীরের কথা। এগারোটি পরিচ্ছদ নিয়ে একটি সুবৃহৎ প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, বিষয় "ঊনিশ শতকে বাংলা বইয়ের বাজার'। উনিশ শতকের সূচনায় কোলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির ছাপানো শিশু পাঠ্য বইয়ের বিক্রি থেকে বাংলা বইয়ের বাজার শুরু। এরপর একে একে এসেছেন বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতন বাংলা শিশু শিক্ষার প্রাণপুরুষেরা। এসেছেন বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি সাহিত্যিকরা। এমনকি বটতলার সাহিত্য নিয়েও একটি পরিচ্ছেদ লিখেছেন লেখক, যদিও তথ্যের দিক থেকে অপ্রতুল মনে হয়েছে পরিচ্ছেদটিকে। তবে সমগ্র প্রবন্ধটি কিন্তু যথেষ্ট তথ্যবহুল, এমনকি চমকে দেওয়ার মতন বহু তথ্য আছে লেখায়। লেখক জানিয়েচ্ছেন যে বছরে প্রায় আড়াই লাখ পঞ্জিকা বিক্রি হতো বাজারে। পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিক্রি ছিল নগণ্য। রবীন্দ্রনাথের বইএর সর্বাধিক বিক্রি হাজার দুই মতন, বঙ্কিমের পাঁচশো থেকে হাজার।

    এরপরেই আসবে স্বপন বসুর প্রবন্ধ "বাংলা পত্রিকার প্রচার: উনিশ শতকে'। এই প্রবন্ধটিও তথ্য এবং স্টাটিসটিকস বহুল কিন্তু একেবারেই দুর্বোধ্য নয়। উনিশ শতকের শুরু থেকে বাংলায় প্রকাশিত বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকাগুলির প্রচার সংখ্যা, দাম ইত্যাদি তলিকাবদ্ধ ভাবে দেওয়া আছে প্রবন্ধে। লেখক যে ভাবে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা, মফস্বল থেকে প্রকাশিত পত্রিকা, প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ভাবে তালিকা বানিয়েছেন, তা সত্যি প্রশংসনীয়। তবে সমস্ত তালিকা বিশ্লেষণ করে লেখকের উপলব্ধি, "পত্রিকা প্রকাশ মোটেই লাভজনক ব্যপার ছিল না'।

    বাংলা পত্রপত্রিকার ইতিহাস নিয়ে আর একখানি মূল্যবান প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন আনিসুজ্জমান, নাম "মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র:১৮৩১-১৯৩০'। বাংলা বইএর অন্যতম মূল ধারা হল মুসলিম সাহিত্যের ধারা। যে ধারায় প্রভাব ফেলেছে ফারসী এবং উর্দু সংস্কৃতি। এই ধারায় দেখা যায় পত্রপত্রিকার নামে ফারসী বা আরবী শব্দের ব্যবহার, এবং ধর্মীয় আলোচনাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সৃষ্টির প্রবণতাকে। প্রবন্ধকার তাঁর প্রবন্ধে যেমন এই ধারার ক্রমবিবর্তন দেখিয়েছেন, তারই পাশাপাশি বাঙালী মুসলিম সমাজের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তনকেও তুলে ধরেছেন। প্যান ইসলামিজমের চিন্তাভাবনা, ভারতীয় মুসলিমদের ওপর তুরস্কের রাজনৈতিক অবস্থার প্রভাব, ক্রমশ নবীনপন্থীদের মনে নায়ক হিসেবে কামাল পাশার উঠে আসা, এসবই এই প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয়।

    বাংলা ছাপাখানার ইতিহাস লেখা হবে, আর তার প্রাণপুরুষ বিদ্যাসগরকে নিয়ে কোনো প্রবন্ধ থাকবে না, সেটা তো হয় না। তাঁর অসামান্য অবদান নিয়ে অভিজিৎ নন্দীর লেখা "বইপাড়ায় বিদ্যাসাগর'। বাংলা প্রকাশনার জগতে বিদ্যাসাগরের মতন উজ্জ্বল নক্ষত্র মনে হয় আর কেউ নেই। শুধুমাত্র সংস্কৃত প্রেস স্থাপন করাই নয়, বাংলা বর্ণমালাকে পাল্টে আধুনিক বানিয়েছেন বিদ্যাসাগর। "সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটরি বাংলা প্রকাশনের ইতিহাসে প্রকাশক, বই বিক্রেতা, মুদ্রক ও গ্রন্থকারকে আলাদা করে চিনতে শেখাল', মন্তব্য লেখকের। তবে শুধু বিদ্যাসাগরের প্রেসই নয়, প্রবন্ধে আছে বাংলার সু-প্রাচীন প্রেসগুলোর উল্লেখও। আছে হরচন্দ্র রায়ের বাঙালী যন্ত্র, মির্জাপুরের সংবাদ তিমিরনাশক যন্ত্র, ব্রজমোহনের প্রজ্ঞা যন্ত্র ইত্যাদির কথা। তবে যে আশা জাগিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করেছিলেন লেখক, তা শেষ অব্দি বজায় থাকেনি তার লেখাতে। লেখার একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বিদ্যাসাগর এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মধ্যে বিরোধ এবং মামলা মোকদ্দমার ইতিহাস, বিদ্যাসাগরের উইলের ব্যখ্যা ইত্যাদি। বিদ্যাসাগরের উইলের ব্যখ্যা কী ভাবে সংকলটির মুল বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে, তা একেবারেই বোঝা গেল না।

    বাংলা বইএর ইতিহাস নিয়ে আরো একখানি প্রবন্ধ আছে বইটিতে। ঢাকা বা বাংলাদেশের অধুনা লুপ্ত একটি পথ সাহিত্যের ধারা পথ-কবিতা নিয়ে লিখেছেন মুনতাসীর মামুন। লেখার বিষয়টি যথেষ্ট অভিনব, কিন্তু বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে পথকবিতার গুরুত্ব ঠিক কতখানি তা অন্তত প্রবন্ধ পড়ে বোঝা গেল না। জানা গেল ঢাকা অঞ্চলে স্বাধীনতার পরেও বিক্রি হত এগুলো, খুব নিম্নমানের নিউজপ্রিন্টে ছাপা কবিতাগুলি। মুলত সমসাময়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা হতো এগুলো। ঝড়, বন্যা থেকে শুরু থেকে পারিবারিক নানা রসালো ঘটনা ছিলো এর বিষয়। পড়ে মনে হয় কলকাতায় বটতলা সাহিত্যের মতনই ছিল পথকবিতার ধারাটা। তবে বটতলার মতন ব্যাপ্তি বা প্রভাব কোনোটাই নেই। প্রবন্ধের সাথে লেখক এমন কিছু কবিতাও দিয়েছেন পরিশিষ্ট হিসেবে। আছে বিভিন্ন প্রকাশিত ছড়ার তালিকাও। প্রবন্ধ থেকে প্রাপ্ত বিষয় বলতে এই দুটো জিনিসই।

    মুদ্রণের টেকনিকাল দিকগুলি নিয়ে তিনখানি খুব মূল্যবান প্রবন্ধ পাওয়া গেলো বইখানি থেকে। প্রথমটি অবশ্যই শুভেন্দু দাসমুন্সীর লেখা "প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে একটি পত্র ও কয়েকটি প্রবণতা'। লেখকের বিষয় বাংলা বইএর প্রচ্ছদ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সংবর্ত বইটির প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন লেখক। প্রবন্ধের প্রথম দিকে আছে প্রচ্ছদের বিবর্তনের কথা। হালেদের ব্যকরণ বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথম দিকের বই গুলির প্রচ্ছদ কেমন ছিল, কী ভাবে লেখা হতো বইয়ের নাম, লেখকের নাম, প্রকাশকের নাম তা উদাহরণ এবং ছবিসহ তুলে ধরেছেন লেখক। তারপর এসেছে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ বদলে যাওয়ার কথা, মধুসূদনের বইতে থাকা সিলমোহর, গিরিশ বাবুর বইতে নিজের ছবি, বটতলার বইগুলির চিত্রিত প্রচ্ছদ ইত্যাদি। এই ধারাতেই ক্রমশ বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ আধুনিক হয়েছে। এসবের সাথে সাথেই লেখক ব্যখ্যা করেছেন কী ভাবে চিন্তা করা হয় প্রচ্ছদ আঁকার ব্যপারে, কী ভাবে প্রচ্ছদ দিয়েই বইয়ের মূল সুরকে তুলে ধরা যায় সে সবের কথা। বিভিন্ন ছবির ব্যবহার করে লেখক তার প্রবন্ধটিকে একটি চলমান স্লাইড শো বানিয়েছেন। সংকলনটির সম্পদ এমন একটি প্রবন্ধ।

    বাংলা হরফের বিবর্তন নিয়ে লিখেছেন পলাশ বরণ পাল। ভুমিকা থেকে জানা গেলো যে পলাশবাবু একজন পদার্থবিদ এবং সাহিত্যিক। পদার্থবিদ বলেই হয়তো এমন একটা জটিল টেকনিকাল বিষয়কে এত প্রাঞ্জল ভাবে লিখতে পেরেছেন এই স্বল্প পরিসরে। বাংলা হরফের বিবর্তনকে পাঁচটা পর্বে ভেঙেছেন লেখক। একদম প্রথম পর্বটি ছাপাখানার আসার আগের কথা- পুরনো বাংলার লিপি, হাতে লেখা পুঁথির সময়ের কথা। লেখক ছবি সহ ব্যখ্যা করেছেন সেই সময়কার বাংলা লিপিকে। অধুনালুপ্ত পেট-কাটা "ব' এর কথা আছে তাতে, আছে "জ' এর উচ্চারণের কথা, অথবা "ড' "ঢ' এর কথাও। দ্বিতীয় পর্বের শুরু হয়েছে হালেদের ব্যকরণ বই ছাপা দিয়ে। এই প্রসঙ্গেই লেখক বুঝিয়েছেন বিচল হরফের কথা। ক্রমবিবর্তনের পথে এসেছে ছাপার নতুন সব প্রযুক্তি। ছাপার সুবিধের জন্য বিদ্যাসাগর পরিবর্তন করেন বাংলা লিপির। তার বিস্তারিত বিবরণ আছে এই তৃতীয় পর্বে। তার পরে বাংলা ছাপার জগতকে বদলে দিয়েছে লাইনো ছাপা। এবং অন্তিম পর্বে আছে কম্পিউটারে বাংলা হরফের বিকাশের কথা। এই প্রসঙ্গে আছে আধুনিক বাংলা ছাপায় আনন্দ প্রকাশনের অবদানের ইতিহাসও। এই ইতিহাস অন্তত পাঠক হিসেবে আমার নিজের অজানা ছিলো। বাংলা হরফকে এক নতুন ভাবে দেখতে শিখিয়েছেন লেখক, এবং প্রবন্ধের প্রতি পাতায় উঠে এসেছে লেখকের অসামান্য পর্যবেক্ষণের পরিচয়।

    এই বিষয়ের ওপর আর একখানি প্রবন্ধ অশোক মুখোপাধ্যায়ের লেখা, নাম "যা পেরেছি, তা-ই পারি'। কিছু বিশেষ বাংলা শব্দের ব্যবহারের অস্বচ্ছতা তুলে ধরাটাই এই প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয়। "ঐ' বনাম "ওই', "মতো' বনাম "মত', "তর' বনাম "তরো' এইসব ছোট ছোট কনফিউশনের কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখা থেকে।

    এই প্রবন্ধগুলি ছাড়াও ভালো লাগে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "শিক্ষা এবং আধুনিকতার পাঠ' প্রবন্ধটি। মুলত শিশুশিক্ষা বা ছোটদের জন্য নীতি শিক্ষা নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি। কী ভাবে প্রচলিত শিশুশিক্ষা ছোট বয়স থেকেই বিভিন্ন "নীতির' বীজ শিশু মনে গেঁথে দিয়ে ক্রমশ মেরুদন্ডহীন করে দিতে পারে মানুষকে, তারই ব্যখ্যা আছে এই প্রবন্ধে। আছে ঔপনিবেশিক আমলে শিশুশিক্ষা তথা নীতির শিক্ষার ক্রমবিবর্তনের কথাও। এই বিশেষ স্পর্শকাতর বিষয়টির ওপর আলো ফেলার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। গৌতম ভদ্রের কলমে উঠে এসেছে বাঙালী পাঠকদের পাঠ্যাভ্যাসের কথা। প্রবন্ধকার অলোক রায়ের "পারিবারিক পুস্তক সংগ্রহ' প্রবন্ধটিও বেশ মনকাড়া। বিভিন্ন বিখ্যাত বাঙালী পরিবার এবং প্রখ্যাত মানুষদের সংগ্রহে থাকা বিপুল বই এর সম্ভারের তথ্য আছে লেখায়। রাধাকান্ত দেবের পারিবারিক লাইব্রেরী, পাথুরেঘাটার টেগোর ক্যাসলসের পুঁথির সংগ্রহ, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সংগ্রহ থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্রের পুঁথির সংগ্রহ, লাহাবাড়ির লাইব্রেরী ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে তাঁর লেখায়। সাথে অতিরিক্ত পাওনা বলতে আছে লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার কথা।

    তবে সমগ্র সংকলটির সুর কেটে গেছে দুটি লেখাতে এসে। একটি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "সম্পাদক কী? কে? কেন? কোথায়?' এবং অন্যটি অরুণ ঘোষের "গ্রন্থপালের বিদ্যেবুদ্ধি তথা গ্রন্থবোধ'। প্রথম প্রবন্ধটি লাইব্রেরীয়ানদের নিয়ে এবং দ্বিতীয়টি বই সম্পাদনা নিয়ে। দুটি লেখাই দিশাহীন এবং ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছাড়া কিছুই প্রকাশ পায়নি তাতে। প্রশ্ন জাগে যে সম্পাদক কেন এমন দুটি লেখা বেছে নিলেন বইটির জন্য? শুধুই লেখকদের নামের ভারের জন্য?

    সবশেষে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় সম্পাদকের নিজের লেখা প্রবন্ধ "বইয়ের ভবিষ্যৎ'-এর কথা। প্রবন্ধটি সমগ্র বইটির উপসংহারের কাজ করেছে। একদিন লোকশিক্ষার বাহন হিসেবে অন্য সব মাধ্যমকে পেছনে ফেলে উঠে এসেছিলো বই। আজকের যুগে সেই বইএর ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কম্পিউটার ইন্টারনেটের যুগে ছাপা বইয়ের পাল্লা কতটা ভারী সে নিয়ে বাদ প্রতিবাদ চলে সর্বত্রই। সেগুলোকেই এই প্রবন্ধে জড়ো করেছেন লেখক। আর লেখক নিজে আশাবাদী বইয়ের ভবিষ্যতের ব্যপারে। "নতুন অতিপাঠের কপালে যা-ই থাকুক, এতে করে অতীতের বইয়ের নতুন ভবিষ্যৎ খুলে যাবে'। এই নতুন ভবিষ্যতের আশাতেই আমাদের বই খোঁজা, বই পড়া। আর সেই বইএর ইতিহাসকে এমন ভাবে দু মলাটে নিয়ে আসার জন্য কৃতিত্ব অবশ্যই সম্পাদকের।

    ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ | ১০১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন